শিরোনাম দেখে হয়তো ভাবছেন সামুতে কোথা থেকে এক মুরাদ টাকলা এসেছে, যে বাংলিশে মানুষ লিখতে গিয়ে Manos লিখে ফেলেছে! আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, এটা ‘মানুষ’ না, এবং বাংলিশও না। Manos হলো একটি স্প্যানিশ শব্দ। এর অর্থ- হাত। আর এত ইতং বিতং করে যার কথা বলতে চাচ্ছি, তা হলো একটি সিনেমা। একটি বিশেষ সিনেমা। তার পুরো নাম, “Manos, The Hands of fate”।
সিনেমার নামের ভেতরেই কিন্তু ঝামেলা আছে, খেয়াল করেছেন? Manos অর্থও হাত, hand অর্থও হাত। তাহলে যদি ছবিটির নামের বাংলা তরজমা করতে যাই, কী দাঁড়াবে? “হাত, ভাগ্যের হাতটি”! পুনরাবৃত্তি দোষে দুষ্ট!
সে আর এমন কী, এর ভেতরে যা আছে তা জানলে এই সামান্য দোষকেও নিখুঁত শিল্পকর্ম মনে হবে।
বুঝতেই পারছেন, আজ বেশ রসিয়ে বলার মুডে আছি! তা বলার আগে কিছু খটমট তথ্য জানিয়ে রাখি। “Manos, The Hands of fate” একটি আমেরিকান ‘ভৌতিক’ চলচ্চিত্র। এটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। এর পরিচালক হ্যাল ওয়ারেন।
কাহিনী সংক্ষেপ-একটি পরিবার (বাবা, মা এবং বাচ্চা মেয়ে) গাড়ি করে কোথাও যাচ্ছিলো। দুর্ভাগ্যক্রমে পথ হারিয়ে ফেললো। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলো এক পোড়োবাড়ির সামনে। সেখানে এক অদ্ভুতদর্শন লোকের কাছে আশ্রয় চাইলো। নানা বাহানা শেষে তাদের আশ্রয় দেয়া হলো বটে, তবে তারা পড়লো এক প্রেতসাধক প্রভুর পাল্লায়, যার কি না ছ ছ’টা নাদুসনুদুস স্ত্রী। এদের কবলে পড়ে পরিবারটির দুর্গতির সীমা রইলো না। মোটামুটি এই হলো কাহিনী। এখন আসুন জেনে নেই, কেন এত মুভি থাকতে একে নিয়ে আয়োজন করে লিখতে বসলাম।
“Your eyes and ears will BLEED!”
এমনটাই মন্তব্য একজন মুভি রিভিউকারীর। এই সিনেমা সম্পর্কে এক কথায় এর চেয়ে যুৎসই মন্তব্য আর হয় না!
আচ্ছা, আপনি কি আলিফ লায়লা দেখেছেন? ঐ যে বিটিভিতে প্রতি শুক্রবার রাত সাড়ে আটটায় প্রচারিত হতো? অত্যন্ত নিম্নমানের নির্মাণ, বাজে অভিনয়, উদ্ভট মেক আপ, প্রলম্বিত হাস্যদৃশ্য সব মিলিয়ে একটা টোটাল বিনোদন প্যাকেজ ছিলো। এই ধরনের প্রোডাকশনগুলিকে বলা হয় “So bad, that it is good”. কিন্তু Manos? এটিও একটি বাজে ছবি। কিন্তু বাজেরও তো একটা রকম থাকে। খারাপ, খুব খারাপ, এত খারাপ যে হাসিই আসে দেখতে- কোনোভাবেই এর নিম্নমানকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। খারাপের সমস্ত সংজ্ঞাকে সপাটে সরিয়ে দিয়ে এটি উঠে গেছে (নাকি নেমে গেছে?) এক অনন্য মাত্রায়, যার কোনো তুলনাই চলে না।
হ্যাঁ, এই সিনেমাটি “সর্বকালের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সিনেমা” হিসেবে বলতে গেলে প্রায় সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
কেন? কতখানি খারাপ হতে পারে একটি ‘সিনেমা’? সামান্য কিছু ইঙ্গিত দেবো এখানে, কারণ পুরোটা বলতে গেলে বিশাল এক বই হয়ে যাবে।
সিনেমার শুরুতে রয়েছে এক অন্তহীন গাড়ি চালানোর দৃশ্য। রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, আর কিছুই ঘটছে না। কোনো সংলাপ, কোনো ঘটনা, না কিচ্ছুই নেই! ঘটনা কী? ঘটনা খুবই সিম্পল। পরিচালক মহাশয় ভেবেছিলেন শুরুতে নাম দেখাবেন, কিন্তু এডিটিংয়ের সময় তা দিব্যি ভুলে গিয়েছিলেন। যার ফলে জন্ম নিয়েছে এই অন্তহীন পথ পরিক্রমার অদ্ভূতুড়ে দৃশ্য!
