যে দায়িত্বশীল সে সর্বত্রই দায়িত্বশীল হয়, রামেন্দু বাবু তার প্রকৃষ্ট উদাহরন। অভি’র নতুন রুমমেট রামেন্দু বাবু বেসরকারি এক ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। দুই সন্তানের জনক এই লোকের বয়স ৪৩/৪৪ হলেও চেহারা দেখে ৩৫ এর বেশি মনে হয় না। ছেলে ক্লাশ সেভেনে পড়ে, মেয়েটা ক্লাশ থ্রিতে। স্ত্রী ফরিদপুর জেলার নিজ(বাবার বাড়ি) গ্রামের সরকারি প্রাইমারীর শিক্ষয়িত্রী, ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে বাড়িতেই থাকেন। সব মিলিয়ে এক সুখী পরিবার। চাকরির সুবাদে পরিবার ছেড়ে ঢাকায় থাকলেও পরিবারের প্রতি রামেন্দু বাবুর দায়িত্বশীলতায় অভি মুগ্ধ। প্রতি সপ্তাহে অনিক বাবু গ্রামের বাড়িতে যান। এরপরও প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে ফোনে প্রচুর সময় দেন পরিবারকে। বয়সের ব্যাবধান থাকলেও অল্প ক’দিনের মধ্যেই রামেন্দু বাবুর সাথে অভি’র খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। চাকরির সন্ধানে আর টিউশনি করে সময় কাটছিলো অভি’র। ঠিক এমন সময় রামেন্দু বাবুর আগমন অভি’র বর্তমান ঠিকানা, মালিবাগ প্রথম গলির এই মেসে। অভি ব্যাতীত ওর মেসের বাকি সবাই চাকরিজীবী। বয়সেও সবার ছোট তাই অভি সবার আদরের পাত্র। এই আদরের পাত্র হওয়ার সুবিধা যেমন বিরম্বনাও কম নয়। রাত বিরেতে, সময়ে অসময়ে কারো কিছু প্রয়োজন হলেই অভি’র তলব পড়ে। কখনো সাদরে, কখনো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো অভি তার দায় সারে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসেই রামেন্দু বাবুর প্রতি অভির একটু বেশি রকম ভালবাসা জন্মে গেছে। রামেন্দু বাবু ওকে যখন যা বলে খুব সাদরে সে কাজের দায়িত্ব ও পালন করে। কুরিয়ার সার্ভিসে টাকা বা কোন জিনিস পাঠানো , সেলফোন ব্যালেন্স রিচার্জ করাসহ ছোট খাট কাজের ব্যাপারে রামেন্দু বাবু অনেকটা নির্ভার অভিকে পেয়ে। আর অভিও খুব বিশ্বস্ততার সাথে ওর অলস সময়ের কিছু অংশের সদ্ব্যবহার করছে রামেন্দু বাবুর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে ।
কোন এক ভোরে চাকরির বিজ্ঞাপনে মগ্ন অভি, একটা ফোন বেজেই যাচ্ছে। কেউ ফোন ধরছেনা তাই একটু বিরক্ত হয়েই ফোনটার কাছে গিয়ে দেখল রামেন্দু বাবুর ফোন। রাম দা, আপনার ফোন বাজছে বলে চিৎকার করতেই কাজের বুয়া বলল, রাম দা বাজারে গেছে। অভি দেখল লিপি অর্থাৎ রামেন্দু বাবুর স্ত্রী(রাম দা’র মুখে বহুবার শুনেছে) ফোন করেছেন। কল রিসিভ করে নমস্কার বৌদি, আমি দাদার রুমমেট অভিজিৎ বলছি। দাদা বাজারে গেছেন, এলে আপনাকে কল করতে বলব । অপর দিক থেকে উত্তর এল আচ্ছা তা বলবেন , আপাতত আপনার ফোন নম্বরটা পেলে খুশি হব। আরও বেশি খুশি হব যদি আপনার দাদাকে এই নম্বর দেওয়ার কথা না জানান। অভির নম্বর পেয়ে পরে কথা হবে বলেই কলটা কেটে দিলেন লিপি। কিছুটা রহস্যময় অথচ খুব সুন্দর করে কথা বলেন বৌদি, মনে মনে ভাবল অভি। তীব্র একটা আকাঙ্খা মনে বাসা বাঁধল অভি’র , কখন বৌদি ফোন দেবেন, কি এমন কথা বলবেন অপরিচিত এই আমার সাথে। রামেন্দু বাবু বাজার থেকে ফিরলে অভি শুধু বলল বৌদি ফোন করেছিলেন, আপনাকে ফোন করতে বললেন। রামেন্দু বাবু একটু যেন উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন, আর কিছু বলল? অভি বলল, না আর কিছুই বলেনি। অভি খেয়াল করল, রামেন্দু বাবু ঠিক যেন অভি’র কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। অভি উপলব্ধি করল কিছু একটা গোলমাল আছে। আর এই রহস্যের গন্ধটা আরও তীব্র হল বৃহস্পতি বার রাতে যখন লিপি বৌদি অভিকে ফোন করে জানতে চাইল রামেন্দু বাবু কোথায়। অভি বলল, দাদা তো বাড়ির উদ্যেশ্যে বেরিয়েছেন কেন আপনাকে বলেননি? ফোন করে দেখেন, হয়তো বাসে আছেন পৌছে যাবেন কিছুক্ষনের মধ্যে। পরদিন সকালে লিপি বৌদির ফোন কলে অভির ঘুম ভাঙল। ভাই, আমার একটু উপকার করবেন? হ্যা , বৌদি কি করতে হবে বলেন? লিপি বললেন, আপনি আমার ছোট ভাইয়ের মতো তাই এক দিদি হয়ে বলছি আমার সংসারটা বাঁচাতে আমাকে একটু সাহায্য করুন। আপনার দাদা দীর্ঘদিন হল বাড়িতে আসেনা, অফিসিয়াল ট্যুর এর কথা বলে কোথায় যায় জানিনা। ইদানিং ছেলে-মেয়ের খোঁজ ও ঠিকমতো নেয়না। সংসারের প্রতি তার কোন দায়িত্ব আছে বলে মনেই হয়না। অথচ ও এমনটা ছিলনা। অভি তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ঐ দিনের মতো কথোপকথন শেষ করল।
রবিবার রাতে রামেন্দু বাবু অফিস থেকে মেসে ফিরলে গতানুগতিক অভির প্রশ্ন, “দাদা, বাড়ির সবাই ভালো আছে?” উত্তরে রামেন্দু বাবু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন, কিন্তু মুখে কেমন একটা দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো। অভি আর কথা বাড়াল না । রাতে আবার অভির তলব পড়ল। ভাই, একটা নম্বরে রিচার্জ করতে হবে , যদি একটু ......। আরে দাদা, এত ইতস্তত করার কি আছে টাকা দেন, আমি যাচ্ছি। টাকা নিয়ে আর নম্বর লেখা চিরকুট নিয়ে অভি বেরিয়ে গেলো। দোকানে গিয়ে নম্বরটা লিখে চিরকুটটা বরাবরের মতো ছিড়ে না ফেলে নিজের ফোনে টুকে নিলো। ডায়াল করল, না এ তো লিলি বৌদির নম্বর নয়! হ্যালো, কে বলছেন? অপর প্রান্ত থেকে অপরিচিত এক তরুণীর কণ্ঠস্বর। আমি রাম দা’র রুমমেট, এইমাত্র আপনার নম্বরে রিচার্জ করলাম, নম্বর ভুল করলাম কিনা নিশ্চিত হবার জন্য কল করলাম। আপনি কি অভি দা? অপর প্রান্ত থেকে এমন প্রশ্নে অভি একটু বিস্মিত হল। হ্যাঁ, কিন্তু আপনি বুঝলেন কি করে? খুব সহজ, এই কাজটা আপনিই করে থাকেন। পাশাপাশি আমার ঠিকানায় টাকা এবং জিনিশপত্র কুরিয়ার করার কাজটাও খুব নিষ্ঠার সাথে আপনিই করেন, ঠিক তো? অভি বলল, হ্যাঁ তার মানে আপনি শিউলি? অপর প্রান্ত থেকে হ্যাঁবোধক উত্তর এলো। আচ্ছা আজ রাখি, পরে কথা হবে বলে অভি ফোন রেখে দিলো। কেউই এই কথোপকথনের ব্যাপারে রামেন্দু বাবুকে কিছুই বলেনি। তবে অভি পরদিন রামেন্দু বাবু অফিসে যাবার পরে লিপি বৌদিকে ফোন দিলো। শিউলি কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমাদের (বাবার বাড়ি) পাশের বাড়ির মেয়ে। ওর বড় ভাই আবার আপনার দাদার খুব ভালো বন্ধু। ও ফরিদপুর শহরে থেকে সরকারি কলেজে পড়ে। ওরা কয়েক বান্ধবী মিলে একটা বাসা ভাড়া করে থাকে। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি কোন কুরিয়ার সার্ভিসের শাখা না থাকায় ওর ঠিকানায় আপনার দাদা টাকা পয়সা পাঠাতো আগে। অভি বলল পাঠাতো মানে এখন পাঠায় না? উত্তরে লিপি বললেন, প্রায় এক বছর হল ওর মাধ্যমে টাকা পাঠানো বন্ধ করেছে। মাঝে মধ্যে যা কিছু নিজে এসে দিয়ে যেত তাও বেশ কিছুদিন হল বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আমিই সংসার দেখছি। প্রথমত ইততস্ত করলেও বিবেকের তাড়নায় সব দ্বিধা ফেলে অভি বলল বৌদি, আপনি একটু শিউলি সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ খবর নেন। দাদা গত সপ্তাহেও শিউলির ঠিকানায় পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছে এবং আমি নিজে তা কুরিয়ার করেছি। ওর ফোন নম্বরে প্রায়ই টাকা পাঠায়, আমি নিজেই কতদিন রিচার্জ করেছি। অভি বুঝল প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে রামেন্দু বাবু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কার সাথে কথা বলে! কিন্তু সেকথা আর বৌদিকে বলল না। রাতে যখন রামেন্দু বাবু ফোনে ব্যাস্ত তখন শিউলিকে কল করে অভি ব্যাস্ত পেল। যতক্ষণ রামেন্দু বাবু ব্যাস্ত ছিলেন ততোক্ষণ শিউলিকে ব্যাস্ত পেল। পরদিন অভি ফোনের ব্যাপারটাও জানালো লিপি বৌদিকে। লিপি কোনভাবেই যেন হিসেব মেলাতে পারছেন না। শিউলি এত ভালো একটা মেয়ে,বয়েসই বা কত! সবে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, পড়ালেখায়ও তুখোড়। তাছাড়া ওর তো সেই স্কুল জীবন থেকে ক্লাসমেট রিয়াজের সাথে সম্পর্ক। এই একটা কারনেই ওর যা একটু বদনাম আছে। কিন্তু দুজনেরই খুব ভালো রেজাল্ট করায় এবং পারিবারিক স্ট্যাটাস মানানসই হওয়ায় এই ব্যাপার নিয়ে কারো কোন অভিযোগ নেই। লিপি কুল কিনারা কিছু না পেয়ে শিউলির এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর আশ্রয় নিলো। জানতে পারল অনেক অজানা তথ্য। দুর্ভাগ্যবশত শিউলির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি কিন্তু রিয়াজের সে সুযোগ হয়েছে । শিউলির মাঝে তখন থেকেই ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতা কাজ করতে শুরু করে । ওদের মাঝে এ নিয়ে তিক্ততা বারতেই থাকে সাথে দূরত্বও। রিয়াজ অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু শিউলিই সম্পর্কটা নষ্ট করেছে। শিউলি যেন কেমন হয়ে গেছে। নতুন একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে ,তবে সেটা স্বীকার করতে নারাজ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে দীর্ঘক্ষণ ফোনে ব্যাস্ত থাকে। কেউ জিগ্যেস করলে বলে রিয়াজের সাথে কথা বলছে। কেউ ভাবে হয়তো সব ঠিক হয়ে গেছে ,কেউবা সঠিকটা বুঝেও বন্ধুত্ব রক্ষার স্বার্থে নীরব দর্শক হয়ে থাকে। শিউলির সাজ, পোশাক, বিলাসিতা আর কেনাকাটার ব্যাস্ততায় বান্ধবীরা পড়ালেখার প্রসঙ্গে ওর সাথে কথা বলারই সুযোগ পায়না। ওরা শুধু ভাবে শিউলি কি আলাদ্বীনের চেরাগ পেল নাকি! তবে বান্ধবীরা অনেকেই রামেন্দু দা’কে ওর সাথে মার্কেটে কয়েকবার দেখেছে। সবার সাথে কেমন যেন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় আগের মতো মন খুলে কিছুই বলে না। এসব ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করলে তাও এড়িয়ে যায়। তাই শিউলি বান্ধবীদের কাছে এখন একটা রহস্যময় বস্তু। তবে ইদানিং প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাড়িতে যায়। লিপি আর কিছু ভাবতে পারছিলো না, শিউলি প্রতি সপ্তাহেই বাড়িতে গেলে লিপির সামনে মাঝে মধ্যে পরার কথা। বরংচ ও জানে শিউলি পড়ালেখার চাপে ইদানিং বাড়িতে খুব কম আসে । লিপি হিসেব কষে বেশ কিছু বুঝে নিলো কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। নিশ্চিত হতে পরের কোন এক ছুটির দিনে অভি’র দেওয়া তথ্য, নিজের ছোট ভাই আর শিউলির বড় ভাই (রামেন্দুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু) এর সহযোগিতায় লিপি গোয়েন্দা অভিযান চালাল । অনাকাঙ্খিত সফল অভিযানে রামেন্দু এবং শিউলিকে এক সাথে উদ্ধার করা হল ফরিদপুরের এক আবাসিক হোটেল থেকে। হাতে নাতে ধরা পরে রামেন্দু এবং শিউলি দুজনই তাদের ভুল স্বীকার করল। পাশাপাশি ভবিষ্যতে আর কখনো এমন ভুল করবেনা এই বলে শপথও করল। লিপির, সব মেনে নিতে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো। শিউলি না হয় বয়সের অপরিপক্কতায় আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল করতে পারে কিন্তু রামেন্দু? এতদিন যে মানুষটার ভালবাসায় নিজেকে সিক্ত করে দূরত্বের যন্ত্রণা ভুলেছে, যার বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ,সেই কি না আজ............? তার কথা না হয় নাই ভাবল, ছেলে মেয়ে দুটোর কথা রামেন্দুর একবারও মাথায় এলো না! এসবের জন্য কি তাহলে লিপি নিজেই দ্বায়ী? তিন বছর আগে লিপির জরায়ু ক্যান্সার ধরা পরে। অপারেশনের পর থেকে লিপি শারীরিকভাবে অক্ষম, কিন্তু এখানে লিপিরতো কোন কিছু করার ছিলোনা। লিপির এই পৃথিবীতে নিজেকে অপাংতেয় মনে হচ্ছিলো। শুধু সন্তান দুটোর ভবিষ্যৎ চিন্তায়, সংসারটাকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনায় স্বামীকে ক্ষমা করতে বাধ্য হল । অন্যদিকে শিউলির ভাই বন্ধুত্ত্বের খাতিরে না হলেও নিজের বোনের ভবিষ্যৎ এবং পরিবারের মান সম্মানের কথা চিন্তা করে এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করেনি। রামেন্দু কিছু জানতে না পারলেও সংসারটা ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষার কৃতিত্ব লিপি অভিকেই দিলো। লিপির কৃতজ্ঞতা স্বীকারে মুগ্ধ অভিও সুযোগ পেলে লিপি বৌদির খোঁজ খবর রাখে । বেশ চলছে লিপি বৌদির সংসার। রামেন্দু নিজেকে শুধরে নিয়েছে। সংসারে আবার মনোযোগী হয়েছে। সব শুনে অভি আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলল, জীবনে তবু কারো কল্যানে নিজেকে লাগাতে পারলাম! এর কিছুদিন পরেই অভির বেকার জীবনের মজা শেষ হল। বাগেরহাটের এক কলেজে প্রভাষক হওয়ার সুযোগে রাজধানীর জীবনকে বিদায় জানিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অভি গ্রামের বাড়িতে চলে গেলো।
মেয়েদের কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় অভির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে লাগলো। তাই খুব স্বল্প সময়ে অতীত ইতিহাসের অনেক কিছুর সাথে রামেন্দু বাবু এবং লিপি বৌদিকেও ভুলতে বসেছিল। ঢাকা ত্যাগ করার প্রায় পাঁচ মাস পরে একদিন ক্লাশ শেষে ফোনের দিকে তাকিয়ে অভি একটু বিস্মিত, অপরিচিত নম্বর থেকে পনের’টি মিসড কল! কল ব্যাক করে জানতে চাইল , কে আপনি? উত্তরটা অপ্রত্যাশিত, আমি শিউলি। খুব জরুরী প্রয়োজনে আপনাকে ফোন করেছি, দয়া করে একটু সাহায্য করুন। অভি বলল , আপনাকে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি তা বুঝে পাচ্ছিনা। তেমন কিছুই না, আপনার রাম দা’র ফোন নম্বরটা দিতে হবে। আগের নম্বরটা বন্ধ পাচ্ছি, কিন্তু ওঁকে আমার খুব প্রয়োজন। অভি বলল ,আচ্ছা দেবো কিন্তু তার আগে বলুন তো আপনি জেনে শুনে কিভাবে একটা সংসার ভাঙতে যাচ্ছিলেন? শিউলি অকপটে সব স্বীকার করল। রামেন্দু পরিবারের জন্য কুরিয়ারে যে টাকা পাঠাতো নিজের প্রয়োজনে সেখান থেকে একদিন পাঁচশত টাকা রেখে বাকি টাকা লিপির কাছে পৌঁছে দেয় শিউলি। রামেন্দুকে ফোনে বলে, পাঁচশত টাকা খরচ করে ফেলেছি পরে দিয়ে দেবো। রামেন্দু বলে, আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নেই। কিন্তু শিউলি পরে কখনো সে টাকা ফেরত দেয়নি। রামেন্দুও লজ্জায় এ প্রসঙ্গে কখনো কিছু বলেনি । বেশ কিছুদিন পরে আবার এক হাজার টাকা একইভাবে নিলো শিউলি।এবারও রামেন্দুর নীরব ভুমিকায় শিউলি কিছুটা প্রশ্রয় পেয়ে গেলো। এরপর মাঝে মাঝেই টাকা, ফোন রিচার্জ করা, জিনিস পত্র যা প্রয়োজন তা রামেন্দুর কাছে চাইতে শুরু করল। প্রথমত বন্ধুর বোনের প্রতি দায়িত্ববোধে সব করলেও যখন বুঝল এগুলো ফেরত পাবার কোন আশা নেই তখন থেকে রামেন্দুও সুযোগ নিতে শুরু করল। প্রথমত ফোনে, এরপর সাক্ষাতে শুরু হল এক নতুন সম্পর্ক। তখন পর্যন্ত রিয়াজের সাথে শিউলির সম্পর্কটা ছিলো। ওদের সুন্দর সম্পর্কটা অটুট থাকুক শিউলিও চেয়েছিল। কিন্তু নিজের বেহিসেবী,বিলাসী, জীবনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে এতটাই বেসামাল হয়ে গিয়েছিলো যে রামেন্দুর নেওয়া চরম সুযোগটাকে তখন আর উপেক্ষা করতে পারেনি। এরপর নিজ থেকেই রিয়াজের সাথে সম্পর্কটা ছিন্ন করেছে। দু’জনের এই লেনদেনের মাধ্যমেই সকলের অগোচরে এক অনৈতিক সম্পর্কের সূত্রপাত। কিছুদিন পরে বিবেকের দংশনে যখন কিছুটা উপলব্ধি বোধ জন্মাল তখন ভাবল এ কি করছে ও? এত সুন্দর সম্পর্কটা শেষ করে দিয়ে কিসের মোহে ছুটছে ও? তখন সব ত্যাগ করে এই মোহের জাল ছিঁড়ে বের হতে চেয়েছিল। কিন্তু রামেন্দু লিপির শারীরিক অক্ষমতার কথা জানিয়ে বিয়ে করার আশ্বাস দিলে সব হারিয়ে নিঃস্ব শিউলি এই আশাটুকু আর ছাড়তে পারেনি । তবে সবাই জেনে যাবার পর নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভেবেছিলো । সব ভুলতে সেভাবে পড়াশোনাও শুরু করেছিলো। এমনকি ২য় বর্ষ চূড়ান্ত পরীক্ষার ব্যাস্ততায় নিজের দিকে তাকানোর পর্যন্ত ফুরসৎ পায়নি। পরীক্ষা শেষে যখন তার চেতন হল, নিজের শরীরের পরিবর্তন উপলব্ধি করে আঁতকে উঠলো, শিউলি গর্ভবতী! কিন্তু ওইদিনের পর থেকে রামেন্দুর সাথে ওর কোন যোগাযোগ নেই, নতুন ফোন নম্বরও জানা নেই, শিউলি এখন দিশেহারা। সব শুনে অভি বলল, আমিতো ঢাকা ছেড়ে চলে এসেছি,এখন গ্রামের বাড়িতে থাকি। রাম দা’র নতুন নম্বর আমার কাছে নেই তবে একটা নম্বর দিচ্ছি এখান থেকে আপনি নম্বর পেয়ে যাবেন। মেসমেট জয় দা’র নম্বরটা বলে ফোনটা রেখে অভি মনে মনে ভাবল এই ব্যাপারে আমাকে আর না জড়ালেই বাঁচি।
প্রায় দেড় বছর পরে শিক্ষা অফিসের কোন এক জরুরী কাজে অভিকে ঢাকায় যেতে হল। পুরনো জায়গার মায়া ওকে আবার একবার টেনে নিয়ে গেলো, কাজ সেরে বিকেল হতে না হতেই সেই মেসে হাজির অভি। গিয়ে দেখল রামেন্দু বাবু চাকরির আবেদনপত্র লিখতে ব্যাস্ত। কোথায় সেই চেহারার জৌলুস! শুকিয়ে রাম দা যে অর্ধেক হয়ে গেছেন! কি ব্যাপার দাদা,আপনার এমন অবস্থা কেন, অসুস্থ নাকি , কি হয়েছে? রামেন্দু বাবু শুধু বোকার মতো একটা হাসি দিলেন আর মুখে বললেন , হ্যাঁ একটু অসুস্থ ছিলাম। অভি তাঁকে আর কিছু জিগ্যেস না করে জয় দা’কে গিয়ে ধরল। জয় দা’র কাছে যা শুনল তাতে অভির আক্কেলগুড়ুম । গর্ভপাত করাতে গিয়ে শিউলির অপমৃত্যু হয়। শিউলির পরিবারের দাবী, ওকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। বোনের মৃত্যুশোকের কাছে এবার বন্ধুত্ব তুচ্ছ হয়ে গেলো। শিউলির পরিবার হত্যা মামলা দায়ের করে রামেন্দুর বিরুদ্ধে । এক বছর জেল খেটে, মন্ত্রী এমপিদের তদবিরে কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু ততোদিনে চাকরিটা চলে গেছে। অনেক দৌড় ঝাঁপ করেও পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি কারন তার এই কুকর্মের সনদ ততদিনে ব্যাংকের পর্ষদে পৌঁছে গেছে। এখন হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। অভি থ হয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকলো জয় দা’র মুখের দিকে। রামেন্দু বাবুর আবেদনপত্র তখনও শেষ হয়নি......
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৪:১৮