somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মীরা হাসছে

১১ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


-আমাদের ল্যাপটপটা নষ্ট হয়ে গেছে।
কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে মীরা জানালো। অফিস থেকে ফিরেই এই ভয়ংকর দুঃসংবাদটা শুনে নিলয়ের মেজাজ চড়ে গেলো। ধমকে উঠলো ক্রন্দনরত মীরা দিকে তাকিয়ে।
-কীভাবে নষ্ট হলো? নিশ্চয়ই আজাইরা গুতোগুতি করে নষ্ট করে ফেলেছো!
-না! আমি কিচ্ছু করি নি। বিদ্যা!
-তুমি একটা দুরমুশা। তোমার কাছে কোনকিছুই ঠিক থাকে না।
-আমার কী দোষ! কম্পিউটারটা হঠাৎ রিস্টার্ট নিলো, তারপর থেকে আর ওপেনই করা যাচ্ছে না।
হু। মীরাকে নির্দোষই মনে হচ্ছে। নিলয় ভাবে। সে খুব একটা গোছালো মেয়ে না। হেলা ফেলায় ভেঙেছে কত গেলাস, থালা, বাটি, পট ইত্যাদি, কিন্তু কম্পিউটারের যত্ন নেয়ার ব্যাপারে সে বিপুল উদ্যমী। এর ভেতরের কলকব্জা এবং সফটওয়্যারগুলোর যত্নে সে কখনো অবহেলা করে না। ভার্চুয়াল জগতের জাদুকাঠি সম্বলিত যন্ত্রটিতে সামান্য ধূলো বালিও জমতে দেয় ন সে। এই ছোট্ট এবং বিস্ময়কর যন্ত্রটিতে মিশে আছে তাদের কত স্মৃতি! কক্সবাজার, রাঙামাটি, কুয়াকাটা, সাজেক... অথবা কারো জন্মদিন, বিয়ে, মুসলমানি...সে যাকগে!
কণ্ঠ থেকে ধমকের ভাবটা তিরোহিত করে নিলয় সান্ত্বনা দেয় মীরাকে।
-ভেবো না। সামনের শুক্রবারেই এটাকে সার্ভিসিং করাতে নিয়ে যাবো আইডিবিতে।
-এত দিন অপেক্ষা করতে হবে! আর ওরা কি পারবে?
-পারবে না কেন? বাংলাদেশের বৃহত্তম কম্পিউটার মার্কেট ওখানে।
-যদি হার্ডডিস্ক ক্র্যাশ করে? তাহলে সবকিছু মুছে যাবে না? ওরা কি পারবে ফিরিয়ে আনতে?
-পারবে নিশ্চয়ই। ওদের কাজই তো ওটা। আর তুমি আগেভাগেই এসব ভাবতে শুরু করেছো কেন? হয়তো বা দেখা যাবে অপারেটিং সিস্টেম ক্র্যাশ, অথবা কুলিং ফ্যানটা ঠিকঠাক কাজ করছে না, এরকম কিছুই হবে। হার্ড ডিস্ক ক্র্যাশ করা অত সহজ না।
মীরা আশ্বস্ত হয় নিলয়ের কথা শুনে। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে রান্নাঘরে ঢুকে চটপট বানিয়ে ফেলে গরম কফি। নিলয় নিশ্চয়ই খুশি হবে তার এই আন্তরিক আপ্যায়নে। বেশিরভাগ দিনই অফিস থেকে ফেরার পর কফি'র জন্যে মীরাকে তাগাদা দিতে হয়। তা শুনে ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে কোনরকমে এক কাপ কফি বানিয়ে দিয়ে নিলা ফিরে যায় তার ইন্টারনেটের বন্ধুদের কাছে। আর আজ! সে দুই কাপ কফি বানিয়ে ফেলেছে নিলয়ের সাথে বসে খাবে বলে। মীরা এমনই। এই হাসে তো সেই কাঁদে, এই তার মুখ ভার তো ওই তার আকাশ অপার।

