আমাকে হয়তো আপনি লক্ষ্য করেন নি তাই না? ঐ যে শপিং করতে এসে আপনি চিজবার্গার আর কোক খাচ্ছিলেন, পাশেই তো ছিলাম আমি! আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে খুকখুক করে কেশেওছিলাম। অবশ্য আপনার মত একজন পরিপূর্ণ এবং সুখী যুবতী, যার একজন লাভিং হাজবেন্ড আর ছোট্ট একটা দেবশিশু আছে, তার কাছে আমার মত আধবুড়োর দৃষ্টি আকর্ষণের এই প্রক্রিয়াটা পাশ কাটিয়ে যাবারই কথা। একটু মন খারাপ হয় অবশ্য এতে, তবে বুড়োদের এসব সয়ে নিতেই হয়।
তবে আপনারা যে সবসময় এই বুড়োর মন খারাপ করিয়ে দেন, তা কিন্তু না। আমার অনেক সুখ সুখ অনুভূতি, যার কিছু বাস্তব, কিছু কল্পনা, এসবে আপনারা জড়িয়ে আছেন। কীভাবে? আরে এই যে আমাদের শপিং মার্ট থেকে এত ছবি ওয়াশ করেন, এটা তো আমারই ডিপার্টমেন্ট! এই কাজে আমার দক্ষতা সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনারা জ্ঞাত! কিছু ছেলেছোকড়া ভাবে যে দুদিনের একটা সেমিনারে এ্যাটেন্ড করে কিছু টুলস শিখলেই সব পারা যায়। ব্যাপারটা অত সোজা না, বুঝলেন? এর জন্যে লাগে বহুদিনের চর্চা, আর অভিজ্ঞতা। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এটাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। আপনাদের কাছাকাছি থাকতে আমার ভালোই লাগে, একজন একাকী বৃদ্ধের তো এরকম মনেই হতে পারে, তাই না?
হ্যাঁ, ইয়র্কিন পরিবার, আমি আপনাদের পছন্দ করি, খুব আপন মনে করি। মিজ নিনা ইয়র্কিন, এবং মিস্টার উইল ইয়র্কিন, আপনাদের জুটিটা এত সুন্দর আর প্রাণবন্ত! জোয়ানকালে আমি মোটেও এমন ছিলাম না, এমন কাউকে পাইও নি! আর আপনাদের ছেলে জ্যাকব, কী হ্যান্ডসাম একটা বাচ্চা! এই বয়সেই ওর ব্যক্তিত্ব দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। আমি যদি ওর আঙ্কেল হতাম, ভালো হতো না? উহু, এটা আসলে বেশি আবদার করা হয়ে যাচ্ছে। তবে আমি একজন ভালো বন্ধু তো হতেই পারি ওর! সেদিন ওকে দেখছিলাম স্কুলের ফুটবল প্র্যাকটিসে। ওর রিফ্লেক্স, স্ট্যামিনা, সবই ঠিক আছে, তবে পাওয়ারটা একটু কম। তা এতটুকু একটা ছেলের শটে কি লিওনেল মেসির জোর আসবে! কিন্তু ওর টিচার ব্যাপারটা মোটেই ভালোভাবে নিলো না। কড়া করে বললো, “জ্যাকব, তোমাকে আর ভালো করতে হবে, আরো জোরে মারতে হবে, হচ্ছে না একদম!”। ঐ ব্যাটা আসলে একটা গর্দভ! এভাবে কি শিশুদের মোটিভেট করা যায়? তবে চিন্তা করবেন না, আমি ওর সাথে কথা বলেছি কিছুক্ষণ। বুঝিয়েছি যে ও খুব ভালো করতে পারবে। ও আমাকে পছন্দ করে আমি জানি। কিন্তু কীসের যেন সংকোচ দেখলাম ওর ভেতর আপনাদের কোনো নিষেধ ছিলো বোধ হয়? হ্যাঁ, দেশে যে হারে চাইল্ড প্রিডেটর বাড়ছে, সাবধান হওয়াই ভালো। কুত্তার বাচ্চাদের যদি চামড়া ছিলে লবণ মাখিয়ে দেয়া যেতো, তাহলে ঠিক হতো। আচ্ছা, অনেক কথা হলো(যদিও একপাক্ষিক), এখন ঘুমোতে যাই, কেমন? বুড়ো মানুষ, রুটিনটা মেইনটেন না করলে চলবে কী করে।
