কয়েকদিন আগে স্বঘোষিত নাস্তিক তসলিমা নাসরিনের রোযা নিয়ে ব্যাঙ্গ করে একটি ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দেখলাম! সেখানে তিনি বলেছেন, “রোযা রাখলে সারাদিন না খেয়ে থাকলে আল্লাহপাকের কোন উপকারটা হয়”! তার এই কথাগুলো আমাকে নতুন করে ভাবতে এবং এই নিয়ে পড়াশুনা করতে অনুপ্রাণিত করে। সত্যি বলতে বান্দা রোযা রাখলে আল্লাহপাকের কোন উপকারই হয় না। আল্লাহ মানুষের জন্য যা কিছু নির্ধারন করে দিয়েছেন সবকিছুই বান্দার উপকারের জন্যই। তেমনি রোযাটাও বান্দার উপকারের জন্যই আল্লাহপাক নির্ধারন করে দিয়েছেন। হাদীসে পাওয়া যায় রাসূল (সঃ) বলেছেন,“রোযা রাখো,সুস্থ থাকবে”। ( মুসনাদে আহমদ,তাবরানী,আবু নায়ী’ম)
এই কথাটি রাসূল (সঃ) ১৪০০ বছর আগে বলেছেন। আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, রোযার মাধ্যমে ২১ টি রোগের চিকিৎসার উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে।
১. জৈব বিষ (Toxin) ধ্বংস হয়ঃ সারা বছর বিভিন্ন রকমের খাবার গ্রহনের কারণে যে জৈব বিষ জমা হয়, রোযার কারণে তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং রক্ত বিশুদ্ধ হয়ে যায়। শরীরে জৈব বিষ বেশি থাকা ক্ষতিকর আর এর কারণে শরীরে বিভিন্ন রোগ আক্রমন করে থাকে।ৎ
২. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ এক গবেষনায় দেখা গেছে রোযা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়লে শরীরে বহুরোগ দানা বাঁধতে পারে না। প্রতিরোধ ক্ষমতা আলফা-১,আলফা-২,বিটা-২ ও গামা নামক প্রোটিন থেকে সৃষ্টি হয়। দেখা গেছে,রোযার ফলে এ প্রোটিনগুলো বৃদ্ধি পায়। ২৭ শে রমজান এগুলো চূড়ান্ত সীমায় পৌছে। প্রতিরোধ ক্ষমতার দ্বিতীয় সেলটিও চূড়ান্ত সীমায় পৌছে যায় যা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ এবং ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করে। এছাড়াও এর কারণে রক্তের শ্বেত কণিকার প্রতিরোধ ক্ষমতা ৩-৫ গুণ বৃদ্ধি পায়।
৩. ওজন ও মেদ-ভুঁড়ি কমে যায়ঃ রোযার মাধ্যমে মেদ ভুঁড়ি কমানো শুধু ইসলামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়।এটি এখন ইউরোপেও স্বীকৃত সত্য। সেখানে রোগীর অতিরিক্ত চর্বি গলানোর জন্য উপবাস করানো হয়। এটা সবাই জানে যে, বছরে শরীরে ৫০ হাজার কিলো ক্যালোরি জমা হয় যা স্নেহ বা চর্বি আকারে জমা থাকে। চিকিৎসকদের মতে রোযা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, শরীরের পরিপাক ও হজম প্রক্রিয়ায় এবং শারীরিক সুস্থতা বিধানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। খাদ্য গ্রহণের ফলে আমাদের শরীর গ্লুকোজ জমা হতে থাকে। আর রোযা সেই গ্লুকোজ কমাতে সহায়তা করে।
৪.রোযার ফলে হজম ও পরিপাকতন্ত্র গুলো বিশ্রাম লাভ করেঃ রোযাদার ব্যক্তি পেটের পীড়া,অজীর্ণ ও বদহমজসহ বিভিন্ন পীড়া থেকে মুক্তি পায়। রোযার মাধ্যমে কলিজায় জমাকৃত চর্বিগুলো ব্যবহারের ফলে তা কমতে থাকে। চর্বি বেশি থাকলে হজম হতে দেরি হয়! স্বাভাবিক নিয়মে যেখানে ২ ঘন্টায় হজম হবার কথা সেখানে ৪ ঘন্টা লাগে। তখন ব্যক্তি নিজেকে ভারি মনে করে এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়। রোযা কলিজার পাশে জড়ো হওয়া চর্বিগুলোকে উজাড় করে দেয়। হজম ওপরিপাক ক্রিয়া দ্রুত করে।
৫. রোযা কিডনীতে পাথর সৃষ্টিতে বাধা দেয়ঃ রোযার ফলে রক্তে সোডিয়ামের পরিমান বৃদ্ধি পায়। ফলে তা কালসিয়ামকে জমতে বাধা দেয়। ক্যালসিয়াম জমেই পাথর সৃষ্টি হয়। কিডনীর পাথর সর্বদা প্রোটিনের কনাকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়। আর রমজানের কারণে সেই পাথর গঠিত হতে পারে না। আর এটা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত।