সান্ধ্যকালীন কফি পানে তারা বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। শারীরিক ভাবে, এবং মানসিক ভাবেও। অনেক দিন পর তারা চটুল কথকতায় মেতে ওঠে। একটু দুষ্টুমি, একটু খুনসুটি, একটু চুমু...একটি কুইকি ধেয়ে আসে সুনামির মত! সবশেষে বিছানা-বালিশ-চাদরের ওলোট পালোট অবস্থা, এবং আলিঙ্গনরত দুই নর-নারীর ভালোবাসার প্রজ্ঞাপন জারি করা। এখানে মহুয়া বনের মাতাল সমীরণে সুবাসিত দুই নর-নারীর নিঃশ্বাস থেকে নির্গত হয় গোলাপ গন্ধ। এখানে কেউ আসবে না। কম্পিউটার, টেলিভিশন, সেলফোন, স্বজন, কেউ না।

রাতে খাবার সময় তারা তাদের বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী এবং আত্মীয় স্বজনেরা কে কতটা খারাপ, কে কতটা লোভী, কার কোনো সিভিক সেন্স নেই, কে অন্যের সাফল্য দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরে, এসব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করে খাবার টেবিলটাকে আরো মশলাদার করে তুললো। সেই সাথে কম্পিউটারটাকেও যে অতি দ্রুত কোন সার্ভিসিং সেন্টারে না নিয়ে গেলে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করলো।

সপ্তাহ শেষ হতে আরো দুই দিন। এই দুই দিন যে কীভাবে কাটবে! ফেসবুকে সেলফি পোস্ট করা অথবা অদ্য যা রান্না করা হয়েছে তার ছবি দেয়া... কিছুই করা যাবে না। এই কয় দিনে কি কেউ তাকে মিস করবে? উৎকণ্ঠায় ব্যাকুল হয়ে মেসেজ পাঠাবে? পুরোনো ছবিতে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার কয়টি হবে? এমন নানাবিধ চিন্তায় কীভাবে যে কেটে যায় দিন দুটি! অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ এলো। ছুটির দিন, আইডিবি ভবন। এখন যে দোকানটা থেকে ল্যাপটপটা কেনা হয়েছিলো, তাদের কাছে গছিয়ে দিলেই হয়। ওয়ারেন্টি আছে। এক বছর এখনও শেষ হয় নি। দোকানের প্রবীণ একজন সবকিছু নিরীখ করে এক ভয়াবহ ঘোষণা দেন।

"সমস্যা তো অনেক। র্যা ম পাল্টানো লাগবে। নতুন মাদারবোর্ড লাগবে। আপনারা আর তিন দিন পরে আইসা নিয়া যায়েন।"

