সুনয়না আজ বাহিরে থেকে পড়াশোনা করছে এটা ভেবে অমল বাবু এবং অরিত্রী দেবীর গর্বের শেষ নেই । এ বাড়ি, ও বাড়ি গেলে মেয়ের কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে তাঁরা তাঁদের মেয়ের কথা খুব গর্বের সহিত উত্তর দেন যে,- "মেয়ে কষ্ট করে পড়াশোনা করছে ওর স্বপ্ন এবং আমাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তর করার জন্যে ।"
-
সুনয়না কখনো বাবা-মাকে ছাড়া একা থাকেনি । যদিওবা কখনো মাসীর বাড়ি যেত তো গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারতো না । বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করতো, আর বাড়ি আসার জন্য পাগল হয়ে যেত । আর আজ সেই সুনয়নাই পড়াশোনার জন্য এতদূরে থাকতে পারছে । এদিকে অমল বাবু এবং অরিত্রী দেবীর একেকটা দিন কীভাবে পার হয় সেটা তাঁরা দুজনে ছাড়া তৃতীয় সুনয়না ছাড়া আর কেউ জানেন না ।
মেয়ে দিনদিন বড় হচ্ছে তাই একা থাকা শিখতে হবে । বিয়ে দিলে তো শশুড় বাড়িতেও থাকতে হবে । এগুলো ভেবে মনকে শক্ত রেখে থাকছেন । তাঁদের অনেক ইচ্ছে, মেয়ে বড় হবে, ভালো একটা ছেলে দেখে বড় একটা পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিবেন । মেয়ে সুখে থাকবে । মেয়ের সুখেই তাঁদের সুখ । মেয়েকে একটা ভালো পরিবারে বিয়ে দিয়ে তাঁরা মারা যাবার পরেও শান্তি পাবেন ।
-
সুনয়না মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে । কোনো খারাপ নেশায় ওর মন নেই । ভালো পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল তুলছে এবং ফলাফল প্রকাশিত হবার পরে বাবা-মাকে ফোনকলে জানাচ্ছে । বাবা-মা শুনেও তা অনেক খুশি হচ্ছেন । অমল বাবুর কষ্টের টাকা সঠিক পথেই যাচ্ছে । তিনি তাঁর দোকানে বসে চা-পান বিক্রি করেন এবং গায়ের মোড়ল এবং মুরুব্বিদের সাথে মেয়ের কথা বলেন এবং তাঁরা সকলে 'তোর কষ্টের টাকা কথা বলবে একদিন' বলেন ।
-
দিনদিন সময় আগাচ্ছে এবং সুনয়নাও বড় হচ্ছে । সুনয়না এখন অনেক বড় হয়ে গেছে । সে এখন অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী । এই কয়েকবছরে অনেকের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছে । সব বান্ধবীদের স্মার্টফোন আছে কিন্তু সুনয়না এখনো সেই বাটনওয়ালা ফোনই চালিয়ে যাচ্ছে । বাবাকে ফোন দিয়ে স্মার্টফোনের কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করলো ।
-
আজ সুনয়নার জন্মদিন । এদিনেই সে তাঁদের ঘর আলোকিত করেছিলো, খুশির বন্যা বইয়েছিলো । মেয়ের জন্মদিনের উপহার হিসেবে দুটো চুমু দেওয়ার সাথে বাবা তাঁর মেয়ের আবদার পূরণ করার জন্যে একটা স্মার্টফোন কিনে দিলেন । দামের তোয়াক্কা করলেন না । মেয়ে অনেকদিন আগেই চেয়েছিলো একটা স্মার্টফোন । সেদিন থেকেই মেয়ের নাম করে একটা ব্যাংকে টাকা জমা রাখতেন । আজ সকালেই সেটা ভেঙ্গে মেয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো আর দামী ফোনটা তিনি নিয়ে আসলেন ।
-
সুনয়না ওর রুমে গিয়েই উপহারটা তাড়াতাড়ি করে খুললো । দরজার আড়াল থেকে অমল বাবু ও অরিত্রী দেবী মেয়ের এই আহ্লাদিপনা দেখছেন আর দুজন-দুজনের দিকে তাঁকিয়ে হাসছেন । সুনয়না উপহারের বাক্সটা খুলেই দেখলো স্মার্টফোন । ওর আর খুশি ধরে না । সুনয়নার খুশি দেখে বাবা-মা দুজনের চোখেই জল চলে আসলো । সুনয়না ফোনটি পেয়ে সত্যিই অনেক খুশি হয়েছে । ওর অনেকদিনের ইচ্ছে স্মার্টফোন চালানোর আর সেটাও আজ পূরণ হয়েছে । মোবাইল হাতে নিলো তো কিন্তু ও তো এর আগে স্মার্টফোন চালায়নি তাই জানেও না কীভাবে এটা চালাবে । ভোর হতে না হতেই মোবাইল হাতে নিয়ে সিম তুলে কোনোরকমে ডায়াল প্যাড খুঁজে অরুন্ধতীকে ফোন করলো ওর প্রথম স্মার্টফোন দিয়ে ।
-
