ভিকারুন্নেসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী অরিত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে ভিকারুন্নেসায় একজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো, তখন আমরা এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে দেখেছিলাম ধর্ষক শিক্ষককে বাঁচাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করতে। ভিকারুন্নেসার ছাত্রীরা প্রতিবাদ করেছিলো, আন্দোলন করেছিলো, অবশেষে ধর্ষক শিক্ষককে অপসারিত করতে বাধ্য হয়েছিলো স্কুল কর্তৃপক্ষ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে স্কুলে একজন ধর্ষককে বাঁচাতে কর্তৃপক্ষ ভূমিকা রাখে, সেই স্কুলকে কেন ভালো স্কুল বলা হবে? ভালো স্কুল মানে শুধুমাত্র ভালো রেজাল্টের নিশ্চয়তা দেয়া? ধর্ষককে প্রশ্রয় দেয়া স্কুলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আমাদের তেজ মিইয়ে গেছে কিছুদিন পর। তারপর আবার নির্লজ্জের মত সেই স্কুলেই ভর্তি করার জন্যে সন্তানকে চাপ দিয়েছি, তার শৈশবকে নষ্ট করেছি। যার পরিণতিতে ধর্ষণের পর হত্যা করার দুঃসাহস পেয়েছে স্কুলটি। না, অরিত্রীকে তারা গলা টিপে হত্যা করে নি, তবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই তথাকথিত ভালো স্কুলের তথাকথিত ভালো শিক্ষকেরা জানেই না যে টিনএজ বয়সটা কত সেনসিটিভ, এই সময় বাচ্চাদের কত মানসিক সাপোর্ট দরকার হয়! একটা ৬ বছরের বাচ্চারও অতটা মানসিক সাপোর্ট দরকার পড়ে না, যতটা একটা ১৫ বছরের বাচ্চার দরকার হয়। এই সময় বাচ্চারা একটা ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যায়, শরীর এবং মনে পরিবর্তন আসে, খুব অল্পতেই রিএ্যাক্ট করে, এই সময় স্কুল এবং পরিবার থেকে তাদের সর্বোচ্চ মানসিক সাপোর্ট দরকার হয়। বাচ্চারা অপরাধ করলে বাবা-মাকে ডেকে এনে অপমান করলে হ্যাডম দেখানো হয়, মাস্তানি করা হয়, তাকে ডিপ্রেশনের পথে ঠেলে দেয়া হয়, এই সহজ কথাটা যে স্কুলের শিক্ষকরা জানে না, তাদের শিক্ষকতা করার কোন যোগ্যতা নেই। আত্মহত্যা কোন সমাধান না, হেনতেন বলে নিজেকে নিজে মোটিভেট করতে পারেন, কিন্তু এতে করে মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না।
শুধু ভিকারুন্নেসার কথা বলছি কেন! ভালো ভালো, নামিদামী স্কুলগুলির প্রতিটিই একেকটি মাফিয়া চক্রে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে একটি ‘সেনাশাসিত’ স্কুলের ওয়ালে দেখেছিলাম দুর্বল ছাত্রদের তালিকা টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। তারা এত শক্তিশালী হলো কীভাবে? এসব বলে মাথা চাপড়িয়ে লাভ নেই। কারণ আমরাই তাদের হাত শক্তিশালী করেছি। ভালো স্কুলে ভর্তি না করলে বাচ্চার ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে, বাচ্চা উচ্ছন্নে যাবে, এ প্লাস না পেলে আপনার মান ইজ্জত থাকবে না, বাচ্চাকে খেলতে যেতে না দিয়ে পড়াবেন, এক ক্লাসে দুইবার রাখবেন ভালো স্কুলে ভর্তি করার জন্যে, এখন হলো তো? ধর্ষণ, হত্যা, বুলিয়িং এর পর আর বাকি থাকে কী? জ্বী না, এই কথা বইলেন না যে একটা স্কুলের সবাই একরকম না, ওসব কথা বলে লাভ নেই। স্কুলের নীতি নির্ধারকেরা যেমন, স্কুল তেমন, এটাই সাফ কথা।
অরিত্রীকে হত্যা করা হয়েছে, আমাকেও হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিলো আজ থেকে বিশ বছর আগে। আমার বয়স তখন আঠার। আমি ঢাকার অন্যতম একটি নামী কলেজে পড়তাম। হারম্যান মেইনার কলেজ। ছোটবেলায় আমার পোলিও হয়ে বাম পা দুর্বল এবং ছোট হয়ে গিয়েছিলো। আমি অবশ্য এসবের কিছুই কেয়ার করতাম না। সব খেলাধুলাতেই আমার অংশগ্রহণ ছিলো। একদিন কলেজে ভলিবল খেলতে গিয়ে পিটি টিচারের বুলিয়িংয়ের স্বীকার হয়েছিলাম। সে আমার “বিকৃত অঙ্গ” নিয়ে ঠাট্টা করেছিলো। সেইদিন আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় যাই। কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে পুরো সময়টাই কেঁদেছি। তবে আমি আমাদের সম্মানিত ভাইস প্রিন্সিপাল স্যারকে আমার অভিযোগ জানিয়েছিলাম, তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন ব্যবস্থা নেবেন। এরপর থেকে সেই চামাড় ‘শিক্ষক’ আমাকে কিছু বলার সাহস পায় নি। আমার অতি প্রিয় একজন বন্ধু ছিলো, তারও সমস্যা ছিলো। সে ছিলো অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত। তাকে নিয়েও সেই চামাড় বাজে কথা বলেছিলো। আমার সেই বন্ধু আমার সঙ্গে প্ল্যান করতো, কীভাবে সে সুযোগ পেলে এর প্রতিশোধ নিবে। আমাদের ট্রমাটা বুঝুন! আমরা সেসময় আত্মহত্যা করলে “আত্মহত্যা করা মহাপাপ” জাতীয় বুলি দিয়ে ঠিকই ভুলে যেতেন, এবং আরো হত্যার পথ সুগম করতেন! এখনও তাই করুন না!
হারম্যান মেইনারকে নিয়ে আমি অভিযোগ করছি না। কারণ শিক্ষক নামের সেই চামাড় কলেজের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কেউ ছিলো না, এবং কলেজের বাকি সময়টায় সে আমাকে আর কিছু বলার সাহস পায় নি। আমি সম্মানিত ভিপি স্যারকে শ্রদ্ধা জানাই ব্যবস্থা নেবার জন্যে।
কিন্তু ভিকারুন্নিসা স্কুল, ধর্ষণ আর হত্যার দায় কীভাবে এড়াবেন আপনারা? এখন খুব আন্দোলন হবে, ক্লাস বর্জন হবে, পরীক্ষা বর্জন হবে, কিন্তু এই মহাশক্তিধর স্কুল মাফিয়া চক্রের আদৌ কি কোন বোধোদয় হবে এতে যদি আমরা “ভালো স্কুল” নামক এই মিথমাদকের পিনিক থেকে বের হতে না পারি?
আমার মনে পড়ছে প্রথম স্কুলের কথা। জলঢাকার অনির্বাণ বিদ্যাতীর্থ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। সেই প্রত্যন্ত মফস্বলের স্কুলে এত মানসিক পীড়ন ছিলো না অন্তত!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:২৮