আরো তিন দিন! মীরার রীতিমত কান্না পায়।
"প্লিজ ভাইয়া... একটু দেখেন না তাড়াতাড়ি করা যায় না কি। "
মীরা তার কণ্ঠের এক বিশেষ আদুরে অংশ থেকে বাক্যগুলি বললো। এভাবে কথা বলে কত পুরুষকে দিয়ে সে নিজের কাজ করিয়ে নিয়েছে! তবে এই আধবুড়ো,গম্ভীর এবং বোরিং লোকটার ওপর প্রয়োগে এটা কাঙ্খিত ফলাফল এনে দেবে কি না বলা যাচ্ছে না।
-দেখি কী করা যায়। এই শিপন, এদিকে আসো তো।
শিপন নামধারী যুবকটি সামনে এসে দাঁড়ালে মীরার কেমন যেন মাথা ঘুরে ওঠে। অসম্ভব সুদর্শন একজন যুবক। সৃষ্টিকর্তা তাকে দু হাত ভরে দিয়েছেন। খাড়া নাকটি যেন গ্রিক দেবতাদের আশীর্বাদ। ঢেউ খেলানো লম্বা চুল। চোখের রঙটা কটা। প্রায় ছয় ফিট লম্বা হবে। মেদহীন শরীর। আগে এ্যাথলেটিক্স করতো না কি? সাধারণত দেখা যায়, অপূর্ব রূপবান পুরুষদের নানারকম খুঁত থাকে। কেউ কুঁজো হয়ে হাঁটে, কারো কণ্ঠস্বর ভালো নয়, কেউ বা আবার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে নিজের সৌন্দর্যের র্যাং কিং পয়েন্ট হারায়! মীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে কখন সে কথা বলে উঠবে। প্রবীণ লোকটা যখন তরুণটিকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, তখন তাদের কথোপকথনে যুবকটির স্পষ্ট,শূদ্ধ বচন এবং কিঞ্চিত 'হাস্কি' ভয়েজ মীরার ভেতরে এক অলঙ্ঘ্যনীয় তরল উপযোগের সৃষ্টি করে। এমন হচ্ছে কেন তার? এমনটা কি হওয়া উচিৎ? কেন এমন হবে? এমন না যে ছেলেটার মত সুন্দর কাউকে সে কখনও দেখে নি। কখনও কখনও দেখা যায় তাদের বাজারে, রাস্তায়, উৎসবে, পার্বনে। কিন্তু এমন দিশেহারা অবস্থা তো কখনও হয় নি! মীরা ভুলেই গিয়েছিলো যে তার পাশে নিলয় আছে। নিলয় মীরার কাঁধে হাত রেখে বললো,
-টেনশনের কিছু নাই। কিছু টাকা অবশ্য গচ্চা যাবে, তবে হার্ড ড্রাইভ ঠিক আছে একদম। সব ডাটাই অক্ষত থাকবে।
পাশ ফিরে মীরা দেখলো এক মাঝারি উচ্চতার, ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসা চুল এবং স্ফিত হওয়া উদরের অধিকারী একজন হাস্যমুখী পুরুষকে। ভাবনাচালিত মোহযানে দূরন্ত গতিতে চলতে গিয়ে গতিরোধকের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো মীরা। নিলয়কে কখনই দেখতে খারাপ লাগে নি তার। হ্যাঁ, এটা ঠিক সম্প্রতি নিলয়ের জামা-কাপড়গুলো আঁটোসাঁটো হচ্ছে, আঁচরাতে গিয়ে থোকায় থোকায় চুল উঠে আসছে, কিন্তু তাই বলে নিলয়ের চেহারার মধ্যে যে একটা আন্তরিক সতেজতা আছে সেটা অস্বীকার করা যায় না। হার্ড ডিস্ক অক্ষত থাকবে জেনে নিলয়কে সেখানে সংরক্ষিত একটি বিশেষ ভিডিওর ব্যাপারে সাবধানী হবার কথা মনে করিয়ে দিতে চায় মীরা, কিন্তু কী মনে করে যেন আর বলা হয় না।
-প্রয়োজনে ফোন করার জন্যে আপনাদের একটি নাম্বার দিন আমাকে।
সুদর্শন যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে মীরা।
-এই যে, এই কার্ডে আমার ফোন নম্বর আছে। আমি আতিক।
-ধন্যবাদ।
গভীর গোপনের কদর্য উল্লাসকে আনুষ্ঠানিক ভদ্রতার লেবাসে আড়াল করে রাখে মীরা।

সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার পর কেমন যেন অস্থির আর অসহিষ্ণু বোধ করতে থাকে দুজনেই। পুরুষ্টু টমেটো আর গ্রাম থেকে আনা খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে মুড়ি-চানাচুর পানসে লাগে। টিভিতে পুরোনো ক্রিকেট খেলার হাইলাইটস, বোওওরিং। শরীর সুধার অমিয় স্বাদও তিতকুটে। সময় কাটানোই দায়। নিলয় বারান্দায় গিয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে ভোঁসভোঁস করে। আর মীরা ভাবে, ফোন করবে না কি একবার আতিকের কাছে? প্রচণ্ড ঔৎসৌক্য অনুভব করলেও, দ্বিধার নোঙর তাকে দমিয়ে রাখে। কেবলই তারা দোকান থেকে এলো। এখন ফোন করা কি ঠিক হবে? আবার ভাবে, একটা ফোন কলই তো! কী এমন এসে যাবে তাতে? যত ভাববে ততই অবস্থাটা জটিল হবে। তাই সে আর অত কিছু না ভেবে ডায়াল করেই ফেললো।
-হ্যালো। কে বলছেন?
দোকানদারদের সাথে কথা বলতে গেলে নিজের নাম প্রকাশ করার কোন প্রয়োজন নেই। তারা চেনে যন্ত্র এবং কাগজপত্র। কিন্তু বর্তমান অবস্থাটা ঠিক স্বাভাবিক পরিস্থিতির সাথে মেলে না। তাই কথোপকথনের ধারাও হলো ভিন্নরকম।
-হ্যালো, আমি মীরা বলছি।
মীরা বলে কাউকে চেনে না কি আতিক, মীরা তার নাম বলে এসেছে কি এসব বিবেচনায় নেয়ার মত অবস্থা নেই তার।
-স্যরি, কোন মীরা বলছেন?
-আজ বিকেলে আপনাদের দোকানে একটা ডেল ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ দিয়ে এসেছিলাম সার্ভিসিংয়ের জন্যে।
-ওহ, হ্যাঁ! এবার চিনতে পেরেছি ম্যাম।
-কাজের কতটুকু অগ্রগতি হলো?
-এই মাত্রই না দিয়ে গেলেন! আর তাছাড়া আমরা তো বলেই দিয়েছি যে তিন দিন লাগবে।
-ওহ আচ্ছা! তাইতো। ঠিক আছে, ধীরে ধীরেই কাজ করেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আর আমার নাম্বারটা সেভ করে রাখেন। আমি মীরা। কল্যানপুরে থাকি।
এই যাহ! কী আবোল তাবোল বকছে সে! আর একটু হলে তো বাসা আর রাস্তার নাম্বারই বলে দিতে নিয়েছিলো সে! নিজেকে সংবরণ করে সারাই সম্পন্ন হলে কল দেয়ার কথা বলে ফোন রেখে দেয় সে।
ওহ! যা হুজ্জোত গেলো! কম্পিউটারের অবর্তমানে বিনোদনবন্ধুর অভাবটা আগামী তিন দিনে বেশ ভালো করেই মিটিয়ে নেয়া যাবে আতিকের কাছে ফোন করে। তার সাথে কথা শেষ হবার পর নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছিলো মীরার। মাথায় চেপে থাকা ভার, মনের অবসাদগ্রস্ততা, আর বুকের ভেতর গুড়ি মেরে থাকা পাথরের ওজন, সব নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। সে এখন নিলয়ের কাছে গিয়ে আহলাদ করবে। ডুবে যাবে রোমান্টিকতার অতলে।
-এই! কতক্ষণ ধরে একটানা সিগারেট খেয়েই চলেছো! ইস! কী বিশ্রী গন্ধ! পুরোই ধোঁয়ার কুয়াশা। সিগারেটই যেন তোমার বউ! আমি কে? কেউ না।
অভিমানে ঠোঁট উল্টালো সে।
-কী ব্যাপার আজকে হঠাৎ এত প্রেম জেগে উঠলো যে! কোন বায়না আছে না কী?
-হু, তা তো আছেই! বায়না টা হলো, তুমি সিগারেট ফোঁকা বন্ধ করে ড্রয়িংরুমে এসে বসো। আমি চটপট নুডলস রান্না করে তোমাকে খাওয়াই।
-যাক, একটা ব্যাপার ভালো হয়েছে কম্পিউটারটা না থাকায়। তোমার মনোযোগ পাচ্ছি। অন্যসময় হলে তো একটু খোঁজও নিতে না আমার।
-আচ্ছা সেটা না হয় স্বীকার করলাম। কিন্তু তোমার কী হয়েছে বলো তো? এখন তো তোমার সাতটার খবর দেখতে বসে যাওয়ার কথা। তা বাদ দিয়ে তুমি সিগারেট টানছো অবিরাম।
-একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত।
-কী ব্যাপার?
-ঐ যে, তোমার সেই ভিডিওটা। ওরা যদি দেখে ফেলে কী অবস্থা হবে ভেবেছো?
হ্যাঁ, সেই ভিডিওটা! মীরার স্নানরত অবস্থায় রেকর্ড করেছিলো নিলয়। উর্ধাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত। কোনরকমে ফিতে লাগানো একটি পেটিকোট অল্প আদরে ধরে আছে মীরার যৌনাঞ্চল, কোমড়। যেন সাক্ষাৎ এক জলপরী! এটা যদি কেউ একবার খুঁজে পায়, তাহলে ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। দোকান থেকে বের হবার সময়ই ব্যাপারটা মাথায় এসেছিলো তার। কিন্তু কাউকে কিছু বলে নি। বলতে চায় নি, আর বললেই বা কী হতো! স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এটা নিয়ে কিছুটা হলেও শঙ্কিত হওয়ার কথা ছিলো। এটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। তাই মীরা এ সংক্রান্ত চিন্তাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে আহলাদ করতেই থাকে।
-এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই সোনা! ওটা তো খুব গোপন একটা ফোল্ডারে। অত ঘাঁটতে যাবে কে? আর তার ওপর হিডেন করা। তুমি খামোখাই চিন্তা করছো।

