একজন লেখক ঠিক ততটাই সার্থক, তাঁর লেখালেখিতে শিল্পমান যতটা সার্থক। মানুষ হিসেবে তিনি কেমন, তিনি কি রকম জীবন-যাপন করেছেন, তা এক্ষেত্রে গৌণ হওয়াই বাঞ্চনীয়। এ কারণে লেখক হিসেবে মূল্যায়নের স্বার্থে আমরা একজন লেখকের শিল্পদৃষ্টিকে অবলম্বন করলে সেটাই যথার্থ হবে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর লেখালেখিতে যে শিল্পদৃষ্টি পরিলক্ষিত হয়, তা আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমকালে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে সফল কথাসাহিত্যিকের শিল্পস্বরূপ উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবো।
ক.
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের আবির্ভাব হয় আধুনিক যুগে। যদিও আধুনিক যুগের প্রবর্তক সাহিত্যিকেরা ছোটগল্পের ভাণ্ডারে তেমন কিছু দিয়ে যেতে পারেন নি, তবে তাঁদের উত্তরসূরিগণ এ ক্ষেত্রটিকে বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তাঁদের ন-প্রবেশের পেছনে অবশ্যি যৌক্তিক কারণ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ছোটগল্পের গঠন-প্রকৃতি অন্যান্য সাহিত্যক্ষেত্রের তুলনায় খানিকটা জটিল। মানুষের জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আবেগানুভূতি, যন্ত্রণা, হর্ষ-বেদনা ছোটগল্পে খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় বলে শুধু বইয়ের বিদ্যায় এটি সম্ভব নয়। আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার উদ্ভব এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা মানুষের জীবনে যে আমূল পরিবর্তন এনেছে, তার ফলে মানুষের জীবন হয়ে গেছে খ-িত। যেখানে যুদ্ধপূর্ব সময়ে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এবং জীবন-যাপনের নানাবিধ সুযোগ ও আনন্দলাভের উপায় বর্তমান ছিল, সেখানে যুদ্ধপরবর্তীকালে মানুষের জীবন হয়ে পড়ে সঙ্কুচিত, মানুষের জীবনবোধ এবং উপলব্ধিগুলো হয়ে পড়ে বিচলিত, বিপর্যস্ত; বৃহত্তর জীবনগোষ্ঠী আশ্রয় খুঁজতে থাকে তার গভীরতম জীবনপ্রদেশে। নানা রকম অভাব-অনটন, জীবনযন্ত্রণা মানুষকে এক অন্য ধরনের জীবন-অভিজ্ঞতার সম্মুখিন করে তোলে। আর তাই মধুসূদন-বঙ্কিম-বিহারিলাল আধুনিকতার পথ-প্রদর্শক হলেও এবং শিল্প-সাহিত্যে নানা রকম গুণগত পরিবর্তন আনয়ন তাঁদের পক্ষে সম্ভব হলেও ছোটগল্প লেখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। জীবনকে তাঁরা দেখেছেন একটি বৃহৎ-মহৎ পরিবেশের মধ্যে, জীবনের নানামুখী বিপর্যয়-অপচয় তাঁরা দেখেন নি। এ কারণেই হিন্দু পুরাণ, ইতিহাস ইত্যাদিকে অবলম্বন করে তাঁদের পক্ষে উপন্যাস রচনা সম্ভব হলেও ছোটগল্প সম্ভব হয়নি।
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প রচনায় অগ্রবর্তী ভূমিকা নিয়েছেন মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিই মূলত ছোটগল্প-সাহিত্যের প্রথম সার্থক রূপকার। এর কারণও সুস্পষ্ট। যুদ্ধপূর্ব, যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী- এ তিন সময়ই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন; অবলোকন করতে পেরেছেন মানুষের জীবনের উত্থান-পতন, যার ফলে মানবজীবনের এ ভাঙা-গড়া, মানবমনের নানাবিধ জটিলতা অনুধাবন করা তাঁর পক্ষে যতটা সহজ হয়েছে, অন্যদের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। যদিও রবীন্দ্র-ছোটগল্পের বিরুদ্ধে গীতিধর্মীতার অভিযোগ উঠেছে, তথাপি এ কথাও সত্য যে, “রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প কিছুতেই