মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হতে হলে প্রথমত ইংরেজীতে নতুবা অংকে খুব ভালো দখল থাকতে হবে পাশাপাশি বিএ, বিএড অথবা বিএসসি, বিএড ডিগ্রী বাধ্যতামূলক। পল্লী অঞ্চলে অতি প্রাচীন কাল থেকেই এই নিয়ম বলবৎ। কিন্তু, মিঃ বি.ডি. হালদারের ক্ষেত্রে এই প্রথাগত রীতির ব্যাতিক্রম ঘটল। ব্যাতিক্রম ঘটল বললে ভুল হবে বরং বলা যায় মিঃ বি. ডি. হালদার তাঁর সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, যোগ্যতা আর কর্মদক্ষতার দ্বারা এই অসাধ্য সাধন করেছেন । বাংলার শিক্ষক হয়েও আজ তিনি অত্র অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বনামধন্য একজন সফল প্রধান শিক্ষক। নিজে যেমন দায়িত্ববান তেমনি তিনি বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় অন্য কারো দায়িত্বে অবহেলার সুযোগ নেই। কিন্তু, প্রকৃতির বিরূপতায় পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ইংরেজির তুখোড় শিক্ষক উপেন বাবু আজ বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। তাই এস,এস,সি পরীক্ষার্থীদের ইংরেজি ক্লাস নিয়ে মিঃ বি.ডি. হালদার একটু উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ নিজেই ইংরেজি ক্লাসে যাবেন । তাই ইংরেজি গ্র্যামার বইয়ে একটু চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন । ঠিক এমন সময় ‘স্যার আসতে পারি?’ মিঃ হালদার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন দরজায় এক ভদ্র মহিলা, পেছনে এক ভদ্রলোক ভেতরে ঢোকার অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কোন শিক্ষার্থীর অভিভাবক হবেন ভেবেই বললেন, হ্যাঁ আসুন। ভেতরে প্রবেশ করেই মহিলা মিঃ হালদারের পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করলেন। মহিলার সাথে সাথে ভদ্রলোকও পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমত একটু বিব্রত বোধ করলেও কিছুক্ষনের মধ্যেই মিঃ হালদার তাঁর প্রাক্তন ছাত্রী সালমাকে চিনতে পারলেন। সাথে যে তাঁর স্বামী এটাও বুঝলেন। তারপরও নিয়মনিষ্ঠ ভাবে পরিচয়পর্ব সেরে নিলেন। সালমার সাথে ওঁর স্বামী রেজা উত্তরবঙ্গের মানুষ, মধুমতি অববাহিকার এ অঞ্চলে প্রথমবার এসেছে। দু’জনের বেশ ভুষা দেখে আর রেজার কথা বার্তা শুনে মিঃ হালদার যেন একটু অবাকই হলেন। আরও বিস্মিত হলেন যখন জানলেন রেজা রাজধানী শহরের নামকরা এক স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজির প্রভাষক। মিঃ হালদারের কাছে একটু অবিশ্বাস্যই লাগছে। বেতন দিতে না পারার জন্য যার পড়ালেখা বন্ধ হতে বসেছিল এই সেই সালমা !
মিঃ হালদার তখন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। বার্ষিক পরীক্ষার প্রথম দিন, পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা পড়ে গেছে বেশ কিছুক্ষন হল। মিঃ হালদার সব পরীক্ষার কক্ষ পরিদর্শন শেষে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করছেন, দেখলেন একটা মেয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, চোখ দিয়ে তার জল গড়িয়ে পড়ছে। কাছে গিয়ে কারন জিগ্যেস করতেই ও কাঁদতে কাঁদতে বলল স্যার আমি বেতন পরিশোধ করতে পারিনি বলে প্রবেশপত্র পাইনি। হেডস্যারকে অনেক অনুরোধ করলাম পরীক্ষার সুযোগ দেবার জন্য, কিন্তু স্যার রাজি হননি। মেয়েটির আবেগ যেন বাঁধ ভাঙল । স্যার, আমার আর পড়ালেখা করা হবেনা বলেই ও শিশুদের মতো কাঁদতে শুরু করল। মিঃ হালদার বললেন, কাঁদিস না, চল তোর পরীক্ষা দেবার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। পরীক্ষা কক্ষের দিকে যেতে যেতে ওর নাম, শ্রেনী, ক্লাশ রোল সব জেনে নিলেন। পরীক্ষা কক্ষে কর্তব্যরত শিক্ষককে বলে সালমার পরীক্ষা দেবার ব্যাবস্থা করে দিয়ে নিজ কক্ষে ফিরলেন। পিয়নকে ডেকে ষষ্ঠ শ্রেণীর হাজিরা খাতা আর বিগত দুই পরীক্ষার রেজাল্ট শিট আনতে বললেন। সব ওলট পালট করে মিঃ হালদার দেখলেন, ক্লাশ শুরুর প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত সালমার কোন অনুপস্থিতি নেই। পরীক্ষার খাতায় কোন বিষয়ে তার ফেল নেই, তবে নম্বর ৫০ এর উপরেও নেই। এর পরে ওর অভিভাবক সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন যে ওর বাবা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান, মা প্যারালাইসড হয়ে ঘরে পরে আছেন। বড় দুই বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা প্রায় নিঃস্ব, এখন শুধু বাড়ির ভিটেটুকুই সম্বল। মিঃ হালদার বুঝলেন ছাত্রী হিসেবে খুব একটা ভালো না হলেও পড়ালেখার প্রতি ওর আগ্রহটা অনেক বেশি। প্রধান শিক্ষককে বুঝিয়ে বলে সালমার বিনা বেতনে পড়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন এবং ওর রীতিমতো খোঁজ খবর নিতে শুরু করলেন মিঃ হালদার । পড়ালেখায় যেমনই হোক শিক্ষকরা সবাই ওর উপস্থিতি আর আচরনে মুগ্ধ। বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় কোন অংশগ্রহন না করলেও স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে সালমা সবার আগে। বিদ্যালয়ে কোন মেয়ে যদি কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে সেবিকা হিসেবে নিজে থেকেই এসে হাজির হয় সালমা। এই সব গুনাবলির কারনে সহপাঠীরা সবাই ওকে মাদার তেরেসা বলে ডাকে। আর তা শুনে ওর মুখে সবসময় একটু লাজুক লাজুক হাসি লেগেই থাকে । যদিওবা চেহারা খুব একটা সুন্দর না তথাপি হাসি মাখা মুখ এবং আচার ব্যাবহারের জন্য সালমা বিদ্যালয়ের এক প্রিয় মিষ্টি মুখ । সেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শুরু করে দশম শ্রেনীর নির্বাচনী পরীক্ষা পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়ে সালমার অন্তরে সবসময় বিদ্যালয়ের প্রতি এক কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করে। তাইতো কখনো বিদ্যালয়ের কোন সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সুযোগ পেলে ওর চোখ চকচক করে ওঠে। সব শিক্ষকরা বলেন, ভালো ছাত্রী আমরা অনেক পেয়েছি কিন্তু ওর মতো ভালো মানুষ আমরা খুব কম পেয়েছি। মিঃ হালদারও মনে মনে তৃপ্তি বোধ করেন এমন একটা মেয়েকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে পেরে। কিন্তু সেই তৃপ্তি শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণতা পায়নি। এস,এস,সি ফর্ম পূরণের ঠিক আগ মুহূর্তে যখন সালমা নিখোঁজ হল তখন তীরে এসে তরী ডোবার কষ্টটা বুকে কাঁটার মতো বিঁধল মিঃ হালদারের। খবর নিয়ে জানতে পারলেন, সালমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওর বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো। তাই বিয়ের ঠিক আগের রাতেই ও পালিয়েছে। কোথায় কি অবস্থায় আছে কেউ জানেনা।
ঠিক পনের বছর পরে আজ সেই সালমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রুপে দেখে মিঃ হালদার যতোটা না অবাক হলেন তার থেকে বেশি খুশি হলেন ওর ভালো থাকার কথা শুনে। কেমন আছিস, জানতে চাইলে সালমার উচ্ছ্বসিত উত্তর স্যার, আপনাদের আশীর্বাদে অনেক ভালো আছি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন। ওর অভিব্যাক্তি বুঝিয়ে দেয় , মুখের ভাষায় বোঝাতে পারছেনা যে ও আশাতীত রকমের ভালো আছে। পাশ থেকে এবার রেজা বলে উঠলো স্যার, ওর মুখে আপনার কথা এত বেশি শুনেছি যে আপনার অনেক কিছুই আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। আপনার প্রশংসা শুনে শুনেই আমার মনে আপনার জন্য এক শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। মনে মনে আপনার একটি ছবিও এঁকে ফেলেছি। সেই ছবিটার সাথে বাস্তবের আপনার কতোটা মিল তা জানার আগ্রহ আমাকে পেয়ে বসেছিল। এবার সুযোগ পেয়ে আপনার সাথে সাক্ষাতের লোভ আর সামলাতে পারলাম না। ইতিমধ্যে ক্লাসের ঘণ্টা পড়লে মিঃ হালদার বললেন, ইংরেজি শিক্ষক একজন অসুস্থ কিন্তু এস,এস,সি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস মিস করা ঠিক হবেনা। তোমরা একটু বস, আমি একটা ক্লাস নিয়ে আসি। রেজা বলল স্যার, যদি আপনার আপত্তি না থাকে ওদের ক্লাসটা আজ আমি নেই? মিঃ হালদার মনে মনে