।। নাসীমুল বারী।।
মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠার অনেক কারণের একটি ভাষা। ভাষা মানুষকে মনের ভাব প্রকাশের পথ চিনিয়েছে। পৃথিবীকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে। ভাষার সহজাত এ বৈশিষ্ট্যই পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে রোপিত হয়েছে সভ্যতার বীজ। মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারলে প্রয়োজন, সমস্যা জানা যায় না। অনুভব করা যায় না ভালো-মন্দ। সুন্দর-অসুন্দর। উপভোগ করা যায় না আনন্দ। প্রকাশ করা যায় না বেদনা-বিরহ-উচ্ছ্বাস। ভাব প্রকাশের এ কার্যকরণগুলো আবার এককভাবে প্রকাশ হলেও হয় না। সমাজ-পরিবেশে সম্মিলিত উদ্যোগে হতে হয়। ভাব বিনিময় ও ভাবপ্রকাশের সম্মিলিত এ উদ্যোগই ভাষা; সভ্যতার উপাদান, উপকরণ। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একটি মাত্রা এ ভাষা।
মনের ভাব প্রকাশে উদ্ভব ভাষা মুখে মুখে প্রচলিত। এর ব্যবহারিক প্রয়োগও একটি নির্দিষ্ট বলয়ে শুরু হয়। এক বলয় থেকে বের হয়ে গেলে সে ভাষা আর অন্য বলয়ের মানুষ বুঝতে পারে না। ধীরে ধীরে মানব সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার ঘটতে থাকে। ফলে ভাষাও ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেক পর্যায়েই ভাষা ও এর রূপ পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবে নতুন নতুন ভাষার যেমন উদ্ভব হয়, আবার অনেক ভাষাও হারিয়ে যায়। ভাষাকে যুগ-সমাজে স্থায়ীত্ব দিতে হলে ভাষার সাহিত্যিক গঠনগত কাঠামোর প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি শৃঙ্খল নিয়মে গঠন প্রকৃতিতে বিন্যাস করা; যাতে ভাষার একটা রূপ-বিধি তৈরি হয়। আর সে প্রয়োজনকে সামনে রেখেই মানুষের ভাব বিনিময়ের ভাষা কালক্রমে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে একটি নিয়মের শৃঙ্খলায় বিধিবদ্ধ হয়ে বিকাশ লাভ করে। সাধারণ কথায় ভাষার এ নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রাতিষ্ঠানিক বিধানই ব্যাকরণ। ব্যাকরণ ভাষাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। ব্যাকরণ একটি ভাষার গঠনশৈলীকে ধ্বনিরূপ, শব্দ, বাক্য বিন্যাস— এমন সব মৌলিক কাঠামো সুবিন্যাস্ত করে ধারাবাহিক রূপ দেয়। ব্যাকরণের মাধ্যমেই ভাষার প্রয়োগিক দিকটা সুনিশ্চিত হয়। একটি ভাষার এসব আঙ্গিক দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত হয়ে ভাষাকে একটা সাবলীল, সুন্দর কাঠামোতে সাহিত্যক রূপ দেয়া যায়। সাহিত্য সৃষ্টি হলেই ভাষা লিখিত রূপ পায়। সাহিত্যেই ভাষার প্রয়োগিক অসামঞ্জস্যতা নিরসনে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করা যায়। লিখিত সাহিত্যরূপের ভাষাই সভ্যতার যুগধর্মে স্থায়ীত্ব পায়। ব্যাকরণ সেই স্থায়ীত্বের ভিত্তিমূল। ব্যাকরণের কারণেই একটি ভাষা সার্বজনীনতা পায়। ব্যাকরণ একটি ভাষার মৌলিক কাঠামো। আর তাই ব্যাকরণের সংজ্ঞা এভাবে বলতে পারি, “কোন ভাষাকে গঠন, পঠন ও উপস্থাপনায় শৃঙ্খলাবদ্ধ রীতি-নীতিতে সংগঠিত করে সার্বজনীনতা দেয়ার জন্যে প্রবর্তীত সংবিধিবদ্ধ বিধানকেই ব্যাকরণ বলে।”
বাংলা ভাষাও ব্যাকরণের ভিত্তিতে একটি উন্নত ভাষা। বাংলা আজ পৃথিবীর একটি শক্তিশালী ভাষা। এর অন্যতম কারণ বাংলাভাষা বিজ্ঞানভিত্তিক এবং বৈয়াকরণিক নিয়মের অধীনে একটি সচল ভাষা। এই বাংলাভাষার ব্যাকরণের উৎপত্তি ১৭৩৪ সালে। তবে প্রথমে তা বাংলাভাষায় রচিত হয় নি। পর্তুগিজ ও ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা এ দেশ দখল করার পর তাদের প্রয়োজন দেখা দেয় বাংলাভাষা শিক্ষার। এ দেশের মানুষকে শাসন করতে হলে বাংলাভাষা শিক্ষা প্রয়োজন। এদেশবাসী জন্মগতভাবেই বাংলাভাষা শিখে ফেলে। কিন্তু বিদেশীদের বাংলাভাষা শিখতে নিয়মকানুন জানা দরকার। এ চিন্তা থেকেই পর্তুগিজ পাদ্রি ম্যানুয়েল দ্যা আস্সুম্পসাঁউ ১৭৩৪ সালে রোমান ভাষায় বাংলাভাষার ব্যাকরণ লিখে ফেলেন। ‘বাংলা-পির্তুগিজভাষার অভিধান ও ব্যাকরণ’ নামের গ্রন্থটি তিনি মূলত পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলেই লিখেছিলেন। এটি পর্তুগালের রাজধানী লিবসন থেকে রোমান হরফে মুদ্রিত হয় ১৭৪৩ সালে। এটি বাংলাভাষা শিক্ষার প্রথম ব্যাকরণ বই।
মুখের ভাষা থেকে মনের ভাব প্রকাশ করতে সাধারণ প্রথায় একটা ক্রমসূচি অনুসরণ করা হয়। যেমন : অর্থবোধক ভাষা, ধ্বনি, শব্দ, শব্দের মাধ্যমে পদাকারে বিন্যাস্ত হয়ে বাক্যে রূপ নেয়। এমন ক্রমসূচি প্রচলিত ভাবপ্রকাশ থেকে উৎসরিত। সাধারণ কথা বা ভাষা প্রকাশের এমন প্রচলিত পদ্ধতিকে সংস্কৃত প-িত পাণিনি নিজস্ব বোধ দিয়ে আটটি অধ্যায়ে একটা শৃঙ্খলিত ক্রমসূচিতে গ্রন্থিত ও সংকলিত করেছেন। তা-ই পাণিনির ‘অষ্টাধ্যয়ী ব্যাকরণ’ নামে খ্যাত।
