ভোর হলো, রুম থেকে বের হয়ে কতক্ষন নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারিনি। দ্রুত রুমে ঢুকে তারেক ভাই কে জোর করে উঠিয়ে বাইরে নিয়ে এসেছি। কেননা এই সকাল না দেখলে তার মস্ত বড় পাপ হয়ে যাবে। অগনিত পাহাড় সামনে দাড়িয়ে আছে, মাথায় গায়ে বরফ এর স্পর্শ নিয়ে!
সকালে নাস্তা করে আমরা বেরিয়ে পরি গাড়িতে করে। আমাদের টিম ৬ জনের। মানস,ইয়োহান,নাম্রিতা,অপরনা,তারেক আর আমি। সাথে আমাদের বস ভুবন। গাড়িতে করে রউনা দিয়েছি ধাক গ্রামের দিকে। আমাদের রিসোর্ট অলি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু পাহাড়ের ১২ কিলোমিটার অনেক রাস্তা,পথ দেখতে দেখতেই তো মাথা নস্ট হয়ে যাচ্ছে।
ধাক গ্রামে নামার পর ই শুরু হয়ে যায় আমাদের হাটা। একটা জিনিস বুজেছি ভারতীয়রা ট্রেক করে ইনজয় করার জন্যে , কোনো তাড়াহুড়ো করেনা তারা আমাদের মত। আজ প্রথম দিনে আমাদের ট্রেক করতে হবে ৯ কিলোমিটার। স্বাভাবিক ভাবে যেই ইটিনেরারি তারা করেছে তা চাইলে আমরা ৫ দিনের পরিবর্তে ৩ দিনেই করে ফেলতে পারি। যাই হোক ধাক গ্রাম থেকে উপরে উঠতে শুরু করি। প্রায় অনেকদিন পর ট্রেক করছি,কেমন যেনো অস্বস্তিকর লাগছিলো নিজেকে। প্রায় ৩০ মিনিট উপরে উঠার পর আমরা আছি থুগাসি নামক অসাধারণ একটি গ্রামে। এখান থেকে পানি রিফিল করে আমারো উপরে উঠা শুরু।
ও হলো আমাদের বস,আমাদের ভালোবাসা ভুবন।
গুলিং টপ এর পর থেকে শুরু হলো ঘন ওক ফরেস্ট। চারপাশে বিশালাকার সব গাছপালা, মাঝে দিয়ে চলে যাচ্ছে বরফ গলা পানির ঝিরি। মনে হচ্ছিলো এক অন্য জগত এটি,মৃদু আলো এখানে। জঙ্গলের মধ্যে আলো,বাতাস খুব কমই প্রবেশ করতে পারে তা গাছগুলোতে জমে থাকা শেওলা দেখলেই বুঝা যাচ্ছিলো।
পথিমধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছি। যত উপরের দিকে যাচ্ছি তত ঠাণ্ডার পরিমান বাড়ছিলো। একটা সময় শরীরে সবায় জ্যাকেট পরে নিলো। হালকা হালকা বরফ ও দেখতে পাচ্ছিলাম । বিকেল ৩ টা নাগাদ পৌঁছেছি আজকের গন্তব্য খুলারা টপ এ (১১১৮১ ফিট)১২।
এখানে এসে নিজেকে একবার চিমটি কেটে নিলাম,যা দেখছি সত্যি কিনা। সত্তিই কি এখানে রাত কাটাবো! কেমন হবে এখানকার রাত!
যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই নাম জানা অজানা পাহাড়ের সারি। সামনেই কামেট,দোনাগিরি পাহাড়। বামে বিধারতলি ও ডানে নিলকান্ত পাহাড়। তাঁবু সেট করে হাটা হাটা শুরু করলাম, আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম।
রাতে খুব তারাতারি খেয়ে আজকের মত ঘুমানোর পালা। কনকনে শীত আর বাতাস। তাপমাত্রা আজ -২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে দিলাম। রাতে ঘুম হয়েছে আমার ভালো। উচ্চতায় আবার ঘুম না হওয়া, অথবা ভেঙ্গে ভেঙ্গে ঘুম আসা একটা প্রবলেম। অনেকের ই এরকম হয়ে থাকে। কিন্তু আমার একবার ঘুম ধরলে আর কে জাগায়!
