নির্মলা সেদিন ধর্ষিত হলো। নির্মলা ১২ বছরের একটি মেয়ে, পিউবার্টির গ্রাসে শিশুকাল হারিয়ে ধর্ষণযোগ্য হয়েছিলো সম্প্রতি। সুযোগসন্ধানী পুরুষ সুযোগ পেয়ে তা কাজে লাগাবে এতে অবাক হবার কী আছে? আর সেজন্যেই অনায়াসে বলে ফেলা যায় এই সেদিন নির্মলা ধর্ষিত হলো। এরপর হয়তো বা সে স্নান করলো, পটল আর ঝিঙের ব্যাঞ্জণ রাঁধলো, ঘর মুছলো, কাজের মেয়ে হয়ে জন্মেছে যেহেতু, সামান্য ব্যাপার নিয়ে বেশি হ্যাংলামি করে সবাইকে বিব্রত করাটা কি তার উচিত হবে, আপনারাই বলুন? নির্মলা নামটাও ঝামেলার। একটা সাম্প্রদায়িক উগ্রতা আর সন্দেহের গন্ধ বুনে দিয়ে যায়। তবে নির্মলার ধর্ষণটা তেমন কোনো ঘটনা ছিলো না। এটা অন্য সব সাধারণ ধর্ষণের মতই ছিলো। পুরুষ দেখেছে নারীকে, উত্তেজিত হয়েছে, সুযোগ পেয়ে পৌরুষত্ব দেখিয়েছে। খুবই সিম্পল ব্যাপার। তবে সমস্যা হলো, সবার চিন্তাধারা এক না। হ্যাঁ, ধর্ষণ অবশ্যই একটি অপরাধ, তবে কোন প্রেক্ষিতে, কিসের ইন্ধনে ধর্ষণ করা হয়েছে সেটাও তো বিবেচনায় রাখতে হবে, না কি!
সুমনার মধ্যে বিবেচনাবোধ, এবং সহিষ্ণুতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সুমনা হলো নির্মলা যে বাসায় কাজ করে, তার গৃহকর্ত্রী। আধুনিক এবং সচেতন নারী হিসেবে তার যথেষ্ট গর্ব আছে। সোশাল মিডিয়ায় মেয়েদের বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেইজে নারী অধিকার, নারীবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখা সে নিয়মিত শেয়ার দিয়ে থাকে। এছাড়া প্রোফাইল পিকচারে বেশ কিছুদিন যাবৎ সে “Stop rape, no means no” শিরোনামের ছবি ঝুলিয়ে রেখে তার অনমনীয় এবং দৃঢ় মানসিকতার প্রমাণ রেখেছে। এমন কী ম্যারেজ ডেতেও তা পাল্টায় নি। নিন্দুকেরা অবশ্য তাকে অনলাইন সর্বস্ব চোটপাটকে ইঙ্গিত করে নানা কথা বলে। তাদেরকে ভুল প্রমাণের আজ দারুণ এক সুযোগ। তবে এক্ষেত্রে তাকে সুযোগসন্ধানী বলাটা মনে হয় বেশি রূঢ় হয়ে যাবে।
সে আসলেই ভীষণ আঘাত পেয়েছে। ফুঁসছে।
-আমজাদ তোকে ভেতরে যেতে বললো, আর তুই গেলি? তোর মাথায় কোনো বুদ্ধি নাই?
নির্মলা কথার জবাব দেয় না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
-কথা বলিস না কেন গাধী মেয়ে? তোকে এত কিছু শিখায়ে দেই, আর তুই সব ভুলে যাস?
রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে সুমনা। বারো বছর বয়সে এমন একটা অভিজ্ঞতা হলো মেয়েটার, এর ছাপ কী সহজে যাবে? স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে নিশ্চয়ই অনেক সময় লেগে যাবে তার? বারো বছর বয়সে একটা মেয়ে কী পারে? কী বোঝে? এই বয়সে সুমনাকে মা খাইয়ে দিতো, দূরপাল্লার বাসে যাত্রাবিরতিতে বাবা সিগারেট টানতে নিচে নামলে ভয়ে অধীর হতো সুমনা বাবাকে রেখে বাস চলে যায় কি না ভেবে।
তারও অবশ্য দোষ আছে। এভাবে ভরদুপুরে নিঝুম পাড়ায় ডিম আনতে দোকানে পাঠানোর খুব কি দরকার ছিলো নির্মলাকে? তাদের পাড়ায় এমন ঘটনা আগে ঘটে নি। তবে সেটা তো আর তার দূরদর্শী চিন্তার ঘাটতির পক্ষে সাফাই গাইতে পারে না! রাগ আর ক্ষোভের সাথে অনুশোচনা যুক্ত হয়ে তাকে পোড়াতে লাগলো শুকনো পাতার মতো। টুটুলকে এখনই জানানো দরকার ঘটনাটা। থানা-পুলিশ-সালিশ যা করার ও করবে। এত ভার সে আর নিতে পারছে না।
#
-রেপটা তাহলে আমজাদই করেছে, না? শিওর তো?
