বাউলিয়ানায় মজেছি বেশ অনেক দিন, সেখান থেকে নিত্যনতুন জ্ঞানার্জন এবং আনন্দ আহরণ চলছে। তার সাথে এখন মাঝে মাঝে কবিতার স্বাদ কুড়োই। সত্যি! কিছু কিছু কবিতা খুলে দেয় মনের দুয়ার, কড়া নাড়ে বিবেকের দ্বারে আর হৃদয় প্রতিনিয়তই পাবে প্রশান্তি। বাংলা ভাষায় লিখে যাওয়া কবিদের প্রেমে পড়ছি প্রতিদিন। নিবেদন করছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা। ভালো যেসব কবিতা পাঠের ভাগ্য হয়েছে, তার মাঝে দর্শন, ভাব, ছন্দের ঝংকার এবং শ্রুতিমধুরতা মিলিয়ে প্রিয় পাচটি কবিতা সবাইকে নিয়ে আরেকবার পড়তে ইচ্ছে হলো। তো চলুন আরেকবার পড়ে নেই- চির তরুন বিপ্লবী সুকান্ত ভট্টাচার্যের হে মহাজীবন ; বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মহাসৃষ্টি বিদ্রোহী (শেষাংশ); কবি গুরুর সোনার তরী (শেষাংশ) ; পরবাসী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত বঙ্গভাষা এবং তারুন্য ও প্রেমের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বাতাসে লাশের গন্ধ।
হে মহাজীবন
-সুকান্ত ভট্টাচার্য
হে-মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা—
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি॥
বিদ্রোহী (শেষাংশ)
-কাজী নজরুল ইসলাম
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন
আমি স্রষ্টা-সুদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিব পদ-চিহ্ন
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন আমি চির-বিদ্রোহী বীর--
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির !
বঙ্গভাষা
-মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে-
``ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!''
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥
সোনার তরী (শেষাংশ)
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও—
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে॥
যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে॥
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহো করুণা ক’রে॥
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহি নু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী॥
বাতাসে লাশের গন্ধ
– রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা, -একি তবে নষ্ট জন্ম?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?
জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন।
বাতাশে লাশের গন্ধ-
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ-
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।
এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমোতে পারিনা-
রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।(সমাপ্ত)
পাঠকদের ধন্যবাদ। ভালো কবিতা শুধু মনের খোরাক নয়, কখনো সমাজের কিংবা জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই আমি বলি-
"ছন্দপ্রেমিক আর শব্দ যোদ্ধারা থাকুক বেশ,
তাদের যত্ন লালিত স্বসংস্কৃতি আর স্বদেশ।"
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৭ ভোর ৪:১৮