somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একুশের স্বপ্ন পূরণ

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দাদাভাই,
ভালো আছিস নিশ্চয়। তোর জন্য সবার যে শুভকামনা আর আশীর্বাদ তাতে করে তোর ভালো না থেকে উপায় আছে? শুধু কি তোর জন্য শুভকামনা, তোর বায়া-তবলার যে যত্ন মা করে তা দেখে মনে হয় আমার তো নয়ই, এমন কি ছোটবেলায় তোরও এত যত্ন করেনি মা। তুই এসে বছরে দু’দিন বাজাস তাও যদি ভালো না থাকে, তাই সুন্দর করে তুলার বালিশ নিজের হাতে তৈরি করে তা দিয়ে মুড়ে ব্যাগে পুরে রেখে দিয়েছে। এদিকে আমার হারমোনিয়ামটার যে কি হাল হয়েছে তার দিকে মা’র কোন ভ্রুক্ষেপও নেই। সামনে ২১ শে ফেব্রুয়ারি স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাই বাবা বলল জেলা সদরে নিয়ে ওটাকে সারিয়ে নিয়ে আসি। গত সপ্তাহে সুর তরঙ্গে ওটা সারাতে নিয়ে গেলে দোকানের মালিক যতিন দাদু বললেন, অনেকদিন তো জোড়াতালি দিয়ে চলল। এবার এটাকে মুক্তি দাও দাদু। নতুন একটা হারমোনিয়াম নাও। বাবা বলল, কিন্তু কাকা এই মুহূর্তে নতুন কেনার মত টাকা তো হাতে নেই। দাদু বলল, তোমার টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না। এই পুরনোটা রেখে যাও, এটা বিক্রি করে হয়তো হাজার দুই টাকা হবে। আর বাকি টাকা তুমি যখন পারো দিয়ে যেও। বাবার মৌন সম্মতি দেখে আমি হারমোনিয়াম দেখতে শুরু করলাম। কিন্তু যা পছন্দ হল তার দাম অনেক বেশি, দশ হাজার টাকা । দাম শুনে আমি বললাম না থাক দাদু আমার পুরনোটাই ঠিক করে দেন। বাবা বলল, তোমার যখন পছন্দ হয়েছে তখন এইটিই নেব। কিন্তু তুই বল, এতো টাকা বাবা কিভাবে পরিশোধ করবে? হয় জমি বন্ধক রাখতে হবে নতুবা বড় দেখে কোন একটা গাছ বিক্রি করতে হবে। তাই আমি আর রাজি হইনি, আমি বলেছি পুরনোটাই ঠিক করে রাখতে। আমি ঠিক করিনি বল? তুই বাড়িতে ফেরার পথে জেলা সদরে নেমে হারমোনিয়ামটা নিয়ে ফিরবি, বাবা যতিন দাদুকে সেভাবেই বলে এসছে । আবার ভুলে যাস না যেন, শহীদ দিবসে কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে আমার। অনেক অনেক ভালো থাকিস এই প্রত্যাশায় রাখছি-
তোর মিনু

চিঠিটা পড়া শেষ করে মিথুনের মন খারাপ হল না বরং আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। আদরের ছোট্ট বোনটাকে তার মনের মত একটা উপহার দিয়ে চমকে দেবার মত একটা সুযোগের হাতছানি দেখে মনের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। সাথে সাথেই যতিন দাদুকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলো, পুরনো হারমোনিয়াম বিক্রি করে দিয়ে মিনুর পছন্দের হারমোনিয়ামটা বরাদ্দ রাখতে। সাথে এও জানিয়ে দিলো, ঢাকা থেকে ফেরার পথে ও বাকি টাকা পরিশোধ করে হারমোনিয়াম নিয়ে যাবে। ভরসা টিউশানি করে গত কয়েক মাস ধরে জমানো তিন হাজার টাকা । এক মাস পূর্ণ হল নতুন আরও একটি ভালো টিউশানি পেয়েছে। নতুন ঠিক নয়, পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে, এলান যাকে গত কয়েক মাস ধরে পড়াচ্ছে তারই বড় বোন এলিটাকে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। সুযোগ পেয়েছে বলার কারন, একটা ভালো টিউশানি পাওয়া এখন সোনার হরিন পাওয়ার মত কঠিন। তার উপর যদি হয় তিন/চার হাজার টাকার এমন দুটো টিউশানি একই বাসায়! সারা মাসের থাকা খাওয়া এবং হাত খরচ মিলিয়ে যেখানে মিথুনের খরচ আড়াই হাজার টাকা, সেখানে ছয়শ টাকার প্রথম টিউশানিটাও অনেক যত্নের ছিল । তবে এই সোনার হরিন পেতে মিথুনকে কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। মিডিয়া সেন্টারগুলোতে টাকা দিয়ে নাম লিখিয়ে দিনের পর দিন জুতার সুকতলা ক্ষইয়েছে। কিন্তু ওঁদের পরামর্শ অনুযায়ী নকল পরিচয়পত্র তৈরি করে ধোঁকাবাজি করার যুদ্ধে বারবার হেরেছে বিবেকের কাছে। ফলাফল বৃথা সময় ও অর্থ নষ্ট আর পণ্ডশ্রম। পরিচিত লোকজন না থাকলে অনেক মেধাবীর পক্ষে টিউশানি পাওয়াও যে