কল্পনাবিলাসের রঙিন ফানুস নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং তদপেক্ষা সত্য অনুভূতির সমবায়ে কবির মানসে যে গভীরতর সত্যসৃষ্টির আয়োজন সঞ্চিত হইয়াছিল তাহারই প্রকাশ তাঁহার ছোটগল্পগুলিতে।” [বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: ড. সুকুমার সেন; ৩য় খ-, পৃ. ২৯৮] প্রকৃত অর্থে, যুদ্ধপূর্ব যুগে যে সামাজিক-রাজনৈতিক অরাজকতা-অবক্ষয় তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাই তাঁর সাহিত্যে দেখা দিল ছোটগল্পরূপে।
শরৎচন্দ্রও যুদ্ধপরবর্তী আধুনিক যুগের রাষ্ট্র-সমাজ-সভ্যতা ও জীবনের এ অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এছাড়া নিজের জীবনের নানাবিধ যন্ত্রণা-জটিলতাও তাঁকে মানবমনের গভীরতর জটিল দিকটিকে অনুধাবন করতে সাহায্য করেছিলো। এ সকল কারণে শরৎচন্দ্রের পক্ষেও ছোটগল্প রচনার বিষয়বস্তু ও সার্থকতা রূপায়ণের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি। শরৎ যে সময়ে সাহিত্য রচনা শুরু করেন, তখন ছোটগল্প ইতোমধ্যেই একটি প্রতিষ্ঠিত এবং নিরীক্ষিত শিল্পকর্ম। অথচ এতগুলো ইতিবাচকতা থাকা সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র তেমন কোনো সার্থক ছোটগল্প লিখে যেতে পারেন নি। তাঁর আলো ও ছায়া, মন্দির, বোঝা, অনুপমার প্রেম, ছবি, দর্পচূর্ণ, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ, বিলাসী, একাদশী বৈরাগী, মামলার ফল ইত্যাদি না বড়গল্প বা উপন্যাস, না ছোটগল্প। কারণ আঙ্গিক বিচারে উপন্যাস বা বড়গল্পের সাথে এর যেমন পার্থক্য রয়েছে, আবার ছোটগল্পের জন্য যে নির্জলা শিল্পদৃষ্টি প্রয়োজন, তেমন শিল্পদৃষ্টিও তাঁর রচিত এ সকল গল্পে অনুপস্থিত-প্রায়। তবে এ কথা অবশ্য-স্বীকার্য যে শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প পাঠকের মধ্যে যে তন্ময়তা সৃষ্টি করে, তা শুধু পাঠকের একক মনোযোগের ফলশ্রুতি নয়, সেখানে লেখকেরও একটি সুগভীর যোগ আছে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের মতো তাঁর ছোটগল্পেও আবেগ ও প্রাণস্পন্দন রয়েছে, ঠিক উপন্যাসের মতোই তাঁর গল্পের শুরু ও সমাপ্তি। শরৎচন্দ্রের গল্পের আরো একটি বিশেষ রীতি, তা তাঁর ছোটগল্পের একটি ত্রুটিও বটে; তা হলো তাঁর অতিশয় অপ্রয়োজনীয় বাগবিস্তার। তিনি নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতেই হোক, বা চরিত্রকে সুদৃঢ় করে তোলার স্বার্থেই হোক, যুক্তিতর্কের অবতারণার পাশাপাশি নিতান্ত স্বগোতক্তিও করে থাকেন। অনেক সময় তা পড়ে পাঠকের বোঝার উপায় থাকে না যে উক্তিটি আসলে কার। তাতে করে লেখকের মতামত হয়ত প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে এটি প্রায় অনতিক্রম্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তা সত্ত্বেও এ জাতীয় ত্রুটি উপন্যাসের ক্ষেত্রে সহনীয় হলেও, ছোটগল্পের ক্ষেত্রে অবশ্য-অমার্জনীয়। ছোটগল্প যেহেতু মানবজীবনের সূক্ষ্মতম আবেগানুভূতির রূপক, সেখানে এ ধরনের বাগবিস্তারের কোনো সুযোগই থাকে না। শরৎবাবুর রচিত ছোটগল্পগুলোর মধ্যে দু-একটি বাদে প্রায় সবগুলোতেই এ জাতীয় ত্রুটি লক্ষ করা যায়। এ সকল দিক বিবেচনায় তাঁর যে ছোটগল্পগুলো সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার সেগুলো হলো ছবি, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ ও মামলার ফল। তবে সবদিক বিবেচনায় মহেশ শরৎচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প। এ গল্পে ছোটগল্পের মৌলিক সবগুলো দিক রক্ষিত হয়েছে।
খ.
