বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রথম পর্ব
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ২য় পর্ব
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ৩য় পর্ব
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ৪র্থ পর্ব
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ৫ম পর্ব
পরিকল্পনার প্রধান অংশগুলো এবং গৃহিত সিদ্ধান্তসমূহঃ
পাকিস্তানী পরিকল্পনাকারিদের গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন অংশ এবং স্বশস্ত্র বাহিনীর যারা সামরিক শাষনকালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জুগিয়েছেন তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া । অপারেশনের সর্বোচ্চ সার্থকতার জন্য ধুর্ততা ও চমকে দেওয়া এবং প্রবঞ্চনা ও দ্রুতগতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোড় দেওয়া হয় । নির্বাধ এবং সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয় । সাধারণ জনবসতি এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান এবং আক্রমণের কর্তৃত্বও প্রদান করা হয় ।
সাফল্যের নিয়ামকগুলো
সারা পূর্বপাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু করা ।
সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক এবং ছাত্র সংগঠনের নেতা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার করতে হবে । ঢাকায় অপারেশন ১০০% সফল হওয়া বাধ্যতামূলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং তল্লাশী করতে হবে ।
সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে উন্মুক্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অস্ত্র ব্যবহারের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয় । টেলিফোন টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফ সহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে । সকল পূর্বপাকিস্তানী বাঙালি সৈন্যদলকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিস্ক্রিয় করে দিতে হবে । আওয়ামী লীগের মনে ভূল ধারণা সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন । এমনকি ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের প্রস্থাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন তবুও ইয়াহিয়া আলোচনা চালিয়ে যাবেন । পরিকল্পনায় পূর্ব নির্ধারিত আক্রমণাত্মক অপারেশন পরিচালনার জন্য চিহ্নিত স্থানগুলো ছিল ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেট। এসব স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সমাবেশ বেশি ছিল। পূর্বপাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত সৈন্যদল এবং প্যরা মিলিটারি বাহিনীরা তাদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রয়ে যাবে এবং প্রয়োজন হলে অন্যান্য স্থানে প্রাথমিক অপারেশনের সময় শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যোগ দেবে। ঢাকা সম্পুর্ন নিরাপদ হলে পাকিস্তানের ৯ম এবং ১৬তম ডিভিশনের সৈন্যরা শক্তিবৃদ্ধির জন্য বিমান যোগে ঢাকা চলে আসবে। যেসব শহরে বিমানঘাঁটি আছে(চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর, কুমিল্লা) সেসব শহরে সরাসরি ঢাকা থেকে সি-১৩০ (C-130) বিমান অথবা হেলিকপ্টার ট্রুপস এর মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করা হবে । যদিও পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানকে দমন করার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় বেধে দেওয়া হয় নি এটা ধারণা করা হয় যে রাজণৈতিক নেতাদের গ্রেফতার এবং বাঙালি সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীদের নিরস্ত্র করার পর সাধারণ জনগণদের ভয় দেখিয়ে এক সাপ্তাহের মধ্যে সামরিক শাষনের আওতাভূক্ত করা হবে । লে জেনারেল টিক্কা বলেন যে ১০ই এপ্রিলের পর আর কোন বাধা বিপত্তি থাকবে না । পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাদের বিন্যাস অপারেশন সার্চলাইটঃ ২৫ মার্চে পাকিস্তানী এবং বাঙালি সৈন্যদের অবস্থান । কয়েকটি ইউনিটের অবস্থান দেখানো হয় নি । ১৪তম পদাতিক ডিভিশনই পাকিস্তানী সেনাদের একমাত্র ডিভিশন যাদের পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ এর মার্চে ঘাঁটি ছিল । যেখানে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ি তিনটে ব্রিগেড থাকার কথা সেইখানে এই ডিভিশনে চারটি পদাতিক ব্রিগেড ছিল । ৫৭তম পদাতিক বাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার জাহানবাজ আরবাব এর অধীনে ঢাকায় ৫৩তম পদাতিক বাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির অধীনে কুমিল্লায় ২৩তম ব্রিগেডকে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালিকের অধীনে রংপুরে এবং ১০৭তম ব্রিগেডকে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার এআর দুররানির অধীনে যশোরে পাঠানো হয় । ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার নামের একজন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার ছিলেন চট্টগ্রামের কমান্ডে। সাধারণ ভাবে প্রতি ব্রিগেডে ৩ থেকে ৪টি পদাতিক ব্যটেলিয়ন এবং একটি ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং আরো কিছু সাহায্যকারী অংশ থাকে । এই চারটি ব্রিগেডে মোট ১২টি পদাতিক ব্যটেলিয়ন ছিলপ্রতি রেজিমেন্টে সাধারণত ৯১৫ জন সৈন্য থাকে যেগুলোর সব গুলোতে ছিল শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা । প্রধানত পাঞ্জাব, বালুচ, পাঠান এবং সিন্ধিদেরই প্রাধান্য দেওয়া হয় । তাদের ২৫শে মার্চের আগেই পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয় । এই ডিভিশনের আরো ছিল ৫টি ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট একটি হালকা এন্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্ট, একটি কমান্ডো ব্যটেলিয়ন ৩য় যেগুলোর সবগুলোতেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রাধান্য । রংপুরে অবস্থানরত ২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্টই ছিল পুর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত একমাত্র স্বশস্ত্র মিশ্র যেখানে বাঙালি সৈন্য ছিল রেজিমেন্ট । ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ইপিআর এর প্রায় ২০% সৈন্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের যেখানে বিভিন্ন ইউনিট এবং সেনানিবাসের সাহায্যকারী সৈন্যরা ছিল মিশ্র জাতীয়্তার । বেশিরভাগ ইউনিটের ইউনিট কমান্ডার এবং উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাগণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী ।
ঢাকা বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর ২০টি এফ-৮৬ সাবের জেট এবং ৩টি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ৪টি এমআই-৮ এবং ৪টি এলট-III হেলিকপ্টার পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয় । সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অপারেশনের জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয় । চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুরের কাছাকাছি লালমনিরহাটে, সিলেটের কাছাকাছি সালুটি করে যশোরে এবং ঠাকুরগাঁয়ের কাছে বিমানঘাঁটিগুলো স্থাপন করা হয় । পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান নৌবাহিনীর চারটি গানবোট রাজশাহী, যশোর , কুমিল্লা এবং সিলেটে একটি পেট্রোল বোট বালাঘাট এবং একটি পিএনএস জাহাঙ্গির নামে একটি ডেস্ট্রয়ার ছিল । পাকিস্তানী নৌবাহিনীর পিএনএস বাবুর নামের পতাকাবাহী জাহাজ অপারেশন শুরুর পর পূর্ব পাকিস্তানে আসবে । বেশির ভাগ নৌঘাঁটিই ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও মংলায় । পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি ইউনিটসমূহ ১৯৭১ এর মার্চে ৬টি নিয়মিত বাঙালি পদাতিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত ছিল । ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) যশোরে ১০৭তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত ছিল । ২য় ইবিআর ঢাকার দক্ষিণে জয়দেবপুরে ৫৭তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত ছিল । ৩য় ইবিআর ২৩তম ব্রিগেডের সাথে সৈয়দপুরে ছিল । এবং ৪র্থ ইবিআর ৫৩তম ব্রিগেডের সাথে কুমিল্লায় ছিল । ৮ম ইবিআর পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং প্রায় ৭৫% সৈন্য ছিল চট্টগ্রামে । চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে ২০০০ বাঙালি সৈন্য অবস্থান করছিল যাদের মধ্যে নতুনভাবে তৈরি করা ৯ম ইবিআর এবং অন্তর্ভূক্ত ছিল । ১০ম ইবিআর ছিল একটি প্রশিক্ষন ইউনিট যেটি ঢাকায় ১৪তম ডিভিশনের সাথে সংযুক্ত ছিল । বাঙালি অফিসাররা ১ম, ২য় এবং ১০ম ইবিআর এর নেতৃত্বে ছিলেন এবং বাদবাকিগুলোর দায়িত্বে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসাররা ।