ঘুমোনোর সময় সেলফোনে কিছুক্ষণ নেটে গুঁতোগুঁতি করাটা মীরার স্বভাব। এর অন্যথা হলে রীতিমত শ্বাসকষ্টে ভোগে সে। আজ তার মোটেও মন টানছে না ব্রাউজিংয়ে। বারবার ডায়াল লিস্টে দেখছে একটি নাম। কেবল তো সাড়ে এগারোটা বাজে। আরেকবার ফোন করবে কি? যত্তসব পাগলামী! নিজের মধ্যে এত উত্তেজনা, এত দুরাচার, এত পাপ আছে কখনোই ভাবতে পারে নি সে। শরীর ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ভিডিওটার ডেস্টিনেশন ফোল্ডার জানিয়ে দিবে নাকি সে আতিক কে? দেখো ওহে সুন্দর, আমার ভেতরেও সৌন্দর্যের ঘাঁটতি নেই। দেখো আমাকে, আমি সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, উর্বর মাটি। আমাতে কী আবাদ করতে চাও তুমি? মুখ ফিরিয়ে নিও না যুবক! ভয় কীসের? দেখো আমি নরম, আমি তপ্ত, আমি ব্যাকুল, আমি তৃষিত। দেখো আমার রহস্যময় ত্রিভুজ, দেখো আমার দুকুল প্লাবী সোমরসবন্যা, দেখো আমার বুকে পরাবৃত্তিক সমীকরণ। নাও, নাও, নাও, এসবই তোমার!
-কী ব্যাপার, এত নড়াচড়া করছো কেনো? ঘুম নাই?
নিলয়ের ঘুম জড়ানো বিরক্তি মাখা প্রশ্নের জবাবে কিছু না বলে হাই তুলে পাশ ফিরে শোয় মীরা। আতিককে নিয়ে যতই ভাবছে ততই জড়িয়ে পড়ছে এক শক্তিশালী জালের ভেতর। এই জাল থেকে বের হবার চেষ্টা করলে শরীরে আরো এঁটে বসে সেগুলো। জাল পরিবেষ্টিত অবস্থায় মুক্তির জন্যে ছটফট করতে থাকে সে। যদিও তার মুক্তির জন্যে কোনরকম আকাঙ্খা ছিলো না। এইভাবে পেঁচিয়ে-পুঁচিয়ে থাকা শরীরটাকে বিলিয়ে দিতেই তার আনন্দ হয়।

