অনেক দিন পর ফিরলাম লেখায়, সময় সুযোগ হয়ে উঠেনা। আজ লেখবো আমাদের বাংলাদেশি দের জন্নে দীর্ঘ দিনের অধরা রহসসের সেই নাগাল্যান্ড কে নিয়ে। এই বছর থেকেই নাগাল্যান্ড ও মনিপুর ফরেইনার দের জন্নে উন্মুক্ত হয়েছে। তাই তো এবারের কুরবানির ইদের ছুটিতে আমরা ৪ জন রউনা হই নাগালান্ড এর উদ্দেশে। গত বছর যখন ডাঊকি পোর্ট ব্যবহার করি তখন খুব কম মানুষ ই এই পোর্ট ব্যবহার করতো। কিন্তু এবার রোজার ইদেও,আর আবার কুরবানির ইদেও রীতিমত যুদ্ধ করে পোর্ট পেরুতে হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১০০০-১২০০ লোক এই পোর্ট ব্যবহার করে ইদের সিজনে মেঘালয় ঘুরার জন্যে। সকাল ৮ টায় বরডার এ দাঁড়িয়ে দুপুর ২ টায় ছাড়া পাই, প্রথমেই মারুতি তে করে আমরা রউনা হই শিলং এর পথে। আজ আমাদের যেতে হবে বহুদুর। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আমরা সন্ধ্যা ৫.৩০ টা নাগাদ শিলং পৌছাই। দুপুরের খাবার খেতে হবে এই সন্ধায়, KFC তে গিয়ে হাল্কা খেয়ে আবারো গাড়ি চড়ে বসলাম। এবারের গন্তব্য আসামের রাজধানি গুয়াহাটি রেলোয়ে ষ্টেশন। শিলং থেকে আসাম যাওয়ার রাস্তা টা অসাধারণ। রাত ১০ টা বাজে আমরা পৌছাই। জটপট করে দিমাপুর এর স্লিপার টিকেট করে ফেলি আমরা। রাত ১১ টায় ছাড়ে ট্রেন। এক ঘুমে আমার সকাল হয়েছে।
দিমাপুর নেমে আবারো গাড়িতে বসে রউনা হই নাগাল্যান্ড এর রাজধানি কোহিমার উদ্দেশে। কিন্তু কপাল মাথায়, রাস্তা সে তো জাহান্নাম। মাত্র ৭২ কিলোমিটার রাস্তা,কিন্তু পুরো রাস্তার কাজ চলছে তাই বেহাল দশা। কিছু যায়গায় এতো পরিমান কাদা দে গাড়ি টানতে কষ্ট। পাক্কা ৪ ঘন্টা লেগেছে এই রাস্তা পেরিয়ে কোহিমা পৌছাতে।
মাত্রই পারমিশন ওপেন হওয়াতে বুঝাই যাচ্ছিলো ট্যুরিজম এর জন্যে এখনো প্রস্তুত নয় এই শহর। প্রায় ১ ঘন্টা শুধু ঘুরেছি একটা ভালো হোটেলের জন্যে। অবশেষে আমরা সেন্ট্রাল গেস্ট হাঊজ এ উঠি।
খাবার নিয়েও আমাদের পড়তে হয়েছে সমস্যায়। অনেক খুজে কোনো মতে ফ্রাইড রাইস খেয়ে দুপুর টা কাটিয়ে দিয়েছিলাম।
ভাবলাম বিকেল টা বসে থেকে লাভ কি, একটু ঘুরে আসি কোথাও। গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম বিশ্ববিখ্যাত হর্নবিল ফেস্টিভাল এর ভেনু তে।
এই ভেনু টি নাগা হেরিটেজ ভিলেজ নামে পরিচিত,এটি কিগয়েমা গ্রামে অবস্থিত। শহর থেকে মাত্র ১৬ কিলমিটার দূরে এই ভিলেজ। প্রতিবছর ডিসেম্বর এর ১-১০ তারিখ পর্যন্ত এখানে হয় হর্নবিল ফেস্টিভাল, যা নাগা দের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফেস্টিভাল। শুধু এই ফেস্টিভাল এর অংশ হতেই বেচে থাকলে এই ডিসেম্বরে আবারো যাবো।
৬ টায় ফিরে আসি হোটেলে,কোহিমা শহর এখনি ঘুমিয়ে গেছে। রাতে হোটেলেই আলু ভাজি আর ডাল অর্ডার দেই, এছাড়া আর উপায় নেই। কাল অনেক সকালে উঠতে হবে।
জুকো ভ্যালি যাবো আজ, যার জন্নেই হয়ত এত কাঠখড় পেরিয়ে এতদুর আসা। ভোর ৫ টায় বৃষ্টির মধ্যেই রউনা হলাম আমরা,এখনো কোহিমা ঘুমে। কোহিমা থেকে গাড়ি তে করে আমরা চলে আসি অপরূপ গ্রাম ভিসামা তে।
