somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনেক বিল উঠে গেছে

১৬ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রচণ্ড ক্ষিধের সময় যদি হাতের কাছেই একটি ভালো রেস্তোরা পাওয়া যায়, এবং সেখানে যদি ভালো মানের মোগলাই পরোটা আর শিক কাবাব থাকে তাহলে ক্ষুধাতুর ফ্যাকাসে সন্ধ্যাটা আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি খেতে ভালোবাসি। ক্ষুধা একটি বিপদজনক বস্তু। বিশেষ করে এই ঢাকা শহরের বিশাল জ্যাম আর বাসে ওঠার প্রতিযোগিতায় নিজের মুল্যবান সময় বিলিয়ে দেয়ার অফিস পরবর্তী সময়গুলোতে। যে বিকেলগুলোতে আমি ভাবি যে নাস্তা না করে কিছু টাকা বাঁচানো যাক, ঠিক সেদিনই দেখা যাবে জ্যামের কারণে বাসায় পৌঁছুতে রাতের খাবার সময় পার হয়ে যায় আর কী! এরকম কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবার পর থেকে আমি পকেটে কিছু বাড়তি পয়সা রাখি, এবং বিকেলবেলায় অল্প কিছু হলেও খাই আসন্ন মহাযাত্রায় টিকে থাকার রসদ যোগাতে! আজ অফিস থেকে বের হবার পরপরই ক্ষুধা চাগাড় দিতে আরম্ভ করলো। দুপুরে কাজের চাপে কোনমতে পাঁচ মিনিট সময় বের করে দুটো সিঙ্গারা আর এক কাপ চা খেয়েছি। এতক্ষণে সেগুলো হজম হয়ে ড্রেইনেজ সিস্টেমের অংশ হয়ে মাছেদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছে। তো যা বলছিলাম, এই রাক্ষুসে ক্ষিধে নিয়ে আমি যখন ভালো একটি রেস্তোরা খুঁজে ফিরছি, তখনই মুরগী ভাজা, কাবাব, আর বিরানির গন্ধে আমার মনটা উড়ে গেল একদম! নতুন একটি হোটেল। বেশ সাজিয়েছে। সজ্জাকরণ, পরিচ্ছন্নতা, এবং সুঘ্রাণ; সব মিলিয়ে এই হোটেলটাকেই আজ ভুড়িভোজের জন্যে বেছে নিলাম। বসতে না বসতেই চটপটে বেয়াড়া এসে জিজ্ঞেস করলো কী খেতে চাই। আমি বেশ ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম এতে। সুখাদ্যের তো অভাব নেই, আর আমার পেটটাও নাছোরবান্দার মত জেদ ধরে আছে সব খেয়ে নেবে যেন! কী খাওয়া যায়! ডাবল ডিমের মোগলাই, শিক কাবাব। সাথে কি একটা গ্রিলও নেবো? আর খাবার শেষে তো হজমের জন্যে একটা ডেজার্ট লাগবেই। কি নেয়া যায়, লাচ্ছি নাকি ফালুদা? নাকি দুটোই? মনে তো হচ্ছে সবই লাগবে আমার! 'থামো!'। লোভ সংবরণ করার জন্যে আমি নিজেকে ধমক দেই। "ক্ষিধে পেয়েছে, খাবে। তাতে এত তাড়াহুড়োর কি আছে? আপাতত মোগলাই আর শিক কাবাব খেয়ে নাও। তারপর অন্য কিছু লাগলে দেখা যাবে!" । নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া শেষে অপেক্ষাকৃত ধীরস্থির এবং নির্লোভ অংশটার যৌক্তিক উপদেশ মেনে নিয়ে আমি মোগলাই এবং শিক কাবাবের অর্ডার দেই।
-মোগলাই হইতে একটু দেরী লাগবো স্যার।
ওয়েটারের এই কথায় আমার পাকস্থলীটা যেন গুমড়ে কেঁদে ওঠে। আমি কোনমতে মেজাজ সামলে নিলাম।
-ঠিক আছে, যাও। তবে বেশি দেরী কইরো না।
-ওকে বস।

