যদিও মানুষ সমগ্র অস্তিত্বের অংশ তার জানা মতে সে সম্পর্কে জানবার চেষ্টা করে এসেছে এবং এখনও করছে সে নিজেই। কারণ এখন পর্যন্ত তার সুক্ষ্ম চিন্তাশীল উদ্ভাবনক্ষম এবং বুদ্ধিদীপ্ত মেধাকে অতিক্রম করার কোন প্রাণীর সন্ধান মেলেনি। তাই মানুষ সেদিক থেকে এখনও শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। যদি কখনও মানুষের চেয়ে উচ্চতর প্রাণী আবি®কৃত হয় বা আকষ্মিকভাবে তার আবির্ভাব ঘটে, তাহলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের আসনটি আর থাকবে না। তবে আপাততঃ সে সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ এবং ভবিষ্যতে আদৌ সে রকম কিছু ঘটবে কি না তাতেও মানুষের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই অস্তিত্ব সম্পর্কিত যাবতীয় চিন্তা ভাবনা ও রহস্য-উদ্ঘাটন চেষ্টা মানুষকেই করতে হবে। অবশ্য এ যাবৎ মানুষ তা করেছেও অনেক। তবে তার অধিকাংশই অসামঞ্জস্য ও বিক্ষিপ্ত। এর কারণও রয়েছে বটে। কারণ অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। স্থান, কাল, পদার্থ ও প্রাণ সব কিছুই এসে পড়ে। প্রচেষ্টায় এগুলোর কোনটিরই এখনও পর্যন্ত শুরু বা শেষ অথবা প্রকৃত অবস্থা জানা যায়নি। এগুলোকে একসাথে প্রকৃতি বলা হয়ে থাকে। এ প্রকৃতি সম্বন্ধে জানাই মানুষের নিরন্তর সাধনা। এটি মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য। তাই মানুষ এ প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকেনি
এবং এখনও নেই। তবে প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে প্রকৃতির বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তার পেছনের কারণ জানার অন্য কোন বিকল্প নেই। তাই মানুষ তার চারপাশের বর্তমান দেখে অতীত
সম্পর্কে ধারণা নিয়েছে এবং এখনও নিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষ দু’রকম ধারণা নিয়েছে। একটি কল্পনা প্রসূত এবং ধ্রুব। অন্যটি যৌক্তিক চিন্তা সমৃদ্ধ এবং পরিবর্তন সাপেক্ষ। এর কারণ বুঝতে হলে
এই একই প্রক্রিয়ার চিন্তা সমৃদ্ধ ধারায় আমরা প্রকৃতির অংশ মানুষেরও বর্তমান দেখে তার অতীত সম্পর্কে ধারণা নিতে পারি। এতে দেখা যায়, খুব কম মানুষই সুক্ষ্ম বোধ বুদ্ধির চিন্তাশক্তি সম্পন্ন। অধিকাংশরই চিন্তা
স্থূল ও যুক্তিবোধহীন এবং তারা কিছুটা বিষ্ময়াভিভূত। আর অনেকটাই ভয়ে তাড়িত। এ ভয় আর বিষ্ময় তাদের মূল চালিকাশক্তি। এ শ্রেণীর মানুষের বর্তমান সংখ্যাধিক্য প্রমাণ করে যে, এটি মানুষের আদি তথা
প্রাথমিক অবস্থা। মানব জাতির আদি পর্যায়ে মানুষের মস্তিষ্ক প্রায় অবিকশিত ছিল। সে সময় মানুষ প্রাণী স্তরেই ছিল বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। ধীরে ধীরে বহুকাল ধরে তার মস্তিষ্ক বিকাশ প্রক্রিয়া চলে। কিন্তু খুব
সীমিত সংখ্যক কিছু মানুষ ছাড়া অধিকাংশ মানুষেরই কাক্সিক্ষত মানের ও মাপের মস্তিষ্কের বিকাশ এখনও ঘটেনি। তাই প্রাথমিক অবস্থায় বিষ্ময়াভিভূত ভয় তাড়িত মানুষ প্রাকৃতিক শক্তি ও অস্তিত্ব সম্পর্কিত যে কল্পনা প্রসূত সমাধান দিয়েছিলেন সেটি আজকের অধিকাংশ মানুষও আঁকড়ে ধরে আছে। এদেরকে সাধারণ মানুষবলা যেতে পারে। এই সাধারণ মানুষ বর্তমানে প্রাকৃতির শক্তির অনেক রহস্য উন্মোচন সত্ত্বেও তাদের প্রাপ্ত পূর্ব ধারণা পাল্টাতে পারে না। এদের মধ্যে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষও রয়েছে। তারা শেখে আধুনিক ধারণা আর বিশ্বাস করে পূর্ব ধারণা। সুতরাং তাদের অবস্থান আরও নিম্নপর্যায়ে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। আসলেই অবস্থানের উন্নতির জন্য বংশগত ও পরিবেশের প্রভাব বিমুক্ত হওয়া জরুরী। কিন্তু এই সাধারণ মানুষের পক্ষে তা প্রায় অসম্ভব। তাই তারা চিন্তা চেতনায় সুদীর্ঘকাল একই অবস্থানেই রয়ে গেছে। অন্যদিকে বহুকাল সংকর প্রজনন ধারা ও বিবর্তন প্রক্রিয়া অব্যহত থাকার ফলে আদি পর্যায় থেকেই গুটিকয়েক ব্যতিক্রমধর্মী মানুষের
আবির্ভাব ঘটে যারা বংশগতি ও পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতার প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রকৃতি সম্পর্কিত নানা প্রশ্নের প্রচলিত সমাধানের বিপক্ষে সম্পূর্ণ নিজস্ব এবং যৌক্তিক পরিবর্তন সাপেক্ষ ধারণা ব্যক্ত করে এসেছে।
মানুষের জীবন যাত্রার সম্মুখ গতি মস্তিষ্ক ও মানব বিকাশের ধারায় এদের ভূমিকাই মুখ্য। তবে মস্তিষ্ক বিকাশের ফলশ্র“তিতে প্রাকৃতিক শক্তির অনেক দিক করায়ত্ত্ব হওয়াই জীবন যাত্রার মান বাড়লেও সে হারে তার মানস বিকাশ ঘটেনি। তাই বলা চলে, মানুষ বাঁচার উপকরণ তৈরিতে যতটা সফল হয়েছে বাঁচার ক্ষেত্র তৈরিতে ঠিক ততটা সফল হতে পারেনি। ঋদ্ব মানুষদের এ মুহুর্তে জীবন যাত্রার মান বাড়ানো ও প্রাকৃতিক শক্তির রহস্য উন্মোচন প্রচেষ্টার পাশাপাশি মানব জাতির মানসিক বিকাশে আরও অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এদিকটিতে মানুষের পিছিয়ে থাকার বেশ লক্ষণীয় একটি কারণ রয়েছে। আদি পর্যায়ের মানুষ জীবন যাত্রার কঠিন অবস্থার কারণে স্বাভাবিকভাবে দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। তাদের এ অবস্থায় আক্রমণ বা আগ্রাসন সমষ্টি স্বার্থে পরিচালিত হত। কোন প্রকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ তখনও জন্মাতে পারেনি। কিন্তু জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের দলগত অবস্থা ভেঙ্গে যায় --- জন্ম নেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ও ব্যক্তি অধিকার তথা ব্যক্তিস্বার্থ। আগ্রাসন এখন দলগত নয় ব্যক্তিস্বার্থেই করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আগ্রাসন এবং আধিপত্য এখন থেকে ব্যক্তি মানুষের স্থায়ী প্রবৃত্তি হয়ে গেল। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে মানুষে মানুষে এখন চলছে আগ্রাসন এবং আধিপত্যের প্রতিযোগিতা। মানুষের ব্যক্তিস্বার্থবোধ এমন প্রকট হয়েছে যে, তার আগ্রাসন প্রবৃত্তি পশ্বাধম পর্যায়ে নেমে গেছে। কারণ পশু তার বেঁচে থাকার নিমিত্ত ছাড়া আক্রমণ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে না। কিন্তু মানুষ প্রকট ব্যক্তিস্বার্থবোধের ফলশ্রুতিতে তার চাহিদা-তৃষ্ণা এতটা বাড়িয়েছে যে প্রায় বিনা প্রয়োজনে অন্যকে আক্রমণ করতেও সামান্যতম দ্বিধা বোধ করে না। এটি নিঃসন্দেহে মানুষের অধঃপতন। এ অবস্থার উন্নতি করতে হলে আমাদের বর্তমান মানুষের হীনব্যক্তিস্বার্থবোধ বর্জন করে আদি পর্যায়ের সমষ্টিস্বার্থবোধ অর্জন করতে হবে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে, এটি অর্জন করা প্রশ্নাতীতভাবে খুব কঠিন কাজ। তবুও মানুষকেই তা করতে হবে- মানুষের পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব এবং তা তাকে করতে হবে নিজের
কারণে- নিজের সুখ ও আনন্দ উপভোগের জন্যই। কারণ, ব্যক্তিস্বার্থবোধ কিছু মানুষকে আরাম-আয়েশবিলাস ও ফুর্তি দিতে সক্ষম হলেও অনাবিল আনন্দ ও সুখানুভূতি প্রদান করতে পারে না। ফলে অনেক কিছুরমাঝে থেকেও কিছু নেই-এর এক পীড়াদায়ক অনুভূতি তাদের হতাশাগ্রস্থ করে তোলে এবং তারা এতে অনেক সময় আত্মঘাতী বা বিকৃত হয়ে শোচনীয় জীবনাবসানের দিকে ধাবিত হয়। যদিও আধিপত্যের স্বাদ পেলে
মানুষ নেশাগ্রস্ত হয় এবং তার পক্ষে তা ছাড়া কঠিন হয়ে পড়ে, তবুও একদিন তার মোহমুক্তি ঘটবে। তবে তা অনেক সময় সাপেক্ষ। তাই বর্তমান মানব সমাজের দ্রুত উন্নয়নের জন্যে জ্ঞানী ও ত্যাগী ব্যক্তিদের প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের মানস গঠনে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ আরম্ভ করে দিতে হবে। একমাত্র এভাবেই বর্তমান মানব সমাজের মানোন্নয়ন সম্ভব-অন্যথায় নয়। কারণ মন বা মানস সমৃদ্ধ না হলে যেমন সত্যিকারের মানুষ হওয়া যায় না, তেমনি সত্যিকারের মানুষ ছাড়া সুন্দর সমাজ গঠন সম্ভবপর নয়। মানুষ গড়া কঠিন হলেও এটি দুঃসাধ্য কাজ নয় মোটেই। শৈশব থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়া উচিত। তাহলেই এটি অনেকটা সহজতর হবে। এছাড়া এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিশুদের বিরুদ্ধ পরিবেশের প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য মানসম্মত শিক্ষক পরিচালিত কিছু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞানমনষ্ক ও বিশ্বভাতৃত্ববোধ তথা মানবিক বোধ সম্পন্ন শিক্ষাক্রমের আওতায় আনতে হবে। কারা এ গুরুদায়িত্ব নেবে এ প্রশ্ন হওয়া যদিও স্বাভাবিক, কখনই এ দায়িত্ব নেবার মানুষ মিলবে না এটিও সত্যি নয়। কারণ মানব সমাজের মধ্য থেকে আদি পর্যায়ে সৃষ্ট ভাল-মন্দবোধ এখনও তিরোহিত হয়নি। বরং তা আরও স্পষ্টতর হয়েছে। ক্রান্তিকালে এ মানুষের আবির্ভাব ঘটবেই। কারণ সমাজ বিবর্তনের ধারায় যুগে যুগে এটিই ঘটে
আসছে। কাক্সিক্ষত পরিবর্তিত সমাজ গঠন হলেই কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যায় না। কারণ সমাজ গঠনের মূলে রয়েছে মানস গঠন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় কোন বিরতি বা ছেদ রাখা যাবে না- এটি একটি বহমান প্রক্রিয়া-
এতে বিরতি বা ছেদ পড়লে মানুষের মানস গঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে এবং তার ফলে সমাজ বিকলাঙ্গ বা বিকৃত হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাবে। এ মুহুর্তে ভবিষ্যৎ সমাজ গঠনকল্পে সুশিক্ষিত ও সচেতন প্রতিটি
মানুষের যার যার অবস্থান থেকে ব্যক্তিমানস গঠনের কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। ক্রান্তিকাল আসা পর্যন্ত এটিই একমাত্র করণীয়।
------০০০০০------
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৪:০৬