আমাকে তোমরা খিস্তি খেউড় করতে পার। আমার নির্বোধ চোখের শুন্য দৃষ্টিতে খসে পড়া তারা, খসে পড়া ফুল, খসে পড়া পাঁপড়ি দেখে খুব একচোট হাসতে পারো। আমাকে তোমরা মাটির শানকিতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ফুটপাত এঁদোগলি, মাকড়শাদের কবরস্থান, তিতকূটে চিরকূটে ভরা ডাকবাক্সে ফেলে আসতে পারো। তারপর তোমাদের সদয় সংস্পর্শে একলা অক্ষিগোলক কোন প্রান্তে গড়াতে গড়াতে উগড়িয়ে দেবে বিষ, সময়সংকেত ধরে হয়ে যাবে বোমা...অপেক্ষা কর অপেক্ষা কর অপেক্ষা কর ৩,২...
(১)
এক বিষণ্ণ বিকেলে প্রতিদিনকার মত আমার শবযাত্রার প্রস্তুতি নেবার প্রাক্কালে সে এলো। আমি তার সাথে কথা বলতে চাইনি। মৃত্যুর মত বন্ধুসুলভ কেউ নয় এই ধূসর ধুলোর ড্রয়িংরুমে। সে আমার কফিনের কাছে এসে আমাকে হিমশয্যা থেকে টেনে তোলে। আগুনের হল্কায় আমার গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়।
আমার প্রফুল্ল অগ্রজ মাতোয়ারা হবে আড্ডায়, এই আশায় ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে ধোঁয়ার দালানকোঠা বানিয়ে সেখানে প্রাচীর ও প্রাণ সঞ্চার করে, রক্ত ও রঙের লেখচিত্র বানায়। জায়গাটা আরো উত্তপ্ত হয়ে এলে একটা আস্ত ডিসেম্বর মাস চাপিয়ে দেয়। আমার ঘরে কোন ক্যালেন্ডার ছিলোনা। কিন্তু আমি শুনতে পাই উত্তপ্ত দিনলিপির উন্মত্ত আর্তনাদ। আমার কন্ঠনালী চেপে ধরে বীভৎস হাসিতে ফেটে পড়ে সে। আমাকে শোনাতে চায় রাজনৈতিক দলগুলোর ম্যানিফেস্টোর অসারতা বিষয়ক জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য, যুদ্ধে বিজিতদের সাম্প্রতিক খোলনলচে পাল্টে মাথাচাড়া দেয়ার প্রবণতা, বাজারের পেটে ধরা পড়া আঁশটে আলসার। আমার কন্ঠনালীতে সাঁড়াশির মত করে তার আঙুল চেপে বসে। সে শুনতে চায় আমার জবাব। আমার গলা থেকে রক্ত ঝলকে ঝলকে পড়ে, আমি বাঁচার জন্যে হাত-পা ছুঁড়তে থাকি। বাঁচতে হলে তাকে মারতে হবে, খুন করতে হবে, এছাড়া আমার নিস্তার নেই, বেশ বুঝতে পারি।
(২)
খুনের ব্যাপারে আমাকে শূচিবায়ূগ্রস্থ বলাটা ভুল হবে। তবে একথা সত্যি যে, আমি সহজে খুন করতে চাইনা অথবা পারিনা। যেসমস্ত রাগী লোক, প্যাঁকাটে যুবক অথবা মোহগ্রস্থ মহাশয়া ক্ষণিকের উত্তেজনায় বউ পিটিয়ে, বন্ধুর নাক বরাবর ঘুষি মেরে অথবা ধর্ষিত কাজের মেয়েটির যোনীতে গরম পানি ঢেলে নতুন চর্মচিত্র, রক্তচিত্র, পুঁজচিত্রের সমন্বয়ে মানচিত্র তৈরী করে চলেছে প্রতিদিন, তারা কেউ জানেনা একটা চরম মুহুর্তের জন্যে অপেক্ষা করে থাকাটা কত আনন্দের! সিরিয়াল কিলারদের তারকা বনে যাবার কাহিনী সে আমরা কম জানিনা, পান চিবুতে চিবুতে গৃহিনীর বটিতে এক ফোঁটা রস গড়িয়ে পড়লে কি রসায়ন তৈরী হয় সেটা ভাবা যেতে পারে বরঙ। অথবা এই মুহুর্তে আমার কন্ঠনালী চেপে ধরে থাকা অগ্রজরূপী পিশাচ, আহ! চেপে ধর আমায়, পিষে ফেল আমার কন্ঠনালী। আমি বহুদিন ধরে চেপে রাখা খুনের তৃষ্ণা মেটাবো আজ। আমাকে গালাগাল দিচ্ছো? খিস্তিখেউড় করছো?