ক্ষিধে পেটে খাবার জন্যে অপেক্ষা করার চেয়ে আজাব যেন আর নেই! সারাদিন উপবাস থেকে পাহাড় সমান ইফতারির সামনে বসে অপেক্ষা করতেও যেন এত কষ্ট হয় না! সময় কাটানোর জন্যে আমি মোবাইল ফোনে গেম খেলতে থাকি। রাশিয়াকে বেছে নিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে ফুটবল যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। সাম্প্রতিক সময়ে এই দুই মোড়ল রাষ্ট্রের মধ্যেকার শীতল যুদ্ধের কথা মনে করে খেলতে থাকার ফলে লড়াইটা বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। মিনিট দশেকের মধ্যে, যখন খেলার স্কোর রাশিয়া২-আমেরিকা১, তখন আমার খাবার চলে আসে। ইচ্ছে করে কুকুরের মত হুমহাম করে হাত দিয়ে মুখে তুলে নেই খাবারগুলো। কিন্তু আমার মনের ভেতরকার সেই নির্লোভ এবং এটিকেট মানা ভদ্র অংশটা আবার ধমক দিলে আমি বাধ্য হয়ে কাঁটাচামচ ব্যবহার করি। অবশ্য এতেও ইতরবিশেষ হলো না। দুই মিনিটের মাঝে ঈদের সময়কার ঢাকার রাস্তার মত দুটি প্লেট খাঁ খাঁ করতে লাগলো। বাধ্য হয়ে ওয়েটারকে আবার ডাকতে হলো। অস্বীকার করবো না, ডাকতে গিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলাম। এ কথা তো সত্যি যে, বেশি বেশি সবকিছুই স্থুল, এবং ক্ষেত্রবিশেষে 'ক্ষ্যাত' অথবা লজ্জাষ্কর। আমার খবরদারি করা ভদ্র-সভ্য সত্ত্বাটিকে আমি ফাজলামি করে চোখ মেরে দিয়ে আরো তাতিয়ে তুললাম। মরুক গে! তার কথা শোনার সময় নেই এখন।
-একটা নান আর একটা গ্রিল। ঝটপট।
প্রশস্ত হাসি হেসে বেয়ারা অর্ডার নিয়ে যায়। তার মনে ফুর্তি। যত বেশি খাবো টিপস তো তত বেশি দেবো, এজন্যে। নাহ, এ ব্যাপারে আমার কোন কিপটেমি নেই। গেলো না হয় গোটা পঞ্চাশেক টাকা বাড়তি। পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ হয়ে মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করার তো কোনো মানে হয় না!
এসে গেলো নান আর গ্রিল। ক্ষিধেটা এখনও যথেষ্ট চনমনেই আছে। তবে আগের মতো হা-ভাতে অবস্থা নয় এখন। ধীরে সুস্থে খাচ্ছি। ঝলসানো মুরগীর প্রতিটা টুকরো, রুটির প্রতিটা নলা উপভোগ করতে করতে খাচ্ছি। মাঝেমধ্যে আনন্দে চোখ বুঁজে আসছে আমার। আজ আমার হলো টা কী! ক্ষুধার্ত ছিলাম, ঠিক আছে। আমার রুচি বেশি সেটাও না হয় মানা গেলো। কিন্তু তাই বলে এই পরিমাণ খাওয়া দাওয়া! ভাগ্যিস আমি সবসময় পকেটে বাড়তি কিছু টাকা রাখি। নইলে আজকের খাবারের বিল দেয়াটা সম্ভব হতো না। কত হতে পারে বিল? আমি মনে মনে হিসাব করি। মোগলাই, কাবাব মিলে দেড়শ, গ্রিল আর রুটি মিলে দুইশ। সাড়ে তিনশ টাকা অলরেডি হয়ে গেছে। এহ মাত্র! আমার কাছে এখনও অনেক টাকা আছে, এবং ক্ষিধেটাও কম জমে নেই। ধীরে ধীরে খাবার প্রাণপন চেষ্টা করা স্বত্ত্বেও সাত মিনিটের মাঝে আমার প্লেট পুনরায় খালি। অথচ পেটে তার কোনো প্রভাব পড়ছে বলে মনেই হচ্ছে না! প্লেট আর পেটের এমন ছান্দিক সহাবস্থানে আমার সেই নির্লোভ, পানসে অংশটি, যাকে আমি ইতিমধ্যে প্রতিপক্ষ আখ্যা দিয়ে ফেলেছি, সে বেশ গম্ভীর ভাবে আমাকে বলে,
-এত খেয়ো না। বিপদ হতে পারে।
-আরে অফ যাও তো! একদিন আমি একটু বেশি খাচ্ছি তাতেই তোমার দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হবার যোগাড়। কী হবে একটু বেশি খেলে হ্যাঁ? একদিনেই আমার প্রেসার, সুগার, কোলেস্টরেল সব বেড়ে যাবে?
-তুমি একটু বেশি না,অনেক বেশি খাচ্ছো, এবং আরো খেতে যাচ্ছো।
-হু, তারপর?
-আমি বলছি না যে একদিনেই তোমার শরীর বিকল হয়ে যাবে। কিন্তু ভেবে দেখো তো, বাসে প্রায় দুই ঘন্টা থাকাকালীন সময়ে যদি তোমার টয়লেট চাপে তখন কি অবস্থা হবে?