প্রবন্ধসাহিত্যেও শরৎচন্দ্র অল্পবিস্তর অবতরণ করেছেন। এসব প্রবন্ধ মূলত দুই ধরনের- কোনো বিশেষ সভা-সমিতিতে বা অভ্যর্থনা উপলক্ষে লিখিত ও পঠিত, এবং মৌলিক মননশীল প্রবন্ধ। তবে শরৎচন্দ্রের প্রবন্ধ কিছু বাঁধাধরা আবেগ-অনুভূতির সমাহার ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর প্রবন্ধগুলোর মধ্যে নারীর মূল্যতে তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরিচয় লাভ করা যায়। এখানে আবেগ যেমন আছে, তেমনি উল্লাস আছে, প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীতে বিদ্রোহের বাসনাও আছে। সমাজ ধর্মের মূল্য প্রবন্ধটিও যুক্তির আলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তার বাইরে তিনি কোনো প্রবন্ধ লেখেন নি।
গ.
উপন্যাসের যে কয়েকটি অবশ্যরক্ষণীয় নীতির কথা সমালোচকেরা বলে থাকেন, তা হচ্ছে পটভূমিকা, কাহিনি, সংলাপ, চরিত্র ও বাণীভঙ্গি। এ উদ্দীপকগুলোর যথাযথ সম্মীলনীই হচ্ছে একটি উন্যাস। উপন্যাসে আকাশের সমগ্রতা থাকে, মানবজীবনের রূপসমগ্রতা এখানে প্রতিফলিত হয়। জীবনের পূর্ণাঙ্গ রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্য একটি বিস্তৃত পরিম-ল আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ প্রয়োজনের কারণে এমন সব বিষয়ও উপন্যাসে উপস্থিত হতে পারে যা অন্য কোনো শিল্পকর্মে সম্ভব নয়।
শরৎচন্দ্রের পূর্ববর্তী ঔপন্যাসিকেরা তাঁদের সৃষ্টিকর্মে শিল্পটাকে পর্যবেক্ষণ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের যে কয়েকটি উপন্যাস রয়েছে তার সবকটিতেই সমগ্র শিল্পরীতি পরিলক্ষণযোগ্য। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, রবীন্দ্র-উপন্যাসের সবগুলোই শিল্পোত্তীর্ণ। বিশেষ করে চোখের বালি ও শেষের কবিতায় যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, একই ব্যক্তি দুটো সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী আবেগানুভূতির যে সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন, তার পরে শরৎচন্দ্রের জন্য আর বেশি কিছু বাকি ছিলো না। তবে যুগবিচারে শরৎচন্দ্রের গুরুত্ব স্বীকার না করে উপায় নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর উপন্যাসগুলোও বিবেচনা করা চলে।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের বিশেষ যে কয়টি দিকে দুর্বলতা লক্ষ করা যায়, তা হচ্ছে কাহিনি, সংলাপ ও বাণীবঙ্গি। তাঁর যে কয়টি উপন্যাস আছে, তাতে কাহিনির বৈচিত্র্য তেমন একটা নেই বললেই চলে। তাঁর প্রায় সবগুলো উপন্যাসের কাহিনি একই ধারায় গড়ে উঠেছে যার মূল বিষয়বস্তু হিন্দু সমাজ ও তার সংস্কারমুখিতা। যেহেতু শুরুতেই বলা হয়েছে যে যুগবিচারে তাঁর উপন্যাসগুলোর মূল্যায়ন করা যুক্তিসংগত হবে; সে দিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে যে শরৎবাবুর উপন্যাসের মূল উপজীব্যগত এ বৈচিত্র্যহীনতা মূলত হিন্দু সমাজ ও সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর আপোষহীনতা। শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের প্রাক্কালে যে সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক বিবর্তন লক্ষ করা যায়, তাতে দেখা যায় যে হিন্দু সমাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিচলিত হওয়া যেকোনো চিন্তাশীল মানুষের পক্ষেই স্বাভাবিক ছিলো। ভাঙা-গড়ার সম্মুখে দোদুল্যমান হিন্দু সমাজ নিয়ে তাঁর যে আশঙ্কা এবং সংশয় কাজ করতো তা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উপন্যাসের পটভূমিকায় স্থান পেয়েছে; তাই এক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা অমূলকই হবে। বরং আমরা বলতে পারি, তাঁর এ সীমাবদ্ধতা তাঁর যুগের প্রয়োজনেই। আমরা একে একজন মহৎ ব্যক্তির প্রচেষ্টা বলতে পারি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দু সমাজের অ্যভন্তরে নানবিধ ত্রুটি লক্ষ করেছিলেন। এ ত্রুটি এতটাই বিস্তৃত ছিলো যে তাঁর পক্ষে সমগ্র জীবনে এর বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁর সমগ্র সাহিত্যেই এর পরিচয় মেলে। তিনি এ সনাতনী হিন্দু সমাজের নানাবিধ সংস্কারের পক্ষে ছিলেন; যদিও তিনি আমূল কোনো পরিবর্তন কখনোই চান নি, তবে হিন্দু সমাজের শুভস্বার্থে তিনি সবসময়ই এর সমালোচনায় মুখর ছিলেন। তাই তাঁর সাহিত্যকর্মগুলো শেষ পর্যন্ত তাঁর সংস্কারমুখিতাই প্রমাণ করে। সুতরাং তাঁর উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনোরূপ মহত্ব আরোপ করা তর্কসাপেক্ষ বিষয়। এ কারণেই বোধ করি সামাজিক ক্ষেত্রে আধুনিক কোনো চিন্তাভাবনার প্রতিফলন শরৎবাবুর সাহিত্যে নেই, একইভাবে উপন্যাসেও।
তাঁর উপন্যাসের কাহিনিগত বৈচিত্র্যহীনতার পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে তাঁর অগভীর শিক্ষা। আধুনিক শিল্প-সাহিত্যের অনেক দিক সম্পর্কেই তাঁর ধারণা ও যোগসূত্র অত্যন্ত ক্ষীণ ছিলো বলে তাঁর মধ্যে প্রকৃষ্ট শিল্পবোধ গড়ে উঠতে পারে নি। যার ফলে তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে নতুন কোনো শিল্পরূপের উদ্ভাবন ধরা পড়ে না।
তবে উপন্যাসের কাহিনি রচনার ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের একটি বিশেষ গুণ ছিলো, তা হচ্ছে সচলতা। তাঁর উপন্যাস শুরু করার পর শেষ না করে উঠে যাওয়া পাঠকের জন্য অত্যন্ত দুষ্কর। বাঙালি জীবন সম্পর্কে তাঁর যে বিপুল অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছিলো, হৃদয়ের সম্পূর্ণ উষ্ণতা ঢেলে দিয়ে তিনি তা উপস্থাপন করেছেন। তাঁর কাহিনি রচনায় সংবেদনশীল মানসিকার প্রকাশ পাঠকের চিত্তকে বিশেষভাবে মোহিত করে রাখে- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
তবে শরৎচন্দ্রের শিল্পবোধ সবচেয়ে বেশি প্রখর তাঁর সংলাপে। মানুষের সাথে নিবিড় যোগসূত্র তাঁকে যে গভীরভাবে সমাজ-সচেতন করে তুলেছিলো, তার প্রমাণ তাঁর রচিত সংলাপ। এগুলো তাঁর প্রখর সমাজচেতনার স্বাক্ষরবাহী। শরৎচন্দ্র সংলাপ সৃষ্টিতে যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, সমমানের শিল্পবোধ তাঁর বাণীভঙ্গিতেও নেই।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের গঠন-প্রকৃতিতেও তেমন কোনো বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় না। শরৎচন্দ্রের সার্থকতা মূলত সামাজিক মানুষের নিতান্ত সাধারণ জীবনের, সাধারণ আবেগ-অনুভূতিজাত তীক্ষ্মতা ইত্যাদির আখ্যানকার হিসেবে। শরৎচন্দ্র বাস্তব জীবনে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন মানুষ ও মানবজীবন সম্পর্কে, তার নানামুখী উত্থান-পতন সম্পর্কে, তা তিনি সফলভাবে রূপায়ণ করেছেন তাঁর উপন্যাসগুলিতে। প্রচ- রকম মানবজীবনমুখিতার কারণে সাধারণ পাঠকের কাছে শরৎবাবুর উপন্যাসসমূহ অনন্য সাধারণ হয়ে ধরা দেয়। তিনি প্রকৃতপক্ষে, সাধারণ মানুষের খুব কাছে অবস্থান করেছেন, তাদের সুখ-দুঃখ খুব কাছ থেকে দেখে তাদের সহমর্মী হয়েছেন। এ কারণে পাঠক তাঁকে সহযাত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছে খুব সহজেই।
