প্রচন্ড মেধাবী ছোট বোন প্রাথমিক সমাপনি পরিক্ষায় অসাধারন রেজাল্ট করার পরেও কিছুটা সামাজিক কুসংস্কার আর কিছুটা তখনকার দিনের গাও গ্রামের অব্যবস্থার ফলে পড়াশোনাটা থামিয়ে দেয়া হয়। গ্রাম গঞ্জের রীতি অনুসারে একটা সময়ে অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্তে বিয়েও হয়ে যায় প্রিয় বোনটির। জমি জিরাত ভালোই ছিল। চাষবাস করে সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে যেত। বোন সন্তান সম্ভবা হন। প্রথম ছেলে সন্তান জন্মের পরপরই মারা যায়। প্রচন্ড আঘাত পান বোন। এবং এটাই বুঝি তার প্রথম আঘাত।
নদীর পাড় থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ছিল এই বোনের বাড়ি। নদী ভাঙ্গনের ফলে একটা সময়ে বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হন তারা। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ভিটে বাড়ি সব কেড়ে নিয়ে গেল নদী। গাছপালা, পুকুর ভর্তি মাছ, সোনালী ধানের হাসিভরা মাঠ, সব সবই কেড়ে নিয়ে গেল সর্বনাশা নদী। নদীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিইবা করার আছে? নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগিয়ে আসছে। চোখের সামনে যেদিন বাড়ির সামনের পাকা প্রাচীন মসজিদখানাও নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখলেন আমার সরলমতি বোনটি দ্বিতীয়বারের মত বুঝি শোকাহত হলেন।
নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে গেল একটি পরিবার। নি:স্বতারও একটা সীমা থাকে। আগুনে পুড়ে গেলে তো ভিটে মাটিটা অন্তত: থাকে। নদী তো কিছুই রেখে গেল না। বাপ দাদার কবরের নিশানাটাও হারিয়ে গেল জলের অথৈ ধারায়। গ্রামের স্বচ্ছল কৃষক পরিবারটি চলে আসে রাজধানী ঢাকায়। ততদিনে বড় মেয়ে মুক্তার বিয়ে হয়ে গেছে। মেঝ মেয়ে মায়া ক্লাশ এসএসসি পরিক্ষা তখনও দেয়নি। বাবা মায়ের অভাবের সংসার। দেখে। সবকিছুই বুঝে। বুঝেও কিছু করতে না পেরে মর্মযাতনায় ভোগে কঁচি মন। বোঝা হয়ে থাকা যেন সম্মানে বেধে যায় ওর। সিদ্ধান্ত নেয় চাকরি করবে। চুপি চুপি মাকে বলে। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে। তাকে নানাভাবে বুঝায়। 'মা, তোমার সংসারে অভাব থাকতে দেব না। তোমাদের কষ্ট করতে দেব না। আমি চাকরি করলে তোমাদের অভাব দূর হবে।'
একটা সময় মেয়ের মন রক্ষার জন্য সম্মতি দেন। মায়া চাকরি নেয় প্রাইভেট একটি কোম্পানীতে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুনি, মায়া অসুস্থ। পেটে ব্যথা। পেটে প্রচন্ড ব্যথা।
কয়েক দিন পর্যন্ত ব্যস্ততার কারনে যেতে পারিনি। ফোনে খোঁজ খবর নিয়েছি। হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেছে তাও জেনেছি। সকাল বিকাল মোবাইলে ফোন করে অবস্থা অবহিত হয়েছি। চিন্তা ছিল, একটু ফ্রি হয়ে মায়াকে দেখতে যাব। কিন্তু ঘূনাক্ষরেও বুঝিনি, এই দেখাই শেষ দেখা।
অবশেষে মায়াকে দেখতে গিয়েছিলাম। মায়াকে দেখেছিলাম। কিন্তু সে অন্য মায়া। ঢাকা মেডিকেলের বেডে নিথর মায়া। কষ্টে নীল হয়ে যাওয়া কঁচি সোনা মুখ। মায়া চলে গেছে। আমাকে না বলেই। মায়াকে পেয়েছি। মায়াকে পাইনি। মায়াকে পেয়েছি কিন্তু মায়া কথা বলেনি। টিয়ে পাখির মত মায়ার মিষ্টি মধুর ডাকে বিমোহিত হতে পারিনি। আর হতে পারবো না কোনো দিন। লিভারের সমস্যা মায়াকে অন্য জগতের বাসিন্দা করে দিয়েছে। পাশে উপবিষ্ট দু:খিনী বোন আমার। বাকরুদ্ধ। হতভম্ব। ভাগ্যের কাছে বারবার পরাজিত পৃথিবী সেরা এক নারী। অশ্রুভেজা ফোলা ফোলা চোখ। কান্না করতেও যেন ভুলে গেছে সরলা অবলা বোন আমার। এই বুঝি বোনের বুকে তৃতীয় এবং সবচে' বড় আঘাতটি সযতনে আসন গেড়ে বসলো।
গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল মায়াকে। পুকুর পাড়ের হিজল গাছের তলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হল মায়া মামনিকে। সাথে ঘুমিয়ে গেল তার দেখা বাবা-মায়ের দু:খ-অভাব দূর করার স্বপ্নগুলোও।
একটি ফুল পাঁপড়ি মেলে মুকুলিত হবার আগেই যেমন ঝড়ে যায় তেমনি ঝড়ে গেল মায়া মামনিও। মায়া, মামনি! অনন্ত নক্ষত্র হয়ে থেকে যেও, দেখা হবে জান্নাতের সিড়িতে!
মায়া মামনিটার জন্য কবিতার ক'টি লাইন-
মায়া, মামনিটা, ঘুমিয়ে থাকো, হিজল শাখের তলে,
তোমার কবর পানে মেঘের ছায়া পড়বে গলে গলে।
কেউ তোমাকে জাগাবে না, ভাঙ্গাবে না তোমার ঘুম,
প্রার্থনা সকাতর, জান্নাত এসে দিক তোমাকে স্নিগ্ধ চুম।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:৪০