"চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে,
কলঙ্ক যা আছে, তা আছে মোর গায়ে৷"
চাঁদের গায়ের কালো দাগটিকে তার কলঙ্ক বলা হয়, সেটা আমরা সকলেই জানি! 'চাঁদের কলঙ্ক চাঁদের কলঙ্ক' বলে এতো লাফালাফির কিছু নাই; কারণ চাঁদকে মূল্যায়ন করতে হবে তার কাজ দিয়ে— রাতের অন্ধকারে তার দেয়া আলো আর জোয়ার-ভাটায় তার ভূমিকাটা ঠিকঠাক থাকলেই হলো, তার সে বিখ্যাত 'কলঙ্ক' কারো কোনো ক্ষতি করছে না!
লতা মুঙ্গেশকর হয়তো ভালো রাঁধতে জানেন না; প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি তাঁর রান্নার দক্ষতা দিয়ে তাঁকে বিচার করবেন কি না, বা মাশরাফিকে তাঁর ফুটবল খেলার দক্ষতা দিয়ে, বা জিম ক্যারিকে তাঁর গানের গলা দিয়ে বিচার করবেন কি না??
ব্যাপারটা হচ্ছে, প্রতিটি মানুষেরই দুর্বলতার দিক (চাঁদের কালো দাগটির মতো) থাকে; কিন্তু দেখার বিষয় হলো তাঁর সেই দুর্বলতাগুলো সমাজ-রাষ্ট্রের কোনোরূপ কোনো ক্ষতির কারণ হচ্ছে কি না; দেখার বিষয় হলো তিনি তাঁর পেশাগত দিক থেকে যে সার্ভিসটি দেয়ার কথা সেটা সততার সাথে দিচ্ছেন কি না! লতাজির বিস্বাদ রান্না সমাজের জন্য বা মানুষের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ নয়; সুতরাং সেটা নিয়ে লেবু কপচানোর চাইতে তাঁর গানের বিষয় নিয়ে আলোচনাটাই যৌক্তিক!
যা-হোক!
কথা বলবো হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে নিয়ে! প্রথম কথা, তাঁকে বিবেচনা করতে হবে তাঁর লেখা দিয়ে; তিনি তাঁর পেশাগত জায়গা থেকে সমাজে সঠিকভাবে সার্ভিস দিচ্ছেন কি না সেটা দিয়ে! ব্যক্তিগত জীবনে নানান দুর্বলতা মানুষের থাকতেই পারে; তবে সেটা তখনই আলোচনার বিষয় হতে পারে যখন তা নৈতিকতার মানদণ্ডে অকৃতকার্য হবে!
দেখুন, প্রথমত অনেকের সমস্যা হলো, "তিনি তাঁর মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করলেন, তাঁর মেয়ের বয়সী একজনকে বিয়ে করলেন, তাঁর বাধলো না?!!"
ভাই, পৃথিবীর ইতিহাসে হাজার হাজার সেলিব্রেটির এ ধরণের উদাহরণ রয়েছে; আমাদের ধর্মগুরুদের মধ্যেও রয়েছে! এটা তো অপরাধ নয়; কারণ তিনি শাওনকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করেন নি, তার সম্মতিতে করেছেন; কোনো সামাজিক রীতিপ্রথা বা আইনকানুন ভঙ্গ করে বিয়ে করেন নি, সামাজিক ও ধর্মীয় সকল রীতি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখেই বিয়ে করেছেন! এখানে সমস্যাটা কোথায়?
হয়তো বলবেন, "তাঁর আগের একটি সংসার ছিলো৷"
হ্যাঁ, ছিলো; তো? দ্বিতীয় বিবাহের লক্ষ লক্ষ উদাহরণ পৃথিবীতে রয়েছে, এমনকি স্ত্রী বর্তমান থাকতেও দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ বা ততোধিক বিয়ের উদাহরণ পৃথিবীতে অসংখ্য রয়েছে যা গণনাতীত! তিনি তো তাঁর প্রথম স্ত্রী বর্তমান থাকতে তার অনুমতি ছাড়াই আরেকটি বিয়ে করেছেন— এমন নয়! গুলতেকিনের সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর শাওনের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং পরে এক সময় বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়! এখানে চরিত্রহীনতা বা অন্যায়-অপরাধের কী দেখতে পান আপনি?
আরেকটি প্রসঙ্গ নিয়ে ছোট্ট করে বলতে চাই!
ম্যাডাম গুলতেকিন খান (যিনি এক সময় 'গুলতেকিন আহমেদ' ছিলেন; হুমায়ূনের প্রথম স্ত্রী) দেখলাম একটি নিউজ পোর্টালকে সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন; তার বেশিরভাগটা জুড়েই হুমায়ূন আহমেদ এর নিন্দা!
মজার ব্যাপার হলো, সম্প্রতি তাঁর যে একটি কবিতার বই বেরিয়েছে, সেটির যা কাটতি হয়েছে তার প্রধানতম কারণ যে তিনি হুমায়ূনের প্রথম স্ত্রী— সেটা তিনি নিজেও অস্বীকার করতে পারবেন না! হুমায়ূনের স্ত্রী না হলে আধুনিক কালে কোন নবীন কবির (বিশেষত মহিলা কবি) কাব্যগ্রন্থের অমন কাটতি হয়, বলুন দেখি! একটি উদাহরণও দিতে পারবেন না!; অন্তত গত বিশ-পঁচিশ বছরে তো নয়ই! আসলে বিষয় হচ্ছে, এই ভদ্রমহিলা এখন এসব বলে একটু লাইমলাইটে আসতে চাচ্ছেন বলেই মনে হয়; এবং সংশ্লিষ্ট নিউজ পোর্টালটির উদ্দেশ্যও যে তা-ই, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই! কারণ, প্রথমত তারা এখন পর্যন্ত এদেশের প্রধান প্রধান কবিদের কোনো এক্সক্লুসিভ (তাদের ভাষায়) ইন্টারভিউ প্রকাশ করেছে বলে দেখি নি; দ্বিতীয়ত, তারা যদি একজন নবীন কবি হিসেবে গুলতেকিনের সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকতো, তাহলে তাঁর লেখালেখি নিয়েই কথা হতো৷ অথচ দেখা যায় যে তারা লেখিকার সংসারজীবন ও তাঁর স্বামীর আচরণগত দিক নিয়েই বেশি উৎসাহিত ছিলো!
আরেকটি ব্যাপারে গুলতেকিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই— ম্যাডাম, কোনো একটি পত্রিকা এত রেখে আপনার সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করতে এত উৎসাহিত কেন হলো বলুন দেখি? উত্তরটা বড্ড সোজা! কারণ, আপনি একজন 'হুমায়ূন আহমেদ' এর স্ত্রী ছিলেন!
সবশেষে, এটুকুই বলতে চাই, লেখককে তাঁর লেখা দিয়ে মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে! আমি জানি, সম্মানিত মানুষদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে অযৌক্তিক আক্রমণ দ্বারা অপদস্থ করার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসা যায়; তবু মানুষ হিসেবে সম্মানিত জনকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করাটাই কর্তব্য! দুটো চরণ দিয়ে শেষ করবো—
"সুজনে সুযশ গায় কুযশ ঢাকিয়া,
কুযনে কুরব করে সুরব নাশিয়া৷"
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১:০১