১৭৭৮ সালে আরেক অ-বাংলাভাষী ন্যাথানিয়েল ব্রাসী হ্যালহেড নামের ইংরেজ বাংলাভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণ বই লিখেন। এতে তিনি আটটি অধ্যায়ে অক্ষর, শব্দ থেকে শুরু করে ছন্দ পর্যন্ত বাংলাভাষা শিক্ষার মোটামুটি মৌলিক নিয়মাবলী আলোচনা করেন। তিনিও পাণিনির অষ্টাধ্যয়ী ব্যাকরণের অনুকরণ করেন। বাংলা ভাষা শিক্ষার শুরুতে ব্যাকরণ রচনায় অ-বাংলাভাষীরা সংস্কৃতকে অনুসরণ করেছেন বলেই বাংলা ভাষার মৌলিক ব্যাকরণ গড়ে উঠে নি। হ্যালহেড রচিত বইটির ভাষা ইংরেজি হলেও উদাহরণগুলো ছিল বাংলায়। ওই বইতেই সর্বপ্রথম বাংলা হরফ মুদ্রিত হয়। মুদ্রণে বাংলা হরফের ব্যবহারের ইতিহাসে এ বইটিই প্রথম। তাই এ বইকে অনেকেই মুদ্রিত প্রথম বাংলা বই মনে করেন। ভারতের হুগলী থেকে ছাপা ও প্রকাশিত হয়। বাংলাভাষাভাষীদের মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলা ব্যাকরণ লিখেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮২৬ সালে তিনিও ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ বই লিখেন। অতঃপর কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামে বাংলায় অনুবাদ করে তা প্রকাশ করেন ১৮৩৩ সালে।
এভাবেই বাংলা ব্যাকরণ যাত্রা শুরু করে। আজ এর একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে। আজ বাংলা ভাষা শিক্ষার সাথে বাংলা ব্যাকরণও প্রাথমিক শ্রেণি থেকে বাংলাভাষায় উচ্চতর পর্যায়েও শিক্ষা দেওয়া হয়। যুগের সাথে মিল রেখে এখন বাংলা ব্যাকরণ শুধু হ্যালহেডের সেই আট অধ্যায়েই সীমিত নয়। এখন নিজস্ব অবস্থানে শুধু বিধিগত ব্যাকরণের অধ্যায়েই নয়— ভাষার বিকাশ, উৎকর্ষতার জন্যে সৃজন দক্ষতা অর্জনেরও অনেক অধ্যায়-পাঠ ব্যাকরণ শিক্ষাক্রমে সংযোজিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আবার সময়ের প্রয়োজনে বৈয়াকরণিক পরিবর্তনও আনা হচ্ছে অনেক ধারা বা অধ্যায়ে। যেমন ‘পুরুষ'। শব্দের যে রূপ-বৈশিষ্ট্য কর্তার নির্দেশক চিহ্নিত করে ক্রিয়াপদকে সম্পন্ন করে, তা-ই ব্যাকরণে ‘পুরুষ’। সে হিসেবে আমরা জানি উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ আর নাম পুরুষ। ব্যাকরণের এ ধারা বা অধ্যায়টি আজ পরিবর্তন হয়ে হয়েছে ‘পক্ষ’।
‘লিঙ্গ’ ব্যাকরণের একটি অধ্যায়। একটি পাঠক্রম।
