আজ লিখব আমার ভ্রমনের তৃতীয় দিন নিয়ে, কেমন করে পর্তুগাল থেকে স্পেন ঘুরে এলাম। আশা করি ভালো লাগবে সবার।
আসলে ভ্রমন শখ আমার আবার নেশা ও। সবসময় এক এক দেশ ঘুরা, এক এক দেশের মানুষ, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা এসব আমাকে খুবই টানে, অনুপ্রাণিত করে। পর্তুগালে যাবার আগে জার্মানি থেকেই ভেবে গিয়েছিলাম সময় পেলে স্পেন ঘুরে আসবো। যথেষ্ট খবরাখবর ও নিয়ে গিয়েছি অনলাইনে ঘেটে। দ্বিতীয় দিনের ঘুরার ক্লান্তি নিয়ে পরদিন আমি একটু বেশীই ঘুমিয়ে উঠেছিলাম! ভাইয়া দেখি ঠিকই সকালে উঠে পায়চারি করতেসিলো। আমি উঠে দেখি ভাইয়া গোসল করে পুরা রেডি! আমি আর কি করা ফ্রেশ হয়ে নাশতা করবো তারপর রেডি হবো। এসে দেখি ভাইয়া ব্রেকফাস্ট অলমোস্ট রেডি করে ফেলেছেন ! মেন্যুতে ছিলো পাউরুটির আমার জীবনে খাওয়া সবচেয়ে মোটা ফালি, গত রাতের গ্রিলড চিকেন, স্ক্রাম্বেলড এগ আর টার্কির মাংসের হ্যাম। আমি শুধু স্ক্রাম্বেলড এগটা করলাম, আর বাকি সব ভাইয়া করেছে। যথারিতি সূর্যের আলোতে বসে নাশতা সেরে নিলাম ।
দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাগরের ঢেউ যেন আমায় আজও ডাকছিলো। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সাগরের পাড় ধরে কিছুক্ষন হেঁটে উবার ক্যাব কল করলাম। সফর সঙ্গী হিসেবে দুজন ইন্ডিয়ান লেডিকে আমাদের ক্যাবে লিফট দিলাম, তারা দুইজন সহোদর । এসেছেন ব্রিটেন থেকে বেড়াতে। আমি চালকের পাশের আসনে বসে পথের দুইপাশের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দী করছিলাম। তাদের আমরা গত দিনের ঘুরাঘুরি এবং বাংলাদেশী দোকানের ব্যাপারে বিস্তারিত বলে দিলাম। তারা পথে বাংলাদেশী দোকানের কাছে নেমে গেলো। আমরা ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত এসে কাউন্টারে থাকা রমনীকে টিকেটের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তাদের ব্যবহার দেখলাম খুব রুক্ষ, এমনকি ইংরেজী পর্যন্ত ভালো জানেনা! আমি জার্মানিতে, নেদারল্যান্ডে, তুরস্কে দেখেছি ইংরেজী না জানলে তারা একটু লাজুক ভঙ্গিতে বা অমায়িক ভাবে দুঃখিত বলে। কিন্তু পর্তুগালে আমি এই একটি মাত্র ব্যাপারে মিল পেলাম না। ওদের ইংরেজীতে কিছু জিজ্ঞেস করলে দেখলাম খুব বিরক্ত হয়েছে। তবে সবাই না, কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য ওখানেও ছিলো। যাই হোক মূল কথায় আসি। পাশের কাউন্টারের ভদ্রলোক মোটামুটি ইংরেজীতে আমাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে ওদের ওয়ান ওয়ে টিকেট কিংবা কোন ডে টিকেট নেই। তাই বাধ্য হয়েই টিকেট কাটলাম ভিলা রিয়েল দে সান্তো আন্তোনিও (Vila Real de Santo António) এর উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গাতে, ওদের রাত ৮.