ক্যলেন্ডারের পাতার চারকোনা বাক্সটার মধ্যে থাকা সংখ্যা দুটি জানান দিল আজও কাজের পথে রওনা দিবে আরিফ।বেশ সতর্কতার সাথেই বের হতে হবে আজ,বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা।৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘর ঘর শব্দ কর হিটারটা চালু থাকলেও জানালার কোনার একটুখানি ফাঁক থেকে চুইয়ে চুইয়ে বাতাস ঢুকেছে ঘরে ।সে বাতাস পুলওভার সোয়েটারের ফাঁক ফাঁক জালগুলো ভেদ করে শার্টের বোতামকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে তার কালো চামড়ায় আবৃ্ত শরীরটাকে হিমায়ক নাড়া দিয়েই যাচ্ছে।গুটিশুটি হয়ে এক কাপ চা খাবার ইচ্ছা থাকলেও সে চায়ের ধোঁয়ার কল্পনাটুকুই তার মনটাকে উষ্ণতার একটা আচ্ছন্ন করা অনূভূতিতে বেষ্টন করে ফেলে।সাদা চায়ের কাপে একটা টি ব্যগ পুরে কতক্ষন ঠায় নিলিপ্ত চেয়ে চেয়ে সে দেখতে থাকে পানির আনমনে রং বদলানো ।তখন চামচের টুংটাং শব্দে সেই ঘোর ভাঙ্গতেই মনে পড়ে যায় হাজারো কর্মব্যস্ততার কথা।অনাগত দিন আসার আগেই সেদিনকে ঘিরে থাকা অজস্র পূর্ব নির্ধারিত খুনসুটি একই অবর্তে, একটা নিদিষ্ট দুশ্চিন্তায়, বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে আরো এলোমেলো করে দেয়। তাই আর ঘড়ির কাটায় চোখ থামিয়ে দিয়ে জুতার ফিতাটার প্যচ মারতে মারতে সুরুপ সুরুপ কয়েক চুমুক পরে গরম কাপে।সেই গরমে জিহবাটা একটু নির্যাতিত হয়--পানসে স্বাদ ঘিরে ধরে চারিপাশ।
ঠান্ডার প্রকোপটাকে সামাল দিতে জানালাটার দিকে এগিয়ে যায় হাতে হাত ঘষা দিয়ে।দেখে মরচে পড়া লোহার শিক গুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে সুক্ষ উইপোকার গর্তের মত ছোট ফুটো সৃ্ষ্টি করেছে,সেই ফুটো দিয়ে আবার আলো আসার অনুমতিও চাইছে।যেন কেউ একজন কাটা চামচ দিয়ে কেঁচে ফুটো করে দিয়ে গেছে। বেঁচে থাকার নামে মরচে ধরা এ দিনগুলো ঘষে ঘষে আস্তরন উঠানোর চেষ্টায় প্রানান্তিকর নিঃশ্বাস ছাড়া আর প্রশ্বাস গ্রহণ তার।ধপাস করে দরজাটা হাতর মোচরে ম্যকগাইভার স্টাইলে ঘুরিয়ে তিনতলা সিঁড়ি অনেকটা নবাব বেটার মত ভেঙ্গে আধুনিক টরোন্টোর রাস্তায় নেমে আসে আরিফ। ফুটপাতে তার দু পা'র সাথে তাল মিলিয়ে সামনে পিছনে ডানে বামে আরো অনেকগুলো পা একই নিয়মে প্যারেড করে যাচ্ছে ; লং কোট গায়ে জড়িয়ে। হলুদ আর কমলার মাঝামাঝি রংয়ের ঝরা মেপেল পাতাগুলির স্তুপ শোঁ শোঁ বাতাসে উড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তায়।কতগুলি পাতা ছুটে যায় আরিফের পা স্পর্শ করে এপিঠ ওপিঠ ।সেই পাতাগুলোর নিশ্চিন্ত এলোমেলো দিক বিহীন ছুটোছুটি দেখে দৃ্ষ্টিটাও ছুটতে চাইল অতীত থেকে অতীতে।কিন্তু হু হু ঠান্ডা বাতাসের তাড়নায় সেই দৃ্ষ্টির সীমা যেন সুদূরবর্তী হবার আগেই ধুপ করে নিভে আসার জন্য আকুপাকু শুরু করে দিল ।
এরই মধ্যে বৃ্ষ্টির ফোঁটাগুলির কয়েকটা একটু হালকা জমে জমে পড়তে শুরু করে দিল।ঝিরি ঝিরি বৃ্ষ্টির মাঝে সে দেখতে পেল একটু একটু তুষার কণা জমাট বেধে গুমোট পরিবেশটাকে আরো গাঢ় বর্ণহীন করে দিয়েছে।রাস্তায় জমছে আবছা সাদা লবনের মত তুষারকণা আর গাড়ির চাকায় থেতলা হয়ে নিমেষেই হারিয়ে যাচ্ছে ,কিন্তু পিছলে যাওয়ার দাগ রেখে যাচ্ছে ঠিকই । তার কষ্ট গুলোও মনে হয় এমনই চেপটে যাওয়া চিহ্নসর্বস্ব।চশমার হাতলটা ধরে খুলে হাতে নিয়ে সেই পিষ্ট হওয়া তুযার দেখতে যাওয়া মাত্রই বলে উঠল--"এই যা বৃ্ষ্টি শুরু হয়ে গেল"এক দৌড়ে ছুটে গেল সে স্টপেজে থামা বাসটার দিকে।বাসের জানালার গ্লাসে তখন ঘোলা কুয়াশা।ডান হাতের তর্জনি জানালার গ্লাসে ঘুরিয়ে ঘোলাটে ভাবটাকে স্বচ্ছ করার কিছুক্ষন চেষ্টা চলল,সাথে কিছু আঁকিবুকিও হল।কাঁচের ওপাশটাতে তখন বিন্দু বিন্দু বৃ্ষ্টি জমে চুইয়ে গড়িয়ে পড়ছে।ঐ ফোটাগুলোর পরিধিকে ছুঁয়ে -ভেদ করে আরিফের দৃ্ষ্টি পড়ে রয়--থেমে থাকা গাড়িগুলোতে ,লাল-হলুদ-সবুজ হওয়া সিগনাল বাতিতে ,রাস্তার ওপাশ থেকে আশা হেড লাইটে আর ফুটপাতে হেটে চলা নিত্য নৈমিত্তিক মানুষগুলোর হারিয়ে যাওয়ার মিছিলে।ক্যালেন্ডারের পাতার ছকগুলোতে কুতকুত খেলতে ইচ্ছা করে ওর।লাফিয়ে লাফিয়ে যদি কাজের ব্যস্ত দিনগুলাকে টপকে আসা যেত!
