আবার হলদে তৃণ
ভরে আছে মাঠে-
পাতায়, শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে দিকে, চড়ুইয়ের ভাঙ্গা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে-পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা কড়কড়
মাকড়ের ছেড়া জাল লতায় পাতায়
ফুটফুটে জোছনা রাতে পথ চেনা যায়;
হিম আকাশের গায় - ইঁদুর পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে মাঠে,
ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে ।
-জীবনানন্দ দাস
সবার কাছেই শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি সবচেয়ে মধুর হয় । শৈশবের সেই সোনালী দিনগুলিতে সবাই থাকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো । এখন জীবন মানেই কাজের চাপ, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, বর্তমানের ভাবনা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, সর্বোপরি জীবন মানে প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে যুদ্ধ । পিছন দিকে তাকিয়ে মনে হয় শৈশবের একটি মাস যেন ছিল একটি দিনের মতো, কখন কেটে গেছে টেরই পেলাম না । কিন্তু এখন যেমন প্রতিটি দিনের আলাদা আলাদা করে হিসেব রাখতে হয়, এই বুঝি কোনো জরুরি কাজ হাতছাড়া হয়ে গেল, সর্বত্র শুধু টেনশন আর পেরেশান । সেই শৈশবের দিনগুলি ভাবতেই ভালো লাগে । আর সেইসব দিনের প্রায় বিস্মৃত অথবা কিঞ্চিত বিস্মৃত কিছু স্মৃতি নিয়ে আমার এই স্মৃতিচারণা ।
স্মৃতিচারণার আগে একটা কথা বলে নেওয়া মনে হয় ভালো হবে । আমার আসলে লেখালেখির তেমন কোনো যোগ্যতা নাই । ব্লগে অক্ষরজ্ঞান আছে কিন্তু কিন্তু লিখতে জানে না আমি সেই শ্রেনীর সদস্য । আমার লেখালেখির দৌড় সর্বোচ্চ দু-একটা মন্তব্য করার মাঝে সীমাবদ্ধ । তবুও আমার শৈশবের কিছু ঘটনা ব্লগের এই ডিজিটাল পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস কিংবা অপচেষ্টা । আপনাদের ভালো লাগলেও আমার ভালো লাগবে, ভালো না লাগলেও আমার স্মৃতি অন্যদের সাথে শেয়ার করতে পারলেই আমি কৃতার্থ ।
বাবার সরকারী চাকরির সুবাদে তাঁকে ২-৩ বছর পরপর নতুন জায়গায় বদলি হতে হতো । প্রথম প্রথম অনেক খারাপ লাগতো; পরিচিত জায়গা, পরিচিত লোকজন আর বন্ধুদের ফেলে নতুন জায়গায় যেতে মোটেও মন চাইতো না এর কারণে আমার কতো প্রায়-সম্পূর্ণ কিংবা অসম্পূর্ণ প্রেম অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে
আমার শিশুকাল কেটেছে মাদারীপুরে । তখনকার স্মৃতি অনেক ঝাপসা । তাও কিছু কিছু মনে আছে আর বেশিরভাগই মায়ের মুখে শোনা । ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম দুরন্ত আর ছটফটে স্বভাবের । ছোটবেলা থেকে শুধু পড়ালেখা আর দুষ্টুমির জন্য কতো যে মাইর খাইছি তার ইয়ত্তা নেই । ছোটবেলা থেকে নদী আমাকে প্রচন্ড রকম কাছে টানে । মাদারীপুরে নদী ছিল না । কিন্তু আমার দাদাবাড়িতে নদী ছিল । একবার দাদাবাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে আবদার করলাম, "এবারে মাদারীপুর যাওয়ার সময় ব্যাগে করে একটু নদী নিয়ে যাব.."। সেই কথা শুনে সবার তখন সে কি হাসি । আমি তো তখন বুঝিনি এই কথায় হাসির কি থাকতে পারে ! শুধু ভেবেছিলাম বড়রা আমাদের ইচ্ছেগুলোকে ছেলেমানুষী() ভাবে !
