১।
- আজকাল আমাকে কবিতা শোনাচ্ছ না যে !!
- কাল কবিতা শোনাব,ঘোর লাগা কবিতা, নেশা ধরে যাবে।
- আমার নেশা চাই না, ভালো লাগা চাই। আজ কোন কবিতা লেখনি ?
- নাহ, আজ মুড ছিলো না ।
মুড ছিলোনা কথাটা মিথ্যা কথা । গত রাত থেকেই কবিতা লেখার ভালো মুড ছিলো । সকালের দিকে একটু চেষ্টাও করেছিলাম । কিন্তু নীলার বায়নার কারণে আর হয়ে ওঠেনি । নীলার একান্ত ইচ্ছা আজ সারাদিন সে আমার সাথে ঘুরবে। নীলা সাধারণত এরকম সময়বহুল বায়না করেনা । অথচ ইদানীং আমার ব্যাস্ততা আছে। কিছুদিন হল এক প্রকাশক কাম রাইটারের সাথে চুক্তি হয়েছে । ভদ্রলোক আমার কবিতাগুলি নিয়ে একটা বই করবেন । তবে কবি হিসেবে বইয়ে আমার নাম থাকবেনা, থাকবে ওনার নাম। বিনিময়ে আমি কিছু টাকা পাবো । যতো কবিতা ততো টাকা। অথচ আমার হাতে অত কবিতা নেই। টাকাও দরকার খুব!
সন্ধ্যে নেমে এসেছে । সোডিয়াম ল্যাম্প গুলি হলুদ হলুদ আলখেল্লা নিয়ে কেমন মায়া মায়া চেহারা করে দাড়িয়ে আছে । ‘একটি হলুদ সন্ধ্যা ‘ও প্রেমিকা’ শিরোনামে একটি সার্থক কবিতা লেখার জন্য আদর্শ পরিবেশ ছিলো। অথচ.......;
- আচ্ছা, অমিয়, সোডিয়াম লাইটের আলোতে বিষণ্ণতা আছে তাই না ?
- মোটেও না ।এই যে আমার শক্ত হাত তোমার নরম আঙ্গুল ধরে আছে, এতে কোন বিষণ্ণতা থাকতে পারে না । সোডিয়াম লাইটের বাপের সাধ্যি নাই, বিষণ্ণতা দেয় ।
- হিহিহি......। মাঝে মাঝে তোমার কথায় খুব মুগ্ধ হই । একদিন নিশ্চয়ই তুমি অনেক বিখ্যাত হবে, তাই না ?
- ঠোঁট দিবে ?
- কেনো ?
- বিখ্যাত হবার আগে আরও একবার অটোগ্রাফ দেই।
- অসভ্য ! । অটোগ্রাফ কেউ ঠোঁটে দেয় নাকি! আচ্ছা, নাও, হাতে কিস কর । ঠিক মাঝ বরাবর করবা ।
- বাদ দাও । আমাকে যেতে হবে’ বলে আমি উঠে পরলাম । মাথায় ঘুরতে থাকা কবিতাটা দ্রুত কাগজে নামিয়ে আনা দরকার । এ মুহূর্তে কবিতা হারাতে দেয়া যাবে না মোটেই । অনেকদিন পর কিছু টাকার ধান্ধা পাওয়া গেছে । নীলা একটু আহত হবে হয়তো । ব্যাপার নাহ । দু একটা নামিক কবিতা শুনিয়ে ওর অভিমান ভাঙ্গিয়ে নেব একদিন । আমি নীলার চোখের দিকে না তাকিয়ে হাটা দিলাম । ওর আহত চোখ দেখা মানেই এখন কবিতা হারিয়ে ফেলা ।
- ‘ অমিয়’ শোনো !!
- বলো
- তোমাকে যেটা বলার জন্য আজ সারাদিন ঘোরাঘুরি , সেটাই বলা হয়নি।
- আজ থাক । অন্যদিন বোলো । আজ হাতে একদম সময় নেই ।
- কেন কি কাজ তোমার ?
- ‘কবিতা লিখবো
২।
আজ বিকেলটা ভালো । আকাশে রোদের চাষাবাদ হয়েছে বেশ । আমার হাতে কবিতার বই । ভদ্রলোক নিজে এসে দিয়ে গ্যাছেন। বইয়ে মোট আঠারো কবিতা ছাপা হয়েছে । অথচ আমি গুনে গুনে উনিশটা পাঠিয়েছিলাম । খুঁজে দেখলাম নীলার নাম উল্লেখ করে লেখা নামিক কবিতাটাই ওরা ছাপেনি । ওরা হয়তো জানে না নীলাই আমার এক পৃথিবীর বনলতা সেন ।
বেচারিকে সময় দেয়া হয়নি এই একটা মাস । ব্যাপার না । আজ এক ডেটেই সব পুষিয়ে দেব । কবিতা বেচে পাওয়া টাকায় নীলার জন্য একটা নীল শাড়ী কিনেছি । নীল টিপ, নীলকাঁচ চুরি । নীলার কপালে নীল টিপ দারুণ মানাবে ।
আমি প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে সেলফোনে নীলার নাম্বারটা ডায়াল দিলাম । নাম্বার বন্ধ পাওয়া গেলো । সমস্যা না। আমি বরং একটা টেক্সট করে দি । এতদিন পর আমার কবিতা আর টেক্সট দেখে বেচারি নির্ঘাত অনেক খুশী হবে । ভাবতেই কেমন ভালো লাগছে । কিন্তু ইনবক্স খুলে আমিই ক্যামন অবাক হয়ে গেলাম। নীলার একটা মেসেজ আনরিড হয়ে আছে ।
প্রিয় অমিয়,
তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো । কথাটা কিভাবে বলব বুজতে পারছিলাম না, তাই একটু সময় নিচ্ছিলাম আমি । ভাবলাম দুই নভেম্বার ই বলি । তোমার হয়তো মনে নেই, এই দিনেই আমি প্রথম তোমার হাত ধরে ছিলাম । তুমি আমার হাতে প্রথম চুমু খেলে । কিন্তু সেদিন যখন আমি বলতে চাইলাম, তুমি শুনতে চাইলেনা । শোনো, আমার আংটি বদল হয়ে গেছে । সামনের যেকোনো দিন বিয়ে । তুমি হয়তো আর বদলাবে না । আমাদের এই আগছালো সম্পর্কটাও আমি আর তাই রাখতে পারলাম না । তোমার কবিতা ভালো লাগত । অথচ শুধু কবিতার বাইরেও যে ভালো লাগার একটা জগত থাকতে পারে আমার, তুমি সেটা বুঝতে চাইলেনা । তুমি একদিন নিশ্চয়ই অনেক বিখ্যাত হবে । আফসোস তোমার অটোগ্রাফ আর নেয়া হল না ।
ইতি,
নীলা ।
পুরো পৃথিবীটা এই মুহূর্তে থমকে যাবার কথা । সেটাই হয়েছে সম্ভাবত। রাস্তার হর্ন ও কানে আসছে না । একটু আগে তৈরি হওয়া মানবিক সুখগুলো কোথাও উড়ে গিয়ে কিঞ্চিত বিরহের দখলে চলে গেছে বলে মনে হয়। নীলা বাস্তববাদী শক্ত মেয়ে । তার শক্ত সিদ্ধান্তের বিপরীতে আমার অলস দুপুরের কবিতাগুলোকে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কেমন সস্তা,ঠুনকো আর বিপন্ন !।
আমি তো সেই কবেই তোমাদের
নাগরিক কোলাহলে হারিয়ে গেছি,
জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে চন্দ্রাহত আমি
হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি "পুরো পৃথিবী শূন্য,
আমি ভীষণ রকমের একা"...।
আজ এই বিষণ্ণ দুপুর,হলুদ মন,যখন ভাবনার দুকূল বন্ধ
চিরকুট এলো,দুরন্ত স্মৃতি, তোমার চুলের গন্ধ।
ছন্নছাড়া, অচল জীবন,প্রহর গুনে ক্লান্ত
বেলা শেষ,ফুরালো কবিতা,এইবার হবো শান্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪১