আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন একেকটা অসামান্য বীরত্বের অমরগাথা। একাত্তরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানী হানাদার পিশাচদের অন্যতম দোসর। চট্টগ্রাম ছিল ১নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। মৌলভী সৈয়দ আহমেদের সভাপতিত্বে কে সি আই, কে সি টু দলনেতাসহ মোহাম্মদ হারেস, জালালউদ্দিন আহমেদসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা আলোচনার দ্বারা সিদ্ধান্ত নেন যে, চট্টগ্রামস্থ আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক আক্রমণ করবেন। কারণ কি? কারণ, আমেরিকান সরকার মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করছে। শুধু তাই নয়, পাক সেনাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতাও করছে। এগুলোর বাইরেও আরেকটা কারণ ছিল। আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম শহরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত হয়। তাঁদের বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রচুর অর্থের দরকার। “পানওয়ালা সবুজবাগ” ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম একটা আস্তানা, যা কিনা ইতোমধ্যেই বেশ পরিচিত হয়ে গেছে। তাই গোপন আরেকটি আস্তানা গড়ার খুবই প্রয়োজন। আর এর জন্য যা যা দরকার তার অন্যতম হল অর্থ। এসব কারণেই মুক্তিযোদ্ধারা প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
পরিকল্পনা করা হয় আগস্টের মাঝামাঝি সময়ের একদিন সকাল সাড়ে নয়টার ভিতর সবাই চলে আসবে ব্যাংকের আশেপাশে। এছাড়াও বিভিন্ন জন বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন পথ হয়ে এখানে এসে পৌঁছবেন। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের কার্যালয়। অপারেশনের সব আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ করার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ন্ত্রিত আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার কেন্দ্রবিন্দু “হোন্ডাপ্যালেস” কে নির্দিষ্ট করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ রাখা হয় এখানে। এটি মূলত বাণিজ্যিক বিভিন্ন অফিসের মধ্যে দোতলায় নুরুল ইসলামের ছোট্ট অফিসঘর।
অপারেশনের দায়িত্বে থাকবেন এনামুল হক দানু, তাঁর সাথে আবদুল্লাহ আল হারুন, আব্দুল আজিজ, ডা. জাফর, অমল মিত্র, মনি, শফিউল বশর, ফজলুল হক। এ অপারেশনে নেপথ্য ভূমিকা রাখেন মোহাম্মদ হারেস, আব্দুল মেনাফ ও জালালউদ্দিন আহমেদ। তো সব পরিকল্পনা শেষ। এখন বাস্তবায়নের পালা। মুক্তিযোদ্ধারা আগস্ট মাসে অপারেশনের দিন সকাল ৯টায় দুইটা ট্যাক্সি নিয়ে দু’দলে ভিন্ন ভিন্ন পথে ব্যাংকের সামনে এসে পৌঁছান। সাধারণ জনতার মাঝে তাঁরা মিশে যান। আবদুল্লাহ আল হারুন একটি জীপ হাইজ্যাক করে ব্যাংকের দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়ে যে কোন সময় হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। ইতোমধ্যেই ব্যাংকের টেলিফোন লাইন সুকৌশলে কেটে দেয়া হয়।
সকাল ৯টা বেজে ৫৫ মিনিটে সংকেত আসে। সংকেত পাবার সাথে সাথে তাঁরা ব্যাংকের প্রধান ফটকের অস্ত্রধারী দারোয়ানকে কাবু করে ফেলেন। এরপর ভিতরে ঢুকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অস্ত্রের মুখে ধরে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন কাউন্টারের ভিতরে প্রবেশ করে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাই মূল টাকার কেন্দ্রে আঘাত করতে পারেনি। তাঁরা কাউন্টারে খুঁজে পান ১৭,০০০/- (সতের হাজার) টাকা। ১১ মিনিটেই সব কাজ শেষ।
মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অপারেশন শেষ করে নিরাপদে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁরা সবাই অতি দ্রুত জনতার সাথে মিশে যান আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা ছেড়ে। পরে মুক্তিসেনারা হাইজ্যাক করা জীপটি আগ্রাবাদ সিডিএ কলোনিতে ফেলে রেখে চলে আসেন। আর এভাবেই একের পর এক দুর্ধর্ষ অপারেশেনের দ্বারা গঠিত হয়েছিলো আমাদের ২৬৬ দিনের মুক্তি সংগ্রামের একেকটি দিন।
সূত্রঃ
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস – সেক্টর এক
২. মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০১