অন্যান্য বাঙালি সশস্ত্র দল ও তাদের অবস্থানঃ
পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীর কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ছাড়া অধিকাংশই ছিল বাঙালি। ১৫০০০ সৈন্যের প্যারামিলিটারি বাহিনী (যার মধ্যে ৮০% বাঙালি) ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ৭টি সেক্টরে (যেগুলোর সদর দফতর ছিল ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী, দিনাজপুর, সিলেট এবং চট্টগ্রামে) ১৭টি অপারেশনাল উইঙে বিভক্ত ছিল (প্রতি উইঙে ১৫০ জনের ৩-৬ টি কোম্পানি থাকতো) যাদের সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয় । ইপিআর কোম্পানীদের প্রায়শই ছোট ছোট সেকশন(১৫-২০জন সৈন্য) এবং প্লাটুনে(২০-৩৫জন সৈন্য) বিভক্ত করে সীমান্তের নিকটবর্তী ক্যম্পে অথবা সীমান্ত ফাঁড়িতে ছড়িয়ে দেয়া হত। যেখানে সেনাবাহিনীর কোম্পানীর দায়িত্বে সাধারণ ভাবে ক্যপ্টেন ও মেজররা থাকতেন, সেখানে ইপিআর কোম্পানীদের কমান্ডের দায়িত্বে থাকতেন জিসিও/এনসিওরা এবং ইপিআর উইংদের ভারি অস্ত্র হিসাবে শুধুমাত্র হালকা ট্যঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র ও মর্টার দেওয়া হত ।
অপারেশনের পূর্বে নেওয়া সাময়ীক বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো কি ছিলঃ
অপারেশনে নামার আগেই যাতে সংশ্লিষ্ট সব পাকিস্তানী ইউনিট কমান্ডার তাদের দায়িত্ব বুঝে নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল অপারেশনর সার্চলাইটের পরিকল্পনাকারীদের। আর এই কাজটি করা দরকার ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে । সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করা, অস্ত্রশস্ত্রের যোগান, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈনিক পূর্ব পাকিস্তানে আনা, আঞ্চলিক সেনানায়কদের কার্যবিবরণী প্রদান এই সব কিছুই করা প্রয়োজন ছিল কোন সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়ে। ২৪ এবং ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী জেনারেলদের একটি দল হেলিকপ্টারে করে প্রধান প্রধান গ্যারিসনগুলো পরিদর্শন করেন এবং গ্যারিসন কমান্ডার ও অপারেশনের অন্যান্য সিনিয়র পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন । এই দলের সাথে ছিলেন জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিট্টা, কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল এবং প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার কর্নেল সাদউল্লাহ । জেনারেল ফরমানকে যশোরে পাঠানো হয়, জেনারেল খাদিম নিজে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের গ্যারিসন কমান্ডারদের ব্রিফ করেন এবং ব্রিগেডিয়ার এল ইদ্রুস ও কর্নেল সাদউল্লাহ রংপুর সফরে যান ।
সকল ক্ষেত্রে পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখা ছিল । না জানলেই নয় এমন কিছু ক্ষেত্রে কেবল গুটিকয়েক লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে বিস্তারিত জানানো হয়েছিল । কিছু বাঙালি কর্মকর্তা পাকিস্তানীদের ঘনঘন ব্রিফিং দেখে সন্দেহ করেছিলেন কিছু একটার কিন্তু ব্রিফিং এ কি ঘটেছে সে সম্পর্কে আক্রমণের পূর্বে তাদের কোন ধারণাই ছিল না ।
রসদপত্র ব্যবস্থাপনা যে ভাবে আনা নেওয়া হয়
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল কামার আলি মির্জা এবং ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব আসেন রসদপত্র ব্যবস্থাপনার জন্য, মূল কারণ ছিল তখন অসহযোগিতার কার্যকলাপের কারণে সেনানিবাসগুলোতে খাদ্য সরবরাহ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছিল । অস্ত্রের মূল ভাণ্ডার ছিল ঢাকার অদূরে অবস্থিত রাজেন্দ্রপুরে এবং ৯০০০ টন অস্ত্র এবং গোলাবারুদ চট্টগ্রামে এমভি সোয়াত নামের একটি জাহাজে খালাসের অপেক্ষায় ছিল । সুতরাং জাহাজ থেকে রসদপত্র খুব দ্রুত খালাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল । ততোদিনে ১৩ এফএফ এবং ২২ বালুচ ঢাকায় পৌঁছে গেছে, পাকিস্তান থেকে পিআইএ ফ্লাইট এ করে বিশেষ যাত্রীরা ঢাকায় আসতে শুরু করেছে । পাকিস্তানীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সফলতা নিশ্চিত করতে ২৫ মার্চের আগেই পশ্চিম থেকে পুরো একটি ব্রিগেড পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো । ধীরে ধীরে সৈন্য এবং রসদপত্র পাঠানোটা সেই মহাপরিকল্পনারই অংশ ছিল । পূর্বে আসা নতুন সৈনিকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অনেক নতুন নতুন ব্যবস্থা করতে হয়েছিল । সাপ্লাই ইউনিট এর বাঙালি সদস্যরা এটা বুঝতে পেরেছিল আগেই । অবশ্য এই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে খুব বেশি অসুবিধা হয় নি এটা অপারেশনের কোন ক্ষতিও করেনি । ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন রসদপত্র ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন পশ্চিমে কার্যক্রম সামাল দিতে ফিরে গিয়েছিলেন জেনারেল মির্জা ।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অদল বদলঃ
সফলতা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনী বাঙালি কর্মকর্তাদের স্পর্শকাতর স্থানগুলো থেকে বদলী করে দিয়ে সেখানে পাকিস্তানী বাহিনী মোতায়েন করেছিল । পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত দুটি পাকিস্তানী ইউনিট ২৫তম পাঞ্জাব এবং ২০তম বেলুচ এর প্রত্যাবর্তন পিছিয়ে দেওয়া হয় তার ওপর ২৫শে মার্চের আগেই পশ্চিম থেকে ঢাকায় উড়ে আসে ১৩তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং ২২তম বেলুচ রেজিমেন্ট । গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য ২৫শে মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোন গ্যারিসনে প্রথমেই অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানো হয় নি । ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গুলি বর্ষণে অস্বীকৃতি জানিয়ে এমভি সোয়াত এর মালামাল খালাসের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করলে তাকে ২৪শে মার্চ তার পদ থেকে অব্যাহতি দেন জেনারেল খাদিম । তাকে এই বলে অব্যাহতি দেওয়া হয় যে তার এখন জয়দেবপুরে গিয়ে ২ ইবিআর এর কাছে রিপোর্ট করতে হবে তার বদলে ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আনসারি চট্টগ্রাম এলাকার দায়িত্ব পান । মার্চের ২২ তারিখ ঢাকায় অবস্থানরত ৫৭তম ব্রিগেড এর ব্রিগেড মেজর মেজর খালেদ মোশাররফ কে বদলি করে কুমিল্লায় ৪র্থ ইবিআর এর ২আইসি হিসেবে পাঠানো হয় । ২৩শে মার্চ ২য় ইবিআর এর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল মাসুদুল হাসানকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং ২৫শে মার্চ তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন লেঃ কর্নেল রকিবউদ্দিন । অবশ্য পাকিস্তানীরা গণহারে বাঙালি কর্মকর্তাদের বদলি করা থেকে বিরত থেকেছিল, কারণ সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা বিনষ্ট হতে পারতো । ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সব ছুটির দরখাস্ত বাতিল করে দেওয়ার পরও মার্চে পাকিস্তানী কৃর্তপক্ষ আবার বাঙালি অফিসারদেরকে ছুটি নিতে উদ্বুদ্ধ করে অন্যদিকে পাকিস্তানী কর্মকর্তাদেরকে কোন ছুটি না নিয়ে সদা সতর্ক থাকতে বলা হয় । পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তা এবং সৈন্যদের পরিবারের সদস্যদেরকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং তার বদলে সুযোগ সুবিধা মত কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী বেসামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানে এনে রাখা হয় ।
২৫শে মার্চের পূর্বে বাঙালি ইউনিটগুলোর বিস্তার
অপারেশন শুরুর আগেই সমস্ত নিয়মিত বাঙালি ইউনিটকে একসাথে নিরস্ত্র করার অনুমতি দেননি জেনারেল হামিদ, ফলে পাকিস্তানী নেতৃত্ব অন্যান্য উপায় বাঙালি ইউনিটগুলোর সম্ভাব্য হুমকি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে । ২৫শে মার্চে এবং এর আগের সময়গুলোতে বাঙালি ইউনিটগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয় । তাদেরকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠানো হয় বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে এক অংশ থেকে আরেক অংশকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় এবং সবগুলো অংশকেই রেডিও এবং তারহীন যোগাযোগের গ্রিড থেকে যত সম্ভব দূরে রাখা হয়েছিল । বাঙালি কর্মকর্তাদের হয় ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল নয়তো নেতৃত্বের