রাতে ভালো ঘুম হয় নি মীরার। ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো, কিন্তু বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখে একটু পর পর ঘুম ভেঙে গেছে। স্বপ্নগুলিতে কখনও আতিক তার পরিত্রাতা আর নিলয় তার অধিকর্তা। কখনও ভিডিওটা বিশাল পর্দায় করে প্রদর্শিত হচ্ছে হাজারো মানুষের সামনে। সবার তীব্র, বুনো উল্লাসে প্রকম্পিত হচ্ছে ঘর-মাটি-আকাশ-মেঘ-জল-ক্ষেদ। এই তীব্র ইরোটিক ফ্যান্টাসি তাকে একদম আঁকড়ে ধরেছে। নিস্তার মিলছে না কোনভাবেই। অগত্যা সে ঘুমোনোর চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রায় না ঘুমো শরীরটাকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে চা চড়িয়ে দেয়। গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। বিশেষ করে একটা নজরুল সঙ্গীত। "আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো
তবু আমারে দেবোনা ভুলিতে"। গানটা তাদের কম্পিউটারে ছিলো। এই মুহূর্তে আপাতত শোনার কোন ব্যবস্থা নেই। মীরার কণ্ঠে অবশ্য সুর আছে বেশ। সে গুনগুনিয়ে গাইতে থাকে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় মৃদু রোদের আলসে আলোতে সকালটাকে কী ভীষণ মায়াচ্ছন্ন লাগছে এখন! এই যে প্রকৃতির সান্নিধ্যে জীবনপাত্রে উপচে পড়া বিপুল উপহার, এই যে স্নিগ্ধ সকাল, এই যে পাখির টুইটকার, ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধা চড়ুই ছানা, ঘাসের মাধুর্যে অনায়াস ক্যামোফ্লেজ নেয়া ঘাসফড়িং, ফলবতী গাছে কৈশোর কাটানো ফলের মুকুর... বহুদিন হলো এভাবে সকাল দেখা হয় নি মীরার। সকালের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে সে ভুলে যায় গত রাতের প্রবঞ্চক শরীরের পাপাটেপনা। জীবন এত সুন্দর! প্রকৃতি এবং জীবনের এত সখ্যতা! কোথায় ছিলো তারা এত কাল? কেন সে এতদিন দেখতে পায় নি? গ্রিলের ফাক দিয়ে রোদ এসে দেয়ালে নকশাকাটা ফুল হয়ে যায়। মীরার খুব ইচ্ছে করে এই ঐশ্বরিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পুষ্প তার খোঁপায় গুঁজে দিতে। কে গুঁজে দেবে এ ফুল? এ অধিকার যার ছিলো, সে এখন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ছুটির দিনে একটু বেশি ঘুমোক বেচারা। তাকে আর জাগাতে চায় না মীরা।

কলিং বেল বাজছে। এত সকালে আবার কে এলো? এ কী! সকাল কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? কোথায় সেই নকশাকাটা রোদ? কোথায় সেই পাখিদের কলতান? কোথায় ঘাসফড়িং? কোথায় ফলের মুকুর? অন্ধকার নেমে আসে। অমাবস্যা রাতের মতো বর্ষিত হয় অন্ধকার। শুধু তাদের বেডরুমে, যেখানে নিলয় ঘুমিয়ে আছে, সেখানে ডিমলাইটটা মিটিমিটি জ্বলে অন্ধকারের ঝাপটা যেন আরো বাড়িয়ে দেয়। মীরাকে অন্তরের গহীন থেকে অবচেতনে কে যেন সতর্ক সংকেত দেয়, "দরোজা খুলো না মীরা। দরোজা খুললে ভীষণ বিপদ হবে।" মীরা ভয় পায়। তার সমস্ত স্বত্তা কেঁপে ওঠে অবর্ণনীয় আতঙ্কে। ও পাশে কলিংবেল তো বাজছেই, সেই সাথে দুম-দাম করে প্রবল ভাবে দরোজায় ঘুষি দিয়ে চলছে কে যেন। চিৎকার করছে সে। ভয়াল সে চিৎকার। এই চিৎকারের সাথে সঙ্গত করতে কোথায় যেন ইসরাফিলের প্রলয় শিঙা বেজে ওঠে। যেন কেয়ামত নেমে আসে মীরাদের ঘরে। সে শেষ সহায় হিসেবে দৌড়ে বেডরুমে যায় নিলয়কে ডাকতে। কিন্তু কোন এক কালঘুমে পেয়ে বসেছে নিলয়কে, এত ডাকাডাকি, ঝাপটাঝাপটি, কিছুতেই সে জাগে না। ও পাশে আরো জোরে দরোজা ধাক্কাতে থাকে সেই পরাক্রমশালী অতিথি। মীরা সহনশীলতার উচ্চতম পর্যায়ে উঠে যায়, অতঃপর ভেঙে পড়ে। তার নিজের প্রতি কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। জিন্দালাশের মতো সম্মোহিত হয়ে দরোজাটার দিকে যায়।