নতুন এক দিনের শুরু, আজ প্রথম দেখা পাবো আমার স্বপ্নের। খুব উত্তেজনা নিয়ে আজকের দিনটা শুরু করেছি। সকাল সকাল কামেট কে সাক্ষী রেখে এক কাপ চা মন্দ নয়।
কৈলাস! সে আমাদের ৫ দিন রান্না করে খাইয়েছিলো।
তার হাতে রাজমা,ডাল,ভেন্ডি ছিলো অসাধারণ। সাথে ছিলো পোহা,উপমা! আর প্রতিদিন বিকালে সুপ,পপকরন!
আজ আমরা যাবো কুয়ারি পাস। যেই ট্রেইল ধরে আমরা যাবো তার নাম লর্ড কার্জন ট্রেইল। এটি সুদীর্ঘ ১০০ কিলোমিটার এর ট্রেইল। কার্জনের সময় এটিই ছিলো একমাত্র রাস্তা গারহাল হিমালয়া ও কুমাওন হিমালয়া এর মধ্যে যোগাযোগ করার জন্যে। লর্ড কার্জন এর মেয়ে কুয়ারি মাত্র ১০ বছর বয়সে এই উঁচু পাস ( ১২৪৭০ ফিট) পেরিয়েছিলো তাই এখান কার নাম কুয়ারি পাস।
উপরে উঠা শুরু হলো, ঢিলে-ঢালা পাথরের রাস্তা ধরে উপরে উঠে যেতে হচ্ছে। প্রায় ৪০ মিনিট এভাবেই উঠে যেতে হয়েছে।
প্রথমে আমাদের টপকাতে হবে গারিয়ারি পাহাড়ের রিজ, সেদিকেই আমরা এগুচ্ছি। রিজে উঠলেই আমি দেখা পাবো আমার ভালোবাসার। ১১ টা নাগাদ পৌঁছে যায় রিজে। রিজ থেকে এক আলাদা জগত। সামনে যা দেখছি সব তুষার শুভ্র।
এই তুষার শুভ্র গালিগাডে আজ আমাদের রাত কাটানোর কথা। রিজ পেরিয়ে আমাদের বরফে হাটা শুরু। আমাদের এক অধরা জিনিস হচ্ছে এই তুষার! তাই নিজেকে এখানে সামলে রাখা মুশকিল। তা করতে পারিনি ও, এলে দিয়েছি নিজের দেহ কে বরফে।
কুয়ারি পাস পৌঁছানোর পর আবহাওয়া খারাপ হতে লাগলো। তার জন্যে আমাদের সামনে দিয়েই ৪ জন ব্যার্থ হয়ে ফিরছিলো, তারা মিনি পাংগারচুলা সামিট করেই চলে এসেছিলো আর এগুতে পারেনি।
মনের কোনে ভয় লাগতে শুরু হয়ে গিয়েছিলো, পারবো কিনা নিজের স্বপ্ন কে ছুতে। যাক পরের গল্প নাহয় পরে। কুয়ারি পাসে দাড়িয়ে পুরো গারহাল ও কুমাওন হিমালয়ার ৩৬০ ডিগ্রী ভিঊ দেখে নিলাম। এখান থেকে দোনাগিরি কেও খুব ভাল্লাগছে।
কুয়ারি পাস থেকে দ্রুত নেমে যেতে হলো। আরো বড় সমস্যা বাধিয়েছিল আবহাওয়া। খারাপ আবহাওয়া এর জন্যে আবারো ফিরতে হবে খুলারা টপ এই,রাতে এখানে ক্যাম্পিং করা টাফ হবে। তাই আবারো ফিরতি পথ ধরি,মন অনেক খারাপ । কালকে জন্যে পথ দিগুন হয়ে গেলো,সাথে আবহাওয়া ও খারাপ!
পাংগারচুলা ভ্রমনের সম্পূর্ণ ভিডিওঃ https://www.youtube.com/watch?v=ThMt2BgMIn0
চলবে........
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৮ রাত ১২:৪৫