০০ টার পর কোন ফিরতি ট্রেন নেই। তো যে কোন উপায়ে হলেও ৮ টার ট্রেন ধরতে হবে। অন্যদিকে ট্রেন ছাড়তেও ১ ঘন্টার বেশী দেরী। আটলান্টিকের পাড়ে জলাভূমির পাশে ট্রেন স্টেশন বলে দাড়িয়ে জলাভূমির সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। দূরের গাঙচিল সহ নাম না জানা পাখিগুলোর মনে কতো আনন্দ, অনবরত কিচিরমিচির করেই যাচ্ছিলো। একটা বিষয় এখানে এ জলাভূমিতে খেয়াল করলাম, প্রচুর মাছ এখানে। রাতের বেলা এতো বেশী যে খালি হাত ডুবিয়ে দিয়েও অনেক মাছ ধরা যাবে।
মনে হলো এই সময়টা হয়ত মাছের প্রজনন মৌসুম, ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ সাগর থেকে নদীতে, খালে এমনকি এই কম পানির জলাভূমিতে চলে আসে। আমি সোঁনারগাওয়ের মানুষ, গ্রামে ভাগ্নের কাছে শুনতাম এমন মাছের কথা। বৃষ্টি হলে নাকে মাছেরা একদম ডাঙাতে উঠে যেতো। আর গ্রামের মানুষরা নাকি আম কুড়ানোর মতো করে সেদিন মাছ কুড়ায়। আমি নিজের চোখে অবশ্য দেখিনি সোঁনারগাওয়ে না থাকার কারনে। রাতের বেলা দেখলাম অনেকেই বড়শি পেতে মাছ ধরে পর্তুগালে, এমনকি কিছু পর্যটকও! যাই হোক যাত্রা শুরুর ২০ মিনিট পূর্বে আমরা ট্রেনে উঠে বসলাম। পর্তুগীজ ভাষা না জানার কারনে ট্রেনে কারো সাথে তেমন কথা বলা হলোনা। আমি অবশ্য ট্রেনে প্রায় সবার সাথেই টুকটাক কথা বলি! কোলন টু ডুইসবুর্গের কয়েকজন টিকিট চ্যাকারের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ঘনঘন যাতায়াতের কারনে। টিকেটে কোন সিট উল্লেখ ছিলো কিনা তা ও বুঝলাম না। যথাসময় ট্রেন ছাড়লো, আটলান্টিকের পাড় ধরে চলতে লাগলো ট্রেন। যাত্রা পথে অসংখ্য কমলা বাগান দেখে মন খুশিতে ভরে গিয়েছিলো। অনেক দূরে দূরে কয়েকটা বাড়ি। কিছুক্ষনের মধ্যে তাভিরা পৌঁছালাম । তাভিরা ছোট্ট একটা শহর, কিন্তু অপরূপ সুন্দর। মনে হলো বলিউড ওয়ালারা তাভিরা সম্পর্কে জানেনা। না হয় অনেক আগেই তাভিরা বলিউডে দেখা যেতো। আরও প্রায় ১ ঘন্টা পর এসে পৌঁছালাম পর্তুগাল এবং স্পেনের সীমান্তবর্তী শহর ভিলা রিয়েল দে সান্তো আন্তোনিও (Vila Real de Santo António) এ। ৬১.২৫ বর্গ কিলোমিটারের এ শহরটাতে প্রায় ২০ হাজার লোকের বসবাস। সামুদ্রিক মাছ তথা টুনা, সার্ডিন ইত্যাদির জন্য প্রসিদ্ধ এ শহর। আগে থেকেই যেহেতু আমি খবরাখবর নিয়ে এসেছিলাম তাই ট্রেন থেকে নেমেই ভাইয়াকে তাড়া দিতে শুরু করলাম স্পেনে যাবো বলে। গুগল ম্যাপ ধরে ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পরে এসে ফেরীঘাটে হাজির হলাম।