পাংশু মেঘের ছোপ ছোপ উল্লাসের দাগ কেটে যেতেই কোথায় যেন সিঁদ কাটা বৃষ্টিটা মেঘচুরির চিহ্নস্বরূপ মানুষগুলোকে সিক্ত করে মিলিয়ে যায় ঠান্ডা বাতাসে। বাসের চাকার পচ পচ চাপা শব্দ ,আশে পাশে মানুষের ফিসফিস আর জ্বলজ্বলে আলোকিত বিলবোর্ডের মাঝে তবুও সময়ের কাছে বেধে রাখা জীবনটাকে ছন্নছাড়া করতে ইচ্ছা হয়। বাস থেকে একপায়ে নেমে কুইন্স লেকের উপরে থাকা ব্রিজের ওপর দিয়ে ধীর পায়ে হেটে যায় সে।তখনই ব্রীজের পাশ-দেয়ালে হাত রেখে কিছুক্ষনের জন্য নীচে তাকিয়ে নগরীর গতিময়তাকে অচেনা করে দেখতে পায়।লেকের পানি বাতাসের ছোঁয়া লেগে দুলে উঠছে,ময়লা পাতাগুলি সেই পানিতে ভেসে যাচ্ছে,কিছু কচ্ছপের দল সেখানে জমায়েত হয়ে আস্তে আস্তে গায়ে কাদা মাখামাখি করে খেলছে ,দুপাশে আছে দ্বিগম্বর ইট পাথরের স্হাপত্যের মাঝে ঠায় দাঁড়ানো ন্যড়া গাছগুলি। কোন অজানা একটা প্রকট চাওয়া, তীব্র আকুতি আর ডুকরে উঠা অনুভবে শহরের কোলাহল হঠাতই নিস্তব্ধ হয়ে আসে তার কাছে।দীর্ঘদিনের পোষ মানানো -দমিয়ে রাখা অনুভূতির তড়না,কেবলই খুঁজে পেতে চায় দুরন্ত বেগে হারিয়ে যাওয়া খোলা মাঠে নাটাই হাতে ডানপিটে ঘুড়ি উড়ানো,কামার কুমোর পাড়ায় দিনরাত ছুটোছুটি,ঝপাৎ করে খালিগায়ে লুঙ্গি কাছা দিয়ে সশব্দে ঝাপিয়ে পড়া পুকুরের ঘোলা পানি আর পেয়ারা গাছের নিচে এক্কাদোক্কার সোরগোলের পিছু নেয়া ঋতু বদল। প্রাণচান্ঞল্যে বন্ধুদের আড্ডায় বিদ্যুত বেগে মেতে উঠা, মাষ্টারমশাইয়ের বেতের বেদনা,কলেজ পালিয়ে সিনেমা যাওয়া দুর্বার সাহসিকতা আর ভাই বোনের সাথে ঝগড়া-ঝাটির ক্ষতগুলো দাপিয়ে বেড়ানো তিক্ত অপ্রকাশ্য উদভ্রান্তির বেদনায় ছটপট করে উঠে।মায়ের অত্যাচার আর খিটমিটানি, চিটচিটে ঘামের স্রোতে শার্ট ভিজে ঠান্ডা লেগে যাবে বলে বুবুর শাসন আর অফিসে যাবার সময় প্রতিদিন বাবার ফিরে ফিরে তাকানো নির্বাক চাহনিটা দেখার জন্য মনটা হু হু করে বুকের মধ্যে একস্রোত হাহাকার জমাট বাঁধায় আর চোখের চশমার ফ্রেমের পাশ দিয়ে একফোটা জল বেয়ে গালে নেমে আসে।সে জল ভীনদেশী শহরের গতিময়তার ভীড়ে কারো চোখে পড়ে না,কেউ দেখে না।পিটপিট করা চোখ সে জলের খানিকটা সরিয়ে নেয় আর বাকিটা শুকিয়ে উড়ে যায় ঠান্ডা বাতাসের সাথে জমাট বাধা আবেগে ,অগোচরে...
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০০৯ সকাল ১১:৪৬