আজ প্রায় ৪ মাস পর সুনয়না বাড়িতে আসছে । অমল বাবু এবং অরিত্রী দেবী অনেক খুশি এই ভেবে যে, অনেকদিন পর তাঁদের কলিজার টুকরো মেয়ে আসছে বাড়িতে । অরিত্রী দেবী সকাল সকাল অমল বাবুকে বাজারে পাঠালেন । মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করবেন তাই । সুনয়না বাসায় ফিরার আগেই রান্নাবান্না শেষ করলেন এবং অমল বাবুও আর দোকানে যাননি দুপুরের পর । মেয়েকে নিয়ে আসতে দুজনেই গেলেন বাসস্ট্যান্ডে মেয়ের আসার অপেক্ষা করতে ।
অপেক্ষা করতে করতে সুনয়না কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসলো । কাঁধেচাপা কলেজ ব্যাগ তাতে বই আছে এবং হাতে কিছু কাপড়চোপড় । অমল বাবু ওর কলেজ ব্যাগ কাঁধে নিলেন এবং অরিত্রী দেবী ওর কাপড়ের ব্যাগ ।
-
অমল বাবু ও অরিত্রী দেবী লক্ষ্য করছেন, মোবাইল পাওয়ার পর তাঁদের মেয়ে আগের তুলনায় অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে । আগে বাড়ি ফিরেই আগে জড়িয়ে ধরতো কিন্তু এবার তা ভিন্ন হলো, জড়িয়ে ধরলো না । কেমন জানি চুপট মেরে থাকছে । সারাদিন দরজা বন্ধ করে দিয়ে মোবাইল টিপছে । আগে বাড়ি ফিরলে অরুন্ধতীকে সাথে নিয়ে আসতো নয়তো অরুন্ধতী আগে বাড়ি চলে আসলে ও আসার পর ফোন করে বাসায় ডেকে নিতো । কিন্তু এবার ব্যতিক্রম সবকিছুই । উনারা ভাবতে পারছেন না আসলে কি করবেন । মোবাইল দিয়ে খাল কেটে কুমির আনলেন । মোবাইল পাওয়ার পর মেয়ে আর আগের মতো স্বাভাবিক মনমানসিকতায় নেই ।
-
মেয়ে প্রায় ১ সপ্তাহ থাকলো । মেয়ে যা যা খেতে পছন্দ করে তা সব অরিত্রী দেবী নিজ হাতে রেঁধে খাওয়ালেন । আজ মেয়ে চলে যাবে ঢাকায় । অমল বাবু এবং অরিত্রী দেবী হাসিমুখে মেয়েকে গাড়িতে দিয়ে আসলেন এবং যথাসময়ে সুনয়না ঢাকা পৌঁছে গিয়ে মা-বাবাকে ফোনকলে জানিয়ে দিলো । বাবা-মা 'ভালোমতো গিয়েছো কি না' জিজ্ঞেস করলে সে উত্তরে 'ভালোভাবেই এসেছি' বলে রেখে দিলো । খুব কষ্ট পেলেন মেয়ের এমন ব্যবহারে ।
-
সুনয়না ঢাকা পৌঁছানোর পর আর নিজ থেকে ফোন দেয়নি বাড়িতে । ওর বাবা-মা ফোন দিলেই শুধু 'হ্যাঁ, হুঁ' করেই শেষ । অমল বাবু ও অরিত্রী দেবী ভাবতে লাগলেন, মেয়ের হাতে মোবাইল যাওয়ার পর থেকে আমাদের সাথে কথা বলার সময় হচ্ছেনা ওর ।
-
আজ সুনয়না বাড়িতে ফোন করলো,-
_ "বাবা,
কেমন আছো? আর মা কেমন আছেন?"
... মেয়ে নিজ থেকে ফোন দেওয়ায় অনেক খুশি হয়েছেন তাঁরা দুজনেই ।
_ "হ্যাঁ মা,
আমরা দুজনেই ভালো আছি । তোমার শরীর ভালো আছে তো মা?"
_ "হ্যাঁ বাবা,
ভালো আছি আমি । বাবা এখন টিউশনি পাচ্ছি না । আগেরগুলোরও পরীক্ষা শেষ । এখন টাকার প্রয়োজন । কালকে প্রাইভেটের টাকা দিতে হবে । সবাই টাকা দিয়ে দিয়েছে শুধু আমিই দিবার বাকি । কাল সকালে প্রাইভেট আছে তখন দিয়ে দিতে হবে । ১০ টার আগে টাকা পাঠাতে পারবে বাব?"