৬. চর্মরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়ঃ রোযার কারণে দিনে শরীরে পানির পরিমান কমে যায়। ফলে, চামড়াতেও পানির অংশ কমে যায়। এর ফলে চামড়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। যাদের মুখে ব্রণ উঠে রোযার কারণে তা সেরে যায়। রোযা সে সকল মাইক্রোব ধ্বংস করে যা বিভিন্ন সেলকে আক্রমন করে।
৭.বাত রোগের চিকিৎসাঃ আমেরকিার চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডঃ ম্যাক ভাডন বলেন,রোযার কারণে বাত রোগের আরোগ্য হয়। অন্যান্যদের মতে শরীরের বিভিন্ন জোড়ার সংক্রামক রোগেরও আরোগ্য হয়।
৮.রক্তে কোলেষ্টরল কমায়ঃ যাদের রক্তে চর্বির হার বেশি তাদের শরীর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এ সপ্তাহ রোযা রাখলে রক্তে চর্বির পরিমাণ কমে যায়। রমজান মাসের কারণে রক্তে চর্বির পরিমান কমার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীরা আরাম বোধ করে।
৯. রক্ত স্বল্পতা ও রক্ত শূন্যতা দূর হয়ঃ রোযার মাধ্যমে ক্ষুধার অনুভূতি সৃষ্টি হলে শরীরে সঞ্চিত লৌহ জাতীয় পদার্থ নির্গত হয় এবং তা রক্তের স্বল্পতা বা রক্ত শূন্যতা দূর করে।
১০. কঠোর স্নায়ু ব্যথার উপশম হয়ঃ মাত্র তিন সপ্তাহ রোযা রাখা দ্বারা কঠিন কঠিন স্নায়ু ব্যথা ভালো হয়।
১১. ডযাবেটিকস রোগ নিয়ন্ত্রনে আসেঃ রাযা ডঅযবেটিকস রোগের জন্য বিশেষ রহমত। কম খাদ্য গ্রহণ ও দির্ঘক্ষণ খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকবার কারণে রক্তে শর্করার পরিমান কমে আসে। ফলে রোগ নিয়ন্ত্রিত থাকে।
১২.রোযা সকল ইনফেকশন ও টিউমারের জন্য প্রতিরোধকঃ রোযা নারীদের বিভিন্ন রোগের ইনপেকশনকে প্রতিরোধ করে। রোযার কারণে নারীদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
১৩. হায়াত বাড়ে ও বার্ধক্য দেরীতে আসেঃ ইঁদুর ও খরগোশের উপর গবেষনা চালিয়ে দেখা গেছে, রোযা পালনকারী প্রাণীটিকে অল্প খাবার দেয়ায় সে বেশী খাবার গ্রহণকারী প্রাণীটি থেকে তিন চারগুণ বেশী বয়স পেয়েছে।
১৪. পুরুষ হরমোন বৃদ্ধি পায়ঃ ২১ জন যুবকের মাঝে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, রমজানের কারণে তাদের হরমোন বৃ্দ্ধি পায়। আর এটি Archieves of Andrology ম্যাগাজিনে ব্যখ্যা পাওয়া যায়।
১৫. দাঁত ও মাড়ির উপকার হয়ঃ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিন ক্যারোলিনা হাসপাতালে ১০০০ জনের উপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়। তারা সবাই স্বেচ্ছায় একদিন রোযা থাকেন। তাতে দেখা গেছে এতে তাদের মাড়ি ও দাঁতের অবস্থার উন্নতি হয়।
১৬. পেপটিক আলসরা হ্রাস পায়ঃ প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডঃ এফ.এম গ্রিমীর বলেন পাকস্থলীতে প্যারাটাইল কোষের সংখ্যা থাকে ১০ কোটি। এই কোষ হতে প্রতিনিয়ত আইসাটনিক হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিঃসৃত হয়। যে অতিরিক্ত হাইড্রোক্লোরিক এসিডের জন্য পাকস্থলীতে গ্যাস্ট্রিক ও ডিওডিনাল আলসার হয়। সেই এসিড সাধারণ খাবার গ্রহণের পরপরই নির্গত হয়। অন্যদিকে পাকস্থলী খালি থাকলে এই এসিড কম নির্গত হয়।