ঠিক চাকরি পাওয়ার মতই কঠিন তা খুব ভালো উপলব্ধি করেছে মিথুন । উপায়ান্তর না দেখে দূর সম্পর্কের আত্মীয় অপু মামাকে ধরল, অবশেসে ফলও মিললো। পুলিশ কর্মকর্তা বস তাঁর ছেলেকে পড়ানোর জন্য একজন ভালো শিক্ষক খুঁজছেন শুনে অপু মামা বলল, খুব ভালো একটা ছেলে আছে স্যার। আপনি চাইলে ওকে নিয়ে আসি, কথা বলে যদি আপনার ভালো মনে হয় তাহলে ওকে দিয়ে পড়াতে পারেন। অপু মামার সুপারিশে পুলিশ কর্মকর্তা, রাজিব সাহেবের বাসায় মিথুন হাজির হল টিউশানি প্রাপ্তির সাক্ষাৎকার দিতে। ছাত্রের পিতা,পুলিশ কর্মকর্তা মিঃ রাজিব কি জিগ্যেস করলেন আর ও কি উত্তর দিলো কিছুই যেন মাথায় কাজ করছে না। বুকের মধ্যে শুধু ঢিব ঢিব আওয়াজ হচ্ছে। বুকের মাঝের এই হাতুড়ির আওয়াজের মধ্যেও ও স্পষ্ট শুনল “ দেখ চেষ্টা করে আমার ছেলেটার ফলাফল যদি একটু ভালো করতে পারো তবে আমার মেয়েটাকেও পড়ানোর দায়িত্ব পাবে। বাড়ি বাড়ি ঘুড়ে তোমার যাতে টিউশানি করতে না হয় আমি সেই ব্যবস্থা করব। আপাতত তিন হাজার টাকা পাবে।” বাসা থেকে বের হয়ে অপু মামার সাথে কথোপকথনে জেনে নিলো সদ্য ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি হওয়া ছাত্র এলান গত পরীক্ষায় খুব খারাপ করেছে তাই নতুন করে শিক্ষক বদল।

পরবর্তী দিন থেকে এলানকে পড়াতে শুরু করলো মিথুন । এলানের কক্ষে ঢুকে প্রথম দিনই ওর চক্ষু ছানাবড়া, এতো দামী আসবাবপত্র এতোটুকু বাচ্চার কক্ষেও! একটি কম্পিউটার টেবিলে প্রিন্টার ও স্ক্যানারসহ একটি কম্পিউটার সুসজ্জিত। এলানের সাথে কথার ছলে জানতে পারলো তার বড় বোনের কক্ষেও ঠিক এমনই প্রিন্টার ও স্ক্যানারসহ একটি কম্পিউটার আছে। নিজে কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে প্রথম বর্ষ ব্যাক্তিগত কম্পিউটারহীন পার করেছে মিথুন । ২য় বর্ষের এসে অনেক কষ্টে আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় একটি কম্পিউটার কিনলেও প্রিন্টার আর স্ক্যানার এর প্রয়োজনীয়তা এখনো অনুভব করেনি। কিন্তু একই বাসায় দুই ভাই বোনের প্রিন্টার ও স্ক্যানারসহ একটি করে কম্পিউটারের উপযোগ চিন্তা মিথুন কে পাগলপ্রায় করে দিলো। তবে দু’দিন যেতে না যেতেই এলানের সাথে কথোপকথন আর অপু মামার কাছে প্রাপ্ত তথ্যে অনেক কিছু জেনে গেল ও। এলানের বাবা রাজিব সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অর্থাভাবে পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হলে এলানের মধ্যবিত্ত নানা তাঁর মেয়েকে বিয়ে করার শর্তে পড়ালেখার ব্যায়ভার বহনের দ্বায়িত্ব নেন এবং পড়া শেষে চাকরির জন্য তদবিরও করেন। মানুষ হিসেবে রাজিব সাহেব যথেষ্ট ভালো ছিলেন । কিন্তু বিয়ের পরে এলানের মায়ের অন্যায় দাবী আব্দার মেটাতে আর নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই পেতে ধীরে ধীরে নিজেকে বদলে নেন। এলানের মায়ের নামে এখন দুটো আলিশান ফ্ল্যাট, দুটো গাড়ি, রাজধানীর নামকরা মার্কেটে তিনটি দোকান, গুলশানে একটা রেস্তোরা, এছাড়াও বেশ কয়েকটি দামী প্লট। তো সেখানে এই দুই ভাই বোনের দুটো প্রিন্টার ও স্ক্যানারসহ কম্পিউটার মামুলি ব্যাপার। কিছুদিন পূর্বেও এই দুই ভাইবোনের বাবা মা আর দাদা দাদীর সাথে দেশী মধ্যবিত্ত হয়ে জীবনযাপন বেশ কাটছিল। বিপত্তি ঘটলো যত এই আলিশান ফ্লাটে ওঠার পর থেকে। সব যেন কেমন করে দ্রুত বদলে যেতে লাগলো। দাদা দাদীকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হল, মা-বাবাও রূপান্তরের ধারায় মাম্মা- ডেডি এ পরিনত হল। এলান কে বাংলা মাধ্যম থেকে ছাড়িয়ে ইংরেজী মাধ্যমে ভর্তি করানো হল। কিন্তু এলিটা ততদিনে মাধ্যমিক পাস করে গেছে, এ নিয়ে ওর মায়ের অনুতাপের শেষ নেই। তাই উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়েকে ইংরেজী মাধ্যমে পড়াতে না পারার ঘাটতিটুকু পুষিয়ে নিতে পশ্চিমা কালচারে দক্ষ হবার যাবতীয় চেষ্টা তাঁর মা করে যাচ্ছেন। অবশ্য মায়ের চাওয়াগুলো যে মেয়ে মনে প্রানে সাদরে গ্রহন করেছে তা তার পোশাক পরিচ্ছদ, আচার আচরনে বেশ বোঝা যায়। কিন্তু এলান যে কোনভাবেই পারছে না তার মায়ের এই অত্যাচার মেনে নিতে। ওর এই কোমল হৃদয় বিদেশী সংস্কৃতিকে কোনভাবেই গ্রহন করতে পারছে না। ইংরেজী মাধ্যমে পড়তে ওর ভালো লাগে না। কিন্তু ওর মা কোনভাবেই ছেলেকে বাংলা মাধ্যমে পড়াবে না, স্ট্যাটাস লো হয়ে যাবে তাই। এমন কি কখনো বাবা মা সম্বোধন করলেও তাতে করে ওর মা ক্ষেপে অগ্নিমূর্তি ধারন করে।