-বুঝছো, এই হৈলো ঘটনা। তোমরা কিছু পুলাপান ফালাফালি কৈরা লাভটা কি হৈলো? উল্টা ট্যাগিং খায়া গেলা। অহন অন্য সিস্টেম ধরতে হৈবো।
চেপে ধর আমার শ্বাসনালী, ভেবেছো জানিনা আমি প্রতিরক্ষাপ্রণালী?
-কি! তুমি আমারে গালি দিলা? আমি তোমার থেকে কত বড়...তুমি কি বললা আবার বলত? তর্কে না পেরে মুখ খারাপ শুরু করছ বেয়াদব!
এইতো! এইতো সবকিছু ঠিকঠাকমতই হচ্ছে যেমনটা হবার কথা ছিলো। সেই চরম ক্ষণটা এসে গেছে যেটা আসতে পারতো আরো দুইদিন আগে বাসে ভাড়া নিয়ে বচসার সময় অথবা ছমাস আগে বেশ্যার বাড়িতে, সে যথেষ্ঠ প্রণোদনা যোগাতে পারেনি বলে, বা তিনবছর আগে রাস্তার পাশে পেচ্ছাপ করার সময় দেয়ালের অদ্ভুত বানান লিখন দেখে, অথবা আরো বারো বছর আগে, আমার জন্মদিনের দিন কেকে পেস্ট্রি কম হবার অজুহাতে...নাহ, বারো বছর বেশি দূর হয়ে যায়। আমি অত দূরে যেতে পারবোনা। ক্লান্ত। আপাতত পেচিয়ে ধরে আছি গর্বিত গোখরোর মত সময়কে, একটু পরেই ফণা উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে যে।
আমি গর্জন করে উঠি। গর্জন করতে আমার ভালো লাগে। হতচকিত, পাংশুটে মুখ দেখতে আমার ভাল্লাগে। পাল্টা গর্জন শুনতেও আমার ভাল্লাগে।
"তুমি রাগ দেখাও আমার সাথে! কিসের এত রাগ তোমার?"
কিসের এত রাগ যদি বুঝতাম তাহলেও কি এই গোখরোসময়ে তাকে বুঝিয়ে বলতে যেতাম! তবে এটা ঠিক, এই রাগের বিস্ফোরনের প্রয়োজন ছিলো খুব। খুব প্রয়োজন ছিলো সময়মত খুনী হয়ে ওঠার।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পরে আমি কর্মপন্থা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। খুন করব কি দিয়ে? বেশি ভাবার সময় নেই, উল্টো আক্রান্ত হয়ে যেতে পারি। বেশি ভাবার সময় নেই। আমার পেন্সিল ধার করার যন্ত্রটা দিয়ে তার গলায় বসিয়ে দিই। এইবার আমার বলার পালা! এতক্ষণতো খুব গলা চেপে ধরে রেখেছিলে!
"কেমন লাগছে? আরেক পোচ দেবো, আর চ্যাচাবা??" নাহ আর লাগবেনা। যা দিয়েছি তাতেই হয়ে যাবে। উদযাপনের জন্যে আমি কাপ-পিরিচ এবং ফুলদানীগুলোকে আছড়ে ভাঙি। কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে স্যাঁতস্যাঁতে করে তোলে পরিবেশ।
আমি রান্নাঘর থেকে একটা বড় দা নিয়ে এসে মৃতদেহটিকে টুকরো টুকরো করতে শুরু করি। এরপর টুকরোগুলোকে বস্তায় ভরে নিয়ে গিয়ে পার্শবর্তী নদীতে ফেলে দিই। কাজ শেষ!