শরৎচন্দ্রের সমালোচকেরা তাঁর বেশিরভাগ সাহিত্যকেই আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিতে চাইবেন; কারণ তাঁরা তাঁর সাহিত্যে শিল্পবোধের পরিচয় তেমন একটা পান না। তবে অনেক ক্ষেত্রে এর যৌক্তিকতাও আছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে শরঃচন্দ্র এতটাই নাটকীয় ঘটনাবলীর অবতারণা করেছেন, যা অনেক সময়ই তাঁর সমালোচকদের জন্য পথ উন্মুক্ত করেছে। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে যেমন সঙ্কীর্ণতা আমরা লক্ষ করেছি, উপন্যাসের ক্ষেত্রে তেমনি ভ্রম সৃষ্টি হয়। কারণ তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাসেই উপন্যাসের চাইতে বড়গল্পের লক্ষণ বেশি লক্ষিত হয়। বিশেষ করে বড়দিদি, পরিণীতা, মেজদিদি, অরক্ষণীয়া, কাশীনাথ, স্বামী, নববিধান ইত্যাদি উপন্যাসগুলো বড়গল্পের লক্ষণাক্রান্ত।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলোর আরো একটি ত্রুটিপূর্ণ দিক হচ্ছে কাহিনির বুনন-অসহিষ্ণুতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপন্যাসের ঘটনাগুলো জমাট বেঁধে উঠতে পারে নি। অনেক ক্ষেত্রে একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী, উপন্যাসের মূল ঘটনার সাথে যার তেমন কোনো যোগ নেই, এমন ঘটনার অবতারণাও তিনি করেছেন। তাঁর উপন্যাসের ঘটনাগুলো অনেক সময়েই এতটাই স্বতন্ত্র যে উপন্যাসের ঘটনাগুলোকে পৃথকভাবে লিখলে তা আলাদা আলাদা ছোট বা বড়গল্পের রূপ নেবে। অর্থাৎ দেখা যায় যে, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো অনেকক্ষেত্রেই কয়েকটি ছোটগল্পের সন্নিবেশ হয়ে উঠেছে; আর এমনটি হয়েছে তাঁর উপন্যাসের ঘটনাগুলোর মধ্যে যথাযথ যোগসূত্র স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। চরিত্র সৃষ্টিতেও কখনো কখনো এমনটি হতে দেখা যায়; তাঁর উপন্যাসে মাঝে মাঝে এমন চরিত্রও এসে হাজির হয়েছে, পুরো উপন্যাসটিতে যার তেমন কোনো ভূমিকাই নেই। তবে এত কিছুর বাইরে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের সবচেয়ে লক্ষণীয় গুণ হচ্ছে উপমা ও রূপকল্প ব্যবহারে তাঁর দক্ষতা। উপন্যাসের পরতে পরতে তিনি এমন সব উপমা-চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন, যা অতি সাধারণ ঘটনাকেও অনন্য সাধারণ করে তুলেছে। এ রকম দু একটি উদাহরণ না দিলেই নয়।
১. যেদিন হইতে মাধবী তাহার ভাদ্র মাসের ভরা গঙ্গার মত রূপ, স্নেহ, মমতা লইয়া পিতৃভবনে ফিরিয়া আসিল, সেই দিন হইতে যেন সমস্ত সংসারে নবীন বসন্ত ফিরিয়া আসিয়াছে। [বড়দিদি]
২. আমি ঘাড় ফিরাইয়া ইন্দ্রের দিকে দেখিলাম, যেন ভষ্মাচ্ছাদিত বহ্নি। যেন যুগ যুগান্তর ব্যাপী কঠোর তপস্যা সাঙ্গ করিয়া তিনি এইমাত্র আসন হইতে উঠিয়া আসিলেন। [শ্রীকান্ত: প্রথম পর্ব]
ঘ.
শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা বাংলা সাহিত্যে অকল্পনীয়। তিনি এমনকি বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের চাইতেও বেশি পাঠকপ্রিয় ছিলেন। এর কারণ এটি হতে পারে যে, তিনি সমাজকে যতটা নাড়া দিয়েছেন, তাঁরা তা পারেন নি। তাছাড়া তাঁর গল্প-উপন্যাসের পটভূমিকাও ছিলো নিতান্ত সাধারণ সামাজিক মানুষকে নিয়ে। যদি পাঠকপ্রিয়তাকে একজন সাহিত্যিকের উচ্চতা মূল্যায়নের মানদ- হিসেবে ধরা হয়, তাহলে শিল্পবোধের বিষয়গুলোর বাইরে শরৎচন্দ্রই যে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে উচ্চাসনের অধিকর্তা, এ কথা বলতে দ্বিধান্বিত হওয়ার কোনোই কারণ নেই। শরৎচন্দ্রেরই ভাষায় ‘আমার লেখা তোমাদের জন্য, আর গুরুদেবের (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) লেখা আমাদের জন্য’। আর এই এক কারণ বোধহয়, যা শরৎচন্দ্রকে বাংলা সাহিত্যে গগনচূর্ণী সফলতা এনে দিয়েছিল। আর তাই শরৎচন্দ্র ব্যতীত বাংলা সাহিত্যে, বাংলা সাহিত্যের একটি বড় অংশই বোধ করি আঁধারে থেকে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:২৭