ভাবলেন মন্দ নয় , সবদিক রক্ষে হল আর মুখে বললেন বেশ তো চল তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসি ক্লাসে। রেজাকে ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে নিজ কক্ষে এসে সগরিকার মুখোমুখি বসে জিগ্যেস করলেন পরীক্ষার আগে পালালি কেন? তোর কোন সমস্যা থাকলে তুই আমাকে বলতে পারতিস। তুই বিয়ে করতে রাজি ছিলিনা আমাকে বললে আমি তোর বাবাকে বোঝাতাম। সালমা বলল স্যার, আমাকে ক্ষমা করে দেন, আমার কিছু করার ছিলোনা। আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার ঋণই তো কখনো শোধ হবার নয়। আমি চাইনি আপনাকে আবার বিরক্ত করতে। পরীক্ষা শেষে বিয়েতে আমার কোন আপত্তি ছিলোনা। কিন্তু বিয়ের দিন নির্ধারণে আমার পরীক্ষার বিষয়টি ছিল একেবারে গুরুত্বহীন। তাও মেনে নিয়েছিলাম। পরে জানতে পারলাম যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে আমি তার পঞ্চম স্ত্রী হতে যাচ্ছি । সে আগে চারটি বিয়ে করেছে। একজনকে নিজ হাতে পিটিয়ে মেরেছে, একজন নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে, বাকি দুইজন জীবিত। সব মিলিয়ে ছেলে মেয়ের সংখ্যা ১৩। অনেক চেষ্টা করেও আব্বাকে বোঝাতে পারিনি। আবশ্য আব্বারও কিছু করার ছিল না। দেনার দায়ে বাড়ির ভিটেটা তখন হাতছাড়া হবার উপক্রম। পাওনাদার বলল টাকা দিতে হবেনা আর ভিটেও ছাড়তে হবেনা, শর্ত শুধু তাঁর সাথে আমাকে বিয়ে দিতে হবে। নিরুপায় হয়ে আব্বা বিয়ের ব্যাবস্থা করেছিলেন। বিয়ের খরচও ঐ লোক দিতে চেয়েছিলেন। আমার জন্য সব থেকে যন্ত্রণাদায়ক বিষয় ছিল, ঐ লোকের এক মেয়ে আমার খুব কাছের বান্ধবী। বিবেকের সাথে বাস্তবতার যুদ্ধটা আমার জন্য কঠিন হয়ে গিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত বাবার অসহায়ত্বকে ধিক্কার দিয়ে চরম স্বার্থপরতার পরিচয় দিতে বাধ্য হলাম। জীবনটাকে নিজের মত করে সাজাতে বিয়ের ঠিক আগের দিন বাড়ি থেকে পালালাম। মিঃ হালদার জিজ্ঞ্যেস করলেন, নিজের মতো করে সাজাতে পেরেছিস জীবনটা? উত্তরে সালমা বলল, পড়ালেখা করা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু স্যার, আপনাদের আশীর্বাদে অনেক সুন্দর একটা সংসার পেয়েছি। আমি এখন অনেক সুখী স্যার। আব্বাকেও ঋণের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পেরেছি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার স্বামী। ও অনেক ভালো মনের মানুষ। আমি ওর যোগ্য নই, কিন্তু ও আমাকে মাথায় করে রেখেছে। সত্যি স্যার, সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। মিঃ হালদার জানতে চাইলেন , ওর সাথে তোর পরিচয় হল কিভাবে? সালমা বলল স্যার, সব কথা আজই বলে ফেললে কাল কি আপনি আমার নিমন্ত্রন রক্ষা করবেন? মিঃ হালদার বললেন তার মানে? ইতিমধ্যে ক্লাশ শেষ করে রেজা ফিরে এসেছে। মিঃ হালদারের কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বলল হ্যা স্যার, আগামীকাল ছুটির দিন, আপনার সাথে একত্রে মধ্যাহ্ন ভোজ করতে চাই। আপনি অনুগ্রহপূর্বক না করবেন না স্যার। মিঃ হালদার ওদের আবদার রক্ষার আশ্বাস দিলে চা চক্র শেষে ঐদিনের মতো দুজন বিদায় নিলো।
পরদিন মধ্যাহ্নের আগেই মিঃ হালদার নিমন্ত্রন রক্ষায় সালমার বাড়িতে (সালমার বাবার বাড়ি) উপস্থিত হলেন। নতুন একটি টিনের ঘর, খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো একটি বাড়ি। মিঃ হালদার এর আগে কখনো এই বাড়িতে না এলেও শিক্ষার্থীদের কাছে শুনে সালমাদের বাড়ির যে চিত্রটা মনে এঁকেছিলেন তার সাথে বর্তমান চিত্রটা একেবারেই মেলাতে পারছেন না। তবে বুঝতে পারছেন, এই না মেলার কারন সদ্য সাধিত পরিবর্তন। আর এ সবই হয়তো রেজার কর্তব্য ও দায়িত্বশীলতার ফল। মিঃ হালদারকে বসতে দিয়ে সালমা ঘরের ভেতরে ডাকতে লাগলো, মা এদিকে এসো। সালমার থেকে বয়সে দশ বারো বছরের বড় এক মহিলা এসে লাজুক লাজুক মুখে দরজার পাশে দাঁড়ালো। সালমা পরিচয় করিয়ে দিলো স্যার, এই আমার মা। আর মাকে বলল মা, এই আমার সেই স্যার। মহিলা সালাম দিয়ে বললেন, সালমার মুখে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। স্যার, আমার মা কিন্তু খুব ভালো রান্না করে। সালমার এই কথার জবাবে মহিলা বললেন, কিন্তু আপনার ছাত্রী আমাকে আজ রান্না করতেই দেয়নি। আপনাকে নিমন্ত্রন করেছে বলে নিজের হাতেই সব রান্না করেছে। সালমা বলল, দুঃখ করনা মা, ডাল আর ভাত তোমার জন্য চুলার উপরে বসিয়ে রেখেছি। তুমি এখন ওগুলো রাঁধ, আমি স্যারের সাথে কথা বলি। মা মেয়ের এই খুনসুটি বেশ উপভোগ্য লাগছিলো মিঃ হালদারের কাছে। কিন্তু একটা বিষয় কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, এই মহিলা কি করে সালমার মা হয়! তাছাড়া ওর মা তো অনেকদিন ধরে প্যারালাইসড ছিলেন । মহিলা রান্না ঘরের দিকে গেলে মিঃ হালদার সালমার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলেন। সালমা বলল, আমার সৎ মা। তবে আমাকে নিজের মেয়ে বই অন্য কিছু ভাবে না। আমার মা বেঁচে থাকলে সেও আমার জন্য এতোটা করত কি না জানিনা। তাছাড়া এই মায়ের জন্যই আমার আব্বা আজো বেঁচে আছে। এই মা না থাকলে নিজের মায়ের মত আব্বাও হয়তো এতদিন আমাদের ছেড়ে চলে যেত। মিঃ হালদার উপলব্ধি করলেন, রক্তের বাঁধনের থেকেও আত্মার বাঁধন কখনো কখনো অনেক বেশি দৃঢ় হয়। রেজা গোসল সেরে এসে ওঁদের সাথে গল্পে যোগ দিলো। মিঃ হালদার রেজাকে বললেন, তুমি যে ছাত্র-ছাত্রীদের কি জাদু করেছো! তোমরা চলে আসার পরে ওরা সবাই আমাকে এসে ধরেছে, তোমাকে আমাদের স্কুলের শিক্ষক করে রাখার জন্য। অনেক কষ্টে বোঝালাম যে সেটা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু ঢাকায় ফেরার আগে তোমাকে আরও একটি ক্লাশ নেওয়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ ওঁদের পক্ষ থেকে আমাকে করতে বলেছে। রেজা বলল স্যার, এভাবে বলে আমাকে অপরাধী করবেন না। আমি চেষ্টা করব, সুযোগ পেলে অবশ্যই আরও একদিন যাবো। তবে সত্যি কথা বলতে কি, আপনার কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে । এতদিন শুধু সালমার মুখে আপনার কথা শুনেছি। কিন্তু বিদ্যালয়ে না গেলে আপনার সম্পর্কে জানায় কিছুটা অপূর্ণতা থেকে যেতো। একজন শিক্ষকের সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মুল্যায়ন কতোটা উচ্চ হতে পারে তা গতকাল বুঝতে পারলাম। যে কোনভাবে আপনার কোন কাজে আসতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব। পরোক্ষভাবে হলেও তো আমি আপনার কাছে অনেক ঋণী স্যার। মিঃ হালদার জানতে চাইলেন, সে কেমন করে? রেজা উত্তরে বলল, স্যার আপনার শিক্ষায় সালমা নিজেকে আলোকিত করেছে আর ওর সে আলোয় আজ আমার জীবন, সংসার আলোকোজ্জ্বল। আমার জীবনে কোন অপূর্ণতা নেই। আমার ছেলেমেয়েদের নিয়েও আমার কোন চিন্তা নেই। সালমা ওদেরকে বেশ ভালোভাবেই গড়ে তুলছে। মিঃ হালদার বললেন, তোমাদের ছেলেমেয়েরা কই, দেখছিনা যে? সালমা বলল, আব্বার সাথে কোথায় যেন ঘুড়তে বেড়িয়েছে। বলতে বলতে নয় বছর বয়সী এক ছেলে আর ছয় বছর বয়সী এক মেয়ে দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির। এসেই মিঃ হালদারকে ছেলেটা সালাম জানালো। ভাইয়াকে অনুসরন করে ছোট বোনও সালাম জানালো। আপনি আম্মুর সেই ভালো স্যার, তাই না? ছেলেটার এমন প্রশ্ন শুনে মিঃ হালদার বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। তিনি বললেন, তুমি কি করে জানলে? আম্মু বলেছে আজ আপনি আসবেন। আম্মুর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আম্মু সবসময় আপনার কথা বলে। মিঃ হালদার বললেন, তাই বুঝি? কিন্তু আমি যে ভালো স্যার তা তুমি বুঝলে কি করে? উত্তরে সে বলল, আপনাকে দেখে আমার মনে হল আপনিই সেই ভালো স্যার । এইটুকু ছেলের এত সুন্দর করে সাজিয়ে কথা বলার ঢং দেখে মিঃ হালদার উপলব্ধি করলেন, পারিবারিক সুশিক্ষার কোন ঘাটতি নেই এদের মাঝে। রেজার মত একজন অসাধারন মনের মানুষ পেয়েছিলো বলেই সেই সালমা আজকের সালমা হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, এত সুন্দর একটা সংসার গড়েছে, দুটো ছেলে মেয়ে নিজের মনের মত করে বড় করার স্বপ্ন দেখতে পারছে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেই যে মানুষের ভাগ্যলিখন, মিঃ হালদার আরও একবার তা মেনে নিলেন। বাড়ি ছেড়ে পালানোর খবরে সালমার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় যে কষ্টটা পেয়েছিলেন, আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই মিঃ হালদারের। বরং এত সুন্দর একটা সাজানো সংসারের মধ্যমণি হিসেবে সালমাকে দেখতে পেয়ে আজ তিনি আবেগাপ্লুত। মনের অজান্তেই সালমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন, “সত্যিই তুই চাঁদকপালি।”
কিন্তু এই চাঁদকপালির ভাগ্য কতই না পরিহাস করেছে ওকে। বাড়ি ছেড়ে পালানোর সময় সালমা সিদ্ধান্ত নিলো ঢাকায় গিয়ে রিতার কাছে উঠবে। রিতা সালমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, অষ্টম শ্রেনিতে পড়ার সময় স্কুল ত্যাগ করে ঢাকায় পারি জমিয়েছে। মাঝে মাঝে এই দুই বান্ধবীর পত্র যোগাযোগ হয়। বিয়ের ঠিক আগের দিন গোধূলি লগ্নে সকলে যখন গবাদি পশু পাখি ঘরে তুলতে ব্যাস্ত ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে বোরখা পরে, গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা সাথে করে বেড়িয়ে পড়ল। নিজের গৃহপালিত হাঁস মুরগীর ডিম বিক্রি করে জমানো কিছু টাকা সম্বল করে শুরু হল এক আনিশ্চিত যাত্রা। পায়ে হেঁটে থানা সদর পর্যন্ত তারপর রাতের বাসে করে ঢাকায় পৌঁছল। বাড়ি থেকে অনেক দূরে পালাতে হবে পাশাপাশি পরিচিত কেউ ওকে চিনে ফেলে কিনা এই শঙ্কায় বাকি সব ভুলেই গিয়েছিলো। ভোরে বাস থেকে যখন নামলো তখন মনে হল, রিতাকে তো কিছুই জানানো হয়নি! তবে বন্ধুত্বের উপর অটুট ভরশায় রিকশা চেপে পৌঁছে গেলো রিতার ঠিকানায়। হতাশা নতুন চাদরে জড়াল ওকে, রিতা এখানে নেই! বস্তির এক ছোট্ট ঘরে চারজন গার্মেন্টস কর্মী একসাথে থাকতো। তিনদিন আগে গার্মেন্টসের কোন এক ছেলের সাথে ভেগেছে। কোথায় আছে ওখানকার কেউ জানেনা। সালমা যেন মহাসমুদ্রে পড়ল। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার ভাবল, বাড়িতে ফিরে যাবে। কিন্তু যখন মনে হল, বাড়িতে গেলে এক নারকীয় জীবন মেনে নিতে হবে তখন আর মন টানলো না। এত সহজে হার মানলে চলবে না। প্রতিজ্ঞা করল, ঢাকাতেই থাকবে ও। রিতার সহকর্মীদের কাছে খুব অনুনয় করে বলল তাদের সাথে ওর থাকার ব্যাবস্থা করার জন্য। ব্যায় সাশ্রয়ে ওদেরও একজন লোক প্রয়োজন তাই একপ্রকার থাকার ব্যাবস্থা হয়ে গেলো। ওদের সাথে গার্মেন্টসে কাজের আশ্বাসও মিললো। গ্রামে খুব কষ্টে জীবন যাপন করলেও এমন পরিবেশে ও কখনো থাকেনি। তারপরও অল্প টাকায় থাকা আর সাথে একটা চাকরির আশ্বাস এখন ওর কাছে অথৈ সমুদ্রে যেন এক ভেলা। পরদিন থেকে ওদের সাথেই শুরু হল সালমার নতুন এক সংগ্রামী কর্মজীবন।
কিছুদিনের মধ্যেই সালমা এক দক্ষ একনিষ্ঠ গার্মেন্টস কর্মী। এক প্রকার রাগ বা অভিমান করেই বাড়ির সাথে আর যোগাযোগ রাখেনি। তবে অসুস্থ মায়ের কথা ভেবেই প্রতি মাসে ডাকযোগে বাড়ির ঠিকানায় যা পারে কিছু টাকা পাঠায়। তবে চিঠিপত্র দেয় না আর নিজের ঠিকানাও বাড়িতে জানায় না। কষ্ট ভুলতে সহকর্মী তিনজনকেই নিজের পরিবার করে নিয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সালমা সহকর্মীদের মন জয় করে নিলো। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে এই সালমা নিজেই মন হারিয়ে বসলো!
প্রতিদিন কর্মস্থলে যাওয়া আসার সময় এক জানালা যত ঝামেলা পাকায়। কেন যে পথের পাশের ঐ জানালাটা খোলা থাকে সবসময়? এখানে এলেই চোখ দুটো ঐ জানালায় আটকে যায়। ভেতর থেকে এক জোড়া চোখ কি এক ভীষণ আকর্ষণে টেনে নিয়ে মিষ্টি মুখের একটু হাসি দিয়ে সালমার মন ভরিয়ে দেয়। সালমার মাথাটা যেন এলোমেলো হয়ে যায়। মায়া ভরা দুটো চোখের গভীরে যেন হারিয়ে যায় ও। আরও একটু কাছ থেকে মানুষটাকে দেখার একটা সুপ্ত বাসনা কাজ করে সালমার। খুব শীঘ্র ওর মনের আশা পূরণও হতে শুরু করে। কোন না কোন ইস্যুতে ঠিক সালমার আসা যাওয়ার সময় রাস্তায় এসে দাঁড়ায় ছেলেটি। শ্যামলা বর্ণের মাঝারি গড়নের এক যুবক, দেখতে খুব সুন্দর না হলেও চেহারায় এক আকর্ষণ আছে। একদিন ওকে দেখতে না পেলে সালমার যেন দিনই কাটেনা। ইনিয়ে বিনিয়ে পরোক্ষ মাধ্যমে তথ্য নিয়ে সালমা ছেলেটির সম্পর্কে যা জানলো তার সারাংশ হল- ছেলেটির নাম নাজমুল, বিএ পড়ে পাশাপাশি কোচিং সেন্টারে চাকরি করে রেজা স্যারের সহকারি হিসেবে। এক কথায় বেশ ভালো ছেলে। সব শুনে সালমার আকর্ষণ যেন দিগুন হয়ে যায় কিন্তু ভয়টা বেড়ে যায় তারও বেশি। নিজেকে সংযত করার চেষ্টায় মগ্ন হয়, কিন্তু পেরে উঠছে না। নাজমুলের মনের অবস্থাও যে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে একদিন তার প্রমান মিলল সালমা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পরলে। সকালে কাজে যাবার সময় সহকর্মীদের সাথে সালমাকে না দেখে মনটা একটু উসখুস করল। মনে ভাবল , হয়তো পেছনে পড়েছে। কিন্তু অপেক্ষা করে করে সময় যখন পার হল তখন বুঝল, কিছু একটা সমস্যা। সালমার সহকর্মীরা দুপুরের খাবার খেয়ে যখন ফিরছিল তখন সকল লজ্জা, সঙ্কোচ, জড়তা ফেলে তাদেরকে ডেকে সালমার খবর জানতে চাইলো। উত্তরে জানতে পারলো সালমা খুব অসুস্থ তাই আজ কাজে যেতে পারেনি। কি হয়েছে জানতে চাইলে ওরা তিনজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল। কিছুক্ষন ইতস্তত করে অবশেষে ওদের একজন বলল, জ্বর হয়েছে। ওরা তিনজন হাসাহাসি করতে করতে চলে গেলে পরে নাজমুল ফলের দোকানে গেলো, বড় বড় চারটা আনারস কিনে নিয়ে সালমার বাসায় গেলো। দরজায় করা নাড়তেই ভেতর থেকে কিছুটা কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন এলো, কে? নাজমুল কি বলবে ভেবে উঠতে পারছিলোনা তাই কোন কথা না বলে আবার কড়া নাড়ল। একটু বিরক্তি নিয়েই সালমা দরজাটা খুলে সাময়িকভাবে নির্বাক হয়ে গেলো। কোনভাবেই নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে তার দরজায় নাজমুল দাঁড়ানো। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আপনি এখানে? নাজমুল বলল, আপনার নাকি জ্বর তাই আপনার বান্ধবীরা আপনার জন্য আনারস কিনে আমাকে দিয়ে বলল একটু পৌঁছে দিতে। সালমা বুঝতে পারলো, এ সব হয় নাজমুলের সাজানো গল্প নতুবা ওর বান্ধবীদের দুষ্টুমি। কারন ওর যে জ্বর হয়নি তা ওর বান্ধবীরা খুব ভালো করেই জানে। তা ছাড়া ও নিজ মুখে কিছু স্বীকার না করলেও ওর বান্ধবীরা যে ওদের দুজনের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণের বিষয়টা যে বুঝে ফেলেছে এ ব্যাপারে সালমা নিশ্চিত। বেশ কিছুদিন ধরেই ওরা নাজমুলের কথা বলে ওকে মাঝে মধ্যেই টিপ্পনি কাটে। সালমা আর কথা না বাড়িয়ে নাজমুলকে ভেতরে এসে বসার জন্য অনুরোধ জানালো। নাজমুল বলল আজ আর নয়, আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন তারপর একদিন এসে বসে যাবো, এখন আসি বলেই হাতের আনারসগুলো দরজায় রেখেই এক প্রকার দৌড়ে পালানোর উপক্রম। সালমার সাথে আর কেউ একজন থাকলে হয়তো বসার সাহস হত, কিন্তু একাকী সালমার পাশে সময় কাটানোর মতো সাহস ওর হল না। বরং ওখান থেকে পালিয়ে বেঁচে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সালমা কিছুটা অবাক হলেও হৃদয়ে বসন্ত বাতাসের এক শীতল স্পর্শ অনুভব করল। রাতে সালমার বাসায় ছোটোখাটো একটা মজার হাট জমজমাট মিলে গেলো। সবার খুনসুটির প্রতিক্রিয়ায় সালমার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে শুধু বলল, তোদের সাথে আমার কোন কথা নেই যা। কিন্তু, ওর মনের যে অভিব্যাক্তি প্রকাশ পেলো তাতে করে বাকিরা সবাই এই ব্যাপারে উৎসাহিতই হল। আর সে উৎসাহের নিবৃত্তির তরে ওদের একজন পরদিন সকালেই নাজমুলকে গিয়ে বলল, সালমা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আপনি যদি একটু সাথে আসেন খুব ভালো হয়। যথারীতি নাজমুল কিছুক্ষনের মধ্যেই ওদের বাসায় গিয়ে হাজির। ছুটির দিন হওয়ায় সবাই রুমে ছিল। নাজমুল গিয়ে দেখল সালমা দিব্যি সুস্থ, সবার সাথে গল্প করছে। নাজমুল বলল আপনি নাকি খুব বেশি অসুস্থ, হাসপাতালে যেতে হবে? নাজমুলের