গোয়েন্দাগিরিটা সবুজের একপ্রকার নেশা। সেই ছোট্ট বেলায় মনের অজান্তেই তার রক্তে ঢুকেছিল যে নেশার বীজ তাতে জল ঢেলেছিল তার দুঃসাহস। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই বীজ আজ বৃক্ষে পরিনত হতে চলেছে। ছোট ফুফির হাতেই সবুজের এই গোয়েন্দাগিরিতে হাতে খড়ি। তাঁর নির্দেশে না বুঝেই যে রহস্য উদঘাটনের নেশায় মগ্ন হয়েছিলো আজ ভালো মন্দ বুঝতে শিখে মাঝে মাঝে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে খুব অপরাধবোধে ভোগে। প্রায় প্রতি রাতেই পড়া শেষে ওকে একটা কাজ করতে হত, তা হল পাশের বাড়ির সদ্য বিধবা চাচীর ঘরে আড়ি পাতা। শুধু আড়ি পাতা নয়, প্রতিনিয়ত সর্বশেষ সূক্ষ্ম এবং সযত্ন সম্পাদিত তথ্য ছোট ফুফিকে জানিয়ে তবেই ঘুমুতে যাবার অনুমতি মিলত। গ্রাম্য ননদ- ভাবীর মধুর সম্পর্কের পাশাপাশি ননদ-ভাবীর সাপে নেউলে সম্পর্কের এক উৎকৃষ্ট উদাহরন এই দুই ব্যাক্তি(সবুজের ছোট ফুফি আর এই বিধবা চাচী)। উল্লেখ্য যে, ঐ চাচীর স্বামী অর্থাৎ সবুজের চাচা ক্যাঞ্ছারে মারা যান যখন তখন তাঁর ছেলের বয়স ৬ বছর আর মেয়ের বয়স ৪ বছর। দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে চাচী তখন অকূল পাথারে। প্রথমত কিছুদিন বাড়ির লোকজন সুখ দুঃখের খোঁজ খবর নিলেও আস্তে আস্তে তাঁদের কর্তব্যে ভাটা পড়তে লাগলো। এক সময় অনেকের দায় এড়ানোর মনোভাবটা এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো যে, আপদ বিদেয় হলেই বাঁচি। কিন্তু, চাচী অনেক কষ্ট স্বত্তেও দুই অবুঝ সন্তান নিয়ে স্বামীর ভিটে আঁকড়ে পড়ে রইলেন। এতে করে লাঞ্ছনা , গঞ্জনা তাঁকে কম শুনতে হয়নি। দেবর, ভাশুর এমনকি সম্পর্কে চাচা শশুর হয় এমন ব্যাক্তিদের জড়িয়েও তাঁর নামে অনেক কুৎসা রটানো হয়েছে। আর এই ভিত্তিহীন রটনাগুলো সত্য ঘটনা বলে প্রমান করার অপপ্রয়াসে ছোট ফুফিকে মদদ যোগাতে হয়েছে সবুজকেই। আজ সে কথা মনে করে নিজেই অনুশোচনায় দগ্ধ হয়। পক্ষান্তরে কখনো কখনো ওর ভালোও লাগে এই ভেবে , না বুঝে শেখা টিকটিকিপনা সমাজের মানুষের কল্যানেও লেগেছে। ঠিক তেমনি একদিন লিলি ভাবীর কাছে এক ঘটনা শুনে সবুজের সচেতন মস্তিস্কে পুরনো নেশা আবার চড়ে বসল। সমাজের/ব্যাক্তির মঙ্গলের তরে কিছু একটা করতেই হবে, মনে জেদ চেপে বসলো। দীর্ঘদিন পরে গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে সবুজ। ও সবে সম্মান ৩য় বর্ষের ছাত্র। বাড়ির পাশের লিলি ভাবী ওর খুব ভালো বন্ধু। বাড়িতে এলে ভাবীর মুখে গ্রামের সমস্ত খবর এবং গল্প না শুনে ওর নিস্তার নেই। অবশ্য ভাবীর সাথে গল্প করতে না পারলে সবুজেরও ভালো লাগেনা। কিন্তু সেদিনের বিশেষ খবর শুনে একটু বেশিই রোমাঞ্চিত হল, কাকলি’কে নাকি জ্বিনে ধরেছে। মাঝে মাঝেই রাতে জ্বিনে ওকে ঘর থেকে বাইরে বের করে নিয়ে যায়। অমাবশ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতেও ঐ ফকিরের বাগানে (যেখানে দিনের বেলায় লোক যেতে ভয় পায়) ওকে কয়েকবার পাওয়া গেছে। ভাবী বলল, “ গত রাতে তোমার ভাইয়া একটু দেরী করে বাড়িতে ফিরছিল। নির্জন রাস্তায় কোথাও কেউ নেই অথচ ফকিরের বাগানের ভেতর থেকে ফিসফিস শব্দ শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো। আস্তে করে কাছে যেতেই কেউ একজন দৌড়ে চলে গেলো । টর্চ লাইটটা জ্বালতেই দেখল কাকলি। প্রথমত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হাতের পেয়ারা তোমার ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ভাইজান, পেয়ারা খান। তোমার ভাইয়া বলল তুই এত রাতে এখানে কি করছিস? পেয়ারা পেলি কোথায়? এইমাত্র কে দৌড়ে গেলো? কাকলি বলল জ্বিনে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, পেয়ারা দিয়েছে, আপনাকে দেখে ছুটে চলে গেছে। তোমার ভাইয়া ওকে বলল চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দেই। ও সুবোধ বালিকার মতো বলল আচ্ছা চলেন। ওকে পৌঁছে দিতে গেলে ওর মা বলল দ্যাখো বাবা আমার এই জ্বিনে ধরা মেয়েটাকে নিয়ে কি দুঃচিন্তায় পড়লাম, মাঝে মাঝেই জ্বিনে ওকে ঐ বাগানে নিয়ে যায়, নিজেই আবার ফিরে আসে। ভোর হলে ওর আর কিছুই মনে থাকেনা। তোমার ভাইয়া বলল তারপরও একটু দেখেশুনে রাখেন। তোমার ভাইয়া রাতে এসে সব আমাকে বলল শুনেতো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ”
সবুজের ৩ বছর আগের সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতিস্বরুপ রাত জেগে পড়ালেখার ধুম চলছে। হঠাৎ কাকলির মায়ের কান্নাকাটি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে দেখল টয়লেটের (গ্রামের বাড়িতে বসতঘর থেকে কিছুটা দূরে স্থাপিত) সামনে একটি হারিকেন জ্বলছে তাঁর পাশে একজোড়া স্যান্ডেল পড়ে আছে যা কাকলির পায়ে থাকার কথা। কাকলির মা কান্না করছে আর বলছে “ও প্রায় ২ ঘন্টা আগে ঘর থেকে বেরিয়েছে। আমি টের পেয়ে জিজ্ঞেস করায় বলল টয়লেটে যাচ্ছে। আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম, ঘরের চালে আম পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলে দেখি দরজা খোলা। তখন কাকলিকে ডেকে কোন সারা না পেয়ে বাইরে আসি। কিন্তু দেখি ও এখানেও নেই। আমার মেয়ে কই গেলরে!” ওর বাবাসহ বাড়ির পাশের কয়েকজন কাকলিকে চারিদিকে খুঁজছে। সবুজও ওঁদের সাথে খুঁজতে খুঁজতে ফকিরের বাগানের কাছে গেলো। ঠিক এমন সময় এলো চুলে বাগানের ভেতর থেকে কাকলি বের হচ্ছিলো জামা কাপড়ে লেগে থাকা ধুলো ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে। সকলের মুখোমুখি হতেই ও পাগলের মতো করতে লাগলো , চোখ পাকিয়ে তাকাতে লাগলো আর বলতে লাগলো জ্বিন... জ্বিন... জ্বিন... ইয়া বড় দাড়িওয়ালা জ্বিন... আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো বাগানের ঐ তালগাছের উপরে। ওখানে বসিয়ে আমাকে মিষ্টি খাইয়েছে, পেয়ারা খাইয়েছে তারপর অনেক্ষন পরে নামিয়ে দিয়ে গেছে। সবুজের ঘটনাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও সবার কথায় একপ্রকার ধরে নিতে বাধ্য হল যে কাকলির মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীরা বলতে লাগলো মেয়েটার উপর জ্বিনের আছর পড়েছে। এবার কাকলির এবং তার পরিবারের একটু বর্ণনা না দিলেই নয়। ষোড়শী কাকলি তার ৫ বোনের মধ্যে সবার বড়। অসাধারন সুন্দরী না হলেও গ্রামের ছেলেদের মাথা নষ্ট করার মতো যথেষ্ট রূপ ওর ছিল। গুনের কথা বলা হয়নি কারন গুন প্রকাশের কিংবা বিকাশের সুযোগ ও পায়নি। প্রাইমারির চৌকাঠ ডিঙ্গানোর সাধ থাকলেও সাধ্য ওর ছিলনা পারিবারিক কারনে। আর এর জন্য অসচ্ছলতা যতোটা না দ্বায়ী তার থেকে বেশি দ্বায়ী ওর পরিবারের গোঁড়ামি আর কুসংস্কারাচ্ছন্নতা। সবুজ ভাবতো একটা ছেলের আশায় বুঝি ওদের বোনের সংখ্যা পাঁচ। কিন্তু, যেদিন লিলি ভাবীকে কাকলির মা জিজ্ঞ্যেস করছিলো “ তোর মাত্র দুইটি ছেলে, তোকে আল্লাহ পাপ দেবেনা?” সেদিন বুঝল ওদের সংখ্যা বেড়ে এক ডজন পূর্ণ হলেও অবাক হবার কিছু নেই।
পরীক্ষার পড়ার চাপে পূর্বে যে ঘটনাকে সবুজ মামুলি একটা গ্রাম্য সাধারন ঘটনার বাইরের কিছু বলে মাথায় নেবার সুযোগ পায়নি দুই বছর পরে গ্রীষ্মের ছুটির অফুরন্ত সময় ঠিক সেই ঘটনাটি নিয়ে রিতিমত গবেষণা করার সুযোগ করে দিল ওকে। ফকিরের বাগান নাকি এক সময় শ্মশান ছিল। ১৯৪৭ সালে এখানকার হিন্দুরা ওপার বাংলায় পারি জমালে ইমান উদ্দিন ফকির ঐ জায়গা দখল করে গাছ লাগিয়ে দেন। শ্মশান ছিল বলে ওখানে সাধারণত মানুষের পদধূলি পড়তনা। আর এতে করেই ওখানকার গাছপালাগুলো নিজেদের মতো করে বেড়েছে যেমন ঠিক তেমনি আগাছাগুলোও বেড়েছে প্রতিযোগিতা করে। ফলে জায়গাটা বিশাল ঘন জঙ্গলে পরিনত হয়েছে। এমন অবস্থা হয়েছে যে কিছু কিছু জায়গায় দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো পৌঁছে না। তাছাড়া জনশ্রুতি আছে ওখানে দিনে বা রাতে কেউ একাকি গেলে সে আর সুস্থভাবে ফেরেনা। ওখানে গিয়ে অনেকে অনেক অস্বাভাবিক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। তাই একান্ত ঠেকায় না পড়লে কেউ ওদিকে পা বাড়ায় না। আর প্রয়োজনে গেলেও একাকী কেউ যায়না। কিন্তু রাঙা দাদীর আচার চুরি করে খাওয়া, তেঁতুল দিয়ে কচি লাউ মাখা খাওয়া, বাদশা মিয়ার দোকানের বেড়ার ফাঁক দিয়ে চুরি করা টোষ্ট/বিস্কুট/ সনপাপড়ি খাওয়ার জন্য সবুজের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ছিল ঐ ফকিরের বাগানের বেশ ভেতরে এক নিভৃত স্থান। আর এই সব সুকর্মের পরিকল্পনাকারী, বুদ্ধিদাতা ছিল সবুজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তুহিন। জায়গাটা সবুজকে তুহিনই চিনিয়েছিল। প্রথমদিন সবুজ ওখানে গিয়েতো অবাক। সুন্দর করে গাছের ডালপালা বিছিয়ে পাখির বাসার মতো করে সাজানো ছোট্ট একটা পরিপাটি বসার জায়গা। তুহিন ওকে প্রথম দিন বলেছিল ভূতে নাকি জায়গাটা এমন করে সাজিয়ে রেখেছে। কিছুদিন যেতে না যেতেই সবুজ বুঝে গেলো আসল ভূতটা কে। পাছে তুহিনের সাথে নিজের সুকর্মের সম্পৃক্ততা লোকে জেনে যায় এই ভয়ে ঐ বাগান সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীগুলো মিথ্যে প্রমান করার চেষ্টা সবুজ কখনোই করেনি। স্কুল পালিয়ে সময় পার করা, মুরগী চুরি করে রান্না করে খাওয়া, রস চুরি করে পায়েস খাওয়া, ডাব ,আম, পেয়ারা চুরি করে খাওয়ার মতো অপকর্মগুলো নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার জন্য ঐ বাগান সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীগুলো যেমন ওদের জন্য সহায়ক ছিল তেমনি ওদের দু’জনের দোস্তি ছিল তখন সময়ের দাবী। দু’জনের বন্ধুত্বে বিরহের সুর বাজতে শুরু করল সংসারের টানাপড়েন সামলাতে যখন তুহিনকে পড়ালেখা ছেড়ে ঢাকায় পারি জমাতে হল। গারমেন্সে চাকরি নিয়ে সংসারের চাহিদা পুরনের চেষ্টায় ব্যাস্ত হয়ে গেলো। এদিকে একাকী তুহিনের বিরহে কাতর সবুজ কিছুদিন মন মরা হয়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে, উপযুক্ত(বিশ্বস্ত) সঙ্গীর অভাবে অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পেরে মনের দুঃখে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করল। বছরে যে এক আধবার তুহিন বাড়িতে আসে তাতে করে আন্তরিকতায় ঘাটতি না থাকলেও দু’জনের দোস্তির সেই পূর্বরুপ আর দেখা যায়না। এই সুযোগে সবুজ ক্রমান্বয়ে ক্লাশের ভালো ছাত্রে পরিনত হয়ে উঠলো, পড়াশোনায় তার বেশ ঝোঁক এসেছে। তাই তুহিন যে ক’দিন বাড়িতে থাকে তার মাঝে মাঝে দু’জনের একত্রে সময় কাটলেও সেই পুরনো নেশা আর সবুজকে আগের মতো করে টানেনা, হয়তো তুহিনকেও নয়। পড়ালেখার নিষ্পেষণে সবুজ ওদের অতি প্রিয় সেই ভুতের জায়গাটিকে ভুলতে বসেছিল। লিলি ভাবীর কাছে সব শুনে পুরাতন স্থানটির প্রতি আবেগ যেন উথলে উঠলো। হিসেবের একটা সমীকরণ মেলানোর অদম্য স্পৃহা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। পরদিন দুপুরে সবার অগোচরে সবুজ একাকী ফকিরের বাগানে ঢুকল। ঘুড়তে ঘুড়তে হাজির বহু স্মৃতির সাক্ষী সেই প্রিয় স্থানে। ওর চোখ ছানাবড়া, এতদিন পরেও ঠিক যেন সেদিনের সেই চিরচেনা রূপ। সমীকরণ প্রায় মিলে গেছে, আর একটু অপেক্ষা । তুহিন এখন বাড়িতে আছে, দু’দিন আগে এসেছে। সবুজ ওইদিন রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে তুহিনদের বাড়ির কথা বলে বেরিয়ে গেলো। বলে গেলো ফিরতে দেরী হবে, রাতে নাও ফিরতে পারে। ও তুহিনদের বাড়িতে না গিয়ে রাত ৯ টা নাগাদ ফকিরের বাগানে ঢুকল। হাতের টর্চটা জ্বেলে অতি সন্তর্পণে পৌঁছে গেলো সেই ভূতের বাড়িতে। কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে অন্ধকারে এতক্ষণ কোনরকম ভয় কাজ না করলেও এখন কেমন যেন গা ছম ছম করছে। তুহিনের সাথে এখানে অনেকবার আসলেও একাকী এই প্রথম সে কথা মনে হতেই একটু ভয় ভয় করতে লাগলো । কিন্তু গোয়েন্দাগিরির নেশায় পরক্ষনেই সব ভয় উবে গেলো। টর্চটা জ্বেলে চারিদিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর সুবিধামত একটা গাছের ডালে উঠল। গামছা দিয়ে নিজের শরীরটাকে গাছের সাথে বেঁধে নিয়ে আরাম করে বসলো। গায়ে হালকা বাতাস লাগতেই বাড়ির থেকে প্রকৃতির এই পরিবেশটাকে অনেক আরামদায়ক লাগলো। কিন্তু প্রতীক্ষার সময় যেন কাটে না, প্রহর গুনে গুনে এক সময় অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে মগ্ন হয়ে গেলো। কখন যে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো নিজেও টের পায়নি। সুখের সেই দিনগুলো তাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে দিলো। ফিস ফিস কথার শব্দে যখন সবুজের চেতন ফিরল রাত তখন প্রায় ১২ টা বাজে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিলোনা, তবে বুঝতে পারছিলো দুটো কণ্ঠের ফিস ফিস শব্দ ঠিক ও যে গাছে চড়েছে টার ঠিক নীচে ওদের সেই প্রিয় স্থান থেকে আসছে। কিছুক্ষন কথা শুনে কণ্ঠ চেনার চেষ্টা করল, পুরোটা না হলেও কিছুটা বুঝতে পারলো। উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে গাছের ডালে বসেই বলে উঠলো ওরে সতর্ক শয়তান, আজ ধরা পরে গেছিস। নিজেকে বন্ধন মুক্ত করে নীচে নামতে নামতে যেটুকু সময় নিলো সেই সুযোগে একটা শরীর ছুটে পালাল। টর্চ জ্বেলে দেখতে পেলেও দৌড়ে ধরতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় কাকলি আর পালানোর সুযোগ না পেলেও তার প্রথাগত ঢঙে বলল জ্বিনে ধরে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। যে পালালো সে কে সবুজ জানতে চাইলে কাকলি উত্তর দিলো ও জ্বিন। সবুজ কাকলিকে আর বিব্রত না করে বলল বাড়িতে যাও। লৌকিকতার খাতিরে জিজ্ঞেস করল, সাথে আসবো, পৌঁছে দেই ? কাকলির জবাব না আমি একাই যেতে পারবো। কাকলি ওখান থেকে চলে গেলে সবুজ ঐ স্থান থেকে একটা স্যান্ডেল আর একটা ব্রেইসলেট সংগ্রহ করে দ্রুত তুহিনদের বাড়িতে ফিরল। দেখল তুহিন টিউবওয়েলের ধারে হাত মুখ ধুচ্ছে। সবুজ তুহিনের কাছে যেতেই তুহিন চমকে উঠে বলল, “ তুই এত রাতে এখানে?” সবুজ উত্তরে বলল, গরমে ঘুম আসছিলো না তাই রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম কিন্তু তুই না যাত্রা দেখতে গেলি, এত তাড়াতাড়ি যাত্রা শেষ হয়ে গেলো? তুহিন বলল না রে শেষ হয়নি, তবে ভালো লাগছিলনা তাই চলে এলাম। তুই খালি পায়ে কেন জানতে চাইলে তুহিন উত্তর দিলো “ আর বলিস না দোস্ত, স্যান্ডেল জোড়া যাত্রার ময়দান থেকে চুরি হয়ে গেছে। ” ও আচ্ছা , ঘরে চল তোর সাথে কথা আছে এই বলে সবুজ তুহিনকে নিয়ে ওদের ঘরে গেলো। আলো জ্বালতেই তুহিনের চোখ গেলো সবুজের হাতের দিকে, একটা স্যান্ডেল । কিরে পা ছেড়ে স্যান্ডেল হাতে উঠলো কেন? সবুজ বলল আমার পায়ের স্যান্ডেল আমার পায়েই আছে, এইটা হাতে উঠেছে এক সতর্ক শয়তানকে শায়েস্তা করার জন্য। এখন বল, কাকলিকে জ্বিনে ধরেছে কতদিন হল? আমি কি করে জানব কতদিন হল, তুহিনের উত্তর। সবুজ বলল, না মানে আমি যতদূর জানি কাকলিকে যতবার ঐ ফকিরের বাগানে জ্বিনে ধরে নিয়েছে অর্থাৎ যতবার ওকে রাতে বাড়ির বাইরে পাওয়া গেছে তুই বাড়িতে ছিলি। তুই ঢাকায় অথচ ওকে জ্বিনে ধরেছে এমনটা কখনই হয়নি। তুহিন বলল, এটা কাকতালীয় ব্যাপার। সবুজ বলল যাত্রার ময়দানে তোর স্যান্ডেল হারাল অথচ তাঁর একটা পেলাম ফকিরের বাগানে, দেখতো এইটা তোর স্যান্ডেল না? এটাও কি কাকতালীয়? তুহিন কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল চোর হয়তো বাগানে ঢুকেছিল। তুহিনের হাতের দিকে তাকিয়ে সবুজ জানতে চাইলো,একি তোর হাতে রক্ত কেন, কি হয়েছে ? যাত্রা দেখে ফেরার পথে রাস্তার উপর পরে থাকা বাঁশের কঞ্চিতে লেগে কেটে গেছে , তুহিনের উত্তর। ও আচ্ছা, তোর হাতে যে ব্রেইসলেটটা ছিল সেটা কই? তুহিন বলল ওটা খুলে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি। দেখিনা তোর ব্রেইসলেটটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমাকে ক’দিনের জন্য দে ওটা। তুহিন ড্রয়ার খুলে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলো। ইতিমধ্যে সবুজ জিজ্ঞ্যেস করলো, আচ্ছা তুই যাত্রাপালা দেখতে গেলি যখন তখনতো তোর বাড়ির লোকেরা জেগেই ছিল, অথচ তুই এসে ঘরের দরজার ছিটকিনি বাইরে থেকে খুললি ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। যাই হোক ব্রেইসলেটটা পেলিনাতো ? জানতাম পাবিনা, দেখত এইটা চিনিস কি না? পকেট থেকে ব্রেইসলেটটা বের করে ওর সামনে ধরল। তুহিন সবুজের হাত চেপে ধরে বলল, “ দোস্ত, আমাকে বাচা। কাউকে কিছু বলিস না। তোকে আমি সব বলছি। কিন্তু বলতো তুই আমাকে সন্দেহ করলি কি করে?” সবুজ বলল, লিলি ভাবীর কাছে সব শোনার পরে ভাবলাম ফকিরের বাগানে এত ঘুরলাম কখনো তোকে বা আমাকে জ্বিনে ধরলনা অথচ কাকলিকে ধরল। মনে পড়ল ৩ বছর পূর্বে যে রাতে ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা ঠিক সেদিনই তুই বিকেলে বাড়িতে এসেছিলি। আমরা পাড়া পরশি সবাই কাকলির মায়ের কান্না শুনে ওদের বাড়িতে জড় হয়েছিলাম কিন্তু তুই ছিলিনা। তাছাড়া তোর সেদিনের বানানো ভূতের গল্পের সাথে জ্বিনের গল্পের সূক্ষ্ম একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলাম পরেরদিন ঐ বাগানে গিয়ে আমাদের সেই চেনা স্থানটিকে ঠিক পূর্বের মতো দেখতে পেয়ে। সন্দেহটা জোড়াল হল আজ বিকেলে , তোকে দাওয়াত করলাম আমাদের বাড়িতে রাতে খেয়ে আমার সাথে থাকার জন্য কিন্তু তুই রাজি হলিনা। বললি মালির বাজারে যাত্রাপালা দেখতে যাবি। অথচ আমাকে একবারও যাবার জন্য বললি না। রাতে ফকিরের বাগানে ঢোকার আগেও আমি তোর জানালায় উঁকি মেরে তোকে দেখে গেছি । যাত্রাপালা দেখতে গেলে অনেক আগেই যেতিস। সমীকরণটা প্রায় মিলে গেলো। তুহিন বলল পুরোটাই মিলে গেছে, এখন সমাধান তোর হাতে। আমি কাকলিকে ভালবাসি ছোটবেলা থেকেই কিন্তু তোকে তখন বলিনি ফাঁস হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে । দিনের বেলায় যেখানে তুই আমার সঙ্গী ছিলি রাতে ঠিক সেখানটাতেই কাকলি থাকতো আমার সাথে। একটু বড় হয়ে বলতে পারিনি তুই ভুল বুঝতে পারিস তাই। আর যখন তোকে সব বলার মতো বয়স হল তখন তোর আমার মাঝে একটা অদৃশ্য দূরত্ব হয়ে গেছে। কিন্তু বন্ধু, ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। সবুজ বলল কিন্তু এইভাবে আর কতদিন চলবে, কতদিন মানুষকে জ্বিনের গল্প বলে ধোঁকা দিবি ? তুহিন বলল কি করব বল, বাবা-মা কে বিয়ের কথা বলতে সাহস পাচ্ছিনা, আবার ওকে ছেড়ে থাকতেও পারছিনা। সবুজ বলল তাইতো বাড়িতে এলেই একটা রাতও মিস হয়না তাইনা? গত রাতে সুমন ভাইয়ার হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেলি, আজ রাতেই আবার! তোরা দুটোই নেশায় ডুবেছিস! বুঝেছি একটা কিছু করতে হবে, আয় এখন ঘুমাই। রাতে দু’জন একসাথে ঘুমাল। ঘুম কি আর হয়, গল্প করে আর পুরনো স্মৃতিচারনে রাত পার হয়ে গেলো। পরদিন ভোরে উঠেই সবুজ কাকলিদের বাড়িতে হাজির। কাকলির মাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় শেষে বলল চাচী, কাকলি রাতে কোথায় গিয়েছিলো জিজ্ঞ্যেস করেনতো। কাকলির মা বুঝতে পেরে বলল , কি করি বলত বাবা? মেয়েটাকে জ্বিনে ধরেছে অনেকদিন হল। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে ও ঐ ফকিরের বাগানে চলে যায়, ভোর হলে আর কিছু মনে থাকেনা। জানাজানির ভয়ে চিকিৎসাও করাতে পারছিনা। সবুজ বলল আমার পরিচিত এক কবিরাজ আছে যে লোক সমাগম ছাড়াই জ্বিন তাড়াতে পারে। আর বেশ ভুষা দেখেও কেউ বুঝতে পারবেনা কিছু। আপনারা রাজি হলে আমিই সব ব্যাবস্থা করব। টাকা পয়সাও তেমন লাগবেনা, শুধু এক বেলা ভালো রান্না করে খাওয়ালেই হবে। ছোট বেলায় যেমনই থাকনা কেন সবুজ এখন এলাকায় হীরার টুকরা ছেলে। তার উপর কাকলির মার অগাধ বিশ্বাস তাই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলো। সবুজের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে সবুজের দূর সম্পর্কের এক নানাকে কবিরাজ সাজিয়ে আনা হল। অনেক ঝার-ফুঁক, হাত দেখা, গননার শেষে কবিরাজের চোখ বন্ধ করে মন্তব্য “ এ বড়ই খারাপ জ্বিন, অনেক দিন হল আছর করেছে এই মেয়ের উপর, অনেক দূরে নিয়ে গেছে একে, ১ মাসের মধ্যে বিয়ে না দিলে অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলবে এমনকি মেরেও ফেলতে পারে। ” কাকলির বাবা বিচলিত হয়ে উঠলো, আর কাকলির মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো- ওরে আমার মেয়েটাকে কিভাবে বাঁচাবোরে! সবুজ অনেক বুঝিয়ে তাঁদের শান্ত করলো। কাকলির বাবা বলল কিন্তু বাবা, এত কম সময়ের মধ্যে কিভাবে মেয়ের বিয়ে দেবো, আর ছেলেই বা পাব কোথায়? সবুজ বলল আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি একটা ছেলের সন্ধান দিতে পারি। কে জানতে চাইলে কাকলির বাবাকে সবুজ তুহিনের নাম বলল। সাথে সাথে কাকলির মা নাক সিটকিয়ে বলল “ ঐ কাইল্যা কাউয়ার সাথে আমার কমলার মতো সুন্দর মেয়ের বিয়ে আমি দেবনা।” সবুজ বলল কিন্তু চাচী আপনার এই জ্বিনে ধরা মেয়েকে জেনেশুনে কে বিয়ে করবে? তাছাড়া তুহিন ছেলে হিসেবে খুবই ভালো। লেখাপড়া কম হলেও কর্মঠ এবং সৎ। চাকরি করে এখন ভালো বেতনও পায়। শুধু গায়ের রঙটাই কালো। কাকলির বাবা বলল হ্যা সবুজ ঠিকই বলেছে। কাকলির মাও বলল তা অবশ্য ঠিক। আপনার মেয়ে ওর ঘরে সুখেই থাকবে বলে সবুজ বলল এখন কাকলির কাছে জিজ্ঞ্যেস করে দেখেন ওর কোন আপত্তি আছে কিনা। কাকলির মুখটা এতক্ষনে যেন চকচক করে উঠলো। কাকলির বাবা কাকলিকে বলল “ কিরে মা, তুহিনকে বিয়ে করতে তোর কোন আপত্তি আছে কি না? ” কাকলির মুখটা লজ্জায় নিচু হয়ে গেলো। ও শুধু বলল তোমাদের যা মত। কাকলির বাবা মা সমস্বরে বলে উঠলো আমরা রাজি। সবুজ একটু গম্ভীর হয়ে ভাব নিয়ে বলল শুধু আপনারা রাজি হলেইতো হবেনা, ছেলে রাজি আছে কিনা তাওতো জানতে হবে। শুনে কাকলি যে একটু মুচকি হাসলো তা সবুজের চোখ এরায়নি। কাকলির বাবা মা বলল দ্যাখো বাবা, তুহিন তোমার বন্ধু, তুমি একটু ওকে বোঝাও, তোমার কথা ও ফেলতে পারবেনা। সবুজ বলল দেখি আমি কি করতে পারি। এরপর সাজানো কবিরাজ নানাসহ সবুজের ভুরিভোজ বেশ ভালোই হল। মুরুব্বিদের মতো ভাব নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় সবুজ কাকলির চোখে মুখে একটা কৃতজ্ঞতার ছাপ দেখল। কাকলিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা তুহিনদের রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল সবুজ। চাচী, আর কতদিন এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এই হেঁসেলের ঘানি টানবেন? কি করব বাবা, কে আমার কাজ করে দেবে? কেন তুহিনের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধু ঘরে আনলেই হয়। তুহিনের মা বললেন মনে মনেতো ভাবছি অনেকদিন ধরে, কিন্তু ও কি এখনই বিয়ে করতে রাজি হবে? তাছাড়া আমার ছেলের যা গায়ের রঙ তাতে করে একটা ফর্সা মেয়ে ঘরে না আনলে আমার নাতি নাতনিদের দিনের বেলাতেও টর্চ জ্বেলে খুঁজতে হবে। তাই আমার খুব ইচ্ছে একটা সুন্দর মেয়ে পুত্রবধূ করে ঘরে আনবো। কিন্তু, আমার এই গারমেন্সে চাকরি করা কৃষ্ণকে কে এমন সুন্দরী মেয়ে দেবে? সবুজ বলল সব আমার উপর ছেড়ে দেন আমি সব ব্যাবস্থা করছি। আপনার মনের খায়েশ পূরণ হবে। আপনি শুধু মত দিলেই হয়। কাকলির কথা শুনে প্রথমত একটু আপত্তি করলো জ্বিনে ধরা প্রসঙ্গ তুলে। কিন্তু কাকলির রূপে তিনি মুগ্ধ ছিলেন কাকলির বাল্যকাল থেকেই। মনে মনে কখনো ওকে পুত্রবধূ করার বাসনাও পোষণ করেছেন তাই হয়তো মাঝে মাঝেই বলতেন ইস এত সুন্দর মেয়েটার উপর জ্বিন আছর করল! অবশেষে সবুজের কাছে বিয়ের পরে কাকলির ভালো হওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত হয়ে বিয়েতে মত দিয়ে দিলেন। অতঃপর সবুজের সার্বিক ব্যাবস্থাপনায় দুই পরিবারের পূর্ণ সম্মতিতে শুভ লগ্নে কাকলির আর তুহিনের শুভ পরিনয় সম্পন্ন হল।
ওদের সংসারজীবন বেশ সুখেই কাটছে। আর আমাদের জন্য সুখের সংবাদ হল, আজ দীর্ঘদিন হয়ে গেলো রাতের বেলা কাকলিকে কেউ ঘরের বাইরে দেখেনি। ওকে এখন আর জ্বিনে ধরেনা...............
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:২৪