আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন একেকটা অসামান্য বীরত্বের অমরগাথা। হবিগঞ্জ মহকুমা সদর থেকে হবিগঞ্জের দক্ষিণপ্রান্তে মাধবপুর থানার পূর্বদিকে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত এলাকায় তেলিয়াপাড়ার অবস্থান। তেলিয়াপাড়ায় তখন ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানি ডিফেন্সে ছিল। এদিকে কলকলিয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খান তাঁর প্লাটুন নিয়ে মনতলা থেকে তেলিয়াপাড়া চলে যান। তাঁকে তাঁর প্লাটুনসহ ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে তেলিয়াপাড়াসহ মুক্তিবাহিনীর ছাউনি থেকে ১২জন মুক্তিযোদ্ধা বের হন অপারেশনে। সময়টা ১৯৭১ সালের ১৪ মে। রাত তখন গভীর। দুইটা বাজে। ভুতুড়ে আঁধারে আচ্ছন্ন সমগ্র এলাকা। নিঝুম নিস্তব্ধ চারিদিক। অন্ধকারে মিশে এগিয়ে যেতে থাকেন বাংলার ১৩জন দামাল সন্তান। সঙ্গে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন, গোলাবারুদ ও প্রচলিত অস্ত্র। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তেলিয়াপাড়া ছিল ৩নং সেক্টরভুক্ত এলাকা।
অল্পক্ষণের মধ্যে নামে ঝুম বৃষ্টি। অবিরাম বৃষ্টিতে সবাই ভিজে একাকার। তবুও থেমে নেই তাঁদের পথচলা। সব বাঁধা ডিঙিয়ে সবাই ছুটছেন অভীষ্ট লক্ষ্যে। হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় তাঁদের চোখে-মুখে। অতি সতর্কতার সাথে পৌঁছলেন তাঁরা। পাকিস্তানি বাহিনীর বিকল্প রাস্তায় তাঁরা স্থাপন করেন ২টি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন। তারপর শুরু হল প্রতীক্ষার পালা।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটতে লাগলো শত্রু হননের অপেক্ষায়। একসময় রাতের অন্ধকার কেটে পুব আকাশে উদিত হয় ভোরের সূর্য। কিন্তু পাক বাহিনীর চিহ্নমাত্রও নেই। এইদিকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে প্রায় অবসন্ন ক্লান্ত মুক্তিসেনারা। বিশ্রাম চাইছে তাঁদের দেহমন। তাই পরদিন ৮টার দিকে বিকল্প সড়ক ছেড়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু সেখানে গিয়ে বিশ্রামের উদ্যোগ নিতেই খবর আসে বিকল্প সড়কপথ ধরে আসছে এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সৈন্য। সামনে একটি জীপ। তারা আসছে সিলেটের দিক থেকে, যাবে ঢাকার দিকে। নির্ভাবনায় অগ্রসর হচ্ছে তারা।
বিকল্প রাস্তা ব্যবহার যে ভুল ছিল একটু পরেই তারা তা হাড়েহাড়ে টের পেলো। বিস্ফোরিত হল মাইন, ধ্বংস হল সামনের জীপটি। দ্বিতীয় গাড়িটিও দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগুতে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। এটাই চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরই অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। উল্লাসের ঝড় বয়ে যায় তাঁদের মনে। জীবিত পাকিস্তানি সেনারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগুতে থাকে গ্রামের দিকে। ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে সমগ্র গ্রাম। লেফটেন্যান্ট মোর্শেদের নেতৃত্বে মুক্তিসেনাদের অস্ত্রও গর্জে উঠলো। তাঁরা পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকেন এবং একই সঙ্গে পিছু হটে সেনাদের নাগালের বাইরে চলে যান। এই যুদ্ধে পাক বাহিনীর অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইনের এটাই ছিল প্রথম ঘটনা।
১৬ মে । ক্লান্ত মোর্শেদ কোম্পানির আক্রমণ, অভিযান আর এ্যামবুশ তখনও থেমে নেই। তেলিয়াপাড়ায় অবস্থানকালে লেফটেন্যান্ট মোর্শেদ তার কোম্পানি নিয়ে বেশ কয়েকটি এ্যামবুশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ মে তেলিয়াপাড়া রাস্তার ৮১ মাইল পোস্টের নিকট একটি এ্যামবুশ করেন তাঁরা। ঐ এ্যামবুশে দু’টি পাকিস্তানি ট্রাক ধ্বংস হয়; সাথে একটা ট্রাক দখলেও আসে। এছাড়া প্রায় ৫০জন সৈন্য হতাহত হয়। চোখে পানি এসে যাওয়া আর গর্বে বুক ভরে ওঠার মতো এমন হাজার হাজার ঘটনা নিয়ে গঠিত হয় আমাদের সংগ্রামমুখর উত্তাল একাত্তরের সেই রণাঙ্গনের দিনগুলি।
কলকলিয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খান
সূত্রঃ
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস – সেক্টর তিন
২. সিলেটের যুদ্ধকথা
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র - দশম খণ্ড
রণাঙ্গনের দিনগুলিঃ অপারেশন জাতিসংঘ গ্যারেজ
রণাঙ্গনের দিনগুলিঃ আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক অপারেশন
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০১