আপনার একটু ভালবাসা বদলে দিতে পারে ওদের জীবন! হ্যাঁ আসলেই তাই। গত পরশু ২৭ মার্চ ২০১৮ কাজের চাপে দুপুরের খাবার গ্রহনে কিছুটা লেট হয়ে যায়। আড়াইটার দিকে অফিসের পাশ্ববর্তী হোটেলে খেতে যাই। দু'চার জন খানা খাচ্ছেন। একটি খালি টেবিলে বসে হোটেল মালিকের ছোট ভাই আবুলকে বললাম, 'খানা দাও।'
অাবুল খানা অানার জন্য হোটেলের পেছনের দিকে চলে গেল। ইত্যবসরে ১৫/১৬ বছর বয়সী অচেনা লুঙ্গি পড়া একটি ছেলেকে দেখলাম, হোটেলের ভেতর ঘোরাফেরা করছে। ভাবলাম, এদের কর্মচারী হবে হয়তো। ছেলেটি ঠিক আমি যে টেবিলে বসেছি, সেই টেবিল থেকে কালো রংয়ের একটি মোবাইল হাতে নিয়ে পেছনের দিকে চলে গেল। পেছনের দিকে যেতে দেখে তাকে বললাম, 'তুমি, আবুলকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বল।'
দু'তিন মিনিটের মাথায় আবুল খাবার নিয়ে এলো। আবুল আসতে না আসতেই বাইরের দিক থেকে এক যুবক দৌড়ে এসে বললেন, 'আমার মোবাইল ভুলে রেখে গেলাম। এই একটু আগে।'
আমার টেবিলটি দেখিয়ে তিনি বলেন, 'এই টেবিলে ছিল। আমার নতুন মোবাইল। দুই সপ্তাহ হয় কিনেছি।'
মুহূর্তেই সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আবুলকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি খাবার আনতে পেছনের দিকে যাওয়ার পরে যে ছেলেটি তোমার পেছন পেছন গেল সে কোথায়? তাকে তো আমি মোবাইল হাতে নিয়ে যেতে দেখেছি। তাকে ডাকো। আবুল বলে, 'কোন্ ছেলে?'
ধমকের স্বরে বলি, 'এই ব্যাটা, চোর আজকে পিটাবো না, মার কিন্তু তোর পিঠেই পড়বে। ডাক ওকে। ও ছেলেটা কে ছিল? এই একটু আগে বেরিয়ে গেল। আর এখনই চিনতে না পারার ভান করছিস?'
ছেলেটির কিছুটা বর্ননা দেয়ার পরে আবুল বুঝতে পারলো এবং তার মোবাইলে ফোন করে তাকে হোটেলে আসতে বললো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখি, সে এসে হাজির।
আশপাশের দোকানীসহ অনেক লোক ইতিমধ্যেই হোটেলে এসে জড় হয়েছে। ছেলেটিকে কঠিনভাবে চেপে ধরা হল, মোবাইল বের করে দেয়ার জন্য। তবে, তার এক কথা, সে মোবাইল নেয়নি। যার মোবাইল হারিয়েছে, তিনি আমাকে দেখিয়ে ছেলেটিকে বললেন, ইনি দেখেছেন, তুই তার সামনে থেকে মোবাইল নিয়েছিস। তুই ছাড়া আর কেউ মোবাইল নিতে পারে না।
কারও কোনো কথাতেই কিছু হল না। ছেলেটির সেই একই কথা, সে মোবাইল নেয়নি। একপর্যায়ে আমার সামনে এসে বললো, 'হুজূর, দেখুন, আমি তো আপনার সামনে থেকেই আমার এই মোবাইল নিয়ে গেলাম। আপনি দেখেছেন না তখন?'
আমি বললাম, 'হ্যাঁ, আমি দেখেছি, তোমাকে কালো রংয়ের এরকম একটি মোবাইলই তো নিতে দেখেছি। আচ্ছা, যে মোবাইলটি তুমি নিয়েছো, সেটাই কি এটা ছিল? তাহলে তুমি কি এই ভদ্রলোকের মোবাইল নাওনি?'
সে বললো, 'এটাই টেবিলে রেখেছিলাম। আবার টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছি।'
এবার তাকে ভাল করে জেকে ধরলো সবাই। উত্তম মধ্যম পর্ব শুরু হবে আরকি! লুঙ্গিপড়া ছেলের ভাবসাব দেখে আমি শিউর, এই ছেলে মার খেয়ে মরে যাবে, তবু মোবাইল চুরির কথা স্বীকার করবে না।
আমি সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বললাম, 'আচ্ছা, যেহেতু ঘটনার শুরু থেকে আমি এখানে ছিলাম। ওকে আমার সাথে একান্তে দু'মিনিট কথা বলতে দিন।'
সবাই সম্মত হলেন। ছেলেটিকে নিয়ে আমি হোটেলের পেছন দিকে চলে গেলাম। যে দিকটায় সে মোবাইল নিয়ে গিয়েছিল। হোটেলের পেছনে সবুজ ঘাসের মাঠ। মাঠে গিয়ে তাকে বললাম, 'বাবা, আমার দিকে তাকাও।'
সে তাকালো। বললাম, 'বাবা, তোমাকে দেখে মনে হয় না তুমি চোর। এই সামান্য একটি মোবাইল নিয়ে তুমি তোমার হাত অপবিত্র করো, এটা আমি চাই না। তোমাকে ভাল ছেলে বলে মনে হয়। তুমি তার মোবাইল যদি নিয়ে থাকো, দিয়ে দাও। কথা দিচ্ছি, কেউ তোমাকে কিছু বলতে পারবে না। সে দায়িত্ব আমি নিলাম।'
আহ! ছেলেটি শুকনো মুখে বললো, 'আপনি যেহেতু বলেছেন, আমার আর কিছু বলার নেই। চলুন, মোবাইল সামনে আছে।'
তার সাথে কিছু দূর যাওয়ার পরে ইটের একটি স্তুপের ভেতর থেকে মোবাইল সেটটি বের করে আমার হাতে দিয়ে দিল।'
আহ! কতটা শ্রদ্ধাবোধ আমার প্রতি তার! অামি অবাক হলাম। আহ! দু'টো কথায় সে মোবাইলটা দিয়ে দিল! আমার মনে হল, আহ! একটু ভাল কথা, তার অন্তরটা ভিজিয়ে দিল। একটু সুন্দর কথায় সে অর্থের লোভ ত্যাগ করে মোবাইলটি দিয়ে দিল!
মাথায় হাত দিয়ে আরও দু'টো কথা বলার পরে সে জানালো, 'জীবনে আর এই কাজ করবে না সে।'
সকলের সাথে আমাদের আচরন যদি সুন্দর হত, সকলেই নিজেকে অন্যায় থেকে বাঁচিয়ে রাখতো! আমাদের সদাচরন বদলে দিত ওদের মত অনেকের জীবন!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৮ বিকাল ৫:২৮