নাহ! এর সাথে আর পারা গেলো না। অবশ্য সে যে সম্ভাবনাটার কথা বলেছে তা একদমই উড়িয়ে দেবার মতো না। মাঝে মাঝে আমার অমন হয়। জায়গায়-অজায়গায় ভীষণ বেগ পেয়ে যায়। তবে প্রতিবারই কোন না কোন ভাবে একটা উপায় হয়ে যায়। এবারও হবে। আমি বেয়ারাকে ডাকলাম আবার।
-এক প্লেট ফুল কাচ্চি বিরিয়ানি দিবা। আর এক গ্লাস বোরহানী।
আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি বিস্মিত বেয়ারার অকথিত প্রশ্নগুলি। সম্ভব হলে সে এভাবেই বলতো, "এত খাওয়া কই রাখেন বস? দেখতে তো হালকা পাতলাই!"
আহ! আহা! এদের কাচ্চি বিরিয়ানির স্বাদটা অসাধারণ! প্রচুর তেল দেয়া হয়েছে যদিও, সাথে একটি তেঁতুল, আর এক পিস লেবু। পরিমাণেও প্রচুর। যত খাই ততই যেন আমার ক্ষিধে বাড়তে থাকে। নিজেকে আমার মনে হচ্ছে একটা রাক্ষস। আচ্ছা, রাক্ষসরা কি কাচ্চি বিরিয়ানি খায়? কাচ্চি বিরিয়ানি খেলে কি ওদের শরীরে কোলেস্টরেল জমে? প্রেসার বেড়ে যায়? কাচ্চি শেষ করে বোরহানিতে চুমুক দেবার পর আমি বুঝতে পারি, এখনও শেষ হয় নি। আমার আরো চাই, আরো! আরো দুই প্লেট এক্সট্রা রাইস নেবার পর অবশেষে মন স্থির করি যে এবার থামা যেতে পারে। তবে শেষ করার আগে একটু ডেজার্ট না খেলে কি হয়? লাচ্ছি নাকি ফালুদা খাবো এই বিরোধে না গিয়ে আমি দুটোরই অর্ডার দিয়ে বসি।

এই বিপুল ভোজ শেষে ডেজার্ট গ্রহণ এক অনবদ্য সুখানুভূতিতে ভরিয়ে দেয় আমার মন। সুন্দর এক সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাই আমি। সন্ধ্যাটা হতে থাকে মন ভালো করা। এতক্ষণে আমার ক্ষিধে মেটার পথে। লাচ্ছিটাতে চুমুক দিয়ে মনে হচ্ছে যেন বেহেশতের অমৃতসুধা পান করছি। পেটের মধ্যিকার যাবতীয় গুপ্তধনকে যেন ঠিকভাবে খুঁজে নিয়ে তাদেরকে অমিয় তরল দ্বারা স্নান করাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তাতে যোগ দিলো ফালুদার দই, আঙুর, আর বরফকুঁচি। শেষ হলো অবশেষে! শরীর জুড়ে ভীষণ এক তৃপ্তিতড়ঙ্গ বয়ে চলেছে। এত তাড়াতাড়ি আমি আর কোথাও যেতে চাই না। কিছুক্ষণ বসে থেকে এই অপার্থিব আনন্দ উপভোগ করাই শ্রেয়। বেয়ারাকে ডাকলাম বিলটা দেয়ার জন্যে। কত হয়েছে বিল? হাজার? বারোশো? হু কেয়ারস! মাসে একবার আমি এরকম একটা ভোজ দেবোই। এইসব ডায়েট কন্ট্রোল, স্বাস্থ্য সচেতনতা, বেশিদিন বাঁচার জন্যে শরীরকে কম কম আনন্দ দেয়া, অন্তত একদিনের জন্যেও আমি ভুলে থাকতে চাই। আমি আবারও ওয়েটারকে ডাকি,
-এই বিলটা দিয়া যাও।

যাবার সময় হয়েছে আমার।
_________________________________________________________________________________
-লাগবো না। বিল তো দিয়া দিছে একজন। কেন আপনারে কয় নাই?
-আশ্চর্য! আমার বিল কে দিতে যাবে? নিশ্চয়ই ভুল করতেছো তুমি। যাও বিলটা নিয়া আসো।
-সত্যিই স্যার, আপনার বিল ঐ যে ওই স্যারে দিয়া গেছে।
তার তর্জনি অনুসরণ করে আমি এক ভদ্রলোকের দেখা পাই। এই গরমেও বেশ স্যুটেড ব্যুটেড। নিখুঁত সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে জরীপ করছেন। মৃদু হেসে হাত নাড়িয়ে আমাদের পরিচয়পর্বের আনুষ্ঠানিক সূচনা করলেন।
-এখানে এসে বসুন।
সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আহবান জানালাম আমি। হয়তো সে আমার পরিচিত কেউ, চিনতে পারছি না। আমার এমন ভয়াবহ খাবারগ্রহণ সম্পর্কে হয়তো বা পরিচিত মহলে রসিয়ে রসিয়ে বাড়িয়ে বাড়িয়ে অপমানজনক কথা ছড়াবে। নাহ, তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে।
-কেমন আছেন?
-এই তো ভালোই। কিছু মনে করবেন না,আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
এসব ক্ষেত্রে, মানে যখন কোন রহস্যময় অথবা ধোঁয়াশাপূর্ণ আচরণের শেষে অন্তরালের মানুষটি মুখোমুখি হয়, তখন নিজের পরিচয় দিতেও সে বেশ আদিখ্যেতা করে এড়িয়ে গিয়ে ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রেখে বিমলানন্দ পায়। কিন্তু এই ভদ্রলোক ওসব কিছুই করলেন না।
-আমি আহনাফ আতিফ মোস্তাকিম। আপনার সাথে বছর পাঁচেক আগে দেখা হয়েছিলো কল্পরাজ্য ডটকমের লঞ্চিং প্রোগ্রামে।
সাথে সাথে আমার মনে পড়ে যায় বছর পাঁচেক আগের সেই দিনটার কথা। অবশ্য পুরোপুরি না, যতক্ষণ আমার চেতনা ছিলো আর কী! লঞ্চিং প্রোগ্রাম সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর আমাদের এমডির যোগসাজশে আমন্ত্রিত অতিথিদের সম্মানে শুরু হয়েছিলো দারুৎসব! সীমাহীন তরলের যোগানে আমি একেবারে অনলখেকো দানব হয়ে গিয়েছিলাম। ইচ্ছেমত পান করেছি। রাত আটটার পর থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত সময়ে কী হয়েছিলো আমার কিচ্ছু মনে নেই। পরবর্তীতে আমাকে বহুবার সেই রাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমার সহকর্মী এবং সদ্য মদ্য পরিচিত ব্যক্তিবর্গ! আমি নাকি কমপক্ষে বিশজন নতুন বন্ধু বানিয়ে ফেলেছিলাম, তাদের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। আরো কত কী! এই লোক সম্ভবত তাদের কেউই হবেন। ভদ্রলোকের স্মৃতির বেশ প্রশংসাই করতে হবে। পাঁচ বছর আগেকার কথা এখনও মনে রেখেছেন, অবশ্য সে রাতের কথা ভুলে যাওয়াটা বেশ কষ্টকর ব্যাপার! অবাক করা বিষয় নহলো, এতদিন পর চেহারা দেখেই চিনে ফেলাটা! আমি স্বাভাবিকভাবেই তাকে চিনতে পারলাম না, তবে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে, হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গি করে তার দিকে পরিচয়ের হাত বাড়িয়ে দিলাম।
-আরে...আহনাফ সাহেব! ভালো আছেন নিশ্চয়ই? অনেকদিন পর দেখা। তো আছেন কেমন?
অভিনয় কলায় আমি কখনই খুব একটু পটু ছিলাম না, তাই আমার এই ছোট্ট অভিনয় টুকু সহজেই ধরে ফেললো সে। তবে মুখে তা প্রকাশ করলো না।
-হ্যাঁ, ভালো আছি। ভালো চলছে।
আমি আশঙ্কামিশ্রিত অপেক্ষায় ছিলাম, সে কখন আমার এই অতিভোজনের প্রসঙ্গ তুলে টিটকারি মারে। কিন্তু না, পাঁচ মিনিট ধরে বসে আছে, এখনও ঐ ব্যাপারে টুঁ শব্দটি করে নি সে। নিপাট ভদ্রলোক। আমি ধীরে ধীরে আড়ষ্টতা কাটিয়ে কথা বলতে থাকি তার সাথে। ভাবছি কখন খাবারের বিল দেয়ার প্রঙ্গটা তোলা যায়, অথবা আদৌ তা তোলা ঠিক হবে কী না। মিনিট দশেকের মাথায় চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলি। তার শখ হয়েছে, টাকা-পয়সা বেশি হয়ে গেছে, সে বিল দিয়েছে, ব্যাস! হয়তো বা এটা এক ধরণের ঘুষ, কোনদিন দেখা যাবে তার ক্লাশ থ্রি পড়ুয়া ছোট্ট ভাগ্নীকে আমাদের অফিসে নিয়ে এসে আমাকে খুঁজে বের করে বলছেন, "এই আমার ভাগ্নী, খুব ভালো অংক আর নৃত্য পারে। একে যদি কল্পরাজ্য সুপারস্টারস টিমে একটু জায়গা দেন তো..." হু, ব্যাপারটা ওরকম কিছুই হবে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তা হোক গে। সেটা পরে দেখা যাবে। আমি এতক্ষণে মোটামুটি নিঃসংশয় হয়ে তার সাথে গল্প করা শুরু করি। এভাবে বেশ খানিকটা সময় কেটে যাবার পর আমার মনে হয় এখন ওঠা উচিৎ।
-তো, অনেক কথা হলো, আহনাফ ভাই। এখন আমার উঠতে হবে। আপনি কোনদিকে যাবেন?
-আমার আপাতত কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। চলেন আপনার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। আপনি কোথা থেকে বাসে উঠবেন?
-কলাবাগান থেকে।
-বেশ। চলেন আপনাকে এগিয়ে দেই।
এই প্রথমবারের মত আমার প্রচণ্ড বিরক্তি লাগলো। আরে, আমারে কি তুমি কোন সুন্দরী মেয়ে পাইছো না কি যে খাবারের বিল দিবা, আবার বাস পর্যন্ত আগায়া দিবা? পাইছো টা কী তুমি? আবার গে- টে না তো! মহা মুসিবতের ব্যাপার। বিরক্তি চেপে রেখে আমি তার সাথে হাঁটতে লাগলাম। দুজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। আমরা যখন হোটেল কস্তুরি পেরুচ্ছি, তখন সে দীর্ঘ নীরবতা ভাঙলো।
-চলুন না, এক কাপ চা খেয়ে নেই। এখানকার চা টা বেশ ভালো। আর সন্ধ্যেবেলায় চা না খেলে আমার কেমন যেন গা ম্যাজম্যাজ করে।
আমার বলতে ইচ্ছে করলো, "দেখুন, আপনার গা ম্যাজম্যাজ করুক বা মাথা ভনভন করুক অথবা কান শনশন করুক তাতে আমার কী? যান রাস্তা মাপেন!"
কিন্তু অভদ্রতা করতে ইচ্ছে করলো না।
-ঠিক আছে চলুন।
কাষ্ঠকণ্ঠে বললাম আমি।
_________________________________________________________________________________

-এই দুই কাপ কড়া করে স্পেশাল পাত্তিঅলা চা দিয়ে যাও।
গমগমিয়ে বললো সে। আমি বেশ চমকে গেলাম। এতক্ষণ তার কণ্ঠ বেশ নিচুলয়েই বাঁধা ছিলো। হঠাৎ এখানে এসে এরকম হেঁড়ে গলায় অর্ডার দিয়ে মানুষকে চমকে দেবার কোন মানে হয়! বিরক্তি গ্রাস করলো আমাকে।
-হোটেলটা বেশ ভালো। দেখেছেন, কত মানুষ এখানে? সিট যে পেয়েছি এটাই ভাগ্যের ব্যাপার। বেশিরভাগ সময়ই বসার জায়গা পাওয়া যায় না।
-ও আচ্ছা।
-বলতে পারেন...বলতে পারেন এখানে সারাক্ষণ ভোজনৎসব চলে। এখানে যারাই আসে তারা আকণ্ঠ খাবার খেয়ে যায়। কেউ খেতে খেতে পেট ফেটে মরে যায়, কেউ আবার বমিতে ভাসিয়ে ফেলে পুরো জায়গাটা। কিন্তু খাওয়ার কোন বিরাম নেই।
-তাই নাকি?
কণ্ঠে ব্যঙ্গ আর বিরক্তির ভাবটা বেশ স্পষ্টভাবেই প্রয়োগ করি। নূণ্যতম কমনসেন্স থাকলে তা ধরে ফেলার কথা। কিন্তু সেটা তার ছিলো না।
ততক্ষণে চা এসে গেছে। চা টা আসলেই বেশ ভালো। বিশাল এক কাপে দিয়েছে, অনেক গরম আর তীব্র মিষ্টি। এটা শেষ করতে কমপক্ষে পনের মিনিট লাগবে। তবে এর সুস্বাদ আমার মধ্যে বেশ আয়েশী একটা ভাব এনে দেয়। ওদিকে আহনাফ সাহেবের এখানে আসার পর কী যেন হয়েছে, উত্তেজিত কণ্ঠে অনবরত কথা বলে চলেছেন। সবই খাদ্যদ্রব্য আর হোটেল নিয়ে।
-এদের চায়ে কী যেন দেয়া থাকে। শুধু চা খেয়ে ওঠা যায় না। ক্ষিধে লাগে। প্রচুর ক্ষিধে। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন কিছুক্ষণ পর।
-কী যে বলেন! পাগলের প্রলাপ। আমি এত কিছু খেয়েছি, আপনি তো নিজেই দেখেছেন। তারপর আবার ক্ষিধে লাগবে, তাও আবার এই বিশাল সাইজের চা খেয়ে? মাথা ঠিক আছে তো আপনার?
আমার তেতে ওঠা কথায় সে বিন্দুমাত্র অপমানিত না হয়ে মিটমিটিয়ে হাসে।
-অত ক্ষেপে যাচ্ছেন কেন? আপনার যা খুশি খাবেন। বিল নিয়ে চিন্তা করবেন না। সেটা আমিই দেবো।
-মানে! আপনি আসলে কে, কী আপনার উদ্দেশ্য সত্যি করে বলুন তো? আমার খাবার দাবার নিয়ে আপনার এত উৎসাহ কেন? আর আপনার বিলের নিকুচি করি আমি! চা টা শেষ করেই সোজা বসার দিকে রওনা দেবো।
-কলাবাগান থেকে মিরপুর, অতদূর হেঁটে যেতে ভারি কষ্ট হবে আপনার।
-হেঁটে যাবো কোন দুঃখে? আমি বাসে করে যাবো।
-বাস তো বন্ধ, জানেন না আপনি? অবশ্য জানবেনই বা কীভাবে। যেমন রেগে আছেন, চারপাশের কিছুই তো খেয়াল করছেন না। এই তো, আমাদের পাশের টেবিলেই আলোচনা চলছে, পরিবহন শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডেকে বাস বন্ধ করে দিয়েছে।
-তাতে কী! আমি ট্যাক্সি ক্যাবে করে যাবো।
-বাহ! বেশ ভালোই তো। খাবেন রাজভোগ, চড়বেন ট্যাক্সি, পড়বেন জার্সি। ভোগবিলাস পূর্ণ এক মহৎ জীবনদর্শন আপনার।
বদমাশ লোকটার সাথে কথা বলার কোন অর্থই খুঁজে পাই না আর আমি।
-আমি উঠছি।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলি আমি।

________________________________________________________________________________

-যাচ্ছেন কোথায়? বসুন না! আলোচনা তো এখনও শেষই হয় নি!
শক্ত করে আমার কবজি ধরে ফেললো সে। বিশেষ কোন পদ্ধতিতে ধরেছে, ব্যথায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। আর একটু নড়ালেই যেন আমার কব্জির হাড্ডি ভেঙে যাবে। ততক্ষণে ওয়েটাররাও চলে এসেছে।
-কী হইছে বস? উনার ক্ষিধা লেগে নাই?
-আরে লাগবে না মানে? না লাইগা উপায় আছে? এরে ধর। ধইরা বাইন্ধা খাওয়া। না খায়া যাইবো কই দেখুম!
আমাকে ওরা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। হঠাৎ আমি পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারি। চারিদিকে প্রচুর মানুষ। সবার সামনে পাহাড়সম খাদ্য। তারা ফেলে ছড়িয়ে খাবলে খুবলে সাঁপটে সুঁপটে খেয়েই চলেছে। তাদের চর্বি ছেড়ার শব্দ, হাড্ডি চিবুনোর শব্দ, সুরুৎ সুরুৎ করে ঝোল টেনে নেয়ার শব্দে চারিদিকে নরক গুলজার অবস্থা। একটা অশুচি অরূচির ঘেন্নাঘেন্না অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরছে। বমি প্রচণ্ড। আর ভয়াবহ গরম লাগছে। অবাক করা বিষয় হলো, এত গরমের মধ্যেও এদের সব ফ্যান বন্ধ। তাতে অবশ্য কারো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয় না! আমাকে ঠেসে চেয়ারে বসিয়ে দেয়ার পরে আমি হাল ছেড়ে দিলাম। আর কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে লাভ হবে না। অনিবার্য পরিণতির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
-স্যরি আপনার সাথে একটু রুড ব্যবহার করে ফেললাম। কিন্তু এ ছাড়া কোন উপায়ও ছিলো না। আপনাকে বুঝতে হবে। খামোখাই যে কেন জোরাজুরি করতে গেলেন! নিজেও হয়রান হলেন, আমাদেরকেও হয়রান করলেন।
-আপনি কী চান আমার কাছ থেকে?
দুর্বল কণ্ঠে কাতর অভিব্যক্তিতে জিজ্ঞাসা করলাম।
-কিচ্ছু না। বিশ্বাস করুন, আপনার ক্ষতি করার কোন উদ্দেশ্যই আমার নেই। আপনি শুধু খাবেন। খেয়ে যাবেন। পেট ভরে খাবেন। আপনি খাবেন আর আমি দেখবো। এটাই আমার চাওয়া।
তার নির্মম ব্যঙ্গ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন চাবুকের বাড়ি দিতে লাগলো। এ কোন ম্যানিয়াকের খপ্পড়ে পড়লাম আমি। এ কোন ভোজভৌতিকতার সম্মুখীন হলাম! চারিদিক থেকে ভেসে আসছে খাবার হুমহাম আওয়াজ। কিছুক্ষণ পর আমাকেও এই কুৎসিত উৎসবে যোগদান করতে হবে। কী ভয়াবহ! কী পৈশাচিক! আমার সামনে তিন প্লেট কাচ্চি বিরিয়ানি নিয়ে আসা হলো। একদম ঠেসেঠুসে দিয়েছে প্লেটের মধ্যে। সুঘ্রাণে সুঘ্রাণে ধূল পরিমাণ!
