সুনয়না এতদিন শুধু পড়া ফাঁকি দিয়েই গেছে । আগে সন্ধ্যার পর বাড়িতে ফোনে কথা বলার পর বই হাতে নিয়ে পড়তো কিন্তু এখন ঠিক উল্টোটাই করছে । বাড়িতে ফোন দিবে তা তো দূরের কথা, বই-ই হাতে নেয়না । সেই যে মোবাইল লাগাবে কানে, লাগানোই থাকে । কথা বলার জন্য ছাদে চলে যায় । কলেজ হোস্টেলে তো আর স্বাধীনভাবে রুমমেটটদের সামনে ওভাবে খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারবে না । এতে করে তাদের সমস্যা হবে ।
-
সুনয়নার পরীক্ষা চলে আসলো । পরীক্ষার ফি'র জন্য টাকা প্রয়োজন । বাবার থেকে কীভাবে সে টাকা চাইবে বুঝে উঠতে পারছিলো না । কেনোনা সে কয়েকদিন আগেই বাবাকে পরীক্ষার ফি'র কথা মিথ্যে বলে বাবার কাছ থেকে টাকা এনেছিলো । টাকা এনে উড়িয়েছে নিজের চাহিদের পিছনেই । একবারও বাবার কষ্টের কথা ভাবেনি, ভাবেনি কীভাবে বাবা টাকাটা জোগাড় করে দিয়েছেন, একবারও তা জানতে চায়নি সুনয়না । সুনয়না বাবাকে টাকার কথা বলতে পারেনি ।
হঠাৎ সুনয়নার মনে পড়লো ওর ফেসবুকেরই একজন বন্ধুর কথা । ওর নাম সৌহার্দ্য । খুবই ভালো ছেলে । একদিন ছেলেটা বলেছিলো সুনয়নাকে "কখনো টাকা-পয়সার সমস্যায় পড়লে তাকে যেন বলে" । যেই মনে হওয়া সেই বলা । সুনয়না ম্যাসেজ করলো সৌহার্দ্যকে । সৌহার্দ্য সুনয়নার সব কথা শুনে সে সুনয়নার পরীক্ষার ফি দিয়ে দেয় । ভালোভাবেই পরীক্ষা দেয় । পরীক্ষা শেষে সৌহার্দ্যের সাথে সুনয়নার খুব ভালো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে । ম্যাসেজে কথা বলা থেকে ফোনালাপ পর্যন্ত গড়ায় সম্পর্কটা । দিনে কম হলেও ৪/৫ বার কথা হয়ই তাদের মধ্যে । সৌহার্দ্য ছেলেটা অনেকটা শৌখিন । বাবার আদরের একমাত্র ছেলে । তাই যা চায় তাই-ই পায় ।
-
একদিন সুনয়না ও সৌহার্দ্য ঠিক করলো তারা দুজনে দেখা করবে । দেখা করার জায়গাও ঠিক হলো । সৌহার্দ্য কখনো দেখেনি সুনয়নাকে । কখনো ছবি চায়নি । কিন্তু সুনয়না ঠিকই সৌহার্দ্যের প্রোফাইলে ওর ছবি দেখেছে । ছেলেটা দেখতে এককথায় অনেক সুন্দর ।
নির্দিষ্ট সময়ে সৌহার্দ্য আসলো । সুনয়না যেভাবে যা করতে বলেছিলো ঠিক সেভাবেই সব করলো সৌহার্দ্য । সৌহার্দ্য গোলাপফুল হাতে বসে রইলো একটা চেয়ারে । কিছুক্ষণ পর সুনয়না এসে পিছন থেকে সৌহার্দ্যের দুচোখ মুঝে ধরল । সৌহার্দ্য তার দুই হাত দিয়ে সুনয়নার দুইহাত ধরেই বললো 'সুনয়না!' ।
সুনয়না মিষ্টি একটা হাসি দিলো, গালে টোল পড়লো । সৌহার্দ্য পিছনে তাঁকিয়ে হতবাক হয়ে গেলো । একজন মানুষ এত্ত সুন্দর হতে পারে!! ঈশ্বর সুনয়নাকে নিজ হাতে যত্ন করে গড়েছেন নিখুঁতভাবে । ওর কি হাসি, সুদীর্ঘ পল্লব বিশিষ্ট কাজল কালো মায়াবী দুটি চোখ আর ঘন কালো চুল তার রুপ কে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, সেই চোখে আজ সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে সৌহার্দ্য ।
সৌহার্দ্যের পাশে এসে বসলো সুনয়না । সুনয়নার পরনে নীল শাড়ী, কপালে নীল টিপ, হাতে কাচের নীল চুড়ি দেখে বলতে লাগলো "অপরুপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী" । সুনয়না-
_ "কীই শুধু তাঁকিয়েই থাকবা নাকি?"
_ "ওহ! না হ্যা, আসলে তোমাকে দেখছিলাম । তুমি কত্ত সুন্দর । সৃষ্টিকর্তা তোমায় অনেক যত্ন করে বানিয়েছেন । কোনো খুঁত রাখেননি ।"
_ "হয়েছে!
আর বলতে হবেনা । এখন বলো কি অবস্থা? আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?"
_ "না,
আসতে তো কোনো সমস্যা হয়নি কিন্তু আসার পর যা সমস্যা হবার তা তো এখনই হচ্ছে ।"
... সুন্দর এক চিলতে হাসি দিয়ে-
_ "বসেই থাকবে নাকি.. হাত ধরবে না?"
_ "হাত ধরতে বলছো?"
_ "নয়তো কি! হাদারাম.."
