শোনগো সোনার মেয়ে !
পরানে আমার তুফান উঠেছে তব মুখপানে চেয়ে।
আমার জীবনে যত হা-হুতাশ যত আছে ক্রন্দন,
তুমি যেন তাহা জুড়াইতে পার বলিছে আমার মন।
তুমি যদি মেয়ে মোর পানে চাও, যদি কথা কও হেসে,
আমার মনের ব্যথার তুফান বুঝি যায় কোথা ভেসে।
ভাবিওনা তাই তোমারে ডাকিয়া এসব বলার ছলে,
তব কানে কানে মোর ভালোবাসা গোপনে যাইব বলে।
আজি জীবনের দীর্ঘ পথের এসেছি এমন খানে,
ভালবাসা প্রেম ওসব কথার বুঝি সে আর এক মানে।
প্রতি পদে পদে সন্দেহ জাগে, প্রত্যয় নাহি আর,
চির-বন্ধুর একাকিয়া পথে সাথী আছে কেউ কার!
প্রভাত আজিকে আমার নয়নে আঁকে না কুহক মায়া,
সন্ধ্যারে হেরি ভাবিতে পারিনে অমরাবতীর ছায়া।
নিঠুর আমারে করিয়াছে আজ পথের কাঙাল হেন,
কান্না সাগরে ভাসিয়া চলেছি সোঁতের শেহলা যেন।
ফুলেরে হেরিয়া শিহরিয়া উঠি, বুঝিবা তাহারি তলে,
বিষ- কন্টক আছে লুকায়িত জ্বলন্ত হলাহলে।
আমার জীবনে চন্দন তরু বেড়িয়া গরজে নাগ,
নব জলদের বক্ষে জ্বলিছে খর বিজলীর আগ।
সোনার মেয়েগো এসব ভাবিতে তোমার যেন না হয়,
তোমার জীবনে শুধু হাসি হোক শুধু হোক ফুলময়।
দূর থেকে তো আশিস করিব, ধূসর বালুর চর,
তাহার উপরে ছবির মতন চাষাচাষীণীর ঘর।
চারিধারে তার ঘন-কলা-বন নাচে বাতাসের সনে,
গোধূলি ও উষা তাহার উপরে মায়া মরীচিকা বোনে।
ছোট ঘরে তারা গলাগলি ধরি সারারাত ঘুম যায়,
বাঁকাচাঁদ তার জোছনা লইয়া মাখায় তাদের গায়।
জীবনে তাদের প্রশ্ন নাহিক, বিচার ভগবান,
পাপ পুণ্যের অঙ্ক কষিয়া দিন করে গুজরান।
গেঁয়ো দেবতার দেউলে রাখিয়া পূজার পাত্র খানি,
জীবনেরে তারা সুষমায় ভরে স্তরে মন্ত্র হানি।
দীঘল সে পথ বাঁকাইয়া গেছে সুদূর নদীর কোলে,
তারি’ পরে রোজ গেঁয়ো চাষীণীর কাঁখের কলসী দোলে।
দূর পথ হ’তে ভেসে আসে তার কৃষাণ সখার বাঁশী,
কাঁখের কলস হেসে কুটি কুটি দোলায়ে জলের রাশি।
তোমার জীবনে নামিয়া আসুক এমন মোহন ছবি,
বিধাতার কাছে এই প্রার্থনা করে এই দীন কবি।
-জসীম উদ্দীন
খুব প্রিয় কবির লিখা কবিতা আমার এটা। দেশ ছাড়ার আগে কবির লিখা সবগুলো বই সাথে করে নিয়ে আসি। প্রায় ১৩ কেজির মত বই নিয়ে আসি। আসলে মন খারাপ হলে এই কবিতাটা ঔষধের মতো কাজ করে। গত পরশু ভেবেছিলাম কবিতাটা লিখব, এই সেই করে অবশেষে আজ লিখলাম। আসলে উনার কবিতার কথাগুলো আমার প্রানের কথা মনে হয়। শহরে বড় হয়ে ওঠা, আজ অব্ধি শহরে বিচরণ হলেও মনটা আজও সেই রাখাল রুপাই ভাবে নিজেকে। কলমি লতার মালা দিয়ে প্রেম কিংবা পাতার বাঁশীর সুমধুর সুর এখনও ব্যাকুল করে তুলে আমার আমিত্বকে, কোন এক অচেনা সোনার মেয়ের জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৮:১৬