কেন্দ্র বা সরাসরি অপারেশনে নিয়োজিত ইউনিটগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা হয়েছিল । কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তারা বাঙালি ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নেয় । বাঙালি সৈনিকদের অনেককে ছুটিতে পাঠানো হয় অনেককে নিরস্ত্র করা হয় তবে এমনভাবে কাজগুলো করা যাতে কারও মধ্যে কোন সন্দেহের উদ্রেক না হয় । সাধারণ সময়ের তুলনায় তখন প্রথম ইবিআর এর শক্তি ছিল অর্ধেক এই ইবিআর কেই শীতকালীন প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্তবর্তী চৌগাছায় পাঠানো হয় ২৯শে মার্চ পর্যন্ত তারা এখানেই ছিল । দ্বিতীয় ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে ঢাকার আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো রাখা হয় । ৩য় ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সৈয়দপুর সেনানিবাসের বাইরে গোড়াঘাট এবং পার্বতীপুর এলাকার আশেপাশে । ৪র্থ ইবিআর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং শমসেরনগর এর মাঝামাঝি এলাকায় । একমাত্র চট্টগ্রামেই নিয়মিত বাঙালি ইউনিটগুলোকে তাদের স্বাভাবিক এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়নি । পশ্চিম পাকিস্তানের ইপিআর বাহিনীর কোম্পানিগুলোকে শহরগুলোর যেখানেই পারা গেছে সেখানেই মোতায়েন করা হয়েছে । অপরদিকে বাঙালি ইপিআর বাহিনীকে পাঠানো হয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায় । অধিকাংশ ইপিআর ইউনিট তাদের মূল অ্যাকশন এর অঞ্চল থেকে অনেক দূরে ছিল এবং নিজ অবস্থান থেকে বড় শহরগুলোতে পৌঁছতে তাদের অন্তত ১ দিন লাগতো । ২৪শে অথবা ২৫শে মার্চ রাতেই ইপিআর এর বেতার যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ।
অপারেশন সার্চলাইটঃ ২৫শে ও ২৬শে মার্চ থেকে ১০শে এপ্রিল
এটি হচ্ছে ২৫শে মার্চ হতে ১০শেই এপ্রিল সময়ে অর্থাৎ অপারেশন যে সময়ের শেষ হয় সে সময়ে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী কোন কোন স্থানে নিয়োজিত ছিল এবং সামরিক আক্রমণের ফলাফলের পূর্ন বিবরন । যেসব স্থানকে অপারেশন সার্চলাইটে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এখানে শুধু সেগুলোর বিবরন দেওয়া আছে সারা পুর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রতিরোধের কথা নেই । কোন কোন স্থানে ২৫শে মার্চেই পাকিস্তানী আক্রমণ এবং গণহত্যা শুরু হবার সাথে সাথেই বাঙালি বাহিনীর সাথে সাথে পাকিস্তানীদের সংঘর্ষ বেধে যায় । অন্যান্য স্থানে ৩০শে মার্চের আগে কোন সংঘর্ষ দেখা দেয় নি ।
ঢাকা
অপারেশন সার্চলাইটঃ ২৫ মার্চ ১৯৭১ এ ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর প্রধান প্রধান লখ্যবস্তু। মানচিত্রটি সঠিক মাপে নেই।
মেজর জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর নিম্ন লিখিত লক্ষ্য ছিলঃ
রাত ১১টায় কারফিউ জারি করা এবং টেলিফোন/টেলিগ্রাফ/রেডিও স্টেশন এবং সকল প্রকার পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া ।
ঢাকা শহরের সড়ক, রেল এবং নৌ পথের দখল নিয়ে সারা শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং নদীতে টহল জারি করা ।
অপারেশন চলাকালীণ সময়ের মধ্যে শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের আরো ১৫ জন বড় নেতাদের গ্রেফতার করা ।
ধানমন্ডি এলাকায় এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্চ বা খোঁজ করা ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দফতর, এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংস ও পরাভূত করা এবং ২য় ও ১০ম ইবিআর কে নিরস্ত্র করা ।
গাজিপুর অস্ত্র কারখানা এবং রাজেন্দ্রপুরের অস্ত্রগুদাম দখল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ।
পাকিস্তানী সেনারাঃ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দফতরের সাথে যুক্ত হয়ে ১৪তম ডিভিশন এবং ৫৭তম ব্রিগেডও ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিল । যেসকল নিয়মিত সেনা ইউনিটগুলো উপস্থিত ছিল সেগুলো হলোঃ ৫৭তম ব্রিগেড যার সাথে আরো ছিল ১৮ এবং ৩২তম পাঞ্জাব সি.ও লে.কর্নেল তাজ রেজিমেন্ট, ১৩তম সীমান্তবর্তী রেজিমেন্ট, ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট, ৬০৪তম ইন্টেলিজেন্স গোয়েন্দা/গুপ্ত ইউনিট এবং ৩১তম ভূ-গোলন্দাজ বাহিনী সি.ও লে.কর্নেল জাহিদ হাসান