-কী, ক্ষুধা লেগে গেছে না? আমি জানতাম তো লাগবেই। নিন, আর দেরী না করে খাওয়া শুরু করুন। তিন প্লেট কাচ্চি দশ মিনিটের মধ্যে খেয়ে শেষ করবেন। পারবেন না? পারতেই হবে।
বিনীত ভঙ্গিতে হেসে বললো সে। আমি সভয়ে একবার খাবারের দিকে, আরেকবার তার দিকে তাকালাম। আমার ভেতর ক্ষুধা অনুভব করছি প্রচণ্ড। পারবো। হ্যাঁ আমি পারবো,পারবোই! হামলে পড়লাম প্লেটগুলোর ওপরে। দুই হাত ভর্তি করে মুখ প্রকাণ্ড হা করে স্রেফ গুঁজে দিতে লাগলাম খাদ্যগুলো। অনেকসময় না চিবিয়ে গিলে ফেললাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেড় প্লেট শেষ হয়ে গেলো। বাকি দেড় প্লেটও ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে শেষ করে ফেললাম। দশ মিনিটে সব সাবাড়! আমার ক্ষুধা তখনও মেটে নি। প্লেটের পর প্লেট বিরানি সরবরাহ করা হতে লাগলো। কতক্ষণ এভাবে খেয়ে গেছি হিসেব নেই, কত প্লেট সাবাড় করেছি সেটাও অপরিমেয়। আমাদের মধ্যে কোন কথা নেই। আমি শুধু এই ভোজনভয়াল রেস্টুরেন্টের খাদ্যবিলাসে, স্থুল শব্দে মিশে গেলাম। হঠাৎ লোকটা থামিয়ে দিলো আমাকে।
-হল্ট! এইবার একটা ব্রেক।
আমি ততক্ষণে প্লেটগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে চার হাত পায়ে উবু হয়ে বসে খাদ্যসঙ্গমে মগ্ন। তার কণ্ঠ শুনে ক্ষেপে উঠলাম। গরগর করে প্রতিবাদ জানালাম। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে হুমকি দিলাম। এক বিঘৎ লম্বা জিহবা বের করে খাদ্যলালসা প্রকাশ করলাম। সে আমার গলায়, ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে চু চু করে ডাকতে লাগলো। আমি তাতে সাড়া দিয়ে নিজের অদৃশ্য লেজটা নাড়াতে থাকলাম।
-অত পাগল হয় না বাবা। খাবার আসবে তো। অত অধৈর্য্য হয়ো না। জানি তোমার মধ্যে এখন কোন প্রশ্ন নেই, শঙ্কা নেই, ভীতি নেই। আসলে কী জানো, তোমার সাথে আজকের আগে আমার কখনও দেখাই হয় নি। তবে তোমাকে নিরীখ করছিলাম আমি কয়েক মাস ধরেই। খেতে বড্ড ভালোবাসো তুমি। আর আমি খাওয়াতে ভালোবাসি। টাকা পয়সার অভাব নেই আমার। তাই তোমাদের খাওয়াতে গিয়ে কখনও অর্থ সংকটে পড়তে হয় নি। তবে আজকে আমার সাথে আর ক্যাশ টাকা নেই। তাই বিলটা দিয়ে চলো ওঠা যাক।
আমি এক ধরণের পাশবিক শব্দ করে তাকে তটস্থ করে ফেলার প্রয়াস নেই। কিন্তু লোকটা এসব কিছুতেই পাত্তা দেয় না। বিল আর টিপস দিয়ে আমার গলায় একটা বেল্ট পরিয়ে দিয়ে চারপেয়ে প্রাণীর মত হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। আমি কুঁইকুঁই করতে করতে তার কাছে আপত্তি জানাতে গেলে পশ্চাদ্দেশে একটা লাথি দিয়ে থামিয়ে দেয়। তারপরেও আমি মৃদুভাবে কুঁই কুঁই করতেই থাকি। এবার সে বিরক্ত হয় বেশ।
-উহু, এখন আর কোন কথা না। বাসায় যেতে হবে না? তোমার বাবা-মা কত চিন্তা করছে তোমায় নিয়ে। ওদের কাছে ফিরে যাও। বৌটার কথা একটু ভাবো। সে হয়তো না খেয়ে অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্যে। তুমি গেলেই ভাত-তরকারি গরম করে তোমাকে নিয়ে খেতে বসবে। আরে কী বিপদ! আমার কাছে আর টাকা নেই তো! কীভাবে তোমাকে খাওয়াবো? আবার অন্য এক সন্ধ্যায় কেমন? অন্য এক সন্ধ্যায়, স্বজনদের দুশ্চিন্তা ভুলে, নিজের নিবাস ভুলে, লালসার তীব্র প্রণোদনায় গলে গিয়ে আবারও মানুষ হয়ে উঠবে কুকুর, মানুষ হয়ে উঠবে শুকর, মানুষ হয়ে উঠবে ব্যাঘ্র। ভোগবাদী সমাজের প্রতিনিধি হয়ে পশুসত্তা আত্মীকরণ করে আমরা মানুষ আর পশুদের সংযোগস্থলে বসে চার হাত পায়ে দাঁড়িয়ে, একে অপরকে চেটে দিয়ে, খাঁমচে দিয়ে, নিজেদের প্রকাশিত করব আড়ম্বরে।