নিরুদ্বিগ্ন কন্ঠে টুটুল জিজ্ঞেস করে।
-আরে হ্যাঁ, কয়বার বলবো। নির্মলা ডিম কিনতে দোকানে গিয়েছিলো, তখন তাকে দোকানে ডিম নেই বলে তার সাথে সামনে এগুতে বলে। তারপর নতুন কন্সট্রাকশনের ওখানে নিয়ে গিয়ে রেপ করে। কুত্তার বাচ্চা...
-হু, কুত্তার বাচ্চাই বটে। কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত ওর। আমি ব্যবস্থা নেবো।
-প্লিজ কিছু একটা করো! এসব জুলুম সয়ে যাবার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। আমি আর নিতে পারছি না। বারো বছরের একটা মেয়ে, উফ!
-হ্যাঁ, বুঝতে পারতেছি। তুমি এত পেরেশান হয়ো না তো। যাও রেস্ট নাও। আমি আরেকটু ভাবি ব্যাপারটা নিয়া।
সাধারণত দেখা যায়, ধর্ষকেরা আকারে আকৃতিতে গরিলার চেয়ে বড় এবং ভিটো কর্লিয়নির চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে থাকে। আর ধর্ষণের পর যত সময় পার হয়, তাদের এই ক্ষমতা এবং আকার আকৃতি জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। আমজাদের সাথে ব্যাপারটার সুরাহা করার জন্যে দেখা করতে গিয়ে টুটুল এই অদৃশ্য বর্ধনের আঁচ কিছুটা হলেও পেলো। তাকে বেশ প্রকাণ্ড এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দেখাচ্ছিলো। টুটুলকে দেখে অবশ্য প্রথমে কিছুটা চুপসে গেলো। তবে ডিফেন্স মেকানিজম দ্রুতই কাজ করা শুরু করলো। সে তো আর যে সে ব্যক্তি নয়, সে একজন ধর্ষক, একজন নারীর জীবনের চরমতম আঘাত করেছে নৃশংস লিপ্সায়, তাকে ভয় পেলে মানায়?
এদিক ওদিক তাকিয়ে, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কেশে বরং টুটুলই নিজের অবস্থানটাকে নেতিয়ে ফেললো।
-কী লাগবে ভাই?
অপ্রস্তুত টুটুলকে আন্তরিকতার সাথে জিজ্ঞেস করে সে। দৃষ্টিতে কিছুটা সতর্কতা।
-ভাই ঐ রেপের ব্যাপারে একটু কথা বলতাম আর কী।
টুটুল এভাবে প্রসঙ্গটা তুলবে তা সে কোনোভাবেই আঁচ করতে পারে নি। প্রচণ্ড বিব্রত হয়ে ঢোঁক গেলে সে। তার অণ্ডকোষ কুঞ্চিত হয়ে যায়।
-ফাইজলামি করেন আপনি? কী কইতে চান?
গলা চড়িয়ে হুমকি দেয় সে।
পরিস্থিতিটা এবার যথেষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ টুটুলও নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠে বল ফিরে পেয়েছে। সেও পালটা গলা চড়ায়।
-আমজাদ, আমার সাথে গলা চড়াইলে আমিও গলা চড়ামু। আপনি নির্মলাকে রেপ করছেন ঐটা নিয়া পরামর্শ করতে আইছি। নির্মলা আমার কিছুই লাগে না। তাই সে রেপ হইছে এই কথা মাইক চালায়া বইলা বেড়াইলেও আমার কিছু আসবে যাবে না। ব্যাপারটা বুইঝেন। বেশি তাংফাং কইরেন না, দোকানে এমন ক্যাওস বাঁধামু, ব্যবসা লাটে উঠবো।
পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনুকূলে নিয়ে নেয় টুটুল। রক্তচক্ষু দিয়ে নীরব শাসানি দিয়ে আমজাদকে বুঝিয়ে দেয় যে খামোখা বিতণ্ডা করে কোনো লাভ হবে না। বিপদ বুঝতে পেরে আমজাদ সুরসুর করে বের হয়ে আসে।
-কী চান আপনে?
