মাধ্যমিকে পড়ার সময় ক্লাসে একদিন আমাদের একজন শিক্ষক বললেন, "সালাম নাকি ঢাকায় একটি বাসা বাড়িতে কাজ করতো। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে তিনি নাকি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিতেই যান নি। তিনি সেদিন বাজার করে ফিরছিলেন, তখন পাশ দিয়ে মিছিল যাচ্ছিলো। ফলে পুলিশ যখন গুলি করলো তখন সালামের গায়েও গুলি লাগলো। আর তিনি হয়ে গেলেন ভাষা শহীদ।"
কী মর্মান্তিক কথা! তাই না? সেদিন এই বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাবে স্যারের কথার কোন উত্তর বা প্রতিবাদ করতে পারিনি। শুধু ক্লাসভর্তি সবাই হেসেই গড়াগড়ি খেয়েছি [কারণ, স্যার কথাগুলো হেসে হেসেই কৌতুকের মত করে বলেছিলেন] আর আমাদের চোখের সামনে মনের পর্দায় ভেসে উঠছিলো বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা গুলিবিদ্ধ সালামের দেহ অবয়ব।
গতকাল (২১ফেব্রুয়ারি ২০১৮) প্রথম আলোতে সালামকে "রিকশাচালক" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে সালাম কি আসলেই কাজের লোক কিংবা রিকশাচালক ছিলেন? নাকি অন্য কিছু ছিলেন?
☼☼☼আসুন জেনে নিই তবে সালাম সম্পর্কে কিছু তথ্য:
১• বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
ভাষা শহীদ আব্দুস সালামের জন্ম ১৯২৫ সালে ফেনী জেলার দাগনভূঁঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের লক্ষণপুর গ্রামে যা বর্তমানে তাঁরই নামানুসারে সালাম নগর। তাঁর পিতার নাম ফজিল মিয়া। তিনি ১৯৫২ সালে ঢাকায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের শিল্প বিভাগে পিয়নের চাকরি করতেন।
২• বাংলা উইকিপিডিয়ায়
আবদুস সালাম কর্মজীবনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের 'পিয়ন' হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
৩•.ইংরেজী উইকিপিডিয়ায়
Salam was able to get a job in the port of Kolkata. In 1947 he moved to Dhaka and got a job at the department of industries as cleric record keeper.
✓উপরের তিনটি তথ্যসূত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে, শহীদ সালাম কাজের লোক কিংবা রিকশাচালক ছিলেন না। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগে পিয়ন অথবা রেকর্ড কিপার ছিলেন। প্রথম আলোর ওই লেখক কি এবার তার লেখায় সালামের পরিচয় সংশোধন করবেন?
☼☼☼তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েও দুটি তথ্য পাওয়া যায়:
১• তিনি স্থানীয় মাতুভূঁঞা করিমুল্লা জুনিয়র হাই স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। অতঃপর চাকরির সন্ধানে ঢাকায় আসেন।
২• ভাষা শহীদ আবদুস সালাম স্থানীয় দাগনভূঁঞা আতাতুর্ক হাই স্কুলে প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।
✓তখনকার যুগে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াও কিন্তু বিশাল ব্যাপার ছিলো। আর্থিক অভাব অনটনের কারণেই তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু তিনি যে শিক্ষিত ছিলেন এটা সুস্পষ্ট। তাই, আমাদের স্যার যে বলেছিলেন তিনি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভাষা শহীদ হয়েছেন। বাজার করে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তা মোটেও সত্য নয়। সালাম স্বপ্রণোদিত ভাবেই ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
☼☼☼গুলিবিদ্ধ হওয়া ও মৃত্যুর তারিখ নিয়ে সংশয়:
১• গতকালের (২১ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) প্রথম আলোতে লেখক ও সাংবাদিক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন-
"২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক সালাম"
২•. অন্য সকল তথ্যমতে, ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ এপ্রিল তিনি মারা যান।
৩• আরেকটি তথ্যসূত্র থেকে পাওয়া যায়, ২১ শে ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে তিনটায় পুলিশের বেপরোয়া গোলাগুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ গুলিবিদ্ধ হন অনেকে। গুরতর আহত অবস্থায় আবদুস সালামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালেই ২৫ ফেব্রুয়ারী বেলা সাড়ে ১১টায় আবদুস সালাম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে সালামের লাশ ঢাকাস্থ আজিমপুর গোরস্থানে নেওয়া হয়। সেখানে সালামের বাবা ফাজিল মিয়া, ভাতিজা মকবুল, জেঠাতো ভাই হাবিব উল্লাহসহ শত শত ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে সালামের জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাষা শহীদ আবদুস সালামকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন। একুশে পদক প্রদানকালে গেজেটে তার মৃত্যুর তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারির স্থলে ৭ এপ্রিল উল্লেখ করা হয়। সেই থেকে সালামের মৃত্যুর তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