এখন যান। উঠে দাঁড়ান। বাসায় সবাই আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। একটু কষ্ট হয়, তবে খানিক প্রচেষ্টার পর সহজেই উঠে দাঁড়াই। লোকটার সাথে কোনরকম বা্য বিনিময় না করে আমি দৌড়ুতে শুরু করি। ভয় পেয়েছি। ভীষন ভয়। আমার ভোগ বিলাসী, খাদুরে, পণ্যময় জীবনকে বিকট ভেংচি কেটে অট্টহাসি হাসতে থাকে লোকটা। সে জেনে গেছে, আমার প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা নেই। জেনে গেছে, কথাটা ঠিক নয়, সে জানতো অনেক আগেই। সময় আর সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো কেবল। জানতো কোন না কোন একদিন আমার লালসাগুলো হুমড়ি খেয়ে গুমড়ে পড়বে তার সামনে। আর তখন সে তা চড়াদামে কিনে নেবে। সে কিনে নেবে আমার বাবা-মার অপেক্ষমান সময়, স্ত্রীর উদ্বিগ্নতা। আজ সে টাকা দিয়ে আমার খাবারের বিল পরিশোধ করেছে, কাল ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা কিনে নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেবে। বিশেষ দিনগুলিতে প্যাথেটিক টিয়ার জার্কিং বিজ্ঞাপন বানাবে। হঠাৎ হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়াবে। আমি হয়ে যাবো নিম্ন থেকেও নিম্নস্তরের লোভী পশু। আমার কুঁজো পিঠে বয়ে বেড়ানো সভ্যতাকে লারেলাপ্পার মত ছুড়ে দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে খেলতে থাকবে। সে কিনে নেবে, কিনে নেবে সব। আমার শবদেহে পরিণত হবার আগ পর্যন্ত।
__________________________________________________________________________________

কোনমতে বাসায় গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কলিংবেলটা টেপার পর তার সুমধুর ডিং ডং শব্দ, আর চপ্পল পায়ে দিয়ে পা ঘেষটে ঘেষটে আমার স্ত্রীর এগিয়ে আসার শব্দ আমাকে আপ্লুত করলো। দরোজা খুলে দেবার পর তার হাস্য অভ্যর্থনায় বিমোহিত হলাম আমি। ওর হাসি যে এত সুন্দর, তা তো খেয়াল করিনি আগে কখনো!
-তোমার জন্যে এক ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন।
-এত রাতে আবার কোন ভদ্দরলোক এলো?
বিরক্তির সাথে সুধোলাম আমি।
-উনার নাম আহনাফ। আহনাফ আতিফ মোস্তাকিম।
তার হাসি প্রসারিত হলো আরো। আমার খুব অসহায় আর অবোধ মনে হচ্ছে নিজেকে।
-বাবা-মা কোথায়? কোথায় আমার বাবা-মা?
রুদ্ধবোধে আক্রান্ত আমি চিৎকার করে উঠলাম আতঙ্কে।
-তারা ড্রয়িংরুমে বসে তর্ক-বিতর্ক শুরু করেছে ভদ্রলোকের সাথে। এনাদের নিয়ে আর পারা গেলো না! তুমি খেয়ে নাও তো। গরমাগরম ভাত। পরে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
বাবা-মার সাথে তর্কে ঐ ব্যাটা কখনই কুলিয়ে উঠতে পারবে না। সে পারবে না তাদেরকে বিশ্ব ভোক্তাগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান লোভ আর ক্ষুধাকে উপজীব্য করে কিনে নিতে। আমি স্বস্তিবোধ করে খেতে বসি। ও ঘরে তর্ক-বিতর্ক, কথা কাটাকাটি বেশ গুরুতর আকার ধারণ করেছে। খাওয়া শেষ করে সেখানে গিয়ে হতচ্ছাড়া লোকটাকে লাথি দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবো, ভাবি আমি। ঠিক সেই সময় আমার দিকে সহাস্যে একটি কাগজ বাড়িয়ে দেয় আমার স্ত্রী। সেখানে লেখা,
-ভাত গরম করা-১০০ টাকা
অপেক্ষা-২৫০ টাকা
হাসি-৪২০ টাকা
___________

মোট-৭৭০ টাকা।


সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৬ রাত ১২:০০
৫৩টি মন্তব্য ৫৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বিহনে কাটে না দিন

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:০৩



অবস্থানের সাথে মন আমার ব্যাস্তানুপাতিক,
বলে যাই যত দূরে ততো কাছের অপ্রতিষ্ঠিত সমীকরণ।
তোমাকে ছেড়ে থাকা এতটাই কঠিন,
যতটা সহজ তোমার প্রতিটি চুল গুনে গুনে
মোট সংখ্যা নির্ণয় করা।
তোমাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

×