এইমাত্র আমি 'Suicide' করলাম..সিলিং ফ্যানের সাথে এখনও আমার লাশটা ঝুলছে...'Suicide Case" এ আইনী কিছু ঝামেলা থাকায় কেউ আমার লাশটা নিচে নামায়নি..সবাই পুলিশকে খবর দিতে ব্যাস্ত...অন্যদিকে এক মহিলার কান্নায় চারপাশের পরিবেশ অশান্ত, খুব খেয়াল করে দেখলাম মহিলাটি আর কেউ নয় আমার জন্মদাত্রী 'মা" নাসিমা বেগম... গলা ফেটে চিৎকার করে বারবার তিনি আমার রুমে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন,কিন্তু প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলা তাকে শক্ত করে ধরে পাশের রুমে নিয়ে যাচ্ছে.. রুমে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে একটু পর পর তিনি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন, মহিলারা মাথায় পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর সাথে সাথে আবার বুকফাটা আর্তনাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন...আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল..বিশ্বাস করুন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে "ওমা তুমি কেঁদনা,এই যে তোমার খোকা"...কিন্তু পারিনি বলতে...!!
রুমের এক কোণায় বসে মুখ লুকিয়ে চুপটি করে কাঁদছিল একটা লোক...কাছে গিয়ে দেখলাম লোকটি আমার রাগী বাবা, এস.এম আসাদ চৌধুরী.. দীর্ঘ কুড়িটা বছর এই মানুষটাই আমাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে লেখা-পড়া শিখিয়ে বড় করেছেন.. আমাকে ঘিরে তার একটা স্বপ্নও ছিল,আর্মির একজন বড় অফিসার হব আমি..ব্যাস এতটুকুই...!! নাহ আমার মৃত্যুতে মোটেই তিনি আম্মুর মত ভেঙে পড়েনি, শুধু ক্ষানিকটা সময় পর পর কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে বাম হাতের কব্জি দিয়ে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করছেন মাত্র...কি আশ্চর্য এত্ত রাগী একটা মানুষও কাঁদতে পারে.??
সুমাইয়া আক্তার সুমু..এই পিচ্চি মেয়েটি হল আমার বোন.. হঠাৎ বাড়িতে এত লোকজন দেখে ভয় পেয়ে মায়ের পাশে বসে নির্বাক তাকিয়ে আছে.. মায়ের আহাজারিতে যখন লোকজনের সামনে মাথার কাপড় পড়ে যাচ্ছিল, বারবার সে শাড়ির আঁচলটা নিয়ে মায়ের মাথায় গুজে দিচ্ছিল...পিচ্চি বোনের এই ব্যাপারটা সত্যিই আমার হৃদয়টাকে নাড়া দেয়.. তবে সে কাঁদছেনা,একদম কাঁদছেনা..কারন সে জানেনা তার ফুচকা,আইসক্রিম আনা ভাইটা আর বেঁচে নেই...হয়তো এখন জানেনা,তবে কাল,পরশু,কিংবা সামনের সপ্তাহে ঠিক জানবে...সে যখন দেখবে "আইসক্রিম" নিয়ে ভাইটা আর বাড়ি ফিরে ডাকছেনা "সুমু পাগলী এদিকে আয়,কি এনেছি দেখবি".. তখন জানবে...হুম জানবেই একদিন...!!
ভোর পাঁচটা..পুলিশ এসে আমার লাশটা ফ্যান থেকে নামালো..স্থানীয় কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির অনুরোধে কোনো রকম ময়নাতদন্ত্র ছাড়ায় আমাকে গোসল করানো হল..এরপর তিন টুকরা সাদা কাপড়ে মুড়ে বাড়ির আঙিনায় রাখা হল... আমাকে দেখার জন্য আশে-পাশের বহু গ্রাম থেকে শত শত মানুষ এসেছে..সবাই এক নজর দেখেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে, কেউ একটু পাশে বসে বলছেনা "এই ছেলে তুমি মরে গেলে কেন.?" কেউ বলছেনা...!!
সকাল দশটায় আমাকে দাফন করা হবে, শেষ বারের মত আমার মা' জননীকে আমার সামনে আনা হল.. সবার মত আমার মা আমাকে এক নজর দেখেই চোখ সরাতে পারলোনা.. হাউমাউ করে সে আমার লাশটাকে ধরে কাঁন্না করতে থাকে, লাশের গালে-কপালে চুমু খেয়ে বলে "নাহ আমার বুকের মানিককে আমি কোথাও নিয়ে যেতে দিবনা..কোথাও না".. শুধু আমিই অকৃতজ্ঞের মত চুপ করে শুয়ে রইলাম..একবারও মুখফুটে বলতে পারলাম না "ওমা আমিও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা মা,আমাকে তুমি যেতে দিওনা মা..দিওনা" কারন আমি যে তখন লাশ...!!
.
খট.খট হঠাৎ দরজায় শব্দ (আম্মু ডাকছে).. নাহ আমি এখনও সুইসাইড করিনি..শুধু মরে যাওয়ার পরের অবস্থাগুলো কল্পনা করছিলাম...দরজা খুলে দিলাম,আম্মু জানতে চাইল "সেহরির সময় হয়েছে,রোজা রাখবো কিনা" আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না.. শুধু মাথা নেড়ে হুম বললাম..আম্মু চলে গেল রান্নাঘরে...!!
কেন জানি আজ আম্মুকে অনেক সুন্দর লাগছিল,আব্বুকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করছিল..সুমুকে চিৎকার দিয়ে ডাকতে ইচ্ছে করছিল.. কিন্তু ইচ্ছে গুলোর কোনো কারন নেই..তাহলে এটাই কি ভালোবাসার গোপন টান.? কিন্তু মুমু...মুমুর জন্য কি ছিল.? ভালোবাসা নাকি না পাওয়ার অন্ধ আবেগ.? এই প্রশ্নের উওর জানিনা.. জানতেও চাই না...!!
কারন এখন আমি জানি পৃথিবীতে কেউ কারো জন্য নয়...কেউ চলে গেলে কারো জীবন থেমে থাকেনা..কারো যায় আসেনা... শুধু মানুষগুলো মাড়ির দাঁত শক্ত করে বলে "ইশ্ মরে গেল.! ব্যাস এতটুকুই...!!
আমার মতে পৃথিবীতে যদি কোনো অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি থাকে তাহলে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি অকৃতজ্ঞগ "যে অল্পদিনের পরিচিত ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রতারনার শিকার হয়ে আত্নহত্যা করে"...পরিবার, বাবা-মা'য়ের কষ্টের কথা সে একবারও ভাবেনা..একবারো না..শুনো ছেলে মরে গিয়ে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার এই দুটি মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার নেই তোমার..হুম কোনোই অধিকার নেই...!!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৬ রাত ৩:৩৬