(৩)
এতটা সহজে কর্ম সম্পন্ন হয়ে যাবে ভাবিনি। ঘরে ফিরে আবার তো সেই ভবঘুরে বিষণ্ণতাই সঙ্গী! ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে যখন রক্ত আর চা মিলেমিশে যায়, টুকরো মাংশ আর কমলার কোয়া পদদলিত হয়, আমার মধ্যে বস্তুবাদ সম্পর্কিত নতুন দর্শনের ঊন্মেষ ঘটে।
সবকিছু ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দেবার পর আমার ক্লান্ত লাগে। সবকিছু অবশ্য ফেলতে পেরেছি বলে মনে হয়না। সবকিছু ফেলা যায়না। এখনও পড়ে আছে ভাঙা গ্লাস, সংঘর্ষের সময় পড়ে যাওয়া টুকটাক ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদী, খুচরো পয়সা, এঁটো নাস্তা। থাকুক! এত পরিপাটী ঘর কবেই বা চেয়েছিলাম আমি! অপরিপাটী ঘরে বিষণ্ণতা, একাকীত্ব আর রাগের খোলস ছেড়ে এইতো বেশ ভালোই লাগছে এখন!
"চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সুখ
চারিদিকে বন্ধু বন্ধু মুখ
আমাকে তুমি যন্ত্রণা দিও বসুন্ধরা
আমি ঘুমুবো
আমাকে তুমি অসুখ দিও বসুন্ধরা
আমি ঘুমুবো"
(৪)
গভীর রাত্তিরে আমার পেচ্ছাপের বেগ পায়, আমি ঘুম থেকে উঠি। ল্যাট্রিনে যাবার পথে অন্ধকারের রোঁয়া ওঠা স্যান্ডেলটা পায়ে গলাতে গিয়ে ধারালো কিছু একটার আঘাত পাই। বুঝতে পারি সেই কাঁচের টুকরোগুলো ঠিকভাবে ঝাঁট দেয়া হয়নি এখনও। কমলালেবুর কোয়াগুলো পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে। খুন খুন চোখে বাতি জ্বালিয়ে দিই। আমার ভেতর কে উল্লাস করে ওঠে আবার। অনতিদূরের নদীতে স্টিমার ভেঁপু বাজিয়ে চলে যায়। আমার মনে পড়ে লাশ এবং সৎকারকার্যের কথা। আমি পেচ্ছাপের কথা ভুলে যাই। ঐ নদীতে সৎকার ঠিকমত হয়েছে বটে কিন্তু এঘরে ঠিকমত হয়নি। ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও। এই কমলার কোয়াগুলো, বেদ্দপ কমলার কোয়াগুলোকে কোথায় রাখা যায়? এর সমানুপাতের কফিন কই? কই? কই? এইতো পেয়েছি একটা সিগারেটের প্যাকেট। কিন্তু ঢুকছেনা কেন ঠিকমত? চিপে তোর রস বের করব সুন্দরী কমলা, ঢুকবিনা মানে? সে খুব আয়েশ করে কমলাগুলো চিবুচ্ছিলো মনে পড়ে আমার। এই কমলাগুলো আমার ভিকটিমের স্মৃতি ধরে আছে। নাহ বড্ড কোমল হয়ে গেল কথাটা, সাক্ষী হয়ে আছে। কোন সাক্ষীর নিস্তার নেই। আমি কমলাগুলোকে আঁটাতে গিয়ে হাত বিশ্রী রসে মাখামাখি করে ফেলি। মুছে ফেলার জন্যে পাশে পড়ে থাকা একটা রুমাল নিতে গিয়ে মনে পড়ে এটাও তারই ছিলো। এই রুমালটা দিয়ে সে ঘেমে থাকা কপাল আর ঘাম মুচ্ছিলো। সুতরাঙ পোড়াকপালে ঘেমো রুমাল, তোমারও নিস্তার নেই। এটাকে কি করা যায়? কি করা যায়? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এটা থেকে ঘাম বেরুচ্ছে, শ্রম বেড়ুচ্ছে ওহোহো ওহোহো এত কিছু দেখছি কেন আজকে? একটা রুমালের ভেতর এত কিছু থাকতে পারে কে জানতো! কে ভাবতে পেরেছিলো কবে! আপাতত পকেটে ঢুকিয়ে রাখি, পরে এটার বন্দোবস্ত করা যাবে। একটা রুমালের ভেতর কান্না থাকতে পারে কত... উফ! কেন ভাবছি এসব? খুন করার চেয়ে খুন পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো বেশি দায় দেখছি। এইসব রুমাল, কাগজ, কলম, কাঁচের টুকরো, টুকরোর টুকরো, তারও টুকরো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টুকরো সবকিছুই স্বচ্ছ এবং দর্পণের মত কাজ করছে। আমি বিকট সব প্রতিবিম্ব দেখতে পারছি তার এবং আমার। কতগুলো ঝাঁট দিয়ে বের করব? একটা বের করি তো আরেকটা বের হয়। আচ্ছা, মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে বসি,
কমলার কোয়াগুলো- সিগারেটের প্যাকেটে ঠেসে দিয়েছি-শেষ!