যাই হোক ওঁদের পারিবারিক বিষয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে মিথুনের নেই, ও আন্তরিকতার সাথে পড়াতে শুরু করলো যাতে করে টিউশানিটা পাকাপোক্ত হয়। ওর পরিশ্রম বৃথা যায়নি, এক সপ্তাহ পার না হতেই অপু মামা একদিন ডেকে বললেন, তুমি তো বাজি মাত করে দিয়েছ। এলান তো তোমার খুব বড় ভক্ত হয়ে গেছে। ওর মুখে প্রসংসা শুনে ওর মা দরজার আড়ালে কান পেতে শুনেছে কয়েকদিন। সে ও বলল , তোমার পড়ানোর স্টাইল নাকি অসাধারন। মিথুন বলল কিন্তু মামা, তিনি যে একটা অন্যায় আব্দার করে বসেছে যা আমার পক্ষে পুরন করা কষ্টকর। আমাকে বলেছেন, ওই ভবনের কেউ যদি জানতে চায় তাহলে আমি যেন বলি আমি বুয়েটের ছাত্র। এলান একদিন আমার কাছে জানতে চাইলো আমি বুয়েটে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ি কিনা? আমি বললাম, বুয়েটে নয় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ি। ও বলল , মাম্মা কাল পাশের বাসার কোন এক আনটির কাছে বলছিল আপনি বুয়েটে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়েন। ঠিক পরদিনই আনটি আমাকে এই কথা বললেন। অপু মামা বললেন, দেখ ওনার কথামত একটু কষ্ট করে চলতে পারলে টিউশানিটা অন্তত পাকা হয়ে যাবে। অপু মামার কথামত বিবেকের সাথে যুদ্ধ করেও সোনার হরিণটা ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো মিথুন । প্রথমত এলান ওকে স্যার বলে সম্বোধন করতো, ইদানিং টিচার বলে। জানতে চাইলে মায়ের আদেশ বলে জানায় মিথুন কে। শুনে মিথুন মনে মনে হাসে। তার এই মনের হাসিটা ঠোঁটের কোনে এসে ভর করে প্রথম মাসের টাকাটা যেদিন হাতে পায়। টাকা পাবার আনন্দে নয় বরং এলানের মায়ের টাকা দেবার ধরন দেখে। পাঁচশত টাকার ছয়টি নোট মিথুনের হাতে ছয়বারে দিয়ে বলে, মাস্টর ট্যাঁকা গুইন্যা লও। ওই সময় আর না গুনলেও বাসার বাইরে এসে ঠিক একাধিকবার টাকাগুলো গুনে দেখেছে মিথুন , সত্যি তিন হাজার টাকা ! মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে প্রথমেই অপু মামার বাসায় গেলো। অপু মামা দেখে বলল, তোমার এই পাগলামির কোন প্রয়োজন ছিল কি? ওঁদের বাসার সবাই তোমাকে গৃহশিক্ষক হিসেবে পছন্দ করেছে এই আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। তবে তোমার জন্য আরও একটা সুখবর হচ্ছে জানুয়ারি মাস থেকে এলিটাও তোমার কাছে পড়বে। ওর সাইন্সের বিষয়গুলো পড়াতে পারবে না? মিথুন মুখে বলল, হ্যা পারবো । আর মনে আনন্দের দিগুন মাত্রা অনুভব করলো। কিন্তু তার এই আনন্দের মাত্রায় ভাটা পড়লো এলানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর। সবার মতে আগের তুলনায় ভালো হলেও মিথুনের আশানুরূপ ফল হয়নি এলানের। এলানের মা মিথুনকে বললেন, তুমি মন খারাপ করছ কেন? তুমি তো খুব বেশি সময় পাওনি পরীক্ষার আগে। আর যেটুকু সময় পেয়েছ চেষ্টা তো করেছ। মিথুন বলল, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি। আমার এই ক’দিনের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে এলানকে বাংলা মাধ্যমে দিলে ও অনেক বেশি ভালো করতে পারবে। সাথে সাথে এলান লাফ দিয়ে বলে উঠলো, হ্যা টিচার ঠিক বলেছেন। কিন্তু এলানের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মিথুন বুঝতে পারলো কথাটা তাঁর কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। পরের পরীক্ষায় ও ভালো করবে বলে তিনি চলে গেলেন। কিন্তু যাওয়ার অভিব্যাক্তি মিথুন কে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো নিজের পায়ে নিজে এভাবে আর কখনো কুড়াল মেরো না।

জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে এলিটাকে পড়ানোর গুরু দ্বায়িত্ব পেয়ে গেলো মিথুন । সকালে এলানকে আর বিকেলে এলিটাকে পড়াতে হবে। প্রথম দিন এলিটার কক্ষে গিয়ে বসার কিছুক্ষনের মধ্যে এলিটা এলো জিন্স আর টি শার্ট পরে যেটা ওর জন্য খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মাথায় এবং হাতে টেনিস খেলোয়াড়দের মত ব্যান্ড দেখে মিথুনের মনে প্রশ্ন জাগলেও কিছু জিগ্যেস করার আগেই এলিটা টেবিলের উপর পদার্থ বিজ্ঞানের একটা ইংরেজি মাধ্যমের প্রশ্ন রেখে তার উপর একটা টোকা দিয়ে বলল, সল্ভ ইট। এলিটার আচরনে প্রথমত কিছুটা ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও স্বীয় ব্যাক্তিত্বের দ্বারা অবস্থা সামলে নিতে মিথুনের খুব বেশি সময় লাগেনি। পড়ানোর শেষ মুহূর্তে মিথুন বলল, তুমি কি পড়া শেষে টেনিস কোর্টে যাবে, না কি কোর্ট থেকে এলে? এলিটা উত্তর দিলো কোনটাই না। মিথুন লক্ষ্য করলো এলিটার কণ্ঠস্বরে যেন কিছুটা নমনীয়তা, সেই প্রথমের ঝাঁঝালো ভাবটা যেন আর নেই। মিথুন আবার জানতে চাইলো পদার্থ বিদ্যার বাংলা মাধ্যমের প্রশ্ন থাকতে ইংরেজী মাধ্যমের প্রশ্ন সমাধান করতে দিলে কি আমাকে যাচাই করার জন্য না কি বাংলা মাধ্যমের সব প্রশ্ন সমাধান করা হয়ে গেছে? কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা ঢাকার চেষ্টা করলো এলিটা। মিথুন ওকে আর বিব্রত না করে সেদিনের মত চলে গেলো। পরবর্তী দিন এলিটাকে পড়াতে গিয়ে মিথুন একেবারে অবাক। গতকালের এলিটা আর আজকের এলিটার মাঝে বিস্তর ব্যাবধান। এতদিন এই বাসায় আসা যাওয়ার মাঝে যতবার এলিটাকে দেখেছে এমন মার্জিত রুচিশীল পোশাকে কখনোই দেখেনি। আজ দেখা হবার সাথে সাথেই মিথুন কে সালাম জানালো যা কিনা এলিটার স্বভাবসুলভ আচরনের বাইরের। একান্ত বাধ্যগত ছাত্রী হয়ে পড়তে বসলো। এলিটার এই পরিবর্তন মিথুনের বেশ উপভোগ্য মনে হল। কিন্তু এই পরিবর্তন কি শুধু ওর সামনে না কি সর্বত্র প্রযোজ্য তা বুঝতে আরও কয়েকদিন সময় লাগলো। এলানের কাছে যেদিন জানলো যে তার মা এলিটাকে দিন দিন ক্ষ্যাত হয়ে যাবার অপবাদ দিচ্ছে তার বর্তমান পোশাকের জন্য সেদিন মিথুন কে নতুন শঙ্কা পেয়ে বসলো। না জানি কখন ওর মা বুঝে ফেলে মিথুনের জন্য এলিটার এই পরিবর্তন, অমনি টিউশানিটা চলে যায়! কিন্তু মেয়ের চতুরতার সাথে মায়ের অপারদর্শিতা মিথুন কে মাস পার করতে সহায়ক ভুমিকাই পালন করে। তাই বলে মেয়েকে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করতে মায়ের চেষ্টা কিন্তু থেমে থাকে না। মা-মেয়ের এই দ্বন্দ্ব যেমন মিথুনের কাছে মজার লাগে তেমনি এতদিনেও তাকে এলিটার কোন সম্বোধন না করাটাও একটু অস্বাভাবিক লাগে। একদিন এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলিটা উত্তর দেয়, আপনি আমার থেকে মাত্র ৩ বছরের সিনিয়র। তাই আপনাকে স্যার বলতে পারবো না। মিথুন বলে আচ্ছা তাহলে ভাইয়া ডাকো। এলিটার তীব্র প্রতিবাদ, না তাও পারবো না। এলিটার সর্বশেষ কথা হল আমি নিজে স্থির করতে না পারা পর্যন্ত আপনাকে কিছুই ডাকতে পারবো না।

প্রথমত মাস শেষ হবার সাথে সাথেই মিথুন হাতে টাকা পেয়ে যেত। গত দু মাস হল ১০ তারিখের পরে টাকা দেয় গৃহকর্ত্রী। কিন্তু তাতে করে ওর কোন দুঃখ নেই বরং ভালই মনে হয়। কেননা দেরি করে টাকা হাতে পেলে খরচ কম হয়। আর এ মাসে একসাথে দুজনকে পড়ানোর বাবদ সাত হাজার টাকা হাতে পাবে এই চিন্তায় দিন যত যায় ততই মনের উত্তেজনা বাড়ে। এর মাঝে হঠাৎ করেই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩ দিন পড়াতে যেতে না পারায় অপু মামার মাধ্যমে মিথুনের বাসায় খবর আসে, এলিটার মা জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বলেছে। এলান বা এলিটার কোন পরীক্ষা বলেই হয়তো