✓ঢাকার আজিমপুর পুরানো কবরস্থানের হাজারো কবরে ভীড়ে মহান ভাষা শহীদ আবদুস সালাম চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন যার কবরের চিহ্ন সংরক্ষন করা সম্ভব হয়নি তৎকালিন পাকিস্তানী শাসকদের কারণে।
☼☼☼সালামের প্রকৃত ছবি ও বর্তমানে ব্যবহৃত ছবি:
১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ভাষা শহীদ আবদুস সালামের কোন ছবি কোথাও সংরক্ষিত ছিলনা। তার কারন ৬০ এর দশকে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য জনাব খাজা আহমদ শহীদ আবদুস সালামের পিতা ফাজিল মিয়াকে দুই হাজার টাকা দিয়ে আব্দুস সালামের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি ও তাঁর দুটি আলোকচিত্র জাতীয় জাদুঘরে দেবেন বলে নিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি ছবি এবং আবদুস সালামের রক্তাক্ত শার্টটি কি করেছেন তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে বর্তমানে ব্যবহৃত শহীদ আব্দুস সালামের ছবিটি ভাস্কর রাসার উদ্দ্যেগে শিল্পী সাহজাহান আহমেদ বিকাশের মাধ্যমে ২০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ সালে শহীদের ভাই-বোনদের বর্ণনা শুনে আঁকা হয়।
বোন বলকিয়ত নেছা তাঁর ভাই শহীদ সালামের চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন-
"আমরা ভাই বোনের মধ্যে সালামের গায়ের রঙ ছিল বেশ ফর্সা। ছোট বেলায় স্থানীয় মসজিদে পড়তে গিয়ে তিনি মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলেন ফলে তাঁর কপাল কেটে গিয়েছিল। সেই কাটা দাগটি তাঁর চেহারার একটি বিশেষ চিহ্ন হিসাবে থেকে যায়।"
✓ উক্ত ছবিটি বর্তমানে জাতীয় যাদুঘরের একুশে গ্যালারীতে শোভা পাচ্ছে।
☼☼☼ভাষা শহীদ সালাম স্মৃতি জাদুকর এবং ভাষা আন্দোলন ও বর্তমান প্রজন্ম:
আমাদের বাড়ি থেকে সালামের বাড়ির দূরত্ব দুই কিলোমিটারের মত হবে। ২১শে ফেব্রুয়ারি আসলে তাই প্রতিবছরই আমাদের স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা সালাম নগরে যায়। সেখানে মেলা হয়। ছাত্রছাত্রীরা মেলায় ঘুরোঘুরি করতেই যায়। কিন্তু কেউই সালামের ইতিহাস জানেনা, জানার চেষ্টাও করেনা। রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের লোকজন এদিন এখানে বক্তৃতা দিতে আসেন। সালাম নগরে একটি স্মৃতি জাদুঘর রয়েছে। জাদুঘরে কয়েকটি দেয়ালিকা ও আলোকচিত্র ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কিছুই নেই। জাদুঘরে আরও উন্নয়ন সাধন এবং বর্তমান প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এবার আসুন সালাম নগর, সালামের বাড়ি ও জাদুঘরের কিছু ছবি দেখি-
☼☼☼একনজরে ভাষা শহীদ আবদুস সালাম
নাম : আবদুস সালাম।
জন্ম : ২৭ নভেম্বর, ১৯২৫।
পিতা : মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া ৷
মাতা : দৌলতের নেছা।
ভাই-বোন: ৪ভাই, ৩বোন (তিনি সবার বড়)
জন্মস্থান : ফেনী জেলার দাগনভুঁঞা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে (বর্তমানে সালাম নগর)।
কর্মস্থান: পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগে।
পদবী: পিয়ন/রেকর্ড কিপার।
গুলিবিদ্ধ: ২১ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।
মৃত্যু : ২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২।(সরকারী গেজেটে ৭ই এপ্রিল ১৯৫২)
সমাধি স্থল : ঢাকার আজিমপুর পুরানো কবরস্থান।
সম্মাননা:
• মহান ভাষা আন্দোলনে আবদুস সালাম অনবদ্য ভূমিকা রাখায় বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন।
• ফেনী স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে ২০০০ সালে 'ভাষা শহীদ সালাম স্টেডিয়ামে' রূপান্তর করা হয়।
• দাগনভুঞা উপজেলা মিলনায়তনকে ২০০৭ সালে 'ভাষা শহীদ সালাম মিলনায়তন' করা হয়।
• তাঁর নিজ গ্রাম লক্ষ্মণপুরের নাম পরিবর্তন করে 'সালাম নগর' রাখা হয়।
☆ছবি ও তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া, ব্লগ, ইন্টারনেট, ভাষা সৈনিক আমানুল হক, ভাস্কর রাসা, বিশ্ব তোরনে বাংলা ও বিভিন্ন পত্রিকা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:১২