মেঝেতে গড়িয়ে পড়া চা- এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে-শেষ!
কাঁচের টুকরোগুলো, এগুলোই সবচে বেশি ঝামেলা করছে।এক কাজ করি রুমালটাতে ভরে নিয়ে তারপরে ফেলে দিই, চমৎকার আইডিয়া! আগে মাথায় আসেনি কেন? ছিঁচকাঁদুনে রুমাল আর হতচ্ছারা কাঁচের টুকরোগুলো একসাথে বিদেয় হবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। কিন্তু রুমালগুলো দিয়ে কাঁচের টুকরোগুলোকে জড় করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে ব্যাপারটা অতটা সহজ না। হাত গলে, রুমাল গলে বেড়িয়ে যায়। তারপরেও ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। একটা মানুষকে এক নিমিষেই খুন করা যায়, কিন্তু তার চিহ্নগুলো নিকেশ করতে এত সময় লাগে কেন? সে খুব কাছের কেউ ছিলো বলে? এজন্যেই কি পরমাণুসমান একটা কাঁচের টুকরো মাটিতে পড়ে থাকলেও আঁচড় কাটে পায়ে? সে যদি খুব কাছের কেউ না হত, ধরা যাক...হঠাৎ করে ঘরে ঢুকে পড়ল অপরিচিত কেউ, তাকে খুন করলেও কি এমন হত? নাহ, তাকে তো খুনই করা যেতনা। খামোখা একজনকে খুন করতে যাবো কেন? অথবা, খুন করলেও পরিতৃপ্ত হতাম কি? সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই, জানা যাবে কিনা কখনও জানিনা। আপাতত আমাকে এই নচ্ছারবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হবে। আমি সিগারেটের প্যাকেটে করে আধখাওয়া পচে যাওয়া কমলার কোয়া, রুমালে বেঁধে কাঁচের টুকরো, এবং বাসি চায়ের গন্ধযুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে কার্পেট বগলদাবা করে নদীটির দিকে যাই।
(৫)
ব্রীজের কাছে এসে চাঁদের আলোতে আমি খুব সহজেই তার উল্টানো মৃতদেহ খুঁজে পাই। জায়গাটা কর্দমাক্ত বলে এখনও সেখানেই আঁটকে আছে। তোমাকে আরেকবার খুন করব বলে এসেছি প্রিয় ভ্রাতা। খুনের চক্করে পড়ে গেছি। কি আর করা! তার মুখে আমি পচা কমলার কোয়াযুক্ত সিগারেটের প্যাকেট ভরে দিই, রুমালের ভেতর থেকে কাঁচের টুকরোগুলো বের করে ঝেড়ে দিই তার শরীরের আনাচেকানাচে। আর বাসি চায়ের গন্ধযুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে কার্পেট দিয়ে তাকে মুড়িয়ে দিয়ে গড়িয়ে দিই। যাও ভেসে চলে এবার। দূর থেকে স্টিমারের ভেঁপু শোনা যায় আবার। আমি রুমালটি প্রাণপণে নাড়াতে থাকি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। তারা দেখতে পেয়ে আমার কাছাকাছি আসে।
-কোথায় যাবেন?
জিজ্ঞাসা করে তাদের কেউ। তবে আমার হাতের রক্তাক্ত রুমালটি দেখে সমঝদারের ভঙ্গীতে মাথা নাড়ায়। তারা লাশটি নিয়ে চলে যায়। মুহুর্তেই একটা বিশাল কালোমেঘ এসে ঢেকে দেয় চাঁদ। হারিয়ে যায় অলৌকিক ইস্টিমার আর লাশ। হারিয়ে যায় আমার প্রশ্নগুলোও, কাছের কাউকে খুন করেছি বলেই কি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এত জটিল হল? যদি অজানা, অচেনা, অপরিচিত কাউকে খুন করতাম তবে কেমন হত?
অন্ধকার শহরে পা হেঁচড়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি খুন করার জন্যে একজন নির্ভরযোগ্য ভিকটিম খুঁজতে থাকি...
আমি একজন নির্ভরযোগ্য ভিকটিম খুঁজছি ফ্রেন্ডো! যে সাত খুনেও রা করবেনা!