জরুরি তলব। তাই পুরোপুরি সুস্থ না হয়েও পরবর্তী দিন ওদের বাসায় যায়। ওদের মায়ের কাছে জানতে পারে এলিটার কি একটা পরীক্ষা আছে তাই আসতে বলা। পড়াতে বসলে এলিটা বলল আপনি অসুস্থ, আজ পড়াতে হবে না। একটু বসে রেস্ট নেন, তারপর চলে যাবেন। বলে মিথুনের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলো। তোমার না পরীক্ষা ? এলিটার কাছে জানতে চাইলে বলল কোন পরীক্ষা নেই। এমনিতে তিনদিন আসেননি তো তাই। সত্যি কথা বলতে কি, আপনার কাছে একদিন ও পড়া মিস করতে চাই না। বলেই যেন একটু লজ্জা পেয়ে মুখটা নিচু করলো। মিথুনের মাথাটা যেন একটু ঝিন করে উঠলো, কি বলতে চাইছে ও? ওর এই লজ্জাবনত মুখ কি বোঝাতে চাইছে? পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মিথুন বলল তাহলে নিজে পড়া কর না কেন? শুধু আমি পড়িয়ে গেলেই হবে, নিজে না পড়লে? এলিটা বলল , এরপর থেকে পড়ব। ১৩ ই ফেব্রুয়ারি পড়তে বসে এলিটা যেন একটু উস খুস করতে লাগলো। মিথুন জানতে চাইলো, কি ব্যাপার তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছ? এলিটা বলে ফেলল, কাল ভ্যালেন্টাইন ডে, আপনি আমার সাথে ঘুড়তে যাবেন। মিথুন জানতে চাইলো, কোথায়? এলিটা উত্তর দিলো জাহান্নামে নিয়ে যাবো, আপনার সমস্যা আছে যেতে? মিথুন বলল, হ্যা সমস্যা আছে বলেই তো জানতে চাইলাম। আমার ক্যাম্পাসে কাল বসন্ত বরন উৎসব যার সমস্ত আয়োজনের গুরু দায়িত্ব আমার উপর। তাছাড়া অনুষ্ঠানে আমাকে তবলা বাজাতে হবে। এলান কাল আমার সাথে যাচ্ছে, তুমিও চল। খুব সুন্দর উপভোগ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে দেখবে। এলিটা বলল, কিন্তু আমি যে আমার সব ফ্রেন্ডদের কথা দিয়েছি কাল আপনাকে নিয়ে যাবো। ওঁদের বলেছি আমি কাল ওদের সবাইকে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো! মিথুন অবাক বিস্ময়ে বলল, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড? এলিটা, তুমি ভুল করছ। আমি ভুল করছি কি সঠিক করছি তা জানি না, আমি শুধু জানি কালকের দিনটা আমার জন্য একটা প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু। এলিটার চেহারায় সেই প্রথম দিনের রুপ দেখতে পেল মিথুন। আর পড়ানোর বা পড়ার মত মানসিক অবস্থা শিক্ষক বা ছাত্রীর কারোই রইলো না।

ক্যাম্পাসের বসন্ত বরন অনুষ্ঠান শেষে এলানকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিকেলে ধানমণ্ডি লেকের রবীন্দ্র সরোবরে আর একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে যাচ্ছিলো মিথুন। পথে যেতে একটু অবাক লাগলো এলিটাকে সেই পশ্চিমা পোশাকে একটা বাইকের পেছনে বসা দেখে। আরও বড় ধাক্কা খেলো বাইক চালক কে চিনতে পেরে, এ যে মিথুনেরই বাড়িওয়ালার বখে যাওয়া নেশাখোর ছেলে রাশেদ। বাইক নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো, মেয়েদের স্কুল কলেজের সামনে দাড়িয়ে আড্ডা দেওয়া আর কিছুদিন পরপর নতুন নতুন প্রেমিকা জোটানোই রাশেদের কাজ। রবীন্দ্র সরোবরের অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে যে আরও বড় চমক মিথুনের জন্য অপেক্ষা করছে তা কি ও জানতো। লেকের পাড়ে আধো আলো ছায়াতে বেশ কয়েকটা ছেলে মেয়ের মাঝে রাশেদের কাঁধে মাথা রেখে এলিটা সিগারেট টানছে! মিথুন যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তবে আত্মসম্মান বাঁচিয়ে ওখান থেকে সরে পড়ার বুদ্ধিটুকু তখনো অবশিষ্ট ছিল। পরদিন পড়াতে গেলে এলিটাকে আবার সেই জিন্স আর টি শার্টে দেখে মিথুনের বেশ খারাপ লাগলো। কি যেন এক অপরাধবোধে অযথা নিজে ভুগতে লাগলো। কোনভাবেই আজ আর পড়াতে পারছে না। এক সময় বলল, এলিটা তুমি ভুল পথে পা বাড়াচ্ছ। রাশেদকে তুমি কতটুকু চেন? ও খুব বাজে ছেলে, তোমার সর্বনাশ করে ছাড়বে। এলিটা মুহূর্তে যেন অগ্নিমূর্তি ধারন করে বলল, আমি ভুল করছি না সঠিক করছি তা আমি বুঝবো। আপনার এতো চিন্তা কিসের? আমার ভালো মন্দ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। কাল থেকে আর আমাকে আপনার পড়াতে হবে না। এলান যদি পড়তে চায় পড়ুক, আমি আর পড়ছি না।

