আজকাল নারী অধিকার আদায়ের নামে অনেকে নানান ধরনের ফর্মুলা বাতিয়ে থাকেন। এসব ফর্মুলা সত্যিকারার্থে নারীর মর্যাদা রক্ষায় কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে, হাল আমলের নারীর প্রতি বৈষম্য, বিশ্বব্যাপী তাদের অধিকারহীনতাই তা প্রমানে যথেষ্ট। নারীর পরিপূর্ন সম্মান, মর্যাদা এবং যথাযথ অধিকার ইসলাম ধর্ম নারীকে দিয়েছে। নারীর পূর্নাঙ্গ অধিকার আদায়ে ইসলাম ধর্মের আদর্শ কোনভাবেই তুলনীয় নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে বলেন,
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
‘তারা তোমাদের আবরণ এবং তোমরা তাদের আবরণ।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)।
দাম্পত্য জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর রয়েছে নির্দিষ্ট অধিকার ও কর্তব্য। স্বামী ও স্ত্রী একে অন্যের সহায়ক ও পরিপূরক। সুতরাং উভয়েরই রয়েছে উভয়ের প্রতি বিশেষ দায়িত্ব ও করণীয়।
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য
আল্লাহ তাআলা বলেন,
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاء بِمَا فَضَّلَ اللّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُواْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ
‘পুরুষগণ নারীদের প্রতি দায়িত্বশীল, যেহেতু আল্লাহ একের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তারা তাদের সম্পদ হতে ব্যয়ও করে।’ (সুরা: ৪ নিসা, আয়াত: ৩৪)।
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রথম দায়িত্ব বা কর্তব্য হলো মোহর পরিশোধ করা। নগদে পরিশোধ করতে হবে স্ত্রীর মোহর। বিশেষ অপারগতায় বাকিতে হলেও তা পরিশোধ করতে হবে। কিস্তিতেও পরিশোধ করা যাবে। মহর পরিশোধ না করে মৃত্যু হলে তা ঋণ রূপে পরিগনিত হবে এবং ঋন হিসেবে গন্য করে স্ত্রীকে দিয়ে দিতে হবে। কোন কারনে মোহর স্ত্রীর জীবদ্দশায় আদায় করা সম্ভব না হলে, স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর বৈধ ওয়ারিশগনের নিকট তা পরিশোধ করতে হবে।
বিয়ের পর স্বামীর প্রতি দায়িত্ব হলো স্ত্রীকে খোরপোশ (খাদ্য এবং পোষাক) ও বাসস্থান দেওয়া। এই তিন মৌলিক চাহিদার প্রথমটি হলো খাদ্য। স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীর উপযুক্ত প্রয়োজনমতো খাদ্য যথাসময়ে নিয়মিত স্ত্রীকে দিতে হবে বা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। উল্লেখ্য, খাদ্য বলতে তাৎক্ষণিক খাবারের উপযোগী দ্রব্য বা প্রস্তুত করা খাবার। অর্থাৎ খাবার সরবরাহ করা যেহেতু স্বামীর দায়িত্বে; সুতরাং খাবার প্রস্তুত করা স্ত্রীর দায়িত্ব নয়। মৌলিক চাহিদা তিনটির দ্বিতীয়টি হলো পোশাক। স্বামী স্ত্রীকে স্বীয় সামর্থ্য অনুসারে স্ত্রীর প্রয়োজনমতো তাঁর যোগ্য পোশাক দেবেন। প্রয়োজনীয় পোশাক প্রদান করা যেহেতু স্বামীর দায়িত্ব; তাই সে পোশাক প্রস্তুত করার ব্যয়ও স্বামীর ওপরই বর্তাবে।
স্ত্রীর মৌলিক অধিকারের তৃতীয়টি হলো নিরাপদ বাসস্থান বা নিরাপদ আবাসন। অর্থাৎ, স্বামী স্ত্রীকে থাকার জন্য এমন একটি ঘর বা কক্ষ দেবেন, যে ঘর বা কক্ষে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া (স্বামী ব্যতীত) কেউই প্রবেশ করতে পারবেন না। এমনকি স্বামীর মা-বাবা, ভাইবোনও না। স্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে এই ঘরে বা কক্ষে তিনি তালাচাবিও ব্যবহার করতে পারেন। স্ত্রীর ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বিষয়ে স্বামী ছাড়া কেউই নাক গলাতে পারবেন না। স্ত্রীর স্যুটকেট, ট্রাঙ্ক ও আলমারি স্বামী ছাড়া কেউ তল্লাশি করতে পারবেন না। কোনো স্ত্রীর চলাফেরা বা আচার-আচরণ শ্বশুর-শাশুড়ির অপছন্দ হলে তাঁকে আলাদা বাড়ি বা ঘর করে দেওয়া উচিত। স্ত্রীর ব্যবহৃত কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও স্বামীকেই করতে হবে এবং সামর্থ্য থাকলে স্ত্রীর ফুট ফরমাশ পালন করার জন্য একজন কাজের লোকও রাখবেন স্বামী। (শরহে বেকায়া, কিতাবুন নিকাহ)।