... হাত ধরে নিজের উরুতে এনে রাখলো সৌহার্দ্য । ইচ্ছে করছে ওর হাত ধরে ওর পাশে দাঁড়িয়ে হাঁটতে কিন্তু ভয় হচ্ছে কীভাবে বলবে ওকে । সুনয়না ওর হাবভাব বুঝে-
_ "অভয় দিলাম.."
... সৌহার্দ্য অভয় পেয়ে সুনয়নার হাতের চারটা আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল ডুকিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো । আর চারদিকে তাঁকাতে লাগলো । ও ভাবতে লাগলো হয়তো ভুল করে প্রেমিক-প্রেমিকাদের পার্কে চলে আসছে । ডানদিকে তাঁকালো,
'একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ।'
বামে তাঁকালো,
'প্রেমিক তার প্রেমিকার হাতে চুমু খাচ্ছে ।'
পিছনে ফিরে আরেকটা জায়গায় দেখলো,
'একজন আরেকজনকে চুমু খাচ্ছে ।'
-
সৌহার্দ্যের সবই লক্ষ্য করছে সুনয়না কিন্তু কিছু বলতে পারছে না । সুনয়না ফুচকা খেতে পছন্দ করে । ফুচকাওয়ালার কাছে গিয়ে ফুচকা কিনে খেলো দুজনেই । সৌহার্দ্যের চোখ-মুখ ও কান লাল হয়ে গেলো । সুনয়না বললো-
_ "ঝাল খেতে পারো না?"
_ "উম, না মানে, আসলে খেতে পারি আবার পারিও না ।"
_ "হুঁ,
হয়েছে! দেখেছি তো কি ঝাল খেতে পারো । দেখতো আমিও তো খাচ্ছি । তোমার মতো চোখ-মুখ ও কান লাল হয়ে যায়নি ।"
... এমনিতেই সৌহার্দ্যের কান আর মুখ জ্বলছে আর ওদিকে সুনয়না মজা নিচ্ছে । তক্ষুনি একটা দুষ্টুবুদ্ধি আটলো সৌহার্দ্য । চুপিসারে ফুচকাওয়ালার মরিচের কৌটো থেকে অনেকটা মরিচের গুড়া নিয়ে সুনয়নাকে পিছনে কিছু একটা আছে বলে পিছনে ঘুরিয়ে প্রতিটা ফুচকার ভেতর ঢেলে দিলো । সুনয়না ঠেরও পেলো না ।
সুনয়না খাচ্ছে আর মুখে ফুচকা নিয়ে গাল ফুলাচ্ছে । দেখা যাচ্ছে মুখের মরিচ চোখের ভিতরে গিয়ে লালচে আকার ধারণ করেছে । সুনয়না এটা সইতেও পারছে না, কিছু বলতেও পারছে না । একসময় সইতে না পেরে ফুচকার প্লেট ফেলে দিয়ে লাফিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো আর 'জল, জল, জল দাও, জল' বলে চেঁচাতে লাগলো । সৌহার্দ্য পানি নিয়ে প্রস্তুত ছিলো । ওকে পানি দিয়ে হাসতে লাগলো । আর এতে সুনয়না অনেক রাগ হলো এবং শেষে পুরো পানি ওর উপর ঢেলে দিলো ।
সুনয়না আর সৌহার্দ্যের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা নেই কিন্তু সৌহার্দ্য চায় সুনয়নার সাথে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হতে কিন্তু সাহস পাচ্ছেনা বলতে । সুনয়না খুবই চালাকচতুর মেয়ে তাই সৌহার্দ্যের মনের কথা বুঝতে পারে ।
-
দিনদিন তারা একে অপরকে গভীরভাবে চিনতে ও জানতে থাকলো । একদিন কথা না হলে কেউ একটা মুহুর্ত কাটাতে পারেনা । দিনে অন্তত একবার হলেও কথা বলতে হয় । সুনয়নার সাথে এর আগে কখনো এমনটি হয়নি । কিন্তু সুনয়না প্রেম-ভালোবাসায় জড়াতে চায়না । 'যে মেয়ে সবই বুঝতে পারে সেই মেয়ে কেনোই বা সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চাচ্ছেনা?' সৌহার্দ্য শুধু তাই-ই ভাবে ।
-
একদিন সুনয়নার রুমমেটরা হোস্টেল ম্যানেজারের কাছে নালিশ করলো সুনয়নার ব্যাপারে । সুনয়না নাকি আগের চেয়ে আরোও বেশি ফোনে কথা বলে আর এতে করে ওদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে । হোস্টেল ম্যানেজার সুনয়নাকে ওয়ার্নিং দিলো পরবর্তীতে যেন ওদেরকে আর বিরক্ত না করে, ওদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত না ঘটায় । কিন্তু সুনয়না সৌহার্দ্যের সাথে কথা না বলে থাকতে পারবে না । সবসময় কি আর ছাদে গিয়ে কথা বলা যায়, রাত্রিবেলা তো অসম্ভবই । এসব ব্যাপারে জানালো সৌহার্দ্যকে । সৌহার্দ্য সুনয়নার সমস্যার কথা শুনে একটা উপায় বললো সুনয়নাকে ।
_ "সুনয়না এক কাজ করতে পারো । তুমি না হয় একটা ছোট রুম নিয়ে একাই থাকো । আমি রুমভাড়া দিবো আর তুমি শুধু খাওয়া-দাওয়ার খরচটা চালিয়ে নিও ।"
_ "আচ্ছা ঠিক আছে ।"
... সুনয়না খুব খুশিই হলো সৌহার্দ্যের এই উপায় শুনে । যেই ভাবা সেই কাজ । মাসের ১ তারিখেই সে হোস্টেল পরিবর্তন করে একটা বাসা নেয় এবং সেখানে থেকেই সে পড়াশোনা চালিয়ে যায় ।
-
চলবে...
17 January, 2019
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:৪৭