বাসায় ফিরে সারাদিন কোন কাজ করতে পারেনি মিথুন, সারারাত ঘুমাতেও পারেনি। ওই বাসায় আর পড়াতে যাবে কি যাবে না ভেবে ভেবে অস্থির। তবে এলান যেন ওকে কি এক মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলেছে। পরের দিন পড়াতে গেলে এলান জানায়, আমার কালকের অনুষ্ঠান খুব ভালো লেগেছে। সে বলে টিচার, আমি কাল বাসায় বলেছি আমি আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ব না, আমিও আপনার মত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। আমিও আপনার মত কবিতা আবৃতি করব, তবলা বাজাবো, গান গাইবো। কিন্তু আপু মাম্মাকে বলেছে আপনি নাকি আমার মাথাটা নষ্ট করে দিচ্ছেন। আপুকেও নাকি বিপথে নিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু সঠিক সময়ে ও ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই আপনার কাছে ও আর পড়বে না। আমাকেও আপনার কাছে পড়তে নিষেধ করেছে। মাম্মাও বলেছে আগামী মাস থেকে আমার জন্য নতুন টিচার ঠিক করবে। কিন্তু স্যার আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কারো কাছে পড়ব না বলেই মিথুনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। মিথুন এলানকে স্বান্তনা দিয়ে বলল আমিই তোমাকে পড়াব । তবে আজ শরীরটা খুব খারাপ লাগছে তাই আজ আর পড়াতে পারবো না বলেই বেড়িয়ে গেলো। কিন্তু চোখের জল আটকাতে পারলো না মিথুন। আর্থিক দীনতাও আজ বিবেকের কাছে হার মানতে বাধ্য হল। সোনার হরিন ধরে রাখার বাসনাকে বিদায় জানাতে আর দ্বিধা রইলো না ।

পরের দিন মিথুন এলানের মাকে ডেকে বলল , আনটি সামনেই আমার পরীক্ষা। পড়াশোনার অনেক চাপ, তাছাড়া ২০ তারিখ গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। তাই বেশ কিছুদিন হয়তো পড়াতে পারবো না, ওদের দুজনেরই পড়ালেখার ক্ষতি হতে পারে। আপনি বরং ওদের জন্য নতুন টিচার ঠিক করে নিন। এলানের মা কোন কথা না বলে মিথুনের সামনে থেকে চলে গেলেন। যাবার সময় অভিব্যাক্তি এমন করে গেলেন যেন বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, তুমি নিজের মত করে সরে যাও। আমাদের ভালো মন্দের জন্য কি করতে হবে তা আমি ভালো বুঝবো। যেহেতু কোন কথা না বলে গেছেন মিথুন ভাবল হয়তো তিনি আবার ফিরে আসবেন ওর মাইনের টাকা নিয়ে। প্রায় এক ঘণ্টা বসে থেকেও যখন কোন সারা শব্দ নেই তখন ভগ্ন হৃদয়ে বাসার বাইরে বের হল। ফেরার পথে অপু মামার সাথে দেখা করে সব বলল। সাথে এও বলল , মামা আমাকে আর ওই বাসায় পড়ানোর অনুরোধ করবেন না। তবে আপনার বসকে বলে ১৯ তারিখের মধ্যে আমার মাসের টাকাটা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, আমি ২০ তারিখ বাড়ি যাবো। অপু মামা সব বুঝলেন এবং বললেন, আচ্ছা তুমি ১৯ তারিখ সন্ধ্যায় আমার বাসায় এসো একবার। ১৯ তারিখ সন্ধ্যায় মিথুন অপু মামার বাসায় গেলে মামা বলল, ভাগ্নে চল রাজিব স্যারের বাসা থেকে ঘুড়ে আসি। যেতে যেতে মামা বললেন, রাজিব সাহেব মিথুনকে দেবার জন্য টাকা অনেক আগেই তার স্ত্রীর কাছে দিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হবে ভেবে অপু মামা তাঁর বসের সাথে এ বিষয়ে আর কিছু আলাপ করেননি। সরাসরি এলানের মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, ভাবী মিথুন তো কাল বাড়ি যাবে ওর টাকাটা যদি দিয়ে দিতেন। খুব বিরক্তি নিয়ে এলানের মা উত্তর দিলেন, আপনারে না কতবার কইছি আমারে ম্যাডাম কইবেন, ভাবী কইবেন না। অপু মামা বললেন, সরি ম্যাডাম ওর টাকাটা আজ দিলে ভালো হয়। ওরে কিসের টাকা দিবো, ও কি আমার ছেলে মেয়েরে পড়াইছে? যদি পড়াইত তাইলে ওরা আরও ভালো রেজাল্ট করতো। অপু মামা বললেন কিন্তু ও তো চেষ্টা কম করে নি, প্রতিদিন আপনার বাসায় এসে কষ্ট করে পড়িয়েছে। হ পড়াইছে না আমার সর্বনাশ করছে, আমার ছেলে মেয়ে দুইডার মাথা এক্কেবারে চিবাইয়া খাইছে। অপু মামা এলানের মায়ের এমন কথা শুনে একটু উত্তেজিত হয়ে গেলেন। বললেন ম্যাডাম, দুদিন আগে যে ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন আজ তাকে এভাবে অপবাদ দিচ্ছেন! স্যার আপনাকে টাকা দিয়েছে ওকে দেওয়ার জন্য সে টাকা ওকে দিতে আপনার এতো গড়িমসি কেন ? ওর কষ্টের দাম দিলে দেবেন না দিলে আপনি আত্মসাৎ করবেন, কিন্তু অযথা মিথ্যে অপবাদ দেবেন না। এই বলে মিথুনের হাত ধরে নিয়ে উত্তেজিত অপু মামা বাসার বাইরে বেড়িয়ে এলেন। আসতে আসতে ওরা শুনতে পেল এলানের মা বলছে, আইজ আসুক রাজিব্যা। মাইনসের কাছে আমারে হেয় কইরা মজা পায় তাই না। পুলিশ অফিসার হইছে, আইজ দেহি ওর একদিন আর আমার যে কয়দিন লাগে। এতক্ষন সব বোকার মত চুপ করে তাকিয়ে দেখছিল মিথুন। বাইরে এসে ও মুখ খুলল, মামা আমার জন্য আপনি কেন আপনার বসের সাথে সম্পর্ক খারাপ করবেন? এমনটা না করলেও তো পারতেন। অপু মামা বললেন, আরে বাদ দাও তো, কিছু হবে না। স্যার তাঁর স্ত্রীকে খুব ভালো করে চেনেন আর আমার সম্পর্কেও জানেন। তুমি এক কাজ কর আমার সাথে বাসায় চল আমি চেক লিখে দিচ্ছি তুমি কাল টাকা তুলে নিয়ে বাড়ি যেও। মিথুনের চোখ গড়িয়ে দু ফোঁটা কৃতজ্ঞতার অশ্রু ঝড়ে গেলো অপু মামার অগোচরেই। মিথুন বলল না মামা সকাল আটটায় গাড়ি, তাই সময় হবে না। তাছাড়া আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে। মামা আমার একটু জরুরী কাজ আছে বলে অপু মামাকে তাড়াতাড়ি দায়মুক্ত করে বিদায় জানালো।

বাড়ি যাবার প্রস্তুতির সাথে এতদিন যে স্বপ্ন দেখেছে তা মুহূর্তে যেন ভেঙ্গে গেলো। এতদিনের জমানো তিন হাজার টাকা মাত্র পকেটে। এতে করে তো বোনের পছন্দের হারমোনিয়ামের দাম পরিশোধ হবে না। তাছাড়া এই টাকার বাইরে আগামী মাসে চলার মত কোন উৎস তো নেই। ভেবেছিলো এলানদের বাসার সাত হাজার টাকা পেলে হারমোনিয়ামের জন্য বাড়তি আট হাজার টাকা দেবার পরেও দু হাজার টাকা থাকবে। আর ছোট্ট যে টিউশানি থেকে ছয়শত টাকা পায় সব মিলিয়ে আগামী মাস বেশ চলে যাবে। কিন্তু সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেলো। একবার ভেবেছিলো বাড়িতে যাবে না। কিন্তু বাড়ির সবাই জানে ওর বাড়িতে যাবার কথা, বিশেষ করে মিনু অনেক বেশি কষ্ট পাবে ও বাড়িতে না গেলে। তাই অনেক দোদুল্যমানতায় দুলেও শেষ পর্যন্ত গাড়িতে চেপে বসলো। পদ্মার মাঝে ডুবোচড়ে ফেরী আটকে গিয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরী হয়ে গেলো। জেলা সদরে পৌঁছতেই প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। তাই নামবে কি না বুঝে উঠতে পারছিলো না মিথুন। আর নেমেই বা কি করবে, যতিন দাদুকে কি বলবে? এই সাত পাঁচ ভেবে জেলা সদরে না নেমে সরাসরি বাড়ি চলে গেলো। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বোনের গানের রেওয়াজ শুনতে পেলো। একটু অবাকই হল মিথুন হারমোনিয়ামের আওয়াজ শুনে। ঘরে ঢুকতেই গান থামিয়ে মিনু দৌড়ে এসে মিথুনকে জড়িয়ে ধরল। এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো, তুই কেমন আছিস দাদাভাই? হারমোনিয়ামটা যা দারুন হয়েছে না, আমার খুব পছন্দ হয়েছে! কিন্তু এতো টাকা কোথায় পেলি তুই? মিনু কি বলছে মিথুন কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছে না । কি উত্তর দেবে তাও বুঝতে পারছে না। বোনকে চমকে দেবার পরিবর্তে যে নিজেই চমকে গেলো। এ যে মাছে ছিপ তাড়ানোর উপক্রম। এমন সময় বাবা এসে তাকে উদ্ধার করলো, আগে ওকে হাত মুখ ধুয়ে খেতে দে তারপর সব কথা বলিস। হ্যা দাদাভাই, আগে খাওয়া শেষ কর তারপর আমার সাথে একটু তবলায় তাল দিবি।