চারিদিকে খুঁজে কাঁচে ঘেরা এক ভবনে টিকেট কাউন্টার আবিষ্কার করলাম। জার্মান জানার কারনে সবাইকেই প্রথমে জিজ্ঞেস করতাম জার্মান জানে নাকি। টিকেট কাউন্টারের ভদ্রলোক ইংলিশে বললো নো জার্মান। তবে সে ভেঙে ভেঙে বুঝাতে সক্ষম হলো পর্তুগাল টাইম বিকেল ৫টায় শেষ ফেরী। ফিরতে হলে ৫ টায় ই শেষ ফেরী সেদিনের মতো। সকলের জানার জন্য বলে রাখি পর্তুগাল এবং স্পেনের মাঝে সময়ের ব্যবধান ১ ঘন্টা।
আর এই ব্যবধানে সহায়তা করেছে গুয়াডিয়ানা নদী।নদীর দুই পাশে দুই দেশ। অদূরেই নদী যেয়ে মিশেছে আটলান্টিকে । এখানে নদী এতো বড় আর গভীর মনে হলো, দেখেই বুক কেমন স্যাঁত করে উঠে।কয়েক বছর আগের এক ভয়ের কারনে এখনোও পানিতে নামিনি। আর এই ফোবিয়ার কারনে এত ইচ্ছা থাকার পরও স্কুবা ডাইভিং করা হয়ে ওঠেনি এখনো। দেখলাম নদীর মাঝের বর্ডার পয়েন্ট পাড় হওয়ার সাথে সাথে মোবাইলের পর্তুগীজ নেটওয়ার্ক পরিবর্তিত হয়ে স্প্যানিশ নেটওয়ার্ক হয়ে গেলো, সাথে সাথে দেখলাম হাতঘড়ি, মোবাইলে সময় ও পরিবর্তিত হয়ে গেলো। কত নিখুঁত বর্ডার এবং নেটওয়ার্ক ওদের! যাত্রা শুরুর প্রায় ১০-১২ মিনিট পরে নদীর অপর পাড়ে স্প্যানিশ শহর আয়ামন্টেতে এসে পৌঁছালাম । Ayamonte হুয়েলভা (Huelva) প্রদেশের একটি মিউনিসিপ্যাল শহর। যা গুয়াডিয়ানা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। ১৪২ বর্গ কিলোমিটারের এই শহরটিতে প্রায় ২১ হাজার লোকের বসবাস। রবিবার ছিলো বলে প্রায় সব দোকান-পাটই বন্ধ ছিলো। তবে রেষ্টুরেন্ট খোলা ছিলো। আর যেহেতু ক্রিসমাস তথা বড়দিনের আগে গিয়েছি, প্রায় সব শহরেই বড়দিনের সাজসজ্জা এবং মেলা দেখতে পেলাম।
যেহেতু আমাদের ফিরতি ফেরীর আর মোটামুটি ১ ঘন্টা বাকি ছিলো, আমরা খুব সামান্যই ঘুরলাম। তবে পর্তুগালের তুলনায় স্পেন অনেক সুন্দর, গোছানো! এখানেও এসে বিপওি বাঁধলো ভাষাতে, কেউ ইংলিশ বলেনা, জার্মান বলেনা। আমি স্প্যানিশ জানিনা। গত পরশুদিনও আমি যখন রাইন নদীর পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম এখানে, এক স্প্যানিশ তরুণী আমার হতে ক্যামেরা দেখে দৌড়ে এসে হাত নেড়ে অভিনয় করে বুঝালো যে ওর একটা ছবি তুলে দিতে, আমি ইংলিশ,জার্মান জানে কিনা জিজ্ঞেস করাতে মাথা নেড়ে বলে স্প্যানিওল। তখন আমারও স্পেনের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লো। স্পেনে রেষ্টুরেন্টে বসে বেয়ারাকে কল করলাম সে ইংলিশ, জার্মান কিছু জানেনা। আর এক জনকে ডাকলো ও নাকি ইংলিশ জানে। দেখলাম ও ইয়েস ইয়েস ছাড়া কিছুই জানেনা। অনেক কষ্টে ওঁকে চিকেন তাপাসের অর্ডার করলাম। হাতে সময় ছিলো তখন ২৫ মিনিট! ১৫ মিনিট পর খাবার এলো। বেয়ারাকে তাড়াতাড়ি করতে হবে বুঝাতে পারিনি, তাড়াতাড়ি করাকে ইশারায় বুঝাতে পারিনি বলে। কোনো মতো ৮ মিনিটে খেয়ে ঝড়ের বেগে ছুটতে হয়েছে। তবে বলবো, আমার জীবনে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে মজার তাপাস স্পেনেই খেয়েছি। এসে টিকেট নিয়ে ফেরীতে ওঠে পুরো স্পেন না ঘুরতে পারার জন্য আক্ষেপ হতে লাগলো মনে।