তার কণ্ঠের শঙ্কা টুটুলকে সন্তুষ্ট করে।
-বের হন। হাঁটতে হাঁটতে বলি।
দোকান থেকে বের হয়ে তারা নির্মাণাধীন ভবনটার কাছে যায়। ঈদের ছুটিতে কাজ থেমে আছে। ভবনটা একদম নির্জন হয়ে আছে। এ ধরনের আলাপের জন্যে চমৎকার।
-এখানেই তো কাম করছিলেন তাই না?
-ভাই, আমি বুঝায়া বলি ব্যাপারটা। শোনেন...
-আরে এত বুঝানোর তো কিছু নাই। আমিও তো পুরুষ, আমি কি বুঝি না বলেন?
টুটুলের এমন আচম্বিত সহৃদয়তায় আমজাদ বিষম খায়। কোন দিকে যাচ্ছে কথাবার্তা?
-হ্যাঁ বোঝেনই তো, মানে...
-হঠাৎ সেক্স উইঠা গেছিলো, তাই তো? ভাই জানি এসব।কী বুঝান আমারে? আসলে এরকম একলা পরিবেশে হঠাৎ দেখতে শুনতে ভালো একটা মাইয়া আসলে তো এমন ভাবনা মাথায় আসতেই পারে। তবে আপনি যদি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারেন, তাইলে কীসের আশরাফুল মাখলুকাত হইলেন কন? আর মেয়েটার বয়সও কম, মাত্র ১২ বছর। আপনি কামডা ভালো করেন নাই মোটেও।
কিছুটা কঠোর হয়ে আসে টুটুলের গলা। তবে ইতমধ্যে আমজাদ তার দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছে। এতক্ষণে সে আত্মপক্ষ সমর্পণের একটা সুযোগ পায়।
-১২ বছর? কী বলেন? আপনি শিওর? আমি মিনিমাম ১৬ ভাবছিলাম। তার গ্রোথ তো বেশ ভালো। কোনোভাবেই বুঝতে পারি নাই আমি। ছিহ, ১২ বছরের একটা মেয়েকে...নাহ এইটা আমি কী করলাম! শিট! শিট! শিট!
হতাশায় দু বাহুর ভেতর মাথা গুঁজে দেয় সে।
-হ্যাঁ, ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। আর হিন্দু মেয়ে তো ওড়না পরবে না, পর্দা করবে না। এসবই তো অপসংস্কৃতির ফসল। সে যদি পর্দানশীন মুসলিম মেয়ে হতো, তাহলে কী আর আপনি রেপ করতে পারতেন? পারতেন না। তবে যত যাই কন, আপনি রেপিস্ট। আপনি অপরাধ করছেন। আপনাকে শাস্তি পাইতে হবে। আবারও বলি, নির্মলা আমার বইন না, যে সে রেপড হইছে এই কথা প্রচার পাইলে আমার কোনো সমস্যা হইবো। যত প্রচার হবে, সমস্যা আপনার বাড়বে। আমার হারানোর কিছুই নাই এখানে।
-বুচ্ছিরে ভাই, আপনে কী চান সেইটা কন!
-ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মেয়ের চিকিৎসা খরচ, তারপর মানসিক হয়রানি...
-কত?
-৫০ হাজার টাকা।
-এটা তো আপনি বিবেচনার কথা বললেন না। সেদিন দেখলাম টাঙ্গাইল না কোথায় জানি এক মহিলারে রেপ করছে, সালিশে ১০ হাজার টাকা দিছে ক্ষতিপূরণ।
-ভালোই তো খবর রাখেন দেখি। ভাই টাঙ্গাইল আর ঢাকার হিসাব এক হবে বলেন? আর আপনার অপরাধটা কিন্তু বেশি। আপনি নাবালিকা রেইপ করছেন।
-আমি বুঝতে পারি নাই...
-সে কথা কী এখন বললে হবে? ঘটনা তো ঘটায় দিছেন। আমার কিন্তু কানেকশন কম না। আমার ওয়াইফের সাথে বহু নারীবাদী সংস্থার চেনাশোনা আছে।
-বাল ফালান নারীবাদী সংস্থা দিয়া। কোনো প্রমাণ দেখাইতে পারবেন যে রেপ করছি?