প্রথম যখন মাদারীপুর উঠলাম তখন আমাদের বাসার আশেপাশে আমার সমবয়সী কেউ ছিলনা । বড়রা কেউ খেলতে নিতো না, তাই সেই সময় আমার একমাত্র খেলার সঙ্গী ছিলেন আমার মা । মা বাসার টুকিটাকি জিনিস আমার সামনে দিয়ে দিত, সেটাই ছিল আমার দোকান । একটু পরপর রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা ৫ পয়সা - ১০ পয়সা দিয়ে আমার দোকান থেকে এটা-সেটা কিনে নিতো । এটাই ছিল আমার দোকান-দোকান খেলা ।
আমার যন্ত্রনায় বাসার টেলিভিশনের টেবিল দিন-দিন উঁচু করতে হতো । প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে এসে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন । আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দুরে, আনুমানিক ৪-৫ মিনিটের পথ হবে সেখানে একটা ছোট একটা পানের দোকান ছিল । সেখান থেকে প্রায়ই বাবা আমাকে চকলেট কিনে দিতেন । সেই সুত্রে আমি ওই দোকানদারকে চিনতাম । একদিন দুপুরবেলা আমার দোকান() থেকে আয় করা ১০ পয়সার একটা কয়েন নিয়ে ওই পানের দোকানে গেলাম চকলেট কিনতে । দোকানদারকে পয়সা দিয়ে বললাম চকলেট দেয়ার জন্য । উনি তো আমাকে একা দেখেই বুঝে ফেলেছে যে আমি নিশ্চয়ই বাসায় বলে আসিনি । উনি আমাকে বসিয়ে রেখে বললেন, "চকলেট তো শেষ হয়ে গেছে, একজনকে চকলেট আনতে পাঠিয়েছি । তুমি একটু বসো ।" এদিকে একটু বসতে বসতে তো প্রায় এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে । উনি চকলেটও দেয় না, আমাকে যেতেও দেয় না । বাসার লোকজন তো এদিক-সেদিক খোজাখুজি করতে করতে অবশেষে আমাকে ওই দোকানে আবিস্কার করলো ।
এরপর যখন আর একটু বড় হলাম তখন একটা নতুন বাসায় উঠলাম । সেখানে আমার সমবয়সী কয়েকজন বন্ধু ছিল । তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল সুমন নামের একটি ছেলে । সুমন কথা বলতে পারত না, শুধু আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিত । ঘটনাক্রমে খেলতে গিয়ে আমি ২ বার সুমনের মাথা ফাটিয়েছিলাম । ঐসময় মায়ের কাছে প্রথম পড়াশুনার পাঠ নিলাম । প্রথম প্রথম "অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে" পড়তে ভালো লাগলেও, কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম পড়াশুনা জিনিষটা আর যাই হোক খুব ভালো কিছু অন্তত হতে পারেনা ।
আমাদের পাশের বাসায় তখন দুবোন থাকত লিজা আপু আর লাইজু আপু । তাদের সাথে খেলতে গিয়ে আমার একবার মাথা ফেটেছিল । তাদের একটা ভাই ছিল তার নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না । ওই ছেলে ছিল কিছুটা বখাটে টাইপের, নেশা-টেশা করতো, আর তার মাকে প্রায়ই "শালার-পো-শালা" বলে গালি দিতো । আমিও কিছুদিনের মধ্যেই গালিটা শিখে ফেললাম । তখন আমার মা আমাকে নিরস্ত করলেন এই বলে, "এইটা বাসস্টান্ডে এক বড় মানুষের নাম । বড়দের নাম ধরে ডাকতে হয় না ।" তখন আমি বললাম, "ওই ভাইয়া তো ডাকতেছে ।" মা বললেন, "ও তো এখন বড় হয়ে গেছে তাই ডাকে ।" আমার ও তাই আর ওই নাম ধরে ডাকা হলো না ।
*পোস্ট বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে । তাই আর বেশি কিছু লিখলাম না ।
**ভালো লাগলে চলবে ।
***অনিচ্ছাকৃত বানান ভুল ও লেখনীর ত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী ।