নবমীর রাতে ঝুম বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে ঘরে ঢুকেই " মা, তাড়াতাড়ি একটা গামছা কিংবা তোয়ালে দাও।" বলেই স্বপ্ননীল মাকে চমকে দিলো। সত্যিই শুধু মা নয় বাড়ির সবাই ওর এই আগমনে বেশ চমকে গেলো। কেননা মাত্র একদিন ছুটি থাকায় স্বপ্ননীলের এবার পুজায় বাড়িতে আসার কথা নয়। বাবা জিগ্যেস করল, "কিরে তুই এই আবহাওয়ায় এত রাতে কোত্থেকে এলি? আর আসবি যদি আগে থেকে ফোন করে এলিনা কেন? গত পরশুদিন যখন তোর সাথে কথা হল তখনো বললি না তো যে বাড়িতে আসবি। আর কাল থেকে তোর সেলফোন বন্ধ কেন? " বাবা, হঠাৎ করেই গতকাল অফিসের কাজে আমাকে ঢাকা থেকে খুলনা যেতে হল। গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে জানালার পাশে বসে কথা বলছিলাম ফোনে। ঠিক সেই মুহূর্তে এক ছেলে চিলের মত ছো মেরে সেলফোনটি নিয়ে দৌড়ে পালালো। তাই ফোন করতে পারিনি, তাছাড়া খুব কাজের ব্যাস্ততা থাকায় বাইরে থেকে কল করার সময় হয়নি। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় ভাবলাম বাড়ি হয়ে তারপর ঢাকায় ফিরবো। প্রয়োজনে একদিন ছুটি নিয়ে নেবো। বাড়ির এত কাছে এসেও দশমীর দিনে বাড়ি থাকবো না তা হয় কি করে। মায়ের হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে উত্তর দিলো স্বপ্ননীল। বাবা মাকে বলল "ওকে তাড়াতাড়ি খাবার দাও। আমি ওর ভেজা জামা কাপড়গুলো সব শুকোতে দিচ্ছি।" ভেজা ব্যাগের ভেতর থেকে সমস্ত ভেজা কাপড় চোপড় বের করতে গিয়ে একটা প্যাকেটে নতুন একটা লুঙ্গি দেখে বাবা স্বপ্ননীলকে বললেন তোর তো কয়েকটা লুঙ্গি বাড়িতে আছে। তাছাড়া বাড়িতে আসবি না বলে সবার জন্য নতুন পোশাক আগেই শুভ’র কাছে পাঠিয়ে দিলি। তবে এই লুঙ্গি আবার কার জন্য? বাবা, ফাজিল ভাইয়ের জন্য এনেছি। ঈদের সময় দেখে গেছি পুরনো মলিন একটা লুঙ্গি পরে নামাজ পড়তে যেতে। স্বপ্ননীলের পুলকিত এই উত্তর শুনে বাবা মা দুজনই যেন নির্বাক হয়ে গেলেন। এক অদৃশ্য কালো মেঘ যেন তাঁদের মুখে ছায়া ফেলল। বাবা বললেন, " স্বপ্ন, তোর ফাজিল ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। গতকাল তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। " স্বপ্ননীলের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। ফাজিল ভাইয়ের মৃত্যুর কারন সম্পর্কে শুনতে শুনতে চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে খাবারের প্লেটে পড়তে লাগলো। বাবা মায়ের শত অনুরোধেও আর এক গ্রাস খাবার ওর মুখে উঠলো না। প্লেটে জল ঢেলে দিয়ে উঠে গেলো। ওই রাতে বাবা মায়ের সাথে আর তেমন কোন কথা বলতে পারেনি ও। বিছানায় শুয়ে আজন্ম শত্রু এই ফাজিল ভাইয়ের চলে যাওয়াকে যতই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে পুরনো স্মৃতিগুলো ততোই ভারী হয়ে ওর বুকে চেপে বসছে।
কোন কালে , কোন মাহেন্দ্রক্ষণে এই দুই অসম ব্যাক্তির শত্রুতার শুরু তা ঠিক স্বপ্ননীলের মনে নেই। তবে ছোটবেলায় ওর কখনো কখনো মনে হত ফাজিল ভাই বুঝি তার পূর্বজন্মের শত্রু। কেননা ছোটবেলা থেকেই ফাজিল ভাই ওকে নীলাচোরা বলে ডাকতো। আর প্রতিশোধ নিতে সেও প্রবীন প্রতিবেশি ফাইজুল ইসলাম কে ফাজিল ভাই বলেই সম্বোধন করত। একটু বড় হয়ে যখন ও বলত ভাই, তুমি আমাকে হয় নীল বলে ডাকবে নতুবা স্বপ্ন বলে ডাকবে। ফাজিল ভাই বলতো, আচ্ছা তোকে স্বপ্ন বলে ডাকবো কিন্তু নীলের পরিবর্তে তোর দোষ গুন কিছু যোগ করে। তাঁর দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে স্বপ্নও বলতো আচ্ছা, তোমার নামটা তাহলে ফাজিল থেকে আর ভদ্রে আনতে পারলাম না।
ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দুটো পরিবার বহুদিন ধরে মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে অন্তরে লালন করে। প্রতিবেশি হিসেবে ছোটখাটো বাগ বিতণ্ডা কখনো যে হয়নি তা নয়, তবে পারস্পরিক আন্তরিকতার ঘাটতি এই দুই পরিবারের কখনোই ছিলোনা। বিরোধ যত সব এই অসম বয়সী দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর (প্রতিবেশি সম্পর্কে দাদা-নাতি) । বাবা কাকা সম্বোধন করেন তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে ফাজিল ভাই সম্বোধন করে স্বপ্ন। না হলে হয়তো শুধু ফাজিল বলেই ডাকতো। বাবা আবশ্য বলেছিলেন দাদাভাই বলে ডাকতে, কে শোনে কার কথা। এক সময় দুজনই দুজনের দেয়া এই ডাকনাম মেনে নিয়েছিলো , তবে কখনোই মনে নয়। ফাইজুল ইসলাম পেশায় একজন মুদি দোকানদার। নিজ বাড়ির সামনে রাস্তার পাশেই তাঁর দোকান। তাঁর দোকানকে শুধু মুদি দোকান না বলে চায়ের দোকান কাম মুদি দোকান বলা চলে। বাজার কাছে হওয়ায় নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য কেনার জন্য প্রতিবেশীরা তাঁর দোকানে কদাচিৎ যায়। তবে সকাল সন্ধ্যায় একটা বিশেষ গোষ্ঠীর বেশ সমাগম হয় তাঁর বানানো চায়ের কাপে চুমুক দিতে। তাঁর চায়ের বিশেষ একটা আকর্ষণ আছে মানতেই হবে। তা না হলে তাঁর বাজে, কসাইসুলভ ব্যবহারের কারনে যারা তাঁকে এড়িয়ে চলে তাঁরাও মাঝে মধ্যে সব ভুলে তাঁর চায়ের স্বাদ নিতে বসে পড়ে তাঁর দোকানের সামনের বেঞ্চিতে। তাঁর এই দোকানদারির পাশাপাশি আরও একটা পেশা আছে ,আর তা হল গবাদি পশুর খোয়ার ইজারা নেওয়া। এলাকার লোকজনের গরু ছাগল অন্যের ফসলের অনিষ্ট করলে তাঁরা ওই গবাদি পশু ধরে এনে এই ফাইজুল ইসলামের খোয়ারে পুরে দেয়। ফাইজুল ইসলাম ওই পশু আটকে রেখে লালন পালন করে ছাড়িয়ে না নেওয়া পর্যন্ত। গবাদি পশুর মালিক এসে ফসলের মালিকের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয় আর খোয়ারের ইজারাদারকে লালন পালনের চার্জ বাবদ কালক্ষেপণ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট হারে একটা টাকা দিয়ে তাঁর পশু ছাড়িয়ে নেয়। কিন্তু ফাইজুল ইসলাম কি দিয়ে যে গবাদি পশুর লালন পালন করে তা আজ পর্যন্ত কারো বোধগম্য নয়। কেননা তাঁর বাড়িতে গবাদি পশুর খাবার বলতে তেমন কিছু কেউ কখনো দেখেছে বলে জানা নেই। আবার প্রকৃতপক্ষে আজ অবধি কোন ফসলের মালিক তাঁর ক্ষতিপূরণবাবদ কিছু পেয়েছে কিনা তাও সন্দেহ। কিন্তু অর্ধেক দিন কিংবা দেড় দিন পশু আটকে রেখে পুরো একদিন বা দুই দিনের বাবদ পশুর মালিকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। আর এই নিয়ে শুরু হয় ত্রিমুখী বিতণ্ডা। এমন কোন দিন নেই যেদিন কারো না কারো সাথে ফাইজুল ইসলামের ঝগড়া না হয়। এভাবেই পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি। অগোচরে স্বপ্ননীলের মত বেশির ভাগ লোকই তাঁকে ফাজিল নামে ডাকে। স্বপ্ননীল অবশ্য ছোট বেলা থেকেই একটু বেশি দুরন্ত ডানপিটে। কেউ তাকে ঘাটালে তাকে সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র সে নয়। আর তাই শুধু ফাজিল নামে ডেকেই যেন তার খেদ মেটে না। ফাজিল ভাইয়ের প্রাপ্য আরো একটু বেশি মনে করেই তাঁর খোয়ারে আসা গরু ছাগলের মালিকদের সাথে আঁতাত করে সেগুলোকে লুকিয়ে মুক্ত করে দেবার পায়তারা প্রায়ই করে সে। আর সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগায়। এসব কার কাজ ফাইজুল ইসলাম তা বুঝতে পারলেও হাতেনাতে আজ পর্যন্ত ধরতে পারেনি, তাই কিছু বলতেও পারেনি। তাছাড়া এই গ্রামের একমাত্র স্বপ্ন’র পরিবারের সাথেই ওঁর সুসম্পর্ক। একমাত্র স্বপ্ন’র বাবার কথাই বোধ হয় ফাইজুল ইসলাম মন দিয়ে শোনে এবং মানে। কিন্তু মুখে এই দাদা নাতির মধুর সম্পর্ক থাকলেও অন্তরে যে শত্রুতা তাঁকে পরস্পরের জন্য মিছরির ছুরি বলা যায়। সুযোগ পেলে কেউ কাউকে ছেড়ে তো দেয়ই না বরং তার সদব্যাবহার করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। যে যেভাবে পারে অগোচরে অন্যজনকে চাটি মারার চেষ্টায় মগ্ন। পড়ালেখার থেকে স্বপ্ন’র এসবের দিকেই ঝোঁক বেশি। আর তার এইসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সহকারীর ভূমিকায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হত বন্ধু দীপন। কিন্তু বেশ কদিন ধরে দীপনকে ও সাথে পাচ্ছে না, কারন ওর বাবা ওকে স্কুল থেকে ফেরার পর বাড়ির বাইরে বের হতে দিচ্ছে না। বিশেষ করে স্বপ্ন’র সাথে মেশা একদম বন্ধ করে দিয়েছেন। বিশ্বস্ত সুত্রে জেনেছে , এ নাকি ফাজিল ভাইয়ের ষড়যন্ত্র। দীপনদের বাড়ির পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করে কোন ফল না পেয়ে বাধ্য হয়ে একদিন রাস্তায় দাড়িয়ে দীপনকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো। কিছুক্ষন পরে দীপনের পরিবর্তে ওর বাবাকে বেড়িয়ে আসতে দেখে ওর মনে একটু সন্দেহ হল। একটা হাত পেছনে দেখে সন্দেহটা আরও ঘনীভুত হল। ভাল করে তাকিয়ে দেখল পেছনে রাখা হাতে একটা লাঠি। স্বপ্ন’র বুঝতে বাকি রইলো না যে তার জন্য বাঁশ ভোগের ব্যাবস্থা হচ্ছে। কিন্তু এই ভরা পেটে এ সইবে না, তাই যথাসময়ে কেটে পরা উচিৎ মনে করে নাগালের বাইরে থাকতেই দে দৌড়। এক দৌড়ে সেই ফাজিল ভাইয়ের দোকান। ওকে হাঁপাতে দেখে ফাজিল ভাই বলল, কিরে নীলাচোরা, কি খবর? পাগলে তাড়া করেছে বুঝি? স্বপ্নও উত্তর দিল, পাগলে না , পাগলা কুত্তায় তাড়া করেছে। এই নে পানি খা বলে ফাজিল ভাই ওর দিকে একটি গ্লাস এগিয়ে দিলো। স্বপ্ন মুখে বলল লাগবে না আর মনে বলল শালা, দীপনের বাবার কান ভারি করেছ তুমি আর এখন আবার আমার সাথে মস্করা করছ? কিছুটা দূরে গিয়ে বলল দাড়াও, তোমার শালা মরন ঘনিয়ে এসেছে। কথাটা ফাজিল ভাই না শুনলেও একটি ছেলে শুনে ফাজিল ভাইয়ের কাছে গিয়ে ঠিকই বলে দিলো। সাথে সাথে ফাজিল ভাইয়েরও মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসলো। কিছুক্ষন পরে স্বপ্ন যখন আবার তাঁর দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখন দোকানের সামনে দাড়িয়ে ছিল একটা কুকুর। স্বপ্ন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফাজিল ভাই দোকানের ঝাপের একটা লাঠি কুকুরটার দিকে এমনভাবে ছুড়ে দিলো যাতে করে কুকুর এবং স্বপ্ন উভয়ই আহত হয়। ভাগ্যক্রমে স্বপ্ন লাফিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হল। ও কিছু বলার আগেই ফাজিল ভাই বলল, কুকুরটা প্রতিদিন দোকানের আটা খেয়ে যায় তাই ওকে উচিৎ শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাই, তুই এসে পড়েছিস আমি তা দেখতে পাইনি। স্বপ্ন’র বুঝতে বাকি রইলো না আসলে ফাজিল ভাইয়ের উদ্দেশ্য কি ছিলো ।
পরদিনই প্রতিশোধের নেশা চাপল স্বপ্ন'র মাথায়, সুযোগও পেয়ে গেলো। প্রতিবেশির বাড়িতে লাগানো গাছের চারা খাচ্ছিল দীপনদের একটা গরুর বাচ্চা। স্বপ্ন তা দেখতে পেয়ে প্রতিবেশিকে ডেকে জানালো। প্রতিবেশি গরুর বাচ্চাটাকে ধরে ফাইজুল ইসলামের খোয়ারে পুরে দিলো। কিছুক্ষণ পরে স্বপ্ন পূর্বানুরূপ সুযোগ খুজে বাচ্চাটাকে খোয়ারের বাইরে আনল এবং তাঁর লেজে একটা কলার শুকনো পাতা (গ্রাম্য ভাষায় যাকে বলে কলার ফ্যাতরা ) বেঁধে দিলো। এরপর শুকনো পাতাটা একটু নাড়াচাড়া দিয়ে ছেড়ে দিতেই গরুর বাচ্চাটা দিলো দৌড়। বাচ্চাটা দৌড়ায় আর ওর পেছনের পায়ে এবং মাটিতে শুকনো কলার পাতা লেগে শব্দ হয়। পেছনে কেউ তাড়া করছে ভেবে বাচ্চাটা আরো জোড়ে দৌড়ায় । এই সুকর্ম করেই ও দীপনের বাবার কাছে গিয়ে বলল কাকা, আপনাদের গরুর বাচ্চাটা সজীবদের গাছের চারা খেয়ে ফেলেছে তাই বাচ্চাটাকে ওর বাবা ফাজিল ভাইয়ের খোয়ারে পুরে দিয়েছে। কিছুক্ষন পরে দিগ্বিদিক ছুটতে ছুটতে গরুর বাচ্চাটা হয়রান হয়ে যখন দীপনের বাবার সামনে পড়ল তখন ওর করুন অবস্থা দেখে মাথায় খুন চেপে গেলো। রেগে মেগে গিয়ে শুরু করলেন ফাইজুল ইসলামকে যাচ্ছে তাই বকা ঝকা। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও কিছুক্ষনের মধ্যে পুরো ব্যাপারটা ফাইজুল ইসলাম বুঝে নিলো স্বপ্নকে দূরে দাড়িয়ে মুচকি হাসতে দেখে। কিন্তু দীপনের বাবাকে সমস্ত ঘটনা বুঝিয়ে শান্ত করতে বেশ বেগ পেতে হল তাঁকে। স্বপ্ন বেশ একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ফাজিল ভাইয়ের সামনে থেকে প্রস্থান করল। ফাজিল মিয়া এর বদলা নিতে নতুন ফন্দি আঁটতে লাগলো।
ফাজিল মিয়া একদিন দীপনকে ডেকে বলল, নিলাচোরা কাল তোদের রসের ঠিলায় প্রস্রাব করছিলো আমি দেখতে পেয়ে বললাম করিস কি? অমনি ও আমার হাত ধরে তোদের কাছে না বলার জন্য অনুরধ করল। ভেবেছিলাম তোকে বললে এ নিয়ে একটা বিবাদ হবে, তোদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে, তারচেয়ে থাক। কিন্তু সেদিন তোর বাবাকে ভুল বুঝিয়ে আমাদের মাঝে বিবাদ বাধাল, তাই না বলে পারলাম না। প্রস্রাব মেশানো রসে তৈরি গুর খাওয়ার কথা মনে করে দীপনের গা গুলিয়ে উঠলো । মনে হলো তখনই বমি হয়ে যায়। সাময়িকের জন্য স্বপ্ন’র সাথে ওর বন্ধুত্ব ভুলে গেলো। তৎক্ষণাৎ বাড়িতে ছুটে গিয়ে প্রথমে গতকালের তৈরি গুর পুকুরে ফেলল তারপর বাবা যখন কারন জানতে চাইলো তখন বাবার কাছে সব খুলে বলল। এমনিতে স্বপ্ন’র দুষ্টুমিতে অস্থির তারপর আবার এমন সংবাদে দীপনের বাবা তখন অগ্নিশর্মা। সাথে সাথেই গেলেন স্বপ্ন’র বাবার কাছে বিচার চাইতে। সব শুনে স্বপ্ন’র বাবা একটু মুচকি হাসছেন দেখে দীপনের বাবা তো আরও রেগে গেলেন। এমন একটা ঘটনা শুনেও তুমি হাসছ? স্বপ্ন’র বাবা বললেন, দাদা, স্বপ্ন তো বাড়িতে নেই । চার দিন হল ওর মামাবাড়িতে গেছে , আজ আসার কথা। কি করে কাল তোমার ঠিলায় ও প্রস্রাব করল? দাদা নাতির এই মধুর শত্রুতার বলি শেষ পর্যন্ত তুমিও? স্বপ্নদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা ফাজিল মিয়ার চায়ের দোকান গিয়ে বলল চাচা, সত্যি তুমি একটা আস্ত ফাজিল। তা না হলে এমন মিথ্যে বলে আমার গতকালের গুঁড়টুকু জলে দিলে? বকা খেয়ে ফাজিল মিয়া বুঝতে পারলো, কূটনৈতিক চালে একটু ভুল হয়ে গেছে। মামাবাড়ি থেকে ফিরে মায়ের কাছে সব শুনে স্বপ্ন তো মহা খুশি। মা বলল নিজের ফাঁদে নিজেই আটকে গেলো। এখন তুই যেন নতুন করে আবার কিছু করতে যাস না। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।
স্বপ্ন’র ছোট কাকা স্বপরিবারে শ্বশুর বাড়িতে গেছেন তাঁর ঘরের দায়িত্ব স্বপ্ন আর তার পিসতুতো দাদা রিপনকে বুঝিয়ে দিয়ে। নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে আরও দুজনকে নিমন্ত্রন করলো । রাতে ফাজিল ভাইয়ের সব খেজুর গাছের রস এনে তা দিয়ে পায়েস রান্না করে চারজনে মিলে পেট পুরে খেলো, সকালে ফাজিল ভাইকেও খাওয়ালো । পরের রাতে আবার একই কাজ। ফাজিল মিয়ার বুঝতে বাকি রইলো না দু,দিন রস কম হবার কারন। তৃতীয় রাতে চার বাঁদর সিদ্ধান্ত নিলো, আজ আর পায়েস খাবে না, আজ রস জাল দিয়ে দুধ আর হরলিক্স মিশিয়ে খাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে জ্বালিয়েও রস যেন আজ গাঢ় হচ্ছেনা, রঙও পরিবর্তন হচ্ছেনা তাই রসের বিষয়ে অভিজ্ঞ রিপনকে রস চেখে দেখতে বলা হল। গ্লাসে করে চুমুক দিয়ে রিপন প্রথমত একটু থমকে গেলো তারপর কিছুটা সময় নিয়ে বলল, ওয়াও! আজকের রসটা যা হয়েছে না,অসাধারন! সম্ভবত ঠাণ্ডা বেশি পড়ার কারনে আজ রস ভাল হয়েছে। এই শুনে লোভ সামলাতে না পেরে বাকিরাও গ্লাস পুরে রস নিলো আস্বাদনের জন্য। মজা করে চিয়ার্স বলে একত্রে সবাই রসে চুমুক দিলো। রস বিশারদ সবার সাথে শুধু গ্লাসে মুখ লাগানোর ভনিতা করল কিন্তু রস আর মুখে নিলো না। চুমুক দিয়ে তিনজনই ওয়াক থু করে রস ফেলে দিলো। স্বপ্ন তো বমিই করে দিলো। সবাই বুঝল রস বিশারদ রিপন নিজে খেয়ে ঠকেছে তাই বাকি সবাইকে রস খাইয়ে নিজের দলে ভিড়িয়েছে। পর দিন সকালে ফাজিল ভাইয়ের দোকানে চারজনই একত্রে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ফাজিল ভাইয়ের গত রাতের কাহিনী শুনছে। ফাজিল ভাই বলছে, “কয়েকদিন ধরে আমার গাছের রস চুরি যায়। গত রাতে শালা চোরদের উচিৎ শিক্ষা দিয়েছি, মাঝ রাতেই সব গাছের রস নামিয়ে প্রত্যেক ঠিলায় গরুর চোনা দিয়ে রেখেছি।” চার জনই এক সাথে চা শেষ না করেই ওয়াক ওয়াক করতে করতে উঠে গেলো । পেছন থেকে ফাজিল ভাই হাসতে হাসতে বলল চায়ের দামটা তো দিয়ে যা। স্বপ্ন বলল তোমার কবরে দিয়ে আসবো। স্বপ্ন একা এই ঘটনার স্বীকার হলে তা মেনে নিতে পারতো কি না তা ভেবে দেখার বিষয়। কিন্তু চারজনের এই অপমান কিভাবে স্বপ্ন একা হজম করে? আবার নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করতে লাগলো। কাকা এখনও বাড়িতে ফেরেনি তাই দুপুরেই সিদ্ধান্ত হল আজ রাতে পিকনিক খাবে। সংখ্যায় আজ একজন বেড়ে পাঁচজন হল। দীপনকে ওরা সাথে নিলো। স্বপ্ন বিকেলে ফাজিল ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলল ভাই, তোমার বাড়িতে দেখলাম বড় একটা তেলতেলে মোরগ নায়কের মত গলা উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওইটা আমাদের দাও, আমরা পিকনিক করব। ফাজিল ভাই বললেন ২০০ টাকা দাম দিতে হবে, তবেই পাবি। কি বল ভাই, এই মোরগের ২০০ টাকা দাম? ৫০ টাকা পাবে, দিয়ে দাও। ফাজিল ভাই বলল এক কাজ কর টাকাই লাগবে না, দীপনদের খামার থেকে মোরগ চুরি কর। আমিও তোদের সাথে খাবো রাতে। কিন্তু সে জানেনা যে দীপনও আজ ওদের সঙ্গী। স্বপ্ন বলল তাইতো ভাল বুদ্ধি দিয়েছ, রাতে আমাদের সাথে সত্যি খাবে কিন্তু। গভীর রাতে পাঁচ নিশাচরের রান্না বাড়া শেষে স্বপ্ন যখন ফাজিল ভাইকে খেতে ডাকতে গেলো তিনি তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। কিন্তু স্বপ্ন নাছোড়বান্দা, তাঁকে ডেকে তুলে নিয়ে যাবেই। ফাজিল ভাই ঘরের ভেতর থেকে বলল আমি চুরি করা জিনিস খাই আর তোমরা আমাকেও চোর সাজাও তাই না? আমি চোরদের দলে নেই, তুই যা, আমাকে ঘুমাতে দে। স্বপ্ন চলে গেলো, ফাজিল ভাই আবার ঘুমিয়ে পড়লো। রাতে খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত শরীরে ওরা পাঁচজন স্বপ্ন’র কাকার ঘরে ঘুমালো । কিন্তু ভোর হতে না হতেই সোরগোল শুনে ঘুম ভাঙ্গল পঞ্চ পাণ্ডবের। দরজা খুলে বাইরে আসতেই দীপনের বাবা দীপনকে বললেন কিরে তুই এখানে? তোরা নাকি আমাদের খামার থেকে মোরগ চুরি করেছিস? দীপন বলল ফাজিল ভাই তোমাকে বলেছে তাই না? বাড়িতে গিয়ে মোরগ গুনে দেখো সব ঠিক আছে। দীপনের বাবা বুঝল এইটাও মিথ্যে নালিশ। ফাজিল ভাইয়ের আবার বেশি কথা শোনার পালা। ফাজিল ভাই বকা খেয়ে সন্দিহান মনে নিজের বাড়িতে গিয়ে বড় মোরগটা খুঁজতে লাগলো। ওঁর স্ত্রী জিগ্যেস করল কি খুজছ? ফাজিল ভাই বলল আমাদের বড় মোরগটা কই দেখছি না যে? স্ত্রী বলল ওটা তো কাল স্বপ্ন’র কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। কত টাকায় বিক্রি করেছে জানতে চাইলে স্ত্রী জানালো ৫০ টাকা। মাত্র ৫০ টাকা? তুমি জানো বাজারে ওই মোরগের ২০০ টাকা দাম আছে? শুনে স্ত্রী বলল হ্যা বলেছে ,তোমার ওই রোগে ধরা মুরগী ২০০ টাকায় কেনার জন্য যেন কতজন মুখিয়ে আছে। রোগ হয়েছে তুমি বুঝলে কিভাবে? সারা বিকেল ধরে মোরগটা ঝিমোচ্ছিল দেখে স্বপ্ন বলল মোরগের তো রানীক্ষেত হয়েছে, বাঁচার কোন লক্ষন নেই। তারচেয়ে আমাদের কাছে বেচে দাও, তোমারও কিছু টাকা হল আর আমাদের পিকনিক ও হল। শুনে ফাজিল ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো আর বলতে লাগলো ওই শালা নীলাচোরা বিকেলে আমাকে বলল রাতে ঘুম হয়না কয়টা ঘুমের ওষুধ কিনে আনি। সবই ওই শালার কারসাজি! মোরগকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তোমাকে বোকা বানিয়েছে।
এমনি করে দুই চিরশত্রুর পরস্পরকে জব্দ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। একদিন ফাজিল ভাই চায়ের কাপে ল্যাসিস ট্যাবলেট মিশিয়ে খাওয়ালে স্বপ্ন সারাদিন ধরে একটু পরপর প্রস্রাব করে। দেখে ফাজিল ভাই বলে কিরে তোর নাকি ডায়াবেটিস হয়েছে ? ঠিক পরদিন স্বপ্ন ফাজিল ভাইয়ের দোকানের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরে বসার জায়গা দয়ার গুড়া (প্রচণ্ড চুলকানি উদ্রেককারী) ছড়িয়ে দেয়। সারা গা চুলকায় আর চুলকায় দোকানে আর ফাজিল ভাইয়ের বসা হয় না। আর তা দেখে স্বপ্ন বলে ভাই, তোমার কি অ্যালার্জি হল না কি বিছায় কামড়ালো? ফাজিল ভাই বলে আমারও সুযোগ আসবে দাড়াও শালা। এই দুরন্ত ডানপিটে স্বপ্ন এত দুষ্টুমি করেও যখন এসএসসিতে অসাধারন ফল দেখিয়ে সবাইকে চমকে দিলো তখন থেকে ওকে সবাই একটু বেশি বেশি ভালবাসতে লাগলো। এতে করে স্বপ্ন’র মাঝেও একটু একটু পরিবর্তন আসতে লাগলো। প্রকাশ্যে দুষ্টুমি কমিয়ে ভদ্র হতে শুরু করল, কিন্তু অন্তরে দুষ্টুমি পুষে রাখল শুধু ফাজিল ভাইয়ের জন্য।
ছোট্ট দোকানদারি করে ফাজিল ভাইয়ের সংসার চলে না। খোয়ার ইজারা নিয়েও খুব একটা সুবিধা হয় না। তাই পেশা হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও দুটোই তাঁর কাছে একপ্রকার নেশা। কিন্তু পকেটে যখন ভাটা পরে তখনই কিছুদিনের জন্য ফাজিল ভাই সফরে বের হয়। বাড়ির গাছের নারকেল, ফলফলাদি নিয়ে কখনো ঢাকায় কখনো বা খুলনা যায় আত্মীয় স্বজনের বাসায় বেড়াতে। যাদের কাছে যায় তাদের কেউ কেউ আবার শিল্পপতি। কিছুদিন ঘুরে ফিরে বিত্তবান আত্মীয় স্বজনের দয়া ও অনুগ্রহে পকেট ভারী করে খুশি মনে বাড়িতে ফেরে । স্বপ্ন কিন্তু তাঁর এই অনুপস্থিতিতে ফাজিল ভাইয়ের স্ত্রীর কান ভারী করে। বলে দাদী, ভাই যে বাড়ির ফল ফলাদি নিয়ে কোথায় যায় তা কি খোজ নিয়ে দেখেছো? আমিতো শুনলাম সে নাকি খুলনার কাছাকাছি কোথায় আর একটা বিয়ে করেছে না কি যেন এক মেয়েকে পছন্দ করেছে তাকে বিয়ে করবে। শুনে তো দাদী মহা চিন্তায় পরে যায়। বলে হ্যা রে ভাই, আগেও আমি একথা শুনেছি। আমিতো এখন বুড়ি হয়ে গেছি তাই তোর ভাই আমাকে আর পছন্দ করে না। যা বলেছিস সত্য হতেও পারে। ফাজিল মিয়া বাড়িতে ফিরলে এই নিয়ে পরিবারে শুরু হয় তুলকালাম কাণ্ড। কিছুদিন পরে আবার ফাজিল ভাই যখন বাড়ির ফলমূল, গাছের নারকেল নিয়ে বাড়ি ছাড়তে উদ্যত তখন বাদ সাধে তাঁর স্ত্রী আর দুই মেয়ে। উপায়ান্তর না দেখে ফলমূল, নারকেল রেখে খালি হাতেই এবার বাড়ি ত্যাগ করল। কেননা পকেটে যে আবার টান পড়েছে। থানা সদরে গিয়ে বাস স্ট্যান্ডে স্বপ্ন’র সাথে দেখা। ভাই, কই যাও জানতে চাইলে উত্তর দিলো ঢাকা যাবো। স্বপ্ন বলল আজ নয় ঢাকা কাল যেও, আজ এক বড় ভাইয়ের বিয়ে খেয়ে আসি চলো। ফাজিল মিয়ার দাওয়াত খাওয়ার প্রতি আবার বিশেষ দুর্বলতা। তাই কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেলো। স্বপ্ন’র বন্ধু, কালামের বড় ভাইয়ের বিয়ে আর স্বপ্নদের বাড়িতে যাওয়া আসার সুবাদে কালামের কাছেও ফাজিল ভাই সুপরিচিত। তাই স্বপ্ন’র সাথে ফাজিল ভাইকে পেয়ে সে মহা খুশি। বরযাত্রীর সাথে সবাই মজা করে ফাজিল ভাইয়ের মাথায় পাগড়ী পরিয়ে বর সাজিয়ে নিয়ে চলল। স্বপ্ন সুন্দর করে পাকা দাড়িওয়ালা নওশার কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। বিয়ে বাড়িতে গিয়েও কনের পাশে সুন্দর করে বসিয়ে আরও কিছু ছবি তুলল। সবাই খুব মজা পেল , ফাজিল ভাইও খুব আনন্দ পেল এবং মজাও করল। কিন্তু স্বপ্ন’র সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ফাজিল ভাই তখনো টের পায়নি। বিয়ে খেয়ে ফাজিল ভাই আনন্দ চিত্তে ঢাকা গেলো।
কয়েকদিন পরে কলেজ থেকে ফিরে স্বপ্ন মাত্র কলেজ ব্যাগটা রেখেছে, অমনি ফাজিল ভাইয়ের চিৎকার “মেরে ফেললোরে ,কে কোথায় আছিস আমাকে বাঁচা।” দৌড়ে গিয়ে দেখল ফাজিল ভাইয়ের দুই মেয়ে তাঁর দুই হাত ধরেছে, বাকি দুই মেয়ে দাড়ি ধরে ঝুলেছে আর তাঁর স্ত্রী শরীরের অতি স্পর্শকাতর অংশ করায়ত্ত করে শক্তিশালী মিনসেকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। আর বলছে শালার বুড়া শয়তান, এই বয়েসে তোর কচি মেয়ে বিয়ে করার সাধ আজ আমি মিটিয়ে দেবো। বুড়োর ভীমরতি তাড়াতে বুড়ি সেনাবাহিনী (মেয়েদের) খবর দিয়ে এনেছে! কালামের ভাইয়ের বিয়ের দিনে তোলা ছবিগুলো যা এই যুদ্ধক্ষেত্রে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা যে এমন মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে তা নিজ চোখে না দেখলে বুঝতেই পারতো না স্বপ্ন। তবে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বোধ হয় একটু বেশি ভয়াবহ হয়ে গেছে । পাড়া প্রতিবেশিরা কেউ তাদের এই যুদ্ধ থামাতে এগিয়ে আসেনি, বরং দূরে দাড়িয়ে শুধু তামাশা দেখছে । স্বপ্নকে দেখে ফাজিল ভাই বলল শালা, তোর জন্য আজ আমার এই দশা। এখন আমাকে বাঁচা । স্বপ্ন বলল ভাল করে বল। আমার পেছনে আর লাগবে না তো, আমাকে আর নীলাচোরা বলে ডাকবে না তো? এবার বিনয়ের সাথে বলল আচ্ছা ঠিক আছে ভাই, তাড়াতাড়ি আমাকে বাঁচা। স্বপ্ন’র হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় ফাজিল ভাই মহিলা ব্যাটেলিয়ানের হাত থেকে বেঁচে গেলো।
গলার কাঁটা নেমে গেলে যেমন বিড়ালের পা ধরার কথা আর মনে থাকে না ঠিক তেমনি কিছুদিন যেতে না যেতেই ফাজিল মিয়ার আবার সেই স্বপ্ন’র পেছনে লাগা। স্বপ্নও কম যায় না, লেগেই আছে ফাজিল ভাইয়ের সাড়ে সর্বনাশের ধান্দায়, তবে সবার অগোচরে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মাঝে গভীর রাতে একদিন পড়ালেখা শেষে স্বপ্ন ঘুমাতে যাবে এমন সময় মাথায় আবার দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। রিপনকে ডেকে তুলে বলল দাদা, ক্ষুধা লেগেছে। রিপনদা বলল এখন ঘুমা সকালে উঠে ভাত খাবি আর খুব বেশি কষ্ট হলে মামিকে ডাক। আমাকে বিরক্ত করিস না, ঘুমাতে দে। স্বপ্ন বলল চলোনা ফাজিল ভাইয়ের দোকানে দাও মেরে আসি। সাথে সাথে রিপনের ঘুম পালালো, লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। ফাজিল ভাইয়ের সাথে তারও কি যেন এক বিরোধের জেরে আজকের সুযোগটা পেয়ে সে কাজে লাগাতে আর আলস্য করল না। দুজন মিলে দোকানের পেছনের দিকের চৌকাঠ আর টিনের চালের মাঝের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে বিস্কিট আর সনপাপড়ি বের করে খেয়ে পেট ভরলো । দুদিন এভাবে খাবার পরেই ফাজিল মিয়া টের পেয়ে কাঠের তক্তায় পেরেক মেরে ফাঁকাটা বন্ধ করে দিলো। তৃতীয় রাতে দুই চোরের অবস্থা ঠিক যেন খাঁচা দিয়ে ঢেকে রাখা দুধের বাটির পাশে ঘুরঘুর করা বিড়ালের মত। কিন্তু এত সহজে রনে ভঙ্গ দেবার পাত্র এরা নয়। স্বপ্ন’র মাথায় এক বুদ্ধি এলো। দোকানের পেছনের বেতির বেড়ার কয়েকটি বেতি নীচে টেনে নামিয়ে যেটুকু ফাঁক হয় সেখান দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলো, ব্যাস কাজ হাসিল। ফাজিল মিয়াও দুষ্টু বুদ্ধিতে কম যায় না, পরদিন দোকান বন্ধের আগে ঝুলিয়ে রাখা সব খাবার নামিয়ে রেখে সেখানে কায়দা করে ঝুলিয়ে রাখল ইঁদুর ধরা ফাঁদ। আর যায় কই, বিস্কিট বা সনপাপড়ির উদ্দ্যেশ্যে হাত বাড়িয়ে সেগুলোর পরিবর্তে যখন স্বপ্ন’র হাতে ফাঁদটা আটকে গেলো তখন ওর মনে হচ্ছিলো প্রাণটা বুঝি হাত ফস্কেই বেড়িয়ে যাবে। চিৎকারও করতে পারছিলো না পাছে সবাই তাদের এই সুকর্মের কাহিনী জেনে যায়। অনেক কষ্টে রিপনদার সহায়তায় নিজেকে ফাঁদ থেকে মুক্ত করলো। কিন্তু ততক্ষনে হাতে একটা গভীর ক্ষত হয়ে গেছে। ভাগ্যিস ঐদিনই তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে, না হলে পরীক্ষার কপালে দুঃখ ছিল। বুঝল যেমন কর্ম তেমন ফল, এমনটা আর কখনো করবে না বলে প্রতিজ্ঞাও করল। অবশ্য এরপর আর কখনো ফাজিল ভাইয়ের পেছনে লাগার সুযোগ তার হয়নি। হাতের ক্ষত নিয়েই স্বপ্ন ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মনোবাসনায়। ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে স্বপ্ন যখন ফাজিল ভাইয়ের কাছে বিদায় নিতে গেলো তখন ফাজিল ভাই তাকে বলল পাশ করে,চাকরি পেয়ে তবেই বাড়িতে ফিরবি, তার আগে যেন আমি তোকে বাড়িতে না দেখি। তুই বাড়ি ছাড়া হলে তবেই আমার হাড় জুড়োবে। স্বপ্ন বলল শালা, তুমি মরলে পরে কবর দিতে আসবো তার আগে আর নয়। সেই যে মধুর শত্রু জুটির বিরহের সূত্রপাত তার স্থায়ী অবসান আর কখনোই হয়নি।
মাস যেতে না যেতেই ফাজিল ভাইয়ের মনটা যেন স্বপ্ন’র জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো, বার বার শুধু ওকে দেখতে মন চায়। কি এক শুন্যতা সারাক্ষন ঘিরে থাকে ফাজিল ভাইকে। স্বপ্ন’র মায়ের কাছে প্রতিদিন অন্তত একবার জানতে চায়, নীলাচোরা কবে বাড়ি আসবে। স্বপ্ন কেমন আছে, পড়ালেখা ঠিকমতো করছে কি না, মাঝে মাঝে চিঠি দেয় তো? সর্বশেষ জিজ্ঞাস্য, নীলাচোরা চিঠিতে তার কথা জানতে চায় কি? আর সারা গ্রামে বলে বেড়ায়, এই গ্রামে যদি একটি মাত্র ভাল ছেলে থেকে থাকে তবে সে হল নীলাচোরা, মানুষের মত মানুষ হলে ওই হবে। স্বপ্ন’র মা বলে, কাকা আপনাদের দুজনের তো সাপে নেউলে সম্পর্ক তবে এখন কেন ওর এত প্রসংসা করছেন। ওর জন্য আপনার কেনই বা লাগে? ফাজিল মিয়া বলে মা, সে তুমি বুঝবে না। স্বপ্নও প্রায় প্রতিটা চিঠিতে ফাজিল ভাইয়ের কথা জানতে চায়। সে কেমন আছে, তার বিরুদ্ধে এখনও নালিশ করে কি না? মা উত্তরে জানায়, না রে সে এখন সারাক্ষন তোর প্রসংসায় পঞ্চমুখ। সারা গ্রামে তোর গুন গেয়ে বেড়ায়। স্বপ্ন বলে এগুলো ওঁর ভণ্ডামি, আমি বাড়ি এলে দেখবে ঠিকই আবার আমার পেছনে লাগবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর কক্ষনোই হয়নি দুজনের কারোই।
দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেছে, নানা প্রকার রোগে ভুগে ফাজিল ভাইয়ের শরীর অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে, দোকানটাও বিলুপ্তপ্রায়। দুই ছেলের কেউই তাঁর তেমন খোজ খবর নেয় না । কিন্তু প্রযুক্তির বদৌলতে স্বপ্ন’র খবরাখবর ঠিকই নিয়মিত জানতে পারে ওর মায়ের কাছে। তাই স্বপ্ন’র চাকরি প্রাপ্তির খবরটা পেতেও খুব বেশি দেরি হয় না। আর ফাজিল ভাইয়ের মুখে গ্রামময় তা প্রচার পেতে মুহূর্ত মাত্র সময় নেয় না। সামনে ঈদের ছুটি, চাকরি পাবার পর প্রথম বাড়ি আসছে স্বপ্ন। মা ফোনে বলল তোর চাকরি পাবার খবরে তোর ফাজিল ভাই এত উচ্ছ্বসিত যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছে। তুই যদি ওনার জন্য কিছু একটা ঈদ উপহার নিয়ে আসিস তাহলে অনেক বেশি খুশি হবে। স্বপ্ন বলল ওই শালা হারামজাদার জন্য উপহার আনবো আমি? মুখে যতই তেতো কথা বলুক অন্তরের টানে ঠিকই স্বপ্ন ফাজিল ভাইয়ের জন্য সুন্দর একটা পাঞ্জাবি আনল। ফাজিল ভাইয়ের হাতে পাঞ্জাবি দিয়ে বলল ভাই এই নাও তোমার ঈদ উপহার, দেখো তো পছন্দ হয় কি না? ফাজিল ভাই আনন্দে স্বপ্নকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ছেড়ে দিলো । আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলল খুব পছন্দ হয়েছে ভাই। ঈদের দিন ফাজিল ভাই নামাজ পড়ে এক কেজি জিলিপি কিনে নিয়ে স্বপ্নদের বাড়িতে ঢুকলো । স্বপ্ন’র মায়ের কাছে গিয়ে বলল মা, আমার নীলাচোরার জন্য তো আমি কখনো কিছু করতে পারিনি আজ ঈদের দিনে ওকে অন্তত একটু মিষ্টিমুখ করাই। স্বপ্ন ঘরের ভেতর থেকে বেড়িয়ে বলল ভাই, আমি কিন্তু এখন সরকারি কর্মকর্তা। তুমি এখনও আমাকে নীলাচোরা নামে ডাকছ! ফাজিল ভাই বলল তুই দেশের রাষ্ট্রপতি হলেই বা কি? আমার কাছে তুই সেই নীলাচোরা। স্বপ্ন আবেগটা উপলব্ধি করতে পেরে বলে আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আমাকে সারাজীবন এই নামেই ডেকো। কিন্তু ভাই, তুমি আমার জন্য টাকা খরচ করতে গেলে কেন? ফাজিল ভাই বলল কেন আমার কি সাধ আহ্লাদ বলে কিছু থাকতে নেই? আচ্ছা এখন বল তো ভাই, আমাকে কেমন লাগছে? স্বপ্ন এবং ওর মা ভালো করে তাকিয়ে দেখল স্বপ্ন’র দেওয়া পাঞ্জাবিতে ফাজিল ভাইকে দারুন লাগছে। তবে পাঞ্জাবির নিচের মলিন লুঙ্গিটা যেন একটু বেমানান লাগছে। স্বপ্ন বলল চলো ভাই, তোমাকে একটা লুঙ্গি কিনে দেবো। ফাজিল ভাই বলল না রে ভাই, এখন নয়। আমার একটু জরুরি কাজ আছে এখন যাই বলে চলে গেলো। কিন্তু এটাই যে দু’জনের শেষ দেখা হবে কেউ কি তা ভেবেছিলো! পরদিন ভোরেই বিশেষ কারনে স্বপ্নকে ঢাকায় ফিরতে হল। পরে মায়ের কাছে জানতে পেরেছিল ফাজিল ভাইয়ের ঐদিনের জরুরি কাজটা ছিলো সারা গ্রামের মানুষকে স্বপ্ন’র দেওয়া পাঞ্জাবিটা দেখিয়ে বেড়ানো আর বলে বেড়ানো যে ওটা স্বপ্ন ওকে দিয়েছে।
আর কখনোই হয়তো ফোনে মায়ের কাছে ফাজিল ভাইয়ের কথা জিগ্যেস করা হবে না। স্মৃতিচারণ করতে করতে শেষ রাতের দিকে ক্লান্ত শরীরে স্বপ্ন ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের মাঝেও ফাজিল ভাই এসে হাজির। নিলাচোরা নাকি আমার জন্য নতুন লুঙ্গি এনেছে? এখন আর আমাকে বেমানান লাগবে না, নতুন পাঞ্জাবির সাথে নতুন লুঙ্গি পড়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাবো এবার। কই মা, আমার নতুন লুঙ্গি কোথায় রেখেছ, তাড়াতাড়ি দাও। স্বপ্ন’র ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। শুনতে পেলো কেউ একজন খুব করুন কণ্ঠে বলছে আমাকে একটা পুরনো লুঙ্গি দেবে মা? আমার লুঙ্গিটা একেবারে ছিরে গেছে, পড়ার মত অবস্থায় নেই। মা তাঁকে একটু দাড়াতে বলে নতুন লুঙ্গিটা এনে বলল চাচা, এইটা নেন। স্বপ্ন বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দেখলো পাশের পাড়ার বৃদ্ধ ভিক্ষুক, ফেলু মিয়া অবাক বিস্ময়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। লুঙ্গিটা হাতে নিতে ইতস্তত করছে আর মুখে বলছে এটা তো নতুন লুঙ্গি, এটা আমি নেব? স্বপ্ন বলল হ্যা দাদা, এইটা আপনার প্রাপ্য। লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে ফেলু মিয়ার মুখ জুড়ে কৃতজ্ঞতার যে আভা ছড়িয়ে পড়লো তা দেখে স্বপ্ন’র চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।