অসাধারন সুন্দর হারমোনিয়ামটার দিকে তাকিয়ে মিথুন ভাবছে সত্যিই এটি মিনুর পছন্দ হবার মতই। এতো দামী জিনিস কিনে দেবার মত সাধ থাকলেও সাধ্য বাবার নেই। কিন্তু কিভাবে এটি বাড়িতে এলো মনে প্রশ্ন জাগলেও জিগ্যেস করার মত সুযোগ পায়নি মিথুন। অবশ্য বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি উত্তর খুঁজে পেতে। মিনুর মুখ থেকেই সব বেড়িয়ে এলো। গতকাল বাবা একটা জরুরী কাজে সদরে গিয়েছিলো। যতিন দাদুর সাথে দেখা হতেই হারমোনিয়াম দিয়ে দিলেন। টাকার কথা জানতে চাইলে বললেন তুই নাকি ডাকযোগে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিস। সত্যি করে বল তো, এতোগুলো টাকা তুই একসাথে কোথায় পেলি? বাবা-মাও এ নিয়ে বলাবলি করছিলো। মিথুন এবার সব বুঝতে পারলো, হাসি দিয়ে বলল সোনার হরিন ধরেছি, দুটো খুব ভালো টিউশানি পেয়েছি। মুখে যতটা হাসি ফুটল মিথুনের, অন্তরটা ঠিক তার দিগুন সংকুচিত হল। যতিন দাদু ওঁদের অনেক বেশি ভালবাসে এবং বিশ্বাস করে তাই হাতে টাকা না পেয়েও এতোটা করেছেন। এ বিশ্বাসের মর্যাদা ও কিভাবে রাখবে সে চিন্তা ওকে গ্রাস করলো। কিন্তু মিনুকে কিছুই বুঝতে দিলো না। বাবা-মাকেও টাকার উৎস সম্পর্কে শুধু টিউশানি প্রাপ্তির কথাটা জানালো। বাকিটুকু সকলের মন ভেঙ্গে যাবার আশঙ্কায় গোপন করলো। কিভাবে বাকি টাকা পরিশোধ করবে? আগামী মাস কিভাবে চলবে? শেষ পর্যন্ত কি তাহলে বাবাকে জমি বন্ধক রাখতে হবে? এই সব চিন্তায় রাতে বিছানায় ছটফট করতে লাগলো মিথুন। দুশ্চিন্তায় অস্থির মস্তিস্ক ঘুমাতে না চাইলেও সারা দিনের ভ্রমনে ক্লান্ত শরীর এক সময় ঠিক ঘুমিয়ে গেলো।

শহীদ দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মিনু গান গাইছে সাথে মিথুন তবলা বাজাচ্ছে। মুগ্ধ দর্শক শ্রোতার মাঝে সামনের সারিতে সগর্বে বসে আছে এলান। হঠাৎ করে সোরগোলে সচকিত সবাই। এলান চিৎকার করে বলল, স্যার মাম্মা এসছে আপনি পালান। মিথুন তাকিয়ে দেখল কয়েকজন পুলিশকে সাথে করে এলানের বাবা আর মা । এলানের মা চিৎকার করে বলছে, আমার ছেলে মেয়ের মাথা খাইয়াও তোর সাধ মিটেনাই? নষ্ট করার লাইগ্যা এহন আবার ওরে লুকাইয়া এই অজ পাড়া গাঁয়ে লইয়া আইছ? এই ওইডারে গুলি কর। বুঝছি তোমার দ্বারা হইব না, আমি নিজের হাতেই শয়তানডারে মারুম। বলেই রাজিব সাহেবের কোমরের রিভলভারটা ছিনিয়ে নিয়ে গুলি চালাল মিথুনের দিকে। নিশানা এক্কেবারে পাকা, কপালের ঠিক মাঝখানে এসে গুলিটা লাগলো। সাথে সাথে মিনু চিৎকার করে উঠলো দাদাভাই! এলান চিৎকার করলো স্যার! আর মিথুন মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে শুধু বলল মা। লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়ল বিছানায় ,ঘুমটা ভেঙে গেলো মিথুনের। সারাটা শরীর ঘামে ভিজে গেছে ওর, বুকটা এখনো ধক ধক করে কাঁপছে । শুনতে পেলো কে যেন নাম ধরে ডাকছে মিথুনকে। চোখ রগড়াতে রগড়াতে ঘর ছেড়ে বের হতেই কলেজের ক্লার্ক রিপন কাকার সাক্ষাৎ। মিথুন তোমার খোঁজেই এলাম, শুনলাম রাতে নাকি তুমি এসেছ। কাল একবার কলেজে এসো তো, কিছু টাকা পাবে নিয়ে যেও। মিথুন জানতে চাইলো কিসের টাকা? রিপন কাকা বললেন, কেন বাড়ির কেউ কিছু বলেনি? আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে ফয়সাল সাহেব তো এখন অনেক বড় শিল্পপতি। তিনি স্বউদ্যোগী হয়ে কলেজে কৃতি সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। তোমার নাকি পরীক্ষা ছিল, আসতে পারবে না তাই আর তোমাকে আসতে বলে নি হয়তো। এ পর্যন্ত আমাদের কলেজ থেকে যত জন স্টার মার্কস পেয়েছে তাঁদের সবাইকে ফয়সাল সাহেব দশ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। তোমার টাকাটা অফিসে জমা আছে, কাল গিয়ে সই করে নিয়ে এসো আর সব স্যারদের সাথে দেখাও করে এসো। রিপন কাকার মুখের দিকে মিথুন অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল, দশ হাজার টাকা! মিথুনের চোখ দুটো চক চক করে উঠলো, আর কানে ভেসে এলো মিনু’র কণ্ঠ......
" আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা,
আমি জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানোর জ্বালা... "
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×