তিথি হাসছে।এই সেই হাসি না। "হো হো" টাইপ হাসি।হাসতে হাসতে কয়েকবার বিষম খেলো। তারপরও হাসি থামলো না।একটাই কারণ অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে আমি পা পিছলে কাঁদায় পড়ে গেছি। ইচ্ছা করলো তিথিকে ধরে আছাড় মারি। অনেক কষ্টে সেই চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলাম। আমার ওজন কম নাহ। ফুফাতো ভাই বাবু আমাকে টেনে তুলতে গিয়ে নিজের ঘাম ঝরালো ।
আকাশে ঘন জোছনা। সাথে মেঘও আছে।কিছুক্ষণ পর পর ঘন মেঘ জোছনাকে আড়াল করে দিচ্ছে। বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না।গ্রামের পথ। আমি, তিথি আর বাবু ওদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি যাচ্ছি।এর মধ্যেই পড়ে গেলাম।
তিথি আমার ফুফাতো বোন।এইবার এইচ.এস.সি দিল। দুনিয়ার তাবৎ শয়তান সম্ভবত তাকে গুরু মানে। মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে যাই। তারপরও চুপ করে থাকি। মায়ের আদর ছাড়াই একরকম বড় হয়েছে তো। তিথির মা আমার ফুফু মোসাম্মাৎ ফেরদৌসি আক্তার মারা গেছেন যখন তিথির বয়স দুই।ফুফুকে নিয়ে কখনই তার সাথে তেমন কথা হয় না।তারপর থেকেই আমার ফুফা এক হাতে পুরা সংসার সামলেছেন।
তিথি গুনগুন করে গান গাইছে।চারিদিক কেমন নিস্তব্দ।কেমন একটা গা ছমছমে ভাব।
হঠাৎ তিথি বললো "ভইয়া, একটা জিনিস দেখবেন?"
আমি উত্তর দিলাম না।
বাবু দেখব দেখব বলে খুব আগ্রহ দেখালো।
তিথি আবার জিজ্ঞেস করলো আমাকে।
এবারও চুপ করে থাকলাম।
তিথি মনে হয় রেগে গেলো। বললো "দেখলে দেখেন না দেখলে নাই।"
বলেই পা চালিয়ে সামনে হাটা দিল। একটু অন্ধকার মতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করতে লাগলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, এক ঝাঁক জোঁনাকি তিথিকে ঘিরে ধরলো। জোনাকির আলোয় তিথিও যেন জ্বলছে। ঠিক তখনই মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বের হয়ে এলো।তিথিকে দেখে মনে হল যেন স্বর্গ থেকে পরী নেমে এসেছে।এক্ষুনি আবার চলে যাবে। আমি আর বাবু হা হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। সারাটাপথ তিথি কোন কথা বললো না।শুধু থ হয়ে দেখলাম জোনাকিরাও ওর সঙ্গে এসেছে বাড়ি পর্যন্ত।
কিভাবে কি হলো জিজ্ঞেস করব করব করেও পরে করা হয়ে উঠলোনা।
বছর তিনেক পর...।
আজ সন্ধ্যায় তিথির বিয়ে হয়ে গেলো। অনেকটা তাড়াহুড়া করেই বিয়েটা দেয়া হলো।
ফুফা গত হয়েছেন মাস ছয়েক। তিথির কি হবে এই ভেবে চিন্তেই সবাই মিলে বিয়েটা দিয়ে দিল।সারাদিন খুব হই হুল্লোড় হলো। একটু পরেই ওকে বিদায় দেয়া হবে।
বিদায় দেয়ার সময় তিথিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। আমিও খুঁজতে বের হলাম। অনেক দূর থেকে পুকুর পারে জমাট আলো দেখে চমকে উঠলাম। কাছে গিয়ে দেখি তিথি তার মা-বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে এক ঝাঁক জোঁনাকি।
ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না।
কাঁদুক। প্রাণ ভরে কেঁদে নিক। অনেকদিন হয়তো মেয়েটা এই বাড়িতে আসবে না।
জোনাকিরাও হয়তো ওর সঙ্গে চলে যাবে।
আকাশে জোছনার বান ডেকেছে।ভরা জোছনা যেন সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তিথিকে ইন্দ্রাণীর মতো লাগছে।
আচ্ছা,ইন্দ্রাণীরা কি কখনো কাঁদে?
হাউ মাউ কান্না শুনে ইচ্ছা হলো বোনটার মাথায় কিছুক্ষণ হাত রাখি।
গেলাম না। প্রকৃতি সবাইকে সব জায়গায় যাবার অনুমতি দেয়না।
দূর থেকে মনে মনে বলতে লাগলাম "আহ। বড় দুঃখী মেয়ে।বড়ই দুঃখী মেয়ে......।।"
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৩৯