মনে ভয় ছিলো প্রথম বার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে ট্রেকের জন্নে কতটা তৈরি আমি তার উপর শরীরে জর আজ প্রায় ৭ দিন। তারপরেও সম্পূর্ণ নতুন একটি ৫ জনের টিম নিয়ে রউনা হই চেংরাবান্ধার উদ্দেশে। চেংরাবান্ধা বর্ডার এক আজগুবে যায়গা, ইমিগ্রেশন এর চেয়ে বেশি আমার কাছের দালালের কারখানা মনে হচ্ছিলো। টাকা ছাড়া এই বর্ডার এ অন্য কোনো কথা নাই, এখানে টাকাই কথা বলে। বর্ডার পেরিয়ে একটা গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি পৌছাতে পৌছাতে দুপুর। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে রউনা হই মিরিকের পথে।
মিরিকের কথা অনেক শুনেছি, পথের রাস্তা ঘেরা চারপাশে চা বাগান। সমতলের চা বাগান গুলো ও দেখতে একটু ভিন্ন।
আকাবাকা পথ পেরিয়ে বিকেলের আগ মুহুরতে পৌছাই মিরিক।
মিরিক বিখ্যাত একটি লেকের জন্নে। যদিও লেক টি অত আহামরি কিছুই নয়। আরো একটি মোনাস্ট্রি আছে,যা মিরিক শহরের উপরাংশে অবস্থিত।
মিরিক থেকে আমাদের আজকের গন্তব্য ছিলো সান্দাকফুর বেজক্যাম্প খ্যাত মানে ভাঞ্জান। পথে সিমানা নামক এক জায়গায় এসে প্রথম শীতের ছোঁয়া, সেখান থেকেই হালকা দেখা যাচ্ছিলো কাঞ্চনঝঙ্গা। মানে ভাঞ্জান যখন পৌছাই তখন সন্ধ্যা ৬ টা বাজে। একটা হোটেল ঠিক করে নেই প্রথমে।
মানে ভাঞ্জান এ ভোর নেমেছে, অসাধারণ একটি ছোট শহর বলা যেতে পারে একে। বিশাল একটি ফুটবল মাঠ আছে, যেটি সকাল থেকেই বেশ ব্যাস্ত ।
আর্মি ক্যাম্প থেকে এনট্রি করে গাইড নিয়ে নেই শেহজাদ আন্সারি কে (উমেশ)। সিংগালিলা পার্ক এর এনট্রি ফি দিয়ে শুরু করলাম আমাদের ট্রেক। প্রথমে কিছুক্ষণ জীপের রাস্তা দিয়েই উপর উঠতে হয়।
যত উপরে উঠতে শুরু করলাম,ততই মেঘের ভিতর ঢুকা শুরু হলো। প্রায় ১ ঘন্টা জীপের রাস্তা ধরে উঠার পরে পেলাম অসাধারণ সুন্দর একটি ছোট গ্রাম চিত্রে।
মাত্র তো দিনের শুরু , এর মধ্যেই ইকবাল ভাই হাঁপিয়ে উঠলো। অবশ্য উনার জন্নে পরিস্থিতি টি সম্পূর্ণ নতুন ছিলো, যে সান্দাকফু ঘুরতে এসেছিলো শুধু দার্জিলিং ঘুরবে বলে। যে শহরে প্রতিদিন মালিবাগ থেকে মৌচাক পর্যন্ত হোন্ডা ব্যাবহার করে সে আজ কিলোর পর কিলো উপরে উঠছে, কিন্তু জানেই না আসলে উনি কি দেখতে যাচ্ছে।
ফয়সাল ভাই এরও ইতিমধ্যে মাথা ঘুরাচ্ছে,বমি বমি ভাব। ঠাণ্ডায় কাবু করে ফেলেছে তাকে,প্রথম বার তো। পথে হাটতে হাটতে হঠাত মেঘ সরে গিয়ে পলক দেখাচ্ছিলো কিছু অসাধারণ ছোট ছোট গ্রামের।
১২ টা নাগাদ পৌছাই লামেধুরা তে, লামেধুরা একটি নেপালি গ্রাম। ছোট একটা দোকানে হাকা নুডুলস খেয়ে আমাদের আবার যাত্রা শুরু । সবার প্রথম দিনের টার্গেট থাকে টুমলিং পর্যন্ত, কিন্তু আমার সান্দাকফু থেকে কাঞ্চনঝঙ্গা দেখার জন্নে তর সইছিলো না। আমি টার্গেট সেট করি আজি গারিবাস পর্যন্ত।
আকাবাকা পথ পেরিয়ে ৩ টা বাজে পৌছাই মেঘমা গ্রামে, মেঘমা গ্রাম টিও নেপালের একটি অংশ। আসলে সান্দাকফু যাওয়ার পুরো পথ তাই জিরো লাইন এ, ভারত ও নেপালের মাঝের রাস্তা। মানে এক ভিসায় আমাদের ২ দেশ ও ভ্রমন হয়ে যাচ্ছিলো। মজার বিষয় হচ্ছে এখানকার মানুষেরা কাঠমান্ডু যায় শিলিগুরি হয়ে।
মেঘমা থেকে ২ টা রাস্তা আলাদা হয়েছে। সোজা রাস্তা টা যায় টোংলু টপ আর বামের রাস্তা টা যায় টুমলিং এর দিকে । আমরা বামে যাওয়া শুরু করলাম। প্রায় ১৫ মিনিট যাওয়ার পর পেলাম একটি অনিন্দ সুন্দর গ্রাম। গ্রাম টির নাম গুরাসি।
এখান থেকে দেখা যায় টুমলিং গ্রাম টি ।
আরো প্রায় ২০ মিনিট উপরে উঠে পাই টুমলিং গ্রাম। টুমলিং পৌঁছে পুরো দলের চোখে মুখে খুশির ছাপ। কারন দূরে দেখা যাচ্ছে মেঘে ভাসা কাঞ্চনঝঙ্গা।
কাঞ্চনঝঙ্গা দেখতে দেখতে কিছুটা সময় শেষ করলাম। বাজে তখন ঘড়িতে ৪ টা । আবার পথ চলতি শুরু করলাম ।
সেখান থেকে আরো কিছুদুর পথ পেরিয়ে পৌছাই সিংগালিলার আসল এন্ট্রি পয়েন্ট এ।
সন্ধ্যা প্রায় নেমে আসছে পাহাড়ের বুকে, আজকের গন্তব্য গারিবাস এখনো ৬ কিলোমিটার। হাটতে লাগলাম একের পর এক পাহাড়।
সন্ধ্যা ৫ টা ৩০ বাজে। নেপাল বর্ডার পুলিশ এর কাছে এন্ট্রি করে প্রবেশ করি জাউবারি তে। সবার অবস্থা দেখে আজকের মতো এখানেই রাতে থাকার সিধ্যান্ত নেই। জাউবারি তে রাতে দাল,আলুভাজি দিয়ে ভাত খাওয়া ছিলো অসাধারন।
এভাবে শেষ হয় আমাদের প্রথম দিনের ১৬ কিলোমিটার ট্রেক। আগামি ভোরের অপেক্ষায় আমরা।
আগামি পর্বে থাকবে সান্দাকফু চূড়ায় পৌঁছানোর কাহিনি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:০০