তো, একসময় এই পথ চলার দৃশ্য শেষ হয়। তারপর কোথা থেকে যেন আবির্ভূত হয় চুম্বনরত এক যুগল। কেন, কোথা থেকে, তার কোনো উত্তর নেই। পুরো সিনেমাটিতে বেশ কয়েকবারই অকারণে এই চুম্বনরত যুগলকে দেখানো হয়েছে। কী জন্যে কে জানে!
আর অভিনয়? অভিনয় বলে কি আদৌ কিছু ছিলো এই মুভিতে? নেই কোন এক্সপ্রেশন, নেই কোন সিনক্রোনাইজেশন, একজন যখন সংলাপ বলে, অন্যজন তখন মূর্তির মত তাকিয়ে থাকে। দেখা গেলো যে অন্যজনের ওপর যখন ক্যামেরা ধরা হয়েছে, সে খেয়ালই করে নি, চুপ করে আছে দিব্যি। ক্যামেরম্যান তথা পরিচালকেরও তাতে কোনো আপত্তি নেই। যেমন চলছে চলুক না! এইভাবে এগোয় মুভিটা। কতক্ষণ দেখতে পারবেন আপনি? যাই হোক বেশিক্ষণ না গাড়ি চলতে চলতে পথ হারাতে হারাতে অবশেষে ১৪তম মিনিটে আমরা পেয়ে যাই আমাদের প্রথম সাসপেন্সে, একটি পোড়ো বাড়িতে চলে আসি।
সেখানে থাকে এক অদ্ভুত দেখতে খোরা লোক, বক্রাকৃতির লাঠি হাতে আর ঝোলানো হ্যাট পরে। বাকিদের এক্সপ্রেশনের অভাব সে মাশাল্লাহ একাই পূরণ করে দিয়েছে। তার শরীরে, চলায়, বলায় বয়ে যায় মহাসাগরের ঢেউ, এতটাই ওয়েভি! আর সে যখন সংলাপ দেয়, মনে হয় একসাথে কয়েকজন কয়েকরকম ভোকাল কর্ড ব্যবহার করছে।
তার নাম হলো টর্গো। এই সিনেমার সবচেয়ে “জনপ্রিয়” চরিত্র। কথা কিন্তু মিথ্যা না, Torgo লিখে গুগলিং করেই দেখুন না!
গুগল করে পাওয়া!
এই সিনেমার সবচেয়ে “বিখ্যাত” দৃশ্যগুলোর একটি হলো, “দ্যা মাস্টার উইল নট এ্যাপ্রুভ”।
পরিবারটি যখন পথ হারিয়ে আলোর দিশা পায় পোড়োবাড়িতে টর্গোকে দেখে, তখন তারা এক রাতের জন্যে আশ্রয় চায় সেখানে। দৃশ্যটি এরকম,
ভদ্রলোক আশ্রয় চাচ্ছেন,
-We could spend the night here.
টর্গোর জবাব- There is no way out of here. It will be dark soon. There is no way out of here.
দম্পতি- No way out here?
(দীর্ঘ নীরবতা)
-It will be dark soon.
(ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকা)
-No way out of here.
এরপর ভদ্রলোক টর্গোকে প্রলুব্ধ করেন এই বলে যে বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই তাদের তাড়িয়ে দেবেন না!