স্বামীর সংসারে স্ত্রী কাজকর্ম করলে এরজন্য স্ত্রী নফল ইবাদতের সওয়াব পাবেন। বিপরীতে, একইরকমভাবে স্বামীর উপার্জিত হালাল অর্থ থেকে স্ত্রী সন্তানদের জন্য ক্রয় করা খাদ্যের প্রতিটি লোকমার জন্যও স্বামীও নফল সদকার সওয়াব প্রাপ্ত হবেন। অসচ্ছল ও অভাবী স্বামীর সংসারে স্ত্রী কাজকর্ম করলে স্বামীর উপার্জনে সহায়তা এবং সন্তানদের প্রতি সহযোগিতা করা হবে। সংসারে উন্নতির জন্য স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে সহযোগিতা করা উচিত।
সংসারে স্ত্রীর কর্তব্য
বিয়ের পর যাবতীয় দায়িত্ব স্বামীর কাঁধে বর্তালেও স্ত্রীরও কিছু কর্তব্য রয়েছে। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নারী যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজান মাসে রোজা রাখে, স্বীয় সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষা করে শালীনতা বজায় রেখে চলে এবং স্বামীর আনুগত্য প্রকাশ করে; তখন সে বেহেশতের যেকোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।’ (আবু দাউদ শরিফ)।
স্ত্রী হিসেবে স্বামীর দেখভাল করা স্ত্রীর দায়িত্ব। স্বামীর সংসারের দেখাশোনা করা এবং স্বামীর সম্পদ সংরক্ষণ করাও স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِّلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللّهُ
‘তবে সৎকর্মশীলা নারী বা সাধ্বী রমণী তাঁরা, যাঁরা অনুগতা এবং লোকচক্ষুর অন্তরালেও তাঁরা তা সংরক্ষণ করেন, যা আল্লাহ হেফাজত করেছেন।’ (সুরা: ৪ নিসা, আয়াত: ৩৪)।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জন্য সঙ্গী জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করো এবং তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সুরা: ৩০ রুম, আয়াত: ২১)।
সন্তান লালনপালন
সন্তানের দায়িত্ব পিতার। তার ভরণপোষণ, চিকিৎসা ও শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভারও বাবাই বহন করবেন। মা তাকে দুধ পান করাবেন। যত্ন করে লালন পালন করবেন। কুরআনুল কারিমে এ বিষয়ে বিবৃত হয়েছে,
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلاَدَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَن يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ وَعلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ لاَ تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلاَّ وُسْعَهَا لاَ تُضَآرَّ وَالِدَةٌ بِوَلَدِهَا وَلاَ مَوْلُودٌ لَّهُ بِوَلَدِهِ وَعَلَى الْوَارِثِ مِثْلُ ذَلِكَ
‘আর জননীগণ যদি চান তাঁদের সন্তানদের দুগ্ধপান পূর্ণ করতে, তবে পূর্ণ দুই বৎসর দুধ পান করাবেন। আর সন্তানের পিতার দায়িত্ব তাদের খাবার ও পোশাক। কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যের অতীত কার্যভার দেওয়া হয় না। সন্তান দ্বারা জননীর ক্ষতি সাধন বিধেয় নয়; আর বিধেয় নয় সন্তান দ্বারা তার জনকের ক্ষতি সাধন। এবং উত্তরাধিকারীদের ওপরও অনুরূপ দায়িত্ব।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ২৩৩)।
শেষের কথা
কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়-
প্রীতি ও প্রেমের পূন্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।
স্ত্রী হলেন সহধর্মিণী, অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানের জননী; তাই স্ত্রী সম্মানের পাত্রী। স্ত্রীর রয়েছে বহুমাত্রিক অধিকার; সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে এবং উভয়ের পরিবারের প্রত্যেকে নিজ নিজ অধিকারের সীমানা ও কর্তব্যের পরিধি জেনে তা যদি যথাযথ চর্চা করেন তাহলে সংসারে নেমে আসবে শান্তির পরিছায়া। মাটির পৃথিবীতেই লাভ করা সম্ভব জান্নাতের অমীয় সুখের পরশ।
আল্লাহ পাক আমাদের দুনিয়া আখিরাত উজ্জ্বল করুন। সকলের সংসার আলোকিত করুন। সুখের প্রদীপ জ্বেলে সকলের কষ্ট দু:খ দূর করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:০১