কথা শুনে সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো, শুধু সালমা বোকার মতো তাকিয়ে রইলো । নাজমুল বুঝতে পারলো ওদের দুষ্টুমি। কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল, আমি আসি। যেই না বেরিয়ে যাবে অমনি হাত টেনে ধরল ওদের একজন। এসছেন যখন একটু বসে যান। নাজমুল সে নিমন্ত্রন উপেক্ষা করতে পারলো না। কাল যে আনারস এনেছেন তা খেয়ে যাবেন না? এই বলেই ওর সামনে আনারসের প্লেট এনে দিলো একজন। একজন বলল, ডাক্তার এসে গেছে রোগীকে ঠিকমতো দেখতে দাও। এমন আরও দু চারটি কথা বলে কেউ রান্না করতে, কেউ গোসল করতে , কেউবা অন্য কাজের ছুতোয় ওখান থেকে সটকে পড়লো। রুমে এখন শুধু ওরা দুজন। এমন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি দুজনকেই খুব বিব্রত করল। সামলে নিতে নাজমুল প্রশ্ন করল, আপনার জ্বর সেরে গেছে? সালমা মুখে উত্তর দিলো, হ্যাঁ। কিন্তু সত্য কথাটা ও নিজেও বলতে পারলো না যে তার জ্বর হয়নি পেট ব্যাথা হয়েছিলো। যে কারনে ওঁর বান্ধবীরা মিথ্যে বলেছিল ঠিক সেই কারনেই ও নিজেও সত্যটা বলতে পারেনি। এরপর কিছুক্ষন নিরবতা। কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে নাজমুল বলল, যদি আপনার আপত্তি না থাকে, আগামি শুক্রবার কি আমরা দুজন বাইরে কোথাও দেখা করতে পারি? সালমা প্রশ্ন করল, কোথায়? নাজমুল বলল আপনিই বলুন । সালমা বলল, আচ্ছা পরে আপনাকে জানাবো। সালমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে আজ আসি বলে নাজমুল চলে গেলো।
দুজনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী শুক্রবার বিকেলটা রমনা পার্কের গাছের ছায়ায় বেশ রোমান্টিক কেটে গেলো। আলাপচারিতায় দুজন দুজনের অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে অবগত হল। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও নাজমুলের সংগ্রামী জীবনের গল্প সালমাকে অনেক বেশি মুগ্ধ করল। নাজমুলের পরিবারের অনটনের মধ্যেও নিজের উপার্জনে পড়ালেখা চালিয়ে যাবার দৃঢ় মনোভাব সালমাকে ওর প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল করে তুলল। ওদের প্রেমের গাড়ি লাইনে উঠতে যতোটা সময় নিলো, গতি তুলতে তাও নিলোনা। এরপর কখনো বোটানিক্যাল গার্ডেন, কখনো বলধা গার্ডেন, কখনো ধানমণ্ডি লেক, কখনো আহসানমঞ্জিল, কখনোবা লালবাগ কেল্লা আবার কখনোবা চিড়িয়াখানায় ঘুরে ঘুরে এক বছরেই প্রেম জমে একেবারে ক্ষীর। ইতিমধ্যেই নাজমুল সালমার শিক্ষানুরাগ উপলব্ধি করল পাশাপাশি এও বুঝল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ও অনেক বই পড়ে। বই এর প্রতি ওর এই প্রচণ্ড নেশা দেখে নাজমুল মাঝে মাঝেই সালমার পছন্দের বই উপহার দেয়। সালমাও সুখী এমন মনের মতো একজন মানুষ কাছে পেয়ে, যে কি না ওকে পুরোপুরি বুঝতে পারে । সব ছেড়ে দূরে এসে এই আত্মীয় স্বজনহীন জীবনে এখন নাজমুলকেই সালমার একমাত্র স্বজন মনে হয়। নাজমুলের অনুরোধেই সালমা দীর্ঘদিন পরে বাড়িতে যোগাযোগ করে জানতে পারে, বেশ কিছুদিন আগেই তার অসুস্থ মা মারা গেছেন। শুনে মায়ের কবরটা দেখার জন্য মনটা প্রচণ্ড ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু ওর বাবার দ্বিতীয় বিয়ের সংবাদ সে ইচ্ছেটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। মায়ের মৃত্যুর এক মাস পার না হতেই ওর বাবা নাকি তালাকপ্রাপ্তা এক মহিলাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। লজ্জা, ঘৃণা আর দুঃখে সালমা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। বন্ধন বা পিছুটান বলতে আর কিছু যেন রইলো না। নাজমুল ই এখন সালমার একমাত্র অবলম্বন। যে কোন মূল্যে ওর জীবনে নাজমুলকে ও ধরে রাখবেই এবং নাজমুলের প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা করবে। নিজে পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কষ্টটা ভুলতে নাজমুলের পড়ালেখার জন্য করনীয় যাবতীয় সালমা সাধ্যমত করতে শুরু করল। টাকা পয়সা যখন যা প্রয়োজন নাজমুলকে দিতে এতটুকু কার্পণ্য করে না। সালমার সব স্বপ্ন এখন নাজমুলকে ঘিরে।
নাজমুলের ডিগ্রীর রেজাল্ট বের হলে পরে সালমাই সকলকে মিষ্টিমুখ করায়। কোচিং সেন্টারের সকলকে মিষ্টি খাওয়াতে গিয়েই প্রথম কোচিং সেন্টারের পরিচালক, রেজা স্যারের সাথে পরিচয়। রেজা স্যার বেশ কিছুদিন পূর্বেই লোকমুখে ওদের প্রেমকাহিনী শুনেছেন । প্রথম দেখাতেই সালমাকে বেশ ভালো লাগলো রেজা স্যারের। রেজা স্যার উপলব্ধি করতে পারলেন নাজমুলের প্রতি সালমার প্রেমের গভীরতা। তারপরও নাজমুলকে যেহেতু নিজের ভাইয়ের মতই মনে করেন তাই একটু ভালো করেই যাচাই করে নিলেন। খাঁটি রত্ন চিনতে ভুল হল না রেজা স্যারের। নাজমুলের উপযুক্ত সঙ্গী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তাঁর কোন দ্বিধা রইলো না। সময়মত নিজেই ওদের বিয়ে দেবেন বলে ঐদিনই ঘোষণা দিলেন। সালমা যেন নতুন এক অভিভাবকের সন্ধান পেলো। আবেগে আপ্লুত হয়ে বাসায় ফিরে বান্ধবীদের সব বলল। সব শুনে বান্ধবীদের উচ্ছাস যেন সীমা ছাড়ায়। সালমার সাথে ওদের খুনসুটি যেন সারা দিনে শেষই হয়না। আর এদিকে সালমার সারাক্ষন কাটে শীঘ্রই এক সুখের ঘর বাঁধার কল্পনায় বিভোর হয়ে। বিয়ের পরে সংসার সাজাতে নাজমুলকে যাতে বেগ পেতে না হয় তাই নাজমুলের মাস্টার্সে ভর্তির যাবতীয় খরচ সালমা দেয়। এমনকি নিজের ব্যাংক হিসেবের চেক বইটাও নাজমুলের কাছে সই করে দিয়ে দেয় যাতে করে যখন যা প্রয়োজন খরচ করতে পারে। নাজমুল সালমার ভালবাসা তখন ঐ মহল্লায় সর্বজন স্বীকৃত। সবাই যেন মুখিয়ে আছে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করার আশায়। সবার মুখে একই প্রশ্ন, কবে বিয়ের দাওয়াত পাব? তবে কিছুদিন ধরে প্রশ্নটা যেন একটু বেশি শুনছে নাজমুল এবং সালমা দুজনই। বিশেষ করে সালমার বান্ধবীরা ওকে খুব বেশি চাপ দিচ্ছে বিয়েটা খুব শীঘ্রই সারার জন্য। দেরি করলে মান সম্মান বাঁচানো যাবেনা, কেন তুই বুঝতে পারছিস না? বান্ধবীদের এমন প্রশ্নে সালমা অবাক হয়ে যায়। সালমা বলে কেন, কি এমন হল? ওর মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলেই আমরা বিয়ে করব। বান্ধবীরা তখন সালমার শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে বলল। মাতৃত্বের লক্ষন যে ওর শরীরে ফুটে উঠেছে তা বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সালমা ওদের সব কথা দুষ্টুমি মনে করে উড়িয়ে দিলো এবং ওদেরকে নিজেদের সম্পর্কের পবিত্রতা বিষয়ে আশ্বস্ত করল। কিন্তু সালমার শারীরিক পরিবর্তন দেখে ওরা কোনভাবেই সালমার কোথায় বিশ্বাস রাখতে পারলো না। ওরা সবাই মিলে নাজমুলের কাছে গেলো এবং তাড়াতাড়ি বিয়েটা করার জন্য পরামর্শ দিলো। কিছুদিন পর থেকে নাজমুলের আচরনেও পরিবর্তন আসতে শুরু করল। সালমার সাথে সেই আগের মতো দেখা সাক্ষাৎও করেনা, আবার সালমা কিছু জিগ্যেস করলে পড়ালেখা বা কাজের কথা বলে এড়িয়ে যায়। সালমার বান্ধবীরাও ব্যাপারটা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। ভেবেছিলো হয়তো মান অভিমান চলছে। কিন্তু দীর্ঘদিন অবস্থার কোন পরিবর্তন না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে যেদিন সালমা নিজে ওদের কাছে নাজমুলের সম্পর্কে অভিযোগ জানালো তখন ওরা মনে করল নাজমুল বোধ হয় প্রতারনার ফাঁদ পেতেছে, এখন ফায়দা লুটে সটকে পড়তে চাইছে। ওরা সালমাকে কিছু না জানিয়েই মহল্লার কয়েকজন মুরুব্বীকে জানায় ব্যাপারটা। এক কান দুই কান করে পুরো মহল্লায় ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। নাজমুলের বিরূপ আচরনের কারন সালমা অনেকবার জানতে চেয়েছে কিন্তু নাজমুল কোন সদুত্তর দেয়নি। উপায়ান্তর না দেখে সালমা রেজা স্যারকে শেষ ভরসা মনে করল। রেজা স্যারের কাছে গেলে তাঁর চোখেও সালমার শারীরিক পরিবর্তন ধরা পড়ল। তিনিও মন্তব্য করলেন, খুব শীঘ্রই তোমাদের বিয়ের ব্যাবস্থা করা উচিৎ। নাজমুলের সাথে কথা বলে যত দ্রুত সম্ভব আমি ব্যবস্থা করছি। সালমা কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলে রেজা স্যারও বাসার উদ্দ্যশ্যে বের হলেন। কিছুদূর যেতেই লোকজনের জটলা দেখে দাঁড়ালেন। দেখলেন কয়েকটা যুবক নাজমুলকে ঘিরে আছে, একজন নাজমুলের কলার ধরে আছে বাকিরা মারতে উদ্যত। রেজা কাছে গিয়ে কারন জানতে চাইলে ওরা বলল, ব্যাটা একটা ধান্দাবাজ। মেয়েটার জীবন নষ্ট করে এখন পালাতে চাইছে। সব শুনে রেজা স্যার বললেন আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, এর সমাধান আমি করে দেবো। ইতিমধ্যে কয়েকজন মুরুব্বীও ঘটনাস্থলে এসে হাজির। অবশেষে বয়োজ্যেষ্ঠ এক চাচার মধ্যস্ততায় রাত্রিবেলা এই ঘটনার ফয়সালা হবে এই মর্মে রেজা স্যারের জামিনদারির শর্তে নাজমুলের মুক্তি মিলল।