এবার আমার একান্ত নিজের জগৎ, এখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। আমি দেখছি আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহের ছবি। সবই ইয়র্কিন পরিবারের । এরা এত ছবি তোলে! গত কয়েক বছরে লুকিয়ে লুকিয়ে আমিবাড়তি অনেক ছবি প্রিন্ট করে রেখেছি ওদের। ম্যানেজার টের পেলে যে ঝাড়িটা দেবে! তবে কিছু জব হ্যারাসমেন্ট তো থাকেই! এই ছবি ওয়াশ করার কেরদানি দেখাতে গিয়ে সবসময় যে সুন্দর সুন্দর ফ্যামিলি ফটো প্রিন্ট করতে হয়, তা না। অপদার্থ স্কিনহেড আর এ্যামেচার পর্ন আর্টিস্টদের ছবিও আমরা যথাযথ ব্যবসায়িক গোপনীয়তা বজায় রেখে প্রিন্ট করি। এগুলো নিয়ে আমার প্রফেশনাল ইন্টারেস্ট ছাড়া আর কোনো আগ্রহ নেই।
রাত গভীর হয়, ঘুমোতে পারি না। একলা বুড়ো আর কতটাই বা ভালো থাকবে? ইয়র্কিন পরিবারের প্রতি অবসেসড হয়ে যাচ্ছি আমি দিনদিন। জ্যাকব কেন আমার নাতি হলো না? নিনা আমার মেয়ে হতে পারতো না? ছবিগুলোর দিকে তাকাই, গভীর আবেগে হাত বুলিয়ে দেই। এহ দেখো, দুষ্টু ছেলেটা জন্মদিনের পার্টিতে সারা মুখে পেস্ট্রি মাখিয়ে কি কাণ্ডটাই না করেছে! তবে নিনা আর উইলের ছবিগুলোতে উইলকে ঠিক ততটা ইমোশোনালি এ্যাটাচড মনে হচ্ছে না। ইজ হি কোল্ড? তার কি অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে? এত সুন্দর আর কেয়ারিং বউ থাকতে যদি কেউ অন্য কারো সাথে সম্পর্ক করে তাহলে তার চামড়া ছিলে লবণ লাগিয়ে দেয়া উচিত। নাহ, ভালো লাগে না এসব ভাবতে, দেখতে। ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাই, অবসেশন বাড়তে থাকে, কাজে ভুল হয়, প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়।
এই তো সেদিন আগফার লোকটার সাথে সবার সামনে সিন করলাম, ম্যানেজার এটা নিয়ে কথা শুনিয়েছে। সেই সাথে এও বলে দিয়েছে যে লাঞ্চের জন্যে আমি বড্ড বেশি সময় নিয়ে ফেলছি। এটা করা যাবে না। আচ্ছা, আমি যে জ্যাকবকে কোম্পানির একটা ডিসপোজেল ক্যামেরা ফ্রি হিসেবে দিয়েছি, এটাও কি সে জেনে গেছে? জেনে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। এত এত অভিযোগ জমা হচ্ছে…
…এ্যান্ড ইয়েস আই এ্যাম ফাকিং ফায়ারড! দ্যাট মরন ফায়ারড মি। এতদিনের নিষ্ঠার এই প্রতিদান? ঠিক আছে, আমি খোলস পাল্টাবো এবার। যতটা দুর্বল আর নিরীহ ভাবো আমাকে, আমি মোটেও সেরকম না।
প্রথমে ম্যানেজারটাকে একটু শিক্ষা দেয়া দরকার। তারপর ধরা হবে উইল ইয়র্কিনকে। সে হোটেলে রক্ষিতা রেখে মচ্ছব করে, খবর পেয়ে গেছি। তাকে শায়েস্তা করার একটা নিখুঁত প্ল্যান করতে হবে। মাথায় আমার বুদ্ধির অভাব নেই। তবে অস্ত্রশস্ত্রও কিছু লাগবে। বেশি কিছু না, একটা ছুরি হলেই মোর দেন এনাফ!