অরুন্ধতী তাদের বাসায় আসলো । এরপর সুনয়না ওর থেকে ফেসবুক আইডি খোলে নিলো । এই প্রথম সুনয়না ফেসবুক চালাবে তার জীবনের প্রথম স্মার্টফোনে । অরুন্ধতী মেয়ে হলেও খুবই চালাক মেয়ে । আইটি নিয়ে তার অনেক ধারণা আছে । অরুন্ধতী মেয়েও হয়ে যে এত এত কিছু জানে তাতে সে প্রায়সময়ই অবাকই হয় । আর ও নাকি কিছুই জানে না । মনে মনে হাসেও ।
ফেসবুকে আইডি খুললো । প্রথম প্রথম আইডি খোলায় সে জানেনা আইডি দিয়ে কি করতে হয় । তবে জানতো যে, ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সাথে যোগাযোগস্থাপন রাখা যায় । প্রথমেই ফেসবুকে সএ বন্ধু বানানোতে মগ্ন হলো । বেশ কয়েকজনকে সে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো । কীভাবে ফ্রেন্ড বানাতে হয়, এরপর কীভাবে তাদের সাথে কথা বলতে হয় সব শিখিয়ে দিলো অরুন্ধতী ।
সুনয়না অনেকজনকে বন্ধু বানালো । বেশ কয়েকজনের সাথে তার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো ।
-
আজ সে বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটিতে যাবে, সাথে অরুন্ধতীও গেলো । সুনয়নার বাবা-মা দুজনেই মেয়েকে এগিয়ে দিতে এসছেন । বাসের জন্য সবাই মিলে অপেক্ষা করছেন । তাঁদের মেয়ে ও অরুন্ধতীকে বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরলেন । বাসে বসে দুজনেই গল্প করছে আর সুনয়না মাঝেমধ্যে ফেসবুকে গিয়ে ফেসবুকে বানানো বন্ধুদের সাথে কথা বলছে । ঢাকা পৌঁছতে তাদের পায় রাত হয়ে গেলো ৮ টা । অরুন্ধতী সুনয়নাকে ওর হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে সে নিজেও চলে গেলো হোস্টেলে ।
-
সুনয়না আজ ভার্সিটিতে গেলো । গিয়ে ওর কাছের বন্ধুদের থেকে ওদের ফেসবুক আইডির নাম নিয়ে সে নিজেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো । তাদের সাথে প্রত্যেকদিন কথা হয় । ধীরে ধীরে সে ইন্টারনেট জগতে একটু বেশিই সময় দিতে শুরু করে । প্রতিদিন নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে সে পরিচিত হচ্ছে ।
ভার্সিটিতে বান্ধবীদের সাথে পরিচিতির পাশাপাশি বড় ভাইদের সাথেও তার পরিচয় হয় । তাদের অনেকেই সুনয়নার চেয়ে বড় । আপনি করেই সম্বোধন করে, আর সে তুমি করে সম্বোধন করে ।
সুনয়নার প্রত্যেকটা বান্ধবীর আচার আচরণ খুবই ভালো, নম্র ও ভদ্র । সবাই সুনয়নাকে খুব ভালোবাসে ।
-
দিন আগাচ্ছে, প্রযুক্তিও আগাচ্ছে, সময়ের তালে তাল মিলাতে গিয়ে সুনয়নাকেও পরিবর্তন হতে হচ্ছে । চাহিদা বাড়ছে, ইচ্ছা বাড়ছে । বাবা-মা'কে ফোন করে এই চাচ্ছে, সেই চাচ্ছে ।
ওর সব বান্ধবী অনেক ভালো কিন্তু সুনয়না কিছু অসাধু মেয়ের পাল্লায় পড়ে । এ জগতের কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের ভালো দেখতে পারেনা । সেই মেয়েগুলোকে দেখে সুনয়নার আফসোস হয় । ওরা কত্ত ধনী, কত্ত সুন্দর, ভালো ও দামী পোষাক-আষাক পড়ছে । সুনয়না ভাবলো, আজ সে বাবাকে ফোন করে বলবেই,-
_ "বাবা,
তুমি কেমন আছো? আর মা কেমন আছেন বাবা?"
_ "মা,
আমি ভালো আছি আর তোমার মাও অনেক ভালো আছেন । তুমি কেমন আছো সোনামণি?"
_ "বাবা,
আমিও ভালো আছি ।"
_ "তোমার পড়াশোনার অবস্থা কেমন মা.. কেমন চলছে তোমার পড়াশোনা । তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো মা?"
_ "না বাবা,
পড়াশোনা ভালো চলছে । আর কোনো সমস্যাও নেই ।"
... সুনয়না বলতে চেয়েও বলতে পারেনি, বলার সাহস সে পায়নি । তাদের পরিবারে সবসময়ই অভাব-অনটন থাকে । এমতাবস্থায় সে কীভাবে ওর ইচ্ছাগুলো পূরণ করবে? টিউশনি করে যা টাকা পাচ্ছে তা দিয়ে ওর নিজের পড়ার খরচই চলছে কোনোমতে আর বাবাও তো টাকা দিচ্ছেন ।
-
সুনয়না কি করবে ভেবে পাচ্ছে না । কেমন জানি সুনয়নার আর দিন ভালো যাচ্ছেনা । ওর বান্ধবীরা কত্ত সুন্দর জীবন-যাপন করছে আর ও কি না সেই নিচেই পড়ে রইলো ।
..
চলবে...
6 January, 2019
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৭:৪২