বৈয়াকরণিকভাবে ‘লিঙ্গ’ হলো বিশেষ্য পদের একটি শব্দরূপ— যা পুরুষ নারী পার্থক্য চিহ্নিত করে। ভাষায় লিঙ্গের ব্যবহার অনিবার্য। কোনো ভাব প্রকাশ করতে পুরুষ-নারীত্বের স্বরূপটাও ভাবের একটা মৌলিক অংশ। পুরুষ-নারীর স্বরূপটাকে চিনিয়ে দিতে ভাষাবিজ্ঞানীরা ব্যাকরণের একটি অধ্যায় ‘লিঙ্গ’ উপস্থাপন করেছেন। লিঙ্গ কিন্তু বাংলা ভাষার একটি প্রচলিত শব্দ। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের একাদশ মুদ্রণ ২০০৯-এর ১০৫৬ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত ‘লিঙ্গ’ শব্দের আভিধানিক প্রধান অর্থ হলো ‘পুরুষের জননেন্দ্রিয়’। এরপর অভিধানে আরও যে অর্থ পাওয়া যায় তার একটি হলো ‘হিন্দুদের শিবলিঙ্গ মূর্তি'। এ শিবলিঙ্গ কী? তারও ব্যাখ্যা একই অভিধানের ১০৮০ নং পৃষ্ঠায় পাওয়া যায় এভাবে— ‘প্রস্তর মৃত্তিকাদি দিয়ে গঠিত শিবের লিঙ্গরূপ মূর্তি।’ বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বাংলা-ইংরেজি অভিধানের ১৭তম মুদ্রণ ১৯৯৭-র ৭৩২ নং পৃষ্ঠায় ‘লিঙ্গ' শব্দের ইংরেজি রূপান্তর—‘সাইন অব সেক্স’, ‘পেনিস’, ‘অর্গান অব জেনারেশন’। এ ছাড়া ‘মার্ক' ‘সাইন’ও বলা হয়েছে। তবে ‘পেনিস’, ‘সাইন অব সেক্স’ ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ইংরেজি-বাংলা অভিধানের ৩২তম মুদ্রণ ২০০৯-এর ৫৬২ নং পৃষ্ঠায় পেনিস-এর বাংলা অর্থ বা বাংলা শব্দ হলো ‘পুং জননেন্দ্রিয়’, ‘লিঙ্গ’। আর কোনো অর্থ বা প্রতিশব্দ নেই। ইংরেজি ব্যাকরণে ‘লিঙ্গ' অধ্যায়টা ‘জেন্ডার’। একই ইংরেজি-বাংলা অভিধানের ৩১১ নং পৃষ্ঠায় ‘জেন্ডার’-এর আভিধানিক অর্থ ‘শব্দের ব্যাকরণগত শ্রেণিবিন্যাস।’ এরপর ব্র্যাকেটে দিয়েছে পুরুষ, স্ত্রী, ক্লীব। ‘জেন্ডার’ ভাবগত অর্থে অবশ্য অন্যভাবে ব্যবহার হয়। আরবি ব্যাকরণে ‘লিঙ্গ’ অধ্যায়টা ‘জিন্স’। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত আরবি-বাংলা অভিধানের ২য় খ- ২য় মুদ্রণ নভেম্বর ১৯৯৯-র ১১১৯ নং পৃষ্ঠায় ‘জিন্স’-এর মূল আভিধানিক অর্থ বর্ণিত হয়েছে—‘বংশ, জাতি, প্রকার, প্রণালী, স্বভাব, প্রকৃতি'। ইংরেজি অভিধানে জেন্ডারকে কিন্তু সরাসরি ‘জননেন্দ্রিয়’ অর্থে অর্থায়িত করে নি। জেন্ডার আভিধানিক কিংবা ব্যাকরণগত উভয় অবস্থানেই পুরুষ, স্ত্রী চিহ্নিত করে মাত্র। একইভাবে আরবি অভিধানেও জিন্সকে সরাসরি ‘জননেন্দ্রিয়’ অর্থে অর্থায়িত করে নি। এ ভাষাতেও জাতি, প্রকার, প্রণালী, স্বভাব, প্রকৃতি ইত্যাদি ভাবার্থে নর-নারীর রূপগত পার্থক্য নিরূপণ করেছে।
‘লিঙ্গ’ শব্দের বাংলা অর্থের মৌলিকতা এটি মানুষের বিশেষ করে পুরুষের জননেন্দ্রিয়। এ শব্দের মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় পুরুষত্বকে চিহ্নিত করা হয়। তাই এর বিপরীত ‘স্ত্রী’। এটাও কি ঠিক? পুরুষের বিপরীতটা কি ‘স্ত্রী' নাকি ‘মাহিলা'? প্রচলিতভাবে আমরা জানি ‘স্ত্রী’র বিপরীত ‘স্বামী’ আর ‘পুরুষের’ বিপরীত ‘মহিলা’— বড়জোর ‘নারী’ও বলতে পারি। আর ব্যাকরণে এসে পুরুষের বিপরীত ‘স্ত্রী’ অর্থাৎ ‘পত্নি’ হয়ে গেল। পত্নি আর নারী বা মহিলা কিন্তু এক নয়। যেমন ‘ভাই’ এটি পুরুষ রূপ। তাহলে এর ‘স্ত্রী' রূপ ‘বোন’ না ‘ভাবী'? ‘বোন’ ও ‘ভাবী’র অর্থগত অবস্থানে বেশ পার্থক্য আছে। আবার মনে করি একটি প্রতিষ্ঠানের দুই জন সদস্য। একজন পুরুষ। অপরজন মহিলা। পুরুষজন ‘সদস্য' আর এর স্ত্রীলিঙ্গ ‘সদস্যা’। তার মানে তিনি কি পুরুষ সদস্যজনের ‘স্ত্রী’? দেখা যায় লিঙ্গ অধ্যায়ে ব্যবহৃত এই ‘স্ত্রীলিঙ্গ’ শব্দটির প্রয়োগও কিন্তু অসংগত, যথাযথ নয়।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষার পরই আবশ্যক ভাষা ইংরেজি। আর আরবি ভাষা প্রায় আবশ্যিকই। এ দুই ভাষাতে নর-নারীর রূপগত পার্থক্য নিরূপণে ব্যাকরণগত শব্দটি সরাসরি কিন্তু ‘জননেন্দ্রিয়’ অর্থে প্রয়োগ হয় নি। শুধু আমাদের বাংলা ভাষায় এমনটি করা হয়েছে। বাংলা ভাষার ‘লিঙ্গ’ শব্দটি মূলত একটি বিব্রতকর শব্দ। শালীনতা বর্জিত শব্দ। আবার ‘স্ত্রীলিঙ্গ’— এটিও যথাযথ প্রয়োগ নয়। এমন বিব্রতকর ও শালীনতা বর্জিত একটি শব্দের উপর ভিত্তি করেই ব্যাকরণের একটি অধ্যায়, ধারা গড়ে উঠেছে। আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা কি আমাদের আবশ্যক ভাষা শিক্ষা থেকে এমন বিব্রত ও শালীনতা বর্জিত এবং অসংগত শব্দ থেকে মুক্তি পেতে পারি না?
‘লিঙ্গ’র পরিবর্তে একটি যুৎসই শব্দ প্রয়োগে ‘লিঙ্গ’ অধ্যায়ের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। ‘পুরুষ’এর বিপরীত ‘স্ত্রী’— এ অসামঞ্জস্যতাও নিরসন করা দরকার। আমার প্রস্তাবে ‘লিঙ্গ’র পরিবর্তে ‘বাচক’ আর রূপগত ‘স্ত্রী’ শব্দটা ‘নারী’ হবে।
‘বাচক’ শব্দের অর্থই ‘অর্থ প্রকাশক রূপ’। বাচকের আরও অর্থ ‘দ্যোতক’ও হয়, ‘বোধক’ও হয়, ‘সূচক’ও হয়। ‘দ্যোতক’-এর অর্থটা হয় প্রকাশক, দীপ্তিমান, সূচক; এর মানেই যা কোনো কিছুকে চিহ্নিত করে, দৃশ্যমান করে। এমন অর্থটাই বুঝতে পারি দ্যোতক থেকে। ‘বোধক’ অর্থ বুঝতে পারা বা উপলব্ধি করা। আর ‘সূচক’ মানেই ‘চিহ্ন’। অতএব, যে উপলব্ধিতে আমরা অর্থ প্রকাশক রূপ বা স্বরূপ বুঝতে পারি বা চিহ্নিত করতে পারি, সেটাই আভিধানিক অর্থে ‘বাচক’। বাচকের সকল সমার্থক শব্দের অর্থও একই ভাবার্থ বহন করে। এর অন্য কোন অমার্জিত বা বিব্রতকর অর্থ নেই। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে আর রাজশেখর বসুর চলন্তিকা বঙ্গভাষার অভিধানে বাচকের এ অর্থগুলো পাওয়া যায়। তাই বিশেষ্য পদে যখন কোনো শব্দের রূপটা অর্থ প্রকাশে পুরুষ অর্থাৎ নর কিংবা নারী ইত্যাদি রূপগত পার্থক্য চিহ্নিত করে; এমন রূপগত অর্থ প্রকাশের ধরনটাই ‘বাচক’ হতে পারে— যাকে আমরা এতদিন ‘লিঙ্গ’ বলে জানি। তাই ‘লিঙ্গ’ পরিবর্তীত হয়ে পরিশীলিত শব্দ ‘বাচক’ করা আমি মনে করি অধিকতর যুক্তিযুক্ত। পাঠক্রমের ধারায় আমরা বাচককে সংজ্ঞায়িত করতে পারি এভাবে, “বিশেষ্য পদে কোনো শব্দ অর্থ প্রকাশে নর-নারী ইত্যাদি রূপগত পার্থক্য চিহ্নিত করে, তাকে বাচক বলে।”
‘বাচক’ দ্বারা আমরা শব্দের রূপগত পার্থক্য চিহ্নিত করি। বাচকের শ্রেণিবিন্যাসে এটি পাঁচ প্রকার। নরবাচক, নারীবাচক, উভবাচক, নিত্যবাচক এবং অবাচক। নরবাচক তো শব্দের পুরুষ বা নর রূপটা। নারীরূপটা নারীবাচক। নারীবাচকও আবার দুই প্রকার। একটি জাতি নারীবাচক অন্যটি পত্নি নারীবাচক। যেমন ‘বন্ধু’ নরবাচক এ শব্দটির জাতিগত নারীবাচক রূপ ‘বান্ধবী’ আর পত্নিগত নারীবাচক রূপ ‘বন্ধুপত্নি’। ‘বান্ধবী’ আর ‘বন্ধুপত্নি' কিন্তু এক অর্থ বহন করে না। আবার ভাসুর বা দেবর শব্দটা দেখি। এরও দুইটি নারীবাচকতা আছে। জাতিগত নারীবাচক ‘ননদ’ আর পত্নিগত নারীবাচক ‘জা'। এভাবে আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহার্য অনেক শব্দই আছে যেগুলোর দুইটি নারীবাচকতা আছে।
কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলোর শুধু একই বাচক হয়, বিপরীত বাচকতা নেই। যেমন ‘বিধবা’। এটি শুধু নারীবাচক, এর নরবাচকতা নেই। ‘কা-পুরুষ’ এ শব্দটি শুধু নরবাচক, এর নারীবাচকতা নেই। এমন শব্দগুলোই নিত্যবাচক। নিত্যবাচকও দুই ভাগ; নরনিত্যবাচক আর নারীনিত্যবাচক।
কিছু শব্দরূপ আছে যেগুলোতে নর-নারী উভয় রূপই চিহ্নিত করে। যেমন ‘মানুষ'। মানুষ বলতে নর বা নারী উভয়টাই বুঝায়। ‘শিশু' বলতেও তেমনি। এমনসব শব্দরূপই উভবাচক।
আবার কিছু শব্দরূপ আছে যেগুলোতে নর-নারী কোন বাচকতাই প্রকাশ করে না। যেমন ‘বই’। এটি নরও নয়, নারীও নয়। ‘হিজড়া’ মানুষ হলেও ওরা নর নয়, নারীও নয়। এমনসব শব্দগোষ্ঠীই অবাচক।
ভাষার উৎকর্ষতা আর বিবর্তনে এখন অনেক শব্দরূপ আছে, যেগুলোর বাচকতা থাকা সত্তেও অপরিবর্তীতভাবে ব্যবহৃত হয়। সমাজ বাস্তবতায় সেসব শব্দের বাচকতা অপরিবর্তনীয় রাখাটাই যুক্তিযুক্ত। যেমন ‘চেয়ারম্যান'। এটি নরবাচক। প্রচলিত ব্যাকরণের রীতিতে এর নারীরূপ ‘মহিলা চেয়ারম্যান’। ‘সভাপতি’র নারীবাচক ‘সভানেত্রী’। কিন্তু বর্তমানে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন বিশ্বময় এগিয়ে গেছে। আর এর প্রভাব ভাষায়ও পড়েছে। রীতি-বিধিতেও পড়েছে। তাই এখন এসব শব্দরূপগুলোর বাচকতা অপরিবর্তীত রয়ে গিয়ে ‘মহিলা চেয়ারম্যান’কে শুধু ‘চেয়ারম্যান’ই বলে। ‘সভানেত্রী’কে ‘সভাপতি’ই বলে। আবার বংশীয় উপাধির নারীবাচক ‘চৌধুরানী’ এখন আর তা নয়। এখন পুরুষ-নারী উভয়েই লিখেন ‘চৌধুরী’। মূলত পেশাগত আর বংশগত পদবীগুলোর বাচকতাই অপরিবর্তনীয় থেকে নর-নারী উভয় বাচকে একই রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তাই এগুলোকে ‘অপরিবর্তনীয়বাচক’ বলতে পারি। বাচকের এটি একটি নতুন অর্থাৎ ষষ্ঠতম শ্রেণিবিন্যাস।
অপরিবর্তনীয়বাচকের কিছু শব্দ তালিকা দেওয়া হলো : বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেতা, উপাচার্য, অধ্যক্ষ, প্রধানশিক্ষক, ব্যারিস্টার, মহা-পরিচালক, পরিচালক, মহা-ব্যবস্থাপক, ব্যবস্থাপক, চেয়ারম্যান, মেম্বার, উকিল, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কেরাণি, সভাপতি, সম্পাদক, মন্ত্রী, কবি, চৌধুরী, সৈয়দ, খান, ইত্যাদি। এ জাতীয় শব্দগুলো নর-নারী উভয় বাচকে অপরিবর্তীত থাকছে।
‘বাচক’ সাধারণ বহুল ব্যবহার্য কোনো শব্দ নয়। বলতে পারি, অনেকটাই অব্যবহৃত শব্দ। ‘লিঙ্গ’ ব্যাকরণ ছাড়াও সাধারণভাবে জননেন্দ্রিয় অর্থেও ব্যাপক ব্যবহার হয়। তখন এটি বিব্রতকর শব্দ, আর ব্যাকরণে পাঠের সময় বিব্রতভাবকে হজম করে স্বাভাবিক ভাবকে ভাবতে হয়। এটা একটা অর্থগত বিভ্রান্তিও বটে। কিন্তু ‘বাচক’-এর কোনো বিব্রতকর অর্থদ্যোকতা নেই। ফলে অর্থগত বিভ্রান্তি ছড়াবে না। সাধারণ ব্যবহার্য নয় বলে শুধু ব্যাকরণগত শব্দ হয়ে উঠলে এর বৈয়াকরণিক স্বাতন্ত্র্যও বজায় থাকবে। চমৎকার ব্যাকরণবিধিগত শব্দ হয়ে উঠবে। আবার পরিশীলিত শব্দ মার্জনে একটি অধ্যায়ও পুনর্গঠিত হবে। এভাবেই ‘লিঙ্গ’কে ‘বাচক’-এ পরিবর্তন করে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় পরিমার্জন ও পুনর্গঠন করা যায়।
আমি প্রস্তাব করছি এভাবে পরিমার্জন করলে বিব্রতকর আর শালীনতা বর্জিত শব্দ ‘লিঙ্গ’কে পাশ কাটিয়ে আমরা একটি পরিশীলিত শব্দযোগে মার্জিত অধ্যায় পেতে পারি। আর মার্জিত এ অধ্যায় ব্যাকরণ শিক্ষাকে আরও পরিশীলিত করবে। বাংলা ব্যাকরণ আরও স্বাতন্ত্র্য উৎকর্ষতায় এগিয়ে যাবে। প্রস্তাবনার স্বপক্ষে এমন প্রত্যাশাই করছি আমি।
#