-ঐ মিয়া মুখ খারাপ কইরেন না। প্রমাণ দেখাইতে পারবো কি না? দেখতে চান আমি প্রমাণ দেখাইতে পারি কি না পারি? আমি তো কইছি আমার হারানোর কিছুই নাই। কচ্ছপের কামড় চিনেন? আমি কচ্ছপের কামড় দিমু কইলাম। অত সহজ ভাইবেন না কেসটা। টাকাটা আজকেই দিবেন।
-আজকেই দিবো মানে?
-না দিলে সালিশ হবে, কোর্টকাচারি হবে, পেপারে নিউজ যাবে, ফেসবুকে আপনার ছবি ভাইরাল হবে। আপনারে গ্যারান্টি দিয়া বলি, আমার সাথে যুৎ করতে পারবেন না। তবে এত হ্যাপা কইরা আমার কী লাভ বলেন? আর আপনি একটা ভুল কইরা ফালাইছেন ঝোঁকের মাথায়, সেটা তো আমি কনসিডারেশনে নিতাছিই। কিন্তু তাই বইলা অপরাধটাও মাপ করনের মত না। টাকাটা দিয়া দেন আজকেই। আমার দরকার। আমি জানি আপনার কাছে ক্যাশ টাকা আছে। খোঁজ নিয়াই আসছি। সময় হলো দশ মিনিট। আর কোনো মূলামূলির চেষ্টা করবেন না। টাইম লস হবে। আপনার জান, মান সবই কিন্তু আমার হাতে, মনে রাইখেন।
*
প্রফুল্ল মনে বাসায় ফিরে সুমনার কাছে গিয়ে শিষ দিয়ে হিন্দি গানের সুর ভাঁজতে থাকে টুটুল। প্রচণ্ড আঘাতে বিমুঢ় সুমনা তার এই প্রফুল্লতার কোনো কারণ খুঁজে না পেলে ব্যথিত হয় টুটুল। অনুযোগ ঝরে পড়ে তার কন্ঠে,
-তুমি ভাবছো যে আমি শুধু শুধুই তোমাকে বলছি যে ব্যবস্থা করবো? বিশ্বাস রাখো নাই, তাই না? এই দেখো সোনা, কড়কড়া ৫০টা এক হাজার টাকার নোট। শালা বাইঞ্চোত মূলামূলি করার চেষ্টা করতেছিলো অবশ্য, তবে...
-তবে কী? এটা কীসের টাকা?
-আরে আমজাদের কাছ থেকে জরিমানা আনলাম। রেপের জরিমানা।
-একটা বাচ্চা মেয়েকে রেপ করলো আর তুমি কিছু নোট এনে আমাকে দেখিয়ে বলছো বিচার করেছো? তুমি?? এই তোমার বিবেক?? থু মারি আমি তোমার টাকায়। থুহ!
প্রত্যুত্তরে মেজাজ খারাপ করে নারীজাতির অসহিষ্ণুতা নিয়ে একটি বর্ণবাদী মন্তব্য করতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো টুটুল। মনমরা হয়ে চটের ব্যাগে রাখা একটি পলিথিন মোড়ানো বস্তু বের করে সে। গজগজ করতে করতে তার অসন্তোষ প্রকাশ করে।
-তোমরা আসলে পুরাটা না শুনেই খালি তেজ দেখাও। জরিমানার পুরাটা তো এখনও দেখোই নাই। এই দেখো কী আনছি। এই ঠোঙ্গার মধ্যে কী আছে বলো তো? অনুমান? হাহাহা! আমজাদের পেনিসটা কেটে নিয়ে আসলাম। প্রস্তুতি নিয়ে গেছিলাম। জিনিসপাতি সব সাথেই ছিলো। বেচারার আমও গেলো ছালাও গেলো। কঠিন দুঃখের ব্যাপার। সে কী, তুমি হাসতেছো কেন? ওহ, এইটার সাইজ দেইখা? হাহাহা!
এই মুহূর্তে আমজাদ উপস্থিত থাকলে নিশ্চয়ই কসম কেটে বলতো এটা কেটে নেয়ার মুহূর্তে এত ছোট ছিলো না!
এগিয়ে চলোর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রথম প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৭ রাত ৮:৫৮