জুকো ভ্যালি ট্রেক করার জন্যে ২ টা ভিন্ন পথ আছে। উঠার পথে ভিসামা সহজ আর নামার পথে যাখামা। আজ রবিবার, সমস্যা টা হয়ে গেছে এখানেই। কোনো খাবার ছাড়াই আমরা ট্রেক শুরু করি ভিসামা থেকে,ভেবেছিলাম এত বিখ্যাত একটা ট্রেক পথে অবশ্যই খাবার পাবো।
এই পথ ধরে তেজবু পর্যন্ত জীপেই যাওয়া যায়, যা মোটামুটি ২ ঘন্টার ট্রেক রাস্তা। জুকো ভ্যালি নাগালান্ড ও মনিপুর এর বর্ডার এ পরেছে। জুকো ভ্যালি ট্রেকের পথ অথবা ডিফিকাল্টিজ এর বাপারে কোথাও বিস্তারিত লেখা নেই। যে কারনে অনেকেই হয়ত জীবনের প্রথম ট্রেকেও চলে যায় এখানে। যেমনটা হয়েছে আমার টিমের ক্ষেত্রে। ৪ জনের মধ্যে ২ জন এর ই প্রথম ট্রেক এটি। কিন্তু আমি বলবো আপনার শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা খুব বেশি ভালো না হলে প্রথম ট্রেকেই জুকো কে বেছে নিবেন না।
তেজবু পর্যন্ত পথ পেরিয়ে শুরু হয় ঘন জঙ্গল দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠা, আপনা স্ব শরিরে উপস্থিত না হলে আপনাকে বুঝানে যাবেনা এই ঘন কাকে বলে।
প্রায় ১ ঘন্টা ধরে সিড়ি উঠে আমরা পৌছাই জুকো মৌ নামের পয়েন্টে। এখান থেকে দুটো ভিন্ন পথের শুরু। ডানে যেটা গিয়েছে সেটা হলো নাগাল্যান্ড এর জুকো ভিউ পয়েন্ট আর বা এর টা হলো মনিপুর জুকো ভিউ পয়েন্টের রাস্তা। এখানে প্রায় ৩০ মিনিট বিশ্রাম করে আবারো আমরা হাটা শুরু করি। একের পর এক পাহাড়ের খাঁজে করা রাস্তা পেরুতে হবে এখন, অনেক ফুল থাকায় মৌমাছি আমাদের ভালোই জ্বালিয়েছে।
প্রায় আরো ২ ঘন্টা পর আমরা জুকোর হাল্কা দেখা পেতে শুরু করেছিলাম। তখন মাথার উপর প্রায় দুপুর, আজ ই আমাদের আবার ফিরে যেতেও হবে। শরীর যেনো আর কারোই চলছেনা, ১ টা বাজে আমরা পৌছাই জুকো ভিউ পয়েন্টে। কোনো কথা না বলে আগে নুডুলস অর্ডার দিয়ে খেয়ে তারপর বাকি চিন্তা। জানিনা কেনো জানি আমার কাছে এত কষ্ট করে এসে জুকোর এই সৌন্দর্য পয়শা উশুল মনে হয়নি।
কিছুক্ষন থেকে আবার আমরা ফিরতি পথ ধরি। এবার আমরা ফিরবো জাখামা হয়ে। কিছুদূর উঠার পর একটা পাহাড় পেরিয়ে আবারো আমরা এক ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। কুচ কালো নিরবতা এই জঙ্গলে। হাজার বছরেও আলো প্রবেশ করতে পারে কিনা আমার জানা নেই। একের পর এক সিঁড়ি নামছি, শেষ হওয়ার কোনো নাম নেই। প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে সিঁড়ি নেমে আমরা প্রায় শেষ বিকালে জাখামা পোছাই। পথে একটা মারাত্মক ঝর্না অবশ্য দেখেছিলাম।
রাতে হোটেলে পৌঁছে কোনো মতে ক্লান্ত অবসাদ দেহ এলিয়ে দেই বিছানায়, কাল আমাদের মনিপুর যাওয়ার কথা থাকলেও বাকি ৩ জন ই শারীরিক পরিস্থিতির জন্যে শিলং ফিরে আসা টাকেই বেশি জোর দেয়।
পরদিন দুপুরের বাসে করে আমরা শিলং এর ফিরতি পথ ধরি।
বিঃদ্রঃ ফরেইনার দের নাগালান্ড/মনিপুর পৌছিয়ে স্থানীয় পুলিশ থানায় রিপোর্ট করলেই চলবে, এছাড়া কোনো প্রকার পারমিশন নিতে হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫৩