_ "বাবা, সাইড নিয়ে হাঁটো । এই জায়গাটায় এসে তিনদিক দেখেশুনে রোড পার হবে । বলা যায় না কখন কোনদিক থেকে আজরাইল এসে পড়ে । "
-
এই একটি বাক্য আমি প্রতিদিনই শুনি । আমার মায়ের মুখে থেকে নয় তবে একজন ছেলেহারা মা'র মুখ থেকে শুনছিলাম ।
-
প্রতিদিনকার মতো আমি আজও হাঁটার জন্যে বের হলাম মেস থেকে । মন যখন খারাপ থাকে তখন আমি প্রায় সময়ই এই দিকে হাঁটতে বের হই একা একা । আমি প্রতিদিন দেখি একজন মহিলা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, বসে নেই কিন্তু । তিনি পায়চারি করেন । একজায়গায় বসে থাকেন না । এই রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে বা আসলে তাঁকেই নিজের ছেলে মনে করে উক্ত কথাটি বলেন যা আমাকে প্রতিদিনই বলতেন । আমি খুবই আশ্চর্য হতাম উনার এমন উপদেশ দেখে । কেনোনা রাস্তাঘাটে কতধরণের লোক নানাকাজে এই রাস্তা দিয়ে যায় । সবাইকেই কেন তিনি উক্ত কথাটি বলে হুশিয়ার করে দেন । এর পিছনে আসলে কী কারণ থাকতে পারে? আমার মনে এই কৌতূহল নিয়ে আজ জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, -
_ "আচ্ছা আপনি প্রতিদিন আমাকে কেন হুশিয়ার করে দেন এই মোড়ে আসলেই?"
উনার উত্তর ছিলো, তখনি উনার চোখে পানির টলমল দেখা গেলো-
_ "আমার ছেলের বয়স ২৪ বছর । সবে মাত্র পা দিয়েছে ২৪ বছরে । ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো । একদিন সে বড় হবে এবং ইঞ্জিনিয়ার হবে । আমার ছেলেকে আমি অন্যের বাড়ি রান্নাবান্নার কাজ করে পড়াশোনা করিয়েছি । ছেলেটি আমাদের পরিবারের অবস্থা বুঝতো । সেও পড়াশোনার পাশাপাশি রিক্সা চালাতো এই সিলেট শহরে । রিক্সা চালিয়ে যে দুপয়সা পেত সেগুলো দিয়ে সে তার পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে পারতো আর আমি মানুষের বাড়ি কাজ করে যা পেতাম তা দিয়ে কোনোরকমে খেয়েপড়ে থাকতাম আমার গ্রামে । ছেলেকে সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি করিয়েছি টাকা ধার করে এনে । সেগুলোর সুদও আমার ছেলে রিক্সা চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলো । ছেলের চোখেও খুব বড় স্বপ্ন ছিলো, সে একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে এবং তার মায়ের স্বপ্ন ও ইচ্ছা পূরণ করবে ।
কিন্তু আমার ছেলে স্বপ্ন পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়নি । এর আগেই উপরওয়ালা তাকে নিয়ে গেছেন ।
প্রতিদিনকার মতো সেদিন সকালেও আমার ছেলে রিক্সা চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে বের হয়েছিলো কিন্তু এই জায়গায় এসে সে আর যেতে পারেনি । তিন রাস্তার মোড় থাকায় ডান দিকের রোড থেকে একটা গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা মেরে চলে যায় । আমার ছেলেটা রিক্সা থেকে পড়ে যায় । রক্তমাখা দেহ নিয়ে সে ছটফট করছিলো আমার ছেলেটা । কতই না কষ্ট পেয়ে ওর জান চলে গেছে । গরমের দিন ছিলো । হয়তোবা আমার ছেলেটা একটু পানি খেতে চেয়েছিলো । ধীরে ধীরে আমার ছেলের চোখ বন্ধ হয়ে যায় । আশেপাশের লোকেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করেন । মারা যাওয়ার সাথে সাথেই আমার ছেলের স্বপ্ন এবং আমার স্বপ্ন থেমে যায় ।
আমার একটা মাত্রই ছেলে । আমি ওকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবো ভেবে কোলকিনারা পাচ্ছি না ।
-
তিনি যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন কাঁদছিলেন আর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছিলেন । আমার মন ভারী হলো ছেলে হারানো এই মায়ের কান্নার শব্দে । আমি অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম । এরপর আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেন, "রাস্তাঘাট দেখে চলবে বাবা । আমার ছেলে মারা গিয়েছে কিন্তু আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয় ।"
-
Friday, 03 May 2019
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১৯ সকাল ৮:১১