_ "আচ্ছা ঠিক আছে মা,
আমি কাল দোকানে যাওয়ার পথে টাকাটা দিয়ে দিবো তোমাকে নাম্বারে বিকাশ করে ।"
-
সকাল হতে না হতেই অমল বাবু মেয়েকে টাকা দেওয়ার জন্য বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন । বাজারে পৌঁছে দেখেন যে দোকানদার এখনো তার দোকান খুলেনি । ওদিকে ১০ টা বাজতে চললো । অমল বাবু চিন্তায় পড়ে গেলেন । পায়ে হেঁটে গেলেন প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে মেয়েকে টাকা পাঠাতে । গিয়ে দেখলেন একটা বিকাশের দোকান খোলা আছে । দোকানে অনেক ভিড় । অন্যদিন ভিড় থাকলেও তিনি দাঁড়িয়ে থেকে টাকা পাঠান কিন্তু আজ ভিড় থাকা সত্বেও তিনি এজেন্টকে বললেন, মেয়ের টাকার খুব প্রয়োজন । আমাকে একটু সুযোগ দিন টাকাটা আগে দেওয়ার । দোকানদার উনার কথা শুনে টাকাটা দিয়ে দিলেন । মেয়েকে সাথে সাথে ফোন করলেন,-
_ "মামনি,
টাকা পেয়েছো?"
_ "হ্যাঁ বাবা,
টাকা পেয়েছি ।"
_ "আচ্ছা মামনি,
আমি বাসায় যাচ্ছি বাসায় গিয়ে তোমায় ফোন করবো ।"
_ "আচ্ছা ঠিক আছে বাবা ।"
... অমল বাবু বাড়িতে গিয়ে সুনয়নার সাথে কথা বলে দোকানে চলে গেলেন । সারাদিন ব্যস্ততায় কাটলো তাই মেয়েকে আর ফোন দিতে পারেননি । রাতে বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সুনয়নাকে ফোন করলেন,-
_ "শুভ সন্ধ্যা মা,
কি করছো তুমি?
পড়তে বসছো? সারাদিন একটু ব্যস্ত ছিলাম মামনি তাই তোমাকে ফোন করতে পারিনি । রাগ করোনা কেমন?"
... যখন বাবা ফোন দিলেন তখন সুনয়না শপিংমলে আছে । ফোন ধরলো কিন্তু কি বলবে বাবাকে সে বুঝে উঠতে পারছিলো না । বললো,-
_ "বাবা আমি একটু পরে কথা বলছি ।"
... এই বলে সুনয়না ফোন কেটে দিলো । যে বাবা সারাদিনের ব্যস্ততা শেষ করে মেয়ের সাথে একটু কথা বলার জন্য ফোন দিলেন আর সেই মেয়েরই নাকি সময় হচ্ছে না একটু কথা বলার? অমল বাবু নিজেকেই প্রশ্ন করলেন । অরিত্রী দেবী জিজ্ঞেস করলেন,- "কি গো, মেয়ে কি বললো? ওর শরীর ভালো আছে তো? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া এবং পড়ছে তো?"
অমল বাবু বিষণ্ণতা নিয়ে বললেন,- "সুনয়না একটু ব্যস্ত আছে তাই পরে কথা বলবে বলছে ।"
দুজনেরই মন খারাপ হলো । অরিত্রী দেবী ভাত বেড়ে অমল বাবুকে খেতে দিলেন । মেঝেতে বসে খাচ্ছেন আর অরিত্রী দেবী হাটুগেড়ে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন আর ভাবছেন ।
-
সুনয়না সেদিন কথা বলতে পারেনি কারণ সে শপিংমলে ছিলো । বাবার কাছে সে প্রাইভটের কথা মিথ্যে বলে টাকাটা চেয়েছিলো । যে বাবা সকাল হতে না হতেই ৩ কিলোমিটারেরও বেশিদূরের বাজারে পায়ে হেঁটে টাকাটা দিলেন মেয়ের প্রাইভেটের বেতন দেওয়ার জন্য । সুনয়না সেই টাকা দিয়ে শপিংমলে গিয়েছে নিজের সাদইচ্ছে পূরণ করার জন্য । একবারো ওর মনে বাঁধা দেয়নি ।
-
রাত ৯ টা বাজলো । মেয়ের একটা ফোনের আশায় মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছেন অমল বাবু । আর অরিত্রী দেবীরও চোখে ঘুম আসছে না । তাঁদের মেয়ে আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে । সেদিন রাতে সুনয়না ফোন দিতে ভুলে গিয়েছিলো । অমল বাবু এবং অরিত্রী দেবী নিজেরাই ফোন করলেন । সুনয়না ফোন ধরলো এবং ১ মিনিটেরও কম কথা বলে ফোন রেখে দিলো ঘুমাবে সেজন্য ।
-
আজ সুনয়নার সময় হচ্ছেনা ওর মা-বাবার কাছে । মোবাইল হাতে পাওয়ার পর এবং কিছু অসাধু বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে নিজেকে খারাপভাবে পরিবর্তন করে নিয়েছে সে । অমল বাবু ও অরিত্রী দেবী সুনয়নাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে লাগলেন । তাঁদের মেয়ে কি থেকে কি হয়ে গেলো । এত কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছি, পড়াশোনার জন্য দূরে থাকতে দিয়ে নিজেরা একা থাকছি । কতটা কষ্টে আমরা একেকটা দিন পার করছি সেটা আমরা ও আমাদের ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানেন না । শুধুই ভাবতে লাগলেন...
-
চলবে...
06 January, 2019
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৭