হঠাৎ কী জন্যে যেন সাসপেন্সফুল মিউজিক বেজে ওঠে, আর টর্গো তার বিখ্যাত উচ্চারণে জানিয়ে দেয়,
-The master will not approve.
এই অল্প কটি সংলাপের পুনরাবৃত্তি দিয়ে পুরো দুই মিনিট কাবার। ভাবা যায়!
এরপর আর কী, তারা আশ্রয় পায়, এবং টিপিক্যাল সব ভুতুড়ে ঘটনা ঘটতে থাকে। দ্যা মাস্টার এসে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করতে চেষ্টা করেন, এবং…
তারপর যা ঘটে তা খুব টিপিক্যাল নয়। তার ছয় স্ত্রী ঈর্ষান্বিত হয়ে নাইট গাউন পরে একে অপরের সাথে কুস্তি করতে থাকে। হ্যাঁ, সত্যি এমন একটি দৃশ্য আসলেই আছে!
এই সিনেমাটি ১৯৬৬ সালে রিলিজ পাবার পর টেক্সাসের ছোট্ট একটি শহরের কিছু হলে মুক্তি পায়, এবং দর্শকরা হতভম্ব হয়ে যায় দেখে। এতটা বাজে কী করে হতে পারে একটা মুভি! তাদের টিটকারি, টিপ্পনিতে তা হল কর্তৃপক্ষ নামিয়ে দেয় সহসাই। হয়তো বা তা কালের গর্ভে হারিয়ে যেতো, কিন্তু ১৯৯৩ সালে আবার এর পুনর্জাগরণ ঘটে।
আমেরিকার একটি বিখ্যাত টিভি শো আছে, Mystery Science Theater 3000 (MST3K); এখানে দুনিয়ার যত আজেবাজে মুভি আছে সবগুলিকে প্রেজেন্টেবল উপায়ে দেখানো হয়। তারা কীভাবে যেন ম্যানোস এর সন্ধান পায়, তারপর যথাযথ ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ সহকারে প্রচার করে। এরপরে ছবিটির “জনপ্রিয়তা” দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ডিভিডি চলে আসে, এবং এক সময়ে তা IMDB Bottom List এ ১ নাম্বারে চলে আসে। দীর্ঘদিন এই অবস্থান ধরে রাখে। তবে কিছু অতিউৎসাহী “ভক্তের” ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এটি তার অবস্থান হারিয়ে বর্তমানে ৫-এ আছে।
কিছু তথ্য-
পুরো সিনেমাটি ধারণ করা হয় একটি হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা দিয়ে, যা মাত্র ৩২ সেকেন্ড চিত্র ধারণ করতে পারতো।
সিনেমার প্রিমিয়ারে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দ্রুত হল ত্যাগ করেন লজ্জিত হয়ে, এবং আর কখনই এই সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করতে চাননি।
যে ক্যামেরাটিতে ধারণ করা হয়, তাতে শব্দগ্রহণের সুবিধে ছিলো না। ডাবিংয়ের সময় মাত্র দুজন সকল চরিত্রের সংলাপ বলেন।
চুম্বন চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েটির পা ভেঙে গিয়েছিল শুটিংয়ের সময়। তাই তাকে একটা পার্ট দেয়ার জন্যে গাড়িতে কয়েকবার বসে চুমা-চাট্টি করার সুযোগ দেয়া হয়!
ধারণা করা হয় টর্গো চরিত্রে অভিনয়কারী পুরো সিনেমাটিতে এলএসডি নিয়ে অভিনয় করেছেন। যার ফলে এই অভাবনীয় বাজে অভিনয়ের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন!
২০০৪ সালে কেন এই ছবি তৈরি হলো তার কারণ অনুসন্ধানে ব্রত হয়ে একজন কানাডিয়ান ফিল্মমেকার “Hotel torgo” নামে একটি ডকুমেন্টারি বানান।
And the list goes on…
প্রথম প্রকাশ- এগিয়ে চলো ডট কম
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৭ রাত ১২:২৬