*
পাঠক, এতক্ষণ আপনারা মনোলগের আঙ্গিকে পড়ছিলেন রবিন উইলিয়ামস অভিনীত সাইকোলোজিক্যাল থ্রিলার ওয়ান আওয়ার ফটোর (One Hour Photo) কাহিনী। ক্লাইমেক্সে পৌঁছে দিয়েছি, বাকিটুকুর ব্যাপারে আমি একদম স্পিক-টি-নট! আপনারা ধারণা করুন, কী হতে পারে। এই নম্র-দুর্বল বৃদ্ধটি অবসেশনের কোন পর্যায়ে পৌঁছুতে পারে! আমি বাজী ধরে বলতে পারি তাকে একজন উন্মত্ত সাইকো হিসেবেই ভাবছেন। হলিউডের ছবিতে যেমন থাকে না, হঠাৎ করে ভালোমানুষীর মুখোশটা বের হয়ে ভায়োলেন্ট দানবে পরিণত হয়ে যায়!
সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না। হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে! তবে ছবির শেষ দৃশ্যটি আপনাকে একদমই হতবাক করে দেবে। আপনাকে চোখ কচলে, পেছনে টেনে আবার দেখতে হতে পারে, আর মনে মনে “এইডা কী হইলো” জাতীয় অনুভূতি তৈরি হবে, গ্যারান্টি!
মুভি সম্পর্কে আর কিছুই বলবো না। বলবো প্যারিশ শাই চরিত্রে রূপদানকারী অস্কারজয়ী অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস (Robin Williams) সম্পর্কে। রবিন উইলিমাস মানেই একটু কমিক্যাল, একটু ওভার এ্যাকটিং করতে পছন্দ করেন, এটাই তার ব্র্যান্ড ইমেজ! রবিন উইলিয়ামসের সাথে আমাদের বেশিরভাগেরই পরিচয় ডেড পোয়েটস সোসাইটি (Dead Poets Society) অথবা গুড উইল হান্টিং (Good Will Hunting) এর মাধ্যমে। ওয়ান আওয়ার ফটোর কথা কজনই বা জানে? তবে এই আমি, হলফ করে বলছি, এই চরিত্রটি রবিন উইলিয়ামসের সেরা কাজ। এর চেয়ে ভালো করা আর সম্ভব না তার পক্ষে, যেহেতু তিনি এখন আর বেঁচে নেই, কী দুর্ভাগ্য!
আমি তন্ময় হয়ে তাকে দেখেছি, কী অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন এই অভিনেতা, চরিত্রের সাথে এত নিবিড়তা, সারাজীবন মনে রাখার মত পারফরম্যান্স।
ছবিটার IMDB রেটিং 6.8
এটি দেখে আপনার মনে দ্বিধা জাগছে? যে মুভির এত প্রশংসা করলাম তার এই এভারেজ মার্কা রেটিং! সেটাকে একটা সস্তা কৌতুক হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে দেখেই ফেলুন না ছবিটা, আজকেই এই বৃহস্পতিবার রাতেই! যদি ভাবতে চান, যদি ভাসতে চান অথৈ জলে!
প্রথম প্রকাশ- এগিয়ে চলো ডট কম
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১০:৫১