১৭. তারাবীর নামায মেরুদন্ডের কর্মক্ষমতা বাড়ায়ঃ ৬০ বছর উর্ধ্ব নারী পুরুষের উপর ৪ বছর ব্যাপী পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, তারাবীর নামায হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা ও শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরের কর্মক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। মেরুদন্ডসহ অন্যান্য জোড়াগুলোকে নমনীয় করে এবং রক্ত প্রবাহকে অধিক ক্রিয়াশীল করে।
১৮. মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়ঃ ডঃ সালওয়া তার এক গবেষনায় বলেছেন কেউ যদি মানষিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে ও দুশ্চিন্তার শিকার হয় তাহলে এক মাস ব্যাপী তারাবীর নামায পড়লে তার মানষিক অবস্থার উন্নতি সাধন হবে।
১৯. যৌন রোগ থেকে বাঁচা যায়ঃ রোযার মা্ধ্যমে মানুষের আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয় এবং তাকওয়া অর্জন করে। যার কারণে তারা অবাধ যৌন কর্ম কিংবা অবৈধ মেলামেশা করতে পারে না। অবৈধ মেলামেশা থেকেই যৌন রোগের সৃস্টি হয়। ১০ম ও ১১ শতাব্দিতে চিকিৎসকরা যৌনরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রোযা রাখার পরামর্শ প্রদান করতেন।
২০. স্নায়ুতন্ত্র শান্ত থাকেঃ রোযার কারণে চা সিগারেট পান এবং কফির মত উত্তেজক দ্রব্য সেবন না করার কারণে স্নায়ুতন্ত্র শান্ত থাকে। ফলে ব্যক্তির মন মেজাজ শান্ত থাকে এবং গঠনমূলত চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ বেশি পায়।
২১. আত্নহত্যার প্রবণতা কমে যায়ঃ রহমত ও বরকতের মাসের বদৌলতে মানুষ আত্নহত্যা করার প্রবণতা তেমন একটা দেখায় না। এই মাসে হৃদযন্ত্রে ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এবং ব্রেইন ষ্ট্রোক করে মৃত্যু বরণের হারও কম থাকে।
১৭৬৯ সালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃপিটার ভেনিয়ামিনভ রোযা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। সেই রিপোর্টে তিনি মানুষকে রোযা রাখার উপদেশ দেন। তার যুক্তি ছিল, রোযার কারণে পরিপাকতন্ত্র একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশ্রাম পায়। ফলে, সুস্থ হওয়ার পর তা ঠিকমত নিজের কাজ চালাতে পারে। মস্কো বিশ্ববিদালয়ের অন্যতম শিক্ষক ডঃ পি.জি স্পাসকী বলেন, রোযার মাধ্যমে কালাজ্বর এবং শরীরের অন্যান্য পুরাতন রোগ মেডিসিন ছাড়াই ভালো হয়ে যায়।
বৃটিশ ডাক্তার তাশিন বলেন, প্রোটেষ্ট্যান্ট খৃষ্টানরা সব সময় বেশি খাওয়া দাওয়া করে। তিনি রোযার মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা করতেন।
জার্মান ডাক্তার ফেডারিক হভম্যান বলেন, রোযার মাধ্যমে মৃগীরোগ ও আলসারের চিকিৎসা করা যায়। এছাড়াও পেটের অসুখ,অজীর্ণ বদহজম ও গ্যাষ্ট্রিকের চিকিৎসা করা যায়।
ইটালীর বিখ্যাত শিল্পী মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ৯০ বছর পার হওয়ার পরও তিনি কর্মক্ষম ও কর্মঠ ছিলেন। তাকে এর রহস্য জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “আমি বহু বছর আগ থেকে মাঝে মাঝে রোযা রেখে এসেছি। আমি প্রত্যেক বছর ১ মাস এবং প্রতি মাসে ১ সপ্তাহ রোযা পালন করতাম”।
আমেরিকান চিন্তাবিদ গ্রেগরি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও ক্লাবে তার বক্তৃতায় শ্রোতাদেরকে রোযা রাখার কথা বলতেন। তিনি বলতেন, রোযার মাধ্যমে শরীরের পবিত্রতা অর্জন হয় এবং শরীরের ক্ষতিকর জিনিষগুলো দূর হয়। মস্কোর মানষিক রোগ ইনষ্টিটিউটের পরিচালক ডঃ নিকোলাইড বিগত ৫০ বছর থেকে নিয়মিত রোযা পালন করে আসছেন।
জার্মানীর একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকের গেটে লেখা আছে, “ রোযা রাখো স্বাস্থ্যবান হবে”।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৪