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে রেজা বরাবর ই ভালো ছাত্র। পিতার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো থাকা সত্ত্বেও স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে ছাত্রজীবন থেকেই সচেষ্ট। তাই চার বন্ধু মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই গড়ে তোলে এই ‘সৃষ্টি’ কোচিং সেন্টার। পড়ালেখা শেষে চাকরির সুবাদে বাকি তিন বন্ধু ‘সৃষ্টি’ ছেড়ে গেলেও রেজা এখনও ধরে রেখেছে তার সাফল্যের এই শেকড়। সফল সে তার নিজের কর্মক্ষেত্রেও। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এক স্কুল এন্ড কলেজের খুব জনপ্রিয় প্রভাষক সে। ছাত্রছাত্রীদের খুব প্রিয় এবং কর্তৃপক্ষের খুবই আস্থাভাজন শিক্ষক রেজা। বয়সের তুলনায় তার প্রাপ্তির ভাড়ারটা একটু বেশিই সমৃদ্ধ। আর তার বড় প্রমান, মহল্লার ছোট থেকে বুড়ো সবার কাছে সে রেজা স্যার নামে পরিচিত। তার এই জনপ্রিয়তার জন্যই আজ নাজমুল গন ধোলাইয়ের হাত থেকে রেহাই পেলো এ কথ্যা একদম সত্য। কিন্তু রাতে ‘সৃষ্টি’ কোচিং সেন্টারে যখন সালিশি বৈঠক বসলো তখন অতি উৎসাহী জনগনের উপচে পড়া ভীর রেজাকে কিছুটা শঙ্কিতও করল। শিক্ষিত , জ্ঞানী এবং ভদ্র লোকেদের কাছে তার যেমন কদর, সবার কাছে ঠিক তেমনটা নাও হতে পারে। তাছাড়া এ ধরনের ঘটনায় জনগনের আবেগ সামলাতে তার ব্যাক্তিগত ইমেজ কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে সে বিষয়ে একটু সন্দিহান হল রেজা। কিছু লোকজনের উদ্ধত আচরন দেখে এবং গরম কথাবার্তা শুনে শঙ্কাটা ঘনীভূত হল। আমাদের মহল্লায় এমন অনাচার চলবে না। ওদের দুজনেরই কঠোর শাস্তি চাই বলে কিছু ছেলেপান মিছিল দিতে শুরু করল। গরম বাতাসে প্রভাবিত হয়ে কয়েকজন মুরুব্বীও বললেন, অবৈধ সম্পর্ক গড়ে প্রথম অন্যায় করেছে। দ্বিতীয়ত এখন আবার ওই ছোকরা দায় এড়াতে চাইছে। এমন ঘটনাকে আমরা যদি প্রশ্রয় দেই তাহলে মহল্লারতো বদনাম হবেই, ছেলেপানরাও খারাপ হবার সুযোগ পেয়ে যাবে। তাই এর কঠোর সাজা হাওয়া উচিৎ। রেজা বুঝল, এই পরিস্থিতিতে উল্টো কোন কথা না বলে খুব ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে। পরের চিন্তা পরে করা যাবে, আপাতত নাজমুল এবং সালমার নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ওদেরকে কিছু জিগ্যেস না করে এবং কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করল। দেখুন, ওরা যে ভুল করেছে তার জন্য পরোক্ষভাবে আমিই দ্বায়ী। ওরা অবৈধ কিছুই করেনি। কাজী অফিসে ওদের বিয়ে হয়েছে, আমি নিজে স্বাক্ষী থেকে ওদের বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু নাজমুলের পড়ালেখার ক্ষতি হতে পারে এই চিন্তা করে ওদেরকে আপাতত আলাদা থাকতে বলেছি। আর যেহেতু দুজন আলাদা থাকবে তাই ব্যাপারটা জানাজানি করতেও নিষেধ করেছিলাম। ভেবেছিলাম যে নাজমুলের মাস্টার্স পরীক্ষার পরই ওদের বাবা মাকে এনে সকলকে নিয়ে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান করবো, তখন সবাই জানবে। এখন আপনারা আমায় যে শাস্তি দেবেন তাই মাথা পেতে নেবো। সব শুনে সালমার বান্ধবীরা তো একদম থ। একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করছে আর বলছে, এক সাথে এতদিন থেকেও আমরা কিছুই জানতে পারলাম না। সালমার প্রতি ওদের যে অবিশ্বাস কিছুদিন পূর্বে জন্মেছিলো আজ তা যেন ঘৃণায় রুপ নিলো। কিন্তু সালমা বুঝল দুজনকে বাঁচাতেই রেজা স্যার আজ এই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। কোন কথা না বলে ও মাথা নিচু করে থাকলো। নাজমুল কিছু একটা না বোধক বলতে যাচ্ছিলো, রেজা থামিয়ে দিলো। গরম পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে গেলো। কিন্তু সালমার এক বান্ধবী বলে বসলো, তাহলে নাজমুল ভাই কেন সালমাকে এড়িয়ে চলছে? আমরা তাঁকে আর বিশ্বাস করতে পারছিনা। এমন কি সালমার উপরও আমাদের এখন আর ভরসা নেই। তাছাড়া ইদানিং প্রায়ই ও অসুস্থ হয়ে পড়ে, আমাদের কাছে ওকে রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছি। আমরা চাই আজই ওদের দুজনের আনুষ্ঠানিক বিয়ে দিয়ে পরস্পরকে পরস্পরের দায়িত্ব গছিয়ে দিতে। উপস্থিত সকলেই এই কথার সায় দিলো । কেউ কেউ বলে উঠলো হ্যাঁ এক্ষনি বিয়ে দিতে হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে রেজা রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু নাজমুল খুব করুন স্বরে হাত জোড় করে সকলের কাছে তার অনুরোধ রাখার আর্তি জানালো। সে বলল, বাবা মা’র একমাত্র সন্তান সে। তাই তাদেরকে না জানিয়ে বিয়ে করাটা তাঁদের জন্য কষ্টের কারন হবে। তাছাড়া সে মেসে থাকে, আজই বিয়ে করে দু’জন কোথায় উঠবে? বরং কিছুদিন সময় দিলে বাবা মাকে কাছে আনার ব্যাবস্থা করবে এবং এই সুযোগে একটা বাসাও ঠিক করে নেবে। প্রথমত কেউ এতে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত রেজার অনুরোধে সবাই পরবর্তী শুক্রবার নাজমুল ও সালমার বিয়ের দিন ধার্যের সিদ্ধান্তকে মেনে নিলো। তবে শর্ত হল রেজাকে নাজমুল এবং সালমার জিম্মাদার হতে হবে এবং বিয়ের আগ পর্যন্ত সালমাকে রেজার বাসায় রাখতে হবে। বাসায় যেহেতু ওর মা এবং বোন থাকে তাই কোন চিন্তা ভাবনা না করে শর্তে রাজি হয়ে ওদের দুজনের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নিলো রেজা। সালিশি বৈঠক শেষ হলে রেজা সালমাকে বলল, বাসায় গিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও আমি বাসায় যাবার পথে তোমাকে নিয়ে যাবো। রাতে নাজমুলকে ও সালমাকে নিয়ে রেজা বাসায় ফিরল। বেশ কিছু টাকা নাজমুলকে দিয়ে বলল, কাল সকালেই বাড়িতে যাবে, বাবা মা কে নিয়ে আসবে। ওঁদেরকে এ বিষয়ে কিছু বলতে হবে না, যা বলার আমি সব বুঝিয়ে বলব। যতদিন না তোমার বাসা ঠিক হচ্ছে ততদিন তাঁরা আমার বাসায় থাকবে।
নাজমুল পরবর্তি দিন তার বাবা মা কে আনতে গ্রামের বাড়ি চলে গেলো। রেজার মা এবং বোন বেশ প্রগতিশীল, তাই সবকিছু জেনে বুঝেও সালমাকে আশ্রয় দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি তাঁরা। কিন্তু সালমা যেন কেমন চুপসে গেলো। ও এতদিনে বুঝতে শুরু করেছে, কি কারনে সবাই ওকে অবিশ্বাস করছে। কিন্তু কাউকেই ও আসল সত্যটা বোঝাতে পারছেনা। পারবেই বা কেমন করে নিজের শরীরের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারন নিজেইতো বুঝতে পারছেনা। তার উপর সবার সম্মুখে যা কিছু ঘোটে গেলো তাতে করে বান্ধবীদের কাছে ওর বিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও যে আর নেই, কাকে সব কথা খুলে বলবে? তারপরও লাজ লজ্জ্বা ফেলে একদিন মা এবং বোনের সামনে রেজা স্যারকে বলল স্যার, বিশ্বাস করুন নাজমুলের সাথে আমার এমন কিছুই হয়নি। কিন্তু সবাই আমাকে ভুল বুঝে অপবাদ দিচ্ছে। স্যার, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলুন , পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তার প্রমান পাবেন। রেজার মা এবং বোন ওকে অনেক স্বান্তনা, সাহস এবং ভরসা দিতে লাগলো । কিন্তু ওর আসল কথায় তেমন গুরুত্ব কেউই দিলো না । রেজা বলল, আচ্ছা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, আগে বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হোক তারপর। এদিকে বৃহস্পতি বার দুপুর পর্যন্ত নাজমুলের কোন সাড়া না পেয়ে রেজার বিশ্বাসে একটু ভাটা পড়তে শুরু করেছে। বিকেলের দিকে একটা চিঠি এসে পৌঁছল রেজার হাতে। রেজা চিঠি খুলে পড়তে লাগলো...
স্যার,
আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা আমি দিতে পারলাম না। সালমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারন প্রথমত একটা অশিক্ষিত গার্মেন্টসকর্মীকে আমার পরিবার মেনে নেবে না। দ্বিতীয়ত ও আমার সাথে প্রতারনা করেছে, আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। ওর সাথে আমার কখনো অবৈধ কোন মেলামেশা হয়নি অথচ ও গর্ভবতী। ওর মতো একটা চরিত্রহীনাকে ঘরের বউ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার ঋণ এ জীবনে শোধ হবার নয়। আজীবন আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
ইতি
আপনার ছোট ভাই
নাজমুল
চিঠিটা পড়ে রেজার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কি করবে এখন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। রাতে বাসায় ফিরে সালমাকে চিঠিটা পড়তে বলল। সালমা চিঠি পড়ে অঝোড়ে কাঁদতে লাগলো। যার জন্য আমার জীবনের সব কিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত সেই কিনা আমাকে এমন অবিশ্বাস করল! এমন একটা অপবাদ দেওয়ার আগে আমার কাছে কিছু জানতেও চাইলো না, একটু ভাবল না! স্যার, বিশ্বাস করুন, আমি কোন প্রতারনা করিনি। আর এমন কিছুই হয়নি যাতে করে ও আমাকে এমন অবিশ্বাস করতে পারে। স্যার, আপনার কাছে আবার করজোড়ে অনুরোধ করছি, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলুন। ও আমাকে বিশ্বাস না করুক আপনারা সবাই অন্তত সত্যটা জানতে পারবেন। আমি আত্মহত্যা করলেও এই অপবাদটা তো থেকেই যাবে। ওকে পাওয়ার আশা আর করি না , কিন্তু আমার ভালবাসাকে আমি কলঙ্কিত হতে দেবো না। সালমার এই কথাগুলো শুনে এবং ওর মনের জোর দেখে ওকে অবিশ্বাস করতে পারলো না রেজা। তাছাড়া এতদিনে দূর থেকে সালমা সম্পর্কে যতটুকু জেনেছে, দেখেছে ও চিনেছে এই চার পাঁচ দিনে তার ভিতটা অনেক বেশি শক্ত হয়েছে রেজার। বিশেষ করে মা এবং বোনের কাছে ওর প্রশংসা শুনে শুনে ওর সম্পর্কে ইতিবাচক ধারনাটা জোড়ালো হয়েছে। সত্যিই সালমার আচার ব্যাবহার, কথা বার্তা, চিন্তা চেতনা সব কিছু যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। উচ্চশিক্ষা গ্রহন না করেও যে স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত হওয়া যায় সালমা এই ক’দিনেই রেজার পরিবারের সবাইকে তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। রেজার মনে একটা বিশ্বাস জন্মাল, সালমা খারাপ কিছু করতে পারেনা। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এবং সেই ভুলটা সংশোধনের জন্য সালমা এবং নাজমুলকে মুখোমুখি করাটা খুবই জরুরী। রেজা ভেবেছিলো, ওদের মধ্যে বোধহয় মান অভিমানের পালা চলছে, এক সময় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঘটনা এতদূর গড়াবে কখনো ভাবেনি। রেজা সালমাকে বলল, আমি নাজমুলের গ্রামের বাড়িতে যাবো, ওকে সব বুঝিয়ে বলব। তুমি চিন্তা করনা, সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যাবে।
ঐ রাতেই রেজা নাজমুলের গ্রামের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা হয়ে পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল নাগাদ গন্তব্যে পৌঁছে গেলো। যে আশার প্রদীপ জ্বেলে রেজা নাজমুলের বাড়িতে পৌঁছল তা নিভে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। নাজমুলের বাড়ির জরাজীর্ণ ছোট্ট একটা ঘরের অবস্থা বেশ করুন। বাবা মা বয়সের ভারে যতোটা নুহ্য, কাজের ভারে তার থেকে ঢের বেশি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। সংসারে বিশ বাইশ বছর বয়সী করুন অথচ মিষ্টি চেহারার এক যুবতী এই দুই বৃদ্ধ- বৃদ্ধার সেবায় ব্যাস্ত। নাজমুলের কথা জানতে চাইলে ওর বাবা জানালো, গত চার বছর নাজমুল বাড়ি ছেড়েছে, কারো সাথে তেমন কোন যোগাযোগ নেই। ঢাকায় থেকে পড়ালেখা করে, কিন্তু কোথায় থাকে কাউকে বলে না। বাবা মা’র কোন খোঁজ তো নেয়ই না এমনকি ওর বউটার পর্যন্ত কোন খোঁজ নেয় না। ভালবেসে খালাতো বোনকে বিয়ে করেছিল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে। পড়ালেখায় খুব একটা ভালো না বিধায় মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে খালা খালুরও কোন আপত্তি ছিল না। খালুর আর্থিক আবস্থা ওদের থেকে বেশ ভালো ছিলো তাই নাজমুলের পড়ালেখার খরচ তাঁরাই দিত, এখনও দেয়। নাজমুলের যখন টাকার প্রয়োজন হয় তখনই শুধু বাড়িতে আসে, দু এক দিন থাকে। বউটাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে টাকা আনায়, হাতে টাকা পেলেই চলে যায়। বউটা ওকে খুব ভালবাসে বলেই ওর এই সব আচরন মেনে নেয়। নাজমুলের সংসারের প্রতি উদাসিনতা, দায়িত্বহীনতা ওর প্রতি অবহেলা সত্বেও মেয়েটা নাজমুলের সংসার আঁকড়ে পড়ে আছে, ওর বাবা মায়ের সেবা করছে। এমনকি নিজের বাবা মায়ের কাছে কখনো নাজমুলের সম্পর্কে খারাপ কিছুই বলেনা। ওর বাবাকে এই বৃদ্ধ বয়সেও সংসারের ঘানি টানতে পরিশ্রম করতে হচ্ছে অথচ নাজমুলের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। রেজার বুঝতে বাকি রইলো না, নাজমুল প্রচণ্ড স্বার্থপর একটা অর্থপিশাচ ছাড়া আর কিছুই নয়। নাজমুলের সম্পর্কে আর কোন কথা বলে ওর দুঃখী পরিবারের দুঃখটা না বাড়িয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করল।
ফেরার পথে ভাবতে লাগলো যাকে নিজের ছোট ভাই মনে করে আদর, স্নেহ, ভালবাসায় সিক্ত করেছে, যার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল সেই ছেলের এ কি রূপ উন্মোচিত হল রেজার কাছে! ভালোই হল, সৃষ্টিকর্তা যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। সালমা একটা বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা পড়াতে যাচ্ছিলো। একটা ধোঁকাবাজের কবল থেকে বেঁচে গেছে মেয়েটি । কিন্তু সালমাকে কিভাবে বলবে সব, কিভাবে বোঝাবে ওকে? চিন্তায় রেজা অস্থির হয়ে উঠলো। ঢাকায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো রেজার। তাই বাসায় না ফিরে সরাসরি কোচিং সেন্টারে গেলো। দেখলো অনেক লোকের সমাগম হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা গরম বিভিন্ন রকম কথাবার্তার উৎপত্তি হচ্ছে সেখান থেকে । হওয়ারই কথা, আজ সেই আকাঙ্খিত বিয়ের দিন। তাই উৎসুক জনতার উপচে পড়া ভীর। রেজাকে দেখে সবার যেন প্রতীক্ষার প্রহরের কাঊণ্ট ডাঊণ শুরু হয়। অধীর আগ্রহে সবাই জানতে চাইলো বর কনে কোথায়? রেজা সবাইকে একটু ধৈর্য ধরে ওর কথা শোনার অনুরোধ জানালো। রেজার মুখে সব শুনে এক মুহূর্ত সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হল গোলমাল। সব বানানো গল্প আপনার, নাজমুলকে আপনি নিজেই পালাতে সুযোগ করে দিয়েছেন এই বলে কিছু লোকজন চিৎকার করতে লাগলো। কেউ বলতে লাগলো, একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আমরা মেনে নেবো না। আজ রাতের মধ্যেই নাজমুলকে হাজির করতে হবে এবং ওদের বিয়ে দিতে হবে। এক মুরুব্বী বললেন, বাবা আপনাকে আমরা এত ভালো জানি ,এত সম্মান করি আর আপনি কিনা এমন একটা কাজ করতে পারলেন? আমরাতো আপনাকে বিশ্বাস করে আপনার উপরই সব ছেড়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আমাদের এভাবে ঠকাবেন তা কখনো ভাবিনি। কেউ কেউ বলতে লাগলো নাজমুলকে যদি রাতের মধ্যে খুঁজে পাওয়া না যায় তবে সালমার সমস্ত দায় দ্বায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। এবং এই কথায় অনাকাঙ্খিত অনেকেরই সমর্থন রেজার চোখে পড়ল। সালমা-নাজমুল প্রেম উপাখ্যানের মাঝে যে সূক্ষ্ম একটা রাজনীতি ঢুকে পড়েছে তা কিছুটা হলেও রেজা আঁচ করতে পারলো এতক্ষনে।
এলাকার কয়েকটি কোচিং সেন্টারের মালিক ‘সৃষ্টি’র সাফল্যে ঈর্ষান্বিত, ব্যাথিত ও মর্মাহত। পরশ্রীকাতরতায় ভুগে নিজেদের ‘সৃষ্টি’র অসম প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে দীর্ঘদিন ধরে। বিভিন্ন কুৎসা রটিয়ে নিজেদের দিকে শিক্ষার্থী ভেড়ানোর ব্যর্থ অপচেষ্টা বহুবার চালিয়েছে। তাই এমন মোক্ষম সুযোগ আর হাতছাড়া না করে এই ইস্যুকে স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার বানানোর নতুন ষড়যন্ত্রে মগ্ন হয়েছে। এই ঘটনাটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের লাভ না হোক রেজা স্যারের ইমেজের বারোটা বাজানো যায় কি না সে ধান্দায় কিছু বখাটে ছেলেকে ব্যাবহার করছে ওরা। বিভিন্ন ভাবে ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে, এমনকি বখাটে ছেলেদের আর্থিক উৎকোচ প্রদানের কথাও রেজা’র কানে এসেছে । এতদিন সেগুলোকে রেজা গুজব ভেবে পাত্তাই দেয়নি । কিন্তু আজ বিষয়টা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারলো। পরিস্থিতি এতোটাই বেসামাল হয়ে উঠলো যে নিজের ইমেজের উপরও যেন ভরসা করতে ভয় হচ্ছে রেজার। আজ এখানে হেরে যাওয়া মানে ‘সৃষ্টি’র অস্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া। তিল তিল করে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠান রেজার কাছে নিজের সন্তানের মতো। এর সাথেই জড়িয়ে আছে নিজের মান , সম্মান, অস্তিত্ব। একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে এগুলো বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকা অর্থহীন। যেভাবেই হোক পরিস্থিতি সামলাতে হবে এই চিন্তায় যেন ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলো রেজা। সমাবেশের সোরগোল ওর চেতন ফেরালো। সকলকে শান্ত হয়ে কথা শোনার অনুরোধ জানালো। এবার সবার মাঝে যেন এক বোমা বিস্ফোরণ ঘটালো রেজা। “আপনাদের কথামতো আজ থেকে সালমার সমস্ত দায় দায়িত্ব আমি নিলাম। আজ রাতেই আমি সালমাকে বিয়ে করব।” কিছুক্ষনের জন্য ‘সৃষ্টি’র সমাবেশ যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। সবাই হা করে রেজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো তারপর নিজেদের মাঝে কথোপকথন শুরু হল। সুযোগসন্ধানী ধান্দাবাজেরা পরিকল্পনা করছিলো, কোনভাবে নাজমুলকে পাওয়া না গেলে রেজার কাঁধে সালমাকে চাপানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করবে। আর যখনই রেজা রাজি হবেনা তখনই ঝামেলা পাকাবে। কিন্তু রেজার এই কথার পরে ওদের সে গুড়ে যেন বালি পড়ল। তবে রেজার কথাগুলো সবাই যেন সহজে মেনে নিতে পারছে না। রাজধানী শহরের সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরা এক প্রভাষক বিয়ে করবে অশিক্ষিত, সহায় সম্বলহীন এক গার্মেন্টস কর্মীকে ! কারো যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। কেউবা প্রশ্ন করল, আপনি ভেবে চিন্তে কথা বলছেন তো? কেউ একজন বলেই ফেললো, আপনি কি আমাদের সাথে মজা করছেন? রেজা বলল আমি কোন মজাও করছি না, আর ভেবে চিন্তেই বলছি। আপনারা বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমি যা বলেছি সব সত্যি কথা বলেছি। আজ পর্যন্ত আমার কোন কথার খেলাপ হয়নি, আজও হবেনা। একটু অপেক্ষা করুন, বলেই রেজা ক্যাশ থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে এক মুরুব্বীর হাতে দিলো। বলল, আজ আপনি আমার অভিভাবক। এখানে যত লোক আছে সবার জন্য রাতের খাবার আর মিষ্টির ব্যাবস্থা করবেন। টাকার জন্য চিন্তা করবেন না, যা প্রয়োজন আমাকে বলবেন। আমি বাসায় যাচ্ছি মা, বোন আর সালমাকে নিয়ে আসছি বলে রেজা বাসায় গেলো। তৃপ্তি সহকারে এক পেট খাওয়ার আশায় নয় বরং শেষ পর্যন্ত কি হয় তা দেখতেই সমবেত উৎসুক জনগন প্রতিক্ষায় রইলো।
রেজার বয়স ৩২ পেরিয়ে ৩৩ হতে চলেছে ।পাত্রী দেখাদেখি বহুদিন ধরে চললেও বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। অভিভাবকদের পিড়াপীড়িতে যে কটা মেয়ে দেখেছে তার একটাও মনে ধরেনি রেজার। এদের মধ্যে যে উপযুক্ত পাত্রী ছিল না তা কিন্তু নয়। আবার সব দিক মিলিয়ে নিজেও সুপাত্রের মাপকাঠিতে লেটার মার্কস পাওয়ার যোগ্য। তা সত্বেও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব বেশি ব্যাস্ততা, বিশেষ করে আর্থিকভাবে সম্পূর্ণরূপে স্বাবলম্বী হাওয়ার প্রচণ্ড স্পৃহা তার শুভ কাজে পিছু টেনেছে। আর এই পিছুটানের রশিটাকে অনেক বেশি শক্ত করেছে ছোট বোনকে উপযুক্ত পাত্রস্থ করার দায়িত্ববোধটা। আজকের পরিস্থিতিতে তার বিবেক তাকে বাধ্য করল সব পিছুটান ভুলতে। বাসায় ফিরে মা এবং বোনকে ডেকে সব খুলে বলল। রেজার মা বলল, সালমা নিঃসন্দেহে খুব ভালো মেয়ে। পুত্রবধূ হিসেবে আমাদের মেনে নিতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ও যে অন্তঃসত্ত্বা, তুই কি পারবি অন্যের সন্তানকে নিজের বলে মেনে নিতে? রেজা বলল , মা অনেক নিঃসন্তান তো অচেনা অজানা বাচ্চাকে দত্তক নিয়ে নিজের সন্তান মনে করে মানুষ করে। তাহলে আমি সালমার সন্তানকে নিজের সন্তান হিসেবে মেনে নিতে পারব না কেন? এমনও তো হতে পারে যে আমার নিজের কখনো সন্তান হলনা। রেজার কথা শুনে ওর মা, বোন আর কোন আপত্তি করল না বরং হাসিমুখে প্রস্তাব গ্রহন করল। কিন্তু এখনও যে সালমার মতামত জানা হয়নি। রেজা ওর বোনকে বলল সালমাকে ডাকতে। রেজার বোন সালমাকে ডাকতে গিয়ে দেখল রুমের ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। ডেকে ডেকে কোন সাড়া না পেয়ে রেজার বোন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যা দেখল তাতে ওর হৃদস্পন্দন থেমে যাবার উপক্রম। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো মা, ভাইয়া, সালমা আপু গলায় ফাঁস লাগাচ্ছে! সবাই দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে দরজার ছিটকিনি ভেঙে ভেতরে ঢুকল। সবে ফ্যানের সাথে ঝুলবে এমন সময় রেজা সালমাকে উদ্ধার করল। ওঁরা তিনজন যখন কথোপকথনে রত ঠিক তখন সালমা ঐ কক্ষের পাশেই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ওদের কথা শুনে ওর ধ্যান ভঙ্গ হল এবং সব শুনে দৌড়ে গিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালাল। রেজা বলল, তুমি এ কি করছ? তুমি নিজেই তো বললে মিথ্যে অপবাদ মাথায় নিয়ে তুমি মরতে চাও না। তবে আজ কেন এমন কাজ করতে যাচ্ছিলে? সালমা বলল স্যার, এতদিনে যা কিছু হয়েছে তা সব মেনে নিয়েছি। আজ আপনাদের কথা সব শুনেছি। নাজমুল আমার সাথে প্রতারনা করে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে পালিয়েছে তাও মেনে নিয়েছি। নিজের সব কষ্ট আমি সইতে রাজি আছি। কিন্তু আমার জন্য আপনি শাস্তি ভোগ করবেন, এ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আপনার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আমি নষ্ট করতে চাই না। আমি কোনভাবেই আপনার যোগ্য নই, সমাজে আমার পরিচয় দেবার মতো কিছুই নেই। আমাকে বিয়ে করলে আত্মীয় স্বজনের কাছে আপনি মুখ দেখাতে পারবেন না, সমাজে আপনার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। সারাটা জীবন আমি আপনার কাঁধে বোঝা হয়েই থাকবো, আমাকে নিয়ে আপনি সুখী হবেন না। তার চেয়ে আমাকে ছেড়ে দিন , আমি এখান থেকে পালিয়ে যাই। আপনি পরে আপনার পছন্দমতো যোগ্য পাত্রী খুঁজে বিয়ে করবেন। রেজা বলল, তুমি যোগ্য কি যোগ্য নও সে কথা আমি জানি। এখন এতসব বলার সময় নেই তুমি শুধু বল, আমার মঙ্গল চাও কি না? যদি তাই চাও তাহলে নিজেকে বাঁচাতে, আমার মান সম্মান বাঁচাতে আমার জীবনে তোমাকে প্রয়োজন। অন্তত এই কথা মেনে নিয়ে তুমি রাজি হও। অবশ্য আমাকে যদি তোমার পছন্দ না হয় তাহলে ভিন্ন কথা, সেক্ষেত্রে আমি তোমায় বাধ্য করবোনা। সালমা বলল স্যার, এমন করে বলবেন না। আপনাকে অপছন্দ করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। তার থেকে বড় কথা আমার এমন কোন যোগ্যতা নেই যার কাছে আপনার কোন দিক ছোট হয় কিন্তু স্যার...। রেজা বলল কোন কিন্তু নয়, আর এখন থেকে স্যার নয় রেজা বলে ডাকবে। ভালোবেসে বিয়ে করতে পারলে না তাতে কি হয়েছে? এবার দেখ, বিয়ে করে ভালোবাসতে পার কিনা। তৈরি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি, সবাই অপেক্ষা করে আছে। রেজা ওর বোন এবং মাকে বলল সালমাকে সাজিয়ে নিজেদেরও ব্যাস্ত হয়ে তৈরি হয়ে নিতে। সালমার চোখ দিয়ে নীরবে টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো। রেজার মা বলল, এমন শুভ দিনে চোখের জল ফেলতে নেই মা। সালমা রেজার মাকে জড়িয়ে ধরে অবুঝ শিশুর মতো কাঁদতে লাগলো। কারো বুঝতে বেগ পেতে হল না যে এ কোন হারানোর দুঃখ কিংবা কষ্টের কান্না নয়। এ আনন্দ অশ্রু অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। রেজার মা নিজের শাড়ি গহনা দিয়ে সালমাকে সাজালেন। রেজা কিন্তু একেবারেই সাদামাটা পোশাকে তৈরি হল। রাত এগারোটা নাগাদ ওঁরা চারজন গিয়ে পৌঁছল ‘সৃষ্টি’ কোচিং সেন্টারে। উৎসুক সমাবেশের অধীর আগ্রহের যেন নিবৃত্তি নেই বিয়েটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। নির্বিঘ্নে শুভকাজ সুসম্পন্ন হলে প্রথমে মিষ্টিমুখ ও পরে সকলে ভুরিভোজ শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে যার যার গন্তব্যে চলে গেলো। ঝামেলা পাকাতে যারা এসেছিলো তাঁদের উদরপূর্তির সান্ত্বনা নিয়ে ক্ষান্ত দিতে হল।
যা কিছু হয়ে গেলো সব বিধিলিপি হিসেবে শুধু মেনেই নয় বরং আন্তরিকভাবে তা রেজা মনেও নিলো। পাত্রী হিসেবে রেজার পছন্দের গুণাবলীর প্রায় সবকিছুই সালমার মাঝে আছে। হয়তো পরিচয় দেবার মতো পারিবারিক বা বংশীয় মর্যাদা সালমার নেই । কিন্তু শ্বশুরের বংশীয় মর্যাদায় গর্ববোধ করার মতো রক্ষণশীলতা রেজার ধাঁচে কখনো ছিল না। আর প্রাতিষ্ঠানিক সনদ না থাকলেও সালমার মাঝে যে আলো ও দেখতে পেয়েছে জীবন ,সংসার আলোকিত করতে তার শিখাই যে যথেষ্ট এ বিষয়ে রেজার বিশ্বাস ইতিমধ্যেই পোক্ত হয়েছে। আর সালমা ও যা হারিয়েছে তার ঢের বেশি পেয়েছে । নাজমুলের প্রতারনার আঘাতের ক্ষত রেজার কাছ থেকে প্রাপ্তির আবরনে ঢাকা পরে গেছে , হয়তো একদিন তা শুকিয়েও যাবে। কিন্তু যা পেয়েছে তা কি সালমা ধরে রাখতে পারবে? আর ধরে রাখতে পারলেও সঠিক মর্যাদা কি ও দিতে পারবে? ও কি আসলেই রেজার যোগ্য? যা কিছু হয়েছে তা কি ঠিক হয়েছে? এ সব কিছুর জন্য ও নিজেই কি দ্বায়ি নয়? এই সব চিন্তায় মগ্ন থেকে, সারাক্ষন এক অপরাধ বোধে ভুগে সালমা যেন গুটিয়ে যেতে লাগলো। প্রচণ্ড মানসিক চাপে নিজের স্বাভাবিকতা হারাতে বসলো। তবে এর কিছুই রেজার চোখ এড়ায়নি। সব বুঝতেও তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি রেজাকে। খুব শীঘ্রই নিজের আন্তরিক প্রচেষ্টায়, মা ও বোনের সহযোগিতায় সালমার স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হল রেজা। সালমার প্রানচাঞ্চল্যে পুরো সংসারে যেন নতুন ফাগুন এলো। সালমাও সংসারের সবার সেবায় নিয়োজিত হয়ে তার সেই মাদার তেরেসা রূপ ফিরে পেতে শুরু করেছে। কিন্তু সবাই যেন সালমাকে নিয়ে মহাব্যাস্ত। ওর যাতে পরিশ্রম না হয়, ঠিকমতো খাওয়া ঘুম হয় কি না এ বিষয়ে পরিবারের সবাই খুব সচেতন। বিশেষ করে খাবারের ব্যাপারে রেজার অতি সচেতনতা চোখে পড়ার মতো। প্রতিদিনই বাসায় ফেরার সময় হাতে করে কোন না কোন ফল আনবেই। শুধু এনেই শেষ নয়, ঠিকমতো সেগুলোর সদ্ব্যবহার না হওয়া পর্যন্ত খবরদারির শেষ হয়না। এ সময়ে নাকি সালমার জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতা অতীব জরুরী। সুখের অসুখে অতিষ্ঠ সালমা মাঝে মাঝে যেমন বিব্রত হয় তেমন দুশ্চিন্তাও ওকে ভাবায়। এত সুখ চিরদিন ওর জীবনে রবে তো? সব সত্যি বহি স্বপ্ন নয়তো? স্ত্রীর প্রতি রেজার দ্বায়িত্ব কর্তব্যে এতটুকু ঘাটতি নেই বরঞ্চ প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই আছে। অথচ সালমার কাছে তার যেন কোন চাওয়াই নেই। রেজার আচরনে মনে হয় স্ত্রীর জন্য কিছু করতে পারলে তাতেই ওর তৃপ্তি। সালমা মাঝে মাঝে আবেগ সামলে রাখতে ব্যর্থ হয়ে সবার অগোচরে চোখের জল ফেলে। যতই দিন যায় রেজার প্রতি সালমার শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আকর্ষণ বেড়েই চলে। কিন্তু প্রকাশে কোথায় যেন এক বাঁধা। সবার সাথে খুব স্বাভাবিক হলেও রেজার কাছেই ওর যত জড়তা। বিয়ের ২ মাস অতিক্রম করার পরও সালমা রেজাকে ডাকার সম্বোধনটা স্থির করে উঠতে পারেনি। রেজার অনেক অনুরোধের পরে তৃতীয় মাসে সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে অবনীত হলেও জড়তা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাইতো না চাইতেই অনেক বেশি পাওয়া সত্ত্বেও রেজার সাথে স্ত্রী হিসেবে স্বাভাবিক হতে পারছে না। বরং নিজেকে রেজার সেবাদাসী ভাবতেই যেন ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মাঝে মধ্যে রেজার সেবা করার সুযোগ পেলে হয়তো কিছুটা স্বাভাবিকতা আসতো। কিন্তু সে সুযোগই তো পায় না ও। আর তাই বিয়ে পরবর্তী চারমাস এক বিছানায় থেকেও ওদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা তাত্ত্বিকই রয়ে গেছে। রেজার এ নিয়ে এতটুকু অতৃপ্তি নেই বরং নতুন কিছু প্রাপ্তির আশায় যেন সর্বদা উৎফুল্ল থাকে।
এতদিন ধরে যা নিয়ে পরিবারের সবাই খুব মাতামাতি করেছে ইদানিং যেন সেই বিষয়টি সবাইকে কিছুটা ভাবাচ্ছে। বিশেষ করে রেজার মা বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে ভাবছেন। প্রথমদিন দেখেই সালমাকে অন্তঃসত্ত্বা মনে হয়েছিলো, কিন্তু আজ তিনি সন্দিহান। কারন এতদিনে সালমার শরীরে খুব সামান্য পরিবর্তন এসেছে যা প্রায় সেই চার মাস পূর্বের অবস্থা । মা ও ছেলের মাঝে জরুরী বৈঠক শেষে মা নিজ দ্বায়িত্ত্বে সালমার সাথে এ বিষয়ে আন্তরিক আলোচনায় বসলেন। আন্তরিকতা আর তাকে নিয়ে শাশুড়ির এতোটা উদ্বেগ দেখে সালমা যেন তার ছোটবেলার মাকে ফিরে পেলো। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলল মা, আপনারা কেউই আমার কথা বিশ্বাস করেননি। তাই এ নিয়ে আমি আর কথা বাড়াইনি। আজও বলছি, আমার এমন কিছু হয়নি যেমনটা আপনারা সবাই ভাবছেন। তবে আমার নিজের শারীরিক পরিবর্তনে আমি নিজেও অবাক। কেন এমনটা হল তা নিজেও বুঝে পাচ্ছি না। তবে মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ব্যাথা হয় তলপেটে। প্রথমত ভেবেছি এটা মেয়েদের জন্য স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু কিছুদিন যাবত বুঝতে পারছি এটা কোন স্বাভাবিক সমস্যা না। কিভাবে কার কাছে বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আপনার কাছে বলতেও সংকোচ হচ্ছিলো, না জানি আমাকে আবার ভুল বোঝেন। সব শুনে রেজা এবং রেজার মা যেন দ্বিধা দ্বন্দের এক দোলাচলে দুলতে লাগলো , কোনটা সত্যি চাক্ষুষ প্রমাণ নাকি মুখের কথা? সত্যিটা যাই হোক সালমার কোন ক্ষতি না হয় তাই যত শীঘ্র সম্ভব ওর পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হবে। পরদিন কলেজ থেকে ফিরে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে এই সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু পরদিন পূর্বাহ্ণেই কলেজে ফোন এলো রেজার বাসা থেকে। ওর বোন বলল, ভাইয়া তাড়াতাড়ি বাসায় এসো, ভাবী অসুস্থ, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। রেজা ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে সালমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলো। ডাক্তারী পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে যা জানা গেলো তাতে করে সবার তো আক্কেলগুড়ুম। সালমা অন্তঃসত্ত্বা নয়, ওর পেটে বিশাল আকৃতির এক টিউমার ! ডাক্তার বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করতে হবে নতুবা ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই অস্ত্রপাচার নিয়ে রেজা যেমন চিন্তিত পাশাপাশি সালমার সুস্থতা কামনায় বেশ উদ্বিগ্নও। ঝুঁকি যখন নিতেই হবে, অপেক্ষা না করে আজই অপারেশন করাতে হবে সিদ্ধান্ত হল। চরম উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে ডাক্তার সফল অস্ত্রপাচারের সুসংবাদ দিলে তবেই রেজার মা, বোন এবং রেজার শরীরে প্রান ফিরল। সুস্থ হয়ে সালমা যখন বাসায় ফিরল ততদিনে বাকি তিনজনেরই বেহাল দশা। হাসপাতালে সালমার সেবা যত্ন করতে গিয়ে খাওয়া ঘুম সবকিছুতে অনিয়ম করে করে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে গেছে। তারপরও তাদের যেন এতটুকু ক্লান্তি নেই। বরং এতদিন সালমাকে নিয়ে যে ভুল ধারনা পোষণ করেছে তার জন্য সবাই খুব বেশি অনুতপ্ত। আর প্রায় তিন কিলোগ্রাম ওজনের টিউমার অপসারনের ফলে সালমা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভারমুক্ত হল ঠিকই। কিন্তু সংসারের সবাইকে স্বভাবিক করার ভার নিজের মাথায়ই নিতে হল। শাশুড়ি এবং ননদকে সহজ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি সালমার। ভ্রান্তিবিলাসের শুভ সমাপ্তি অনুষ্ঠান কখন হবে তাঁরা দু’জন এখন সেই পরিকল্পনায় ব্যাস্ত। গণ্ডগোলে প্যাচ লেগে গেলো সেই রেজার কাছে গিয়ে। “আমাদের জীবন থেকে মুল্যবান যে চারটি মাস হারিয়ে গেলো, তার কি হবে?” রেজার এমন প্রশ্নে সালমার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে এলো। রেজার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে শুধু বলল, জানিনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:৩৪