তবে আমাদের বন্ধু হাইমে (Jaime) ‘র বাসা বার্সেলোনা । ও দাওয়াত দিয়ে রেখেছে, খুব শীঘ্রই আবার স্পেনের বিমানে চড়ব বলে আশা করি। ঠিক ১৩ মিনিট পর আবার ভিলা রিয়েল দে সান্তো আন্তোনিও (Vila Real de Santo António) তে এসে পৌঁছালাম । ইতোমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, চারিদিকে রং বেরঙয়ের আলোকসজ্জা। আমরা নগর উদ্যানের মেলাতে গেলাম। দেখলাম অপূর্ব সুন্দর করে সাজানো , অনেক লোকের সমাগম। আশেপাশে অনেক এশীয় দোকানপাট চোখে পড়লো। আসলে পর্তুগীজ সরকারের সহজ অভিবাসনের জন্য অনেকেই পর্তুগালে এসে বসবাস, ব্যবসা বানিজ্য করছেন । আমরা একটা দোকানের পাশে অনেক ভিড় দেখে কাছে গেলাম। গিয়ে দেখলাম অক্টোপাস গ্রিল করছে সেখানে! আমরাতো খুশি হয়ে অর্ডার করলাম। ভাগ্য ভালো ছোট এক টুকরা নিয়েছিলাম। মুখে দিয়ে দেখলাম ওটা ছিলো অক্টোপাসের শুঁটকি! আমার তো বমি হওয়ার উপক্রম! দুইজনই ওটা ফেলে একটা প্যাষ্ট্রিশপে যেয়ে হরেক রকম ফলের একটা প্যাষ্ট্রি নিলাম, সেই যাত্রাতে রক্ষা! আমরা কিছু দোকান ঘুরলাম। এখানে অনেক দোকানের বাইরেই গরুর বিশাল মূর্তি লাগানো, গরু পর্তুগালের জাতীয় প্রতীক বলে। অবশেষে আমরা ৭ টায় এসে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছালাম। ৮ টায় যে ট্রেনটা আসবে ওটা নাকি ফিরবে না ফারোতে। রাত ৯টায় নাকি একটা ট্রেন আসবে এবং ঐটাই নাকি শেষ ট্রেন ঐ দিনের। হাতে প্রায় ২ ঘন্টা সময়, আমরা পুরো স্টেশনে একা! আমি ব্যাগ থেকে আইপ্যাড বের করে গ্যারেজ ব্যান্ডে টুংটাং করে কিছুক্ষন পর দুইজন আর্টসেল, সোলস, এলআরবি, জেমস এর গান করলাম। এমনকরে প্রায় ২ ঘন্টা পাড় হয়ে গেলো!
যথারিতি ট্রেন এলে ট্রেনে উঠে পড়লাম। লক্ষ্য করলাম পুরো ট্রেনে আমরা সহ যাত্রী ৩ জন! ফারোতে পৌঁছে আজ বাস পেলাম, বাসে করে সোজা বাসায়। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে সোজা ঘুম। আর লিখার বড় করছিনা। এমন করে শেষ করলাম পর্তুগাল ট্রিপ। খেতে বসে দেখলাম আমি ২টার রিটার্ন ফ্লাইটের টাইম ৫টা ভেবে বসে ছিলাম, ভাগ্যিস! যাই হোক পরদিন সকালে চেক আউট করে কিছুক্ষন সাগরপাড়ে ঘুরে ঊবার ক্যাবে করে সোজা এয়ারপোর্ট, তারপর আমার ঘর, জার্মানিতে।
খুব শীঘ্রই আমার পরবর্তী ট্রিপগুলো তুলে ধরবো আপনাদের সামনে। সামনে লিখব জার্মানি র হামিলিন শহর নিয়ে। আরো লিখব আরেক জার্মান শহর মুইন্সটার নিয়ে। ততোদিন পর্যন্ত ভালো থাকবেন সবাই, সেই কামনায় বিদায় নিচ্ছি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৪০