দরোজা খোলার সাথে সাথেই বিকটদর্শন লম্বা একটি দানব ঘরে ঢোকে। তার শরীর ভর্তি অজস্র লোম। লকলকে সূচালো লাল জিহবা। বিষাক্ত সাপের মতো। পুরো শরীরে এক রত্তি কাপড়ও নেই। এক দেখাতেই চিনে ফেলে মীরা তাকে। কম্পিউটার সারাইকারী সেই সুদর্শন যুবকটিই এই বেশ ধরে এসেছে। তার জিহবা থেকে লালা ঝরে। কামজর্জর কণ্ঠে সে মীরাকে কাছে টেনে নিতে চায়। “তোমার আহবান আমি শুনেছি মীরা। আমি চলে এসেছি তোমাকে ভরিয়ে দিতে, নিজেকে তৃপ্ত করতে। আমরা দুজন মিলিত হব অগ্নিসঙ্গমে, আমি সাক্ষাৎ শয়তানের কাছ থেকে প্রত্যয়িত। তোমাকে কানায় কানায় ভরিয়ে দেবো” কিন্তু মীরা কিছুতেই সায় দেয় না। ঠেলে সরিয়ে দেয় দানবটিকে। হঠাৎ সে অনুধাবন করে যে, এই দানবটিকে দেখতে যতটা ভয়ানক হোক না কেন, সে বাস্তবে দুর্বল এবং পলকা। বিশেষ করে এই পরিস্থিতিতে, মীরার কাছে। মীরার নিস্পৃহতা আর নির্বিকারত্বের কাছে। মীরা বুঝে ফেলে, সে পারবে। সে পারবে গতরাতের ভুলনামচা থেকে বেরিয়ে এসে দানবটিকে প্রবল আঘাত করতে। হঠাৎ করে এই দানবাগমন, দম বন্ধ হয়ে ফুরিয়ে যাওয়া সকাল, তমসার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা দাম্পত্য জীবন, আর যাবতীয় ভীতিবোধক অব্যয়িকা সবকিছুই একটা বেতাল হাসির দৃশ্য বলে মনে হয় মীরার। সে হাসতে থাকে সবকিছু তুচ্ছ জ্ঞান করে। ওদিকে দানবরূপী কম্পিউটার সারাইকারীটি নানারকম হুঙ্কার, গর্জন, আর হুমকি দিয়ে পরিস্থিতিটাকে নিজের অনুকূলে নেয়ার চেষ্টা করছে। যতই তার নর্তন কুর্দন বাড়ছে, মীরার হাসি ততই বেগবান হচ্ছে, আর একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে তিমিরক্ষণ। ক্ষুধার্ত দানবটি তার কাঁধে থাকা ব্যাগটা খুলে সেখান থেকে কাপড় নিয়ে পরছে। ধীরে ধীরে সে একজন সুদর্শন যুবকে পরিণত হচ্ছে। তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না তর্জন গর্জন করা। কয়েকবার চেষ্টা করে হাস্যকর মিনমিনে কণ্ঠটি তাকে অপ্রস্তুত করে তোলে। শেষ চেষ্টা হিসেবে সে মীরাদের কম্পিউটারের সেই হিডেন ফোল্ডারটির কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে।
-এখনও সময় আছে, আমার কথা মতো চলো, নইলে সব ফাঁস করে দেবো।
এ কথায় মীরা হাসি সমাপ্ত করে। চপেটাঘাতে লম্পট যুবকটির হৃদয় বিদীর্ণ করে তাকে প্রস্থানের পথ দেখিয়ে দেয়।
আলো আসছে। আলো আসছে আবার। মীরা চা চড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় বসে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে, "আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো তবু আমারে দেবোনা ভুলিতে"।
-কী ব্যাপার মীরা! এই সাত সকালে এমন চনমনে আছো যে! বলি এত ফূর্তির কারণ কী?
প্রত্ত্যুত্তরে মীরা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে।
-তুমিও বসো না, আমি আরো দুই কাপ চা বানিয়ে আনছি চটপট।
কিছু কিছু অপেক্ষা সুন্দর। নিলয় সকালের চোখে চোখ রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবে।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:০৭
৪২টি মন্তব্য ৪২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বিহনে কাটে না দিন

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:০৩



অবস্থানের সাথে মন আমার ব্যাস্তানুপাতিক,
বলে যাই যত দূরে ততো কাছের অপ্রতিষ্ঠিত সমীকরণ।
তোমাকে ছেড়ে থাকা এতটাই কঠিন,
যতটা সহজ তোমার প্রতিটি চুল গুনে গুনে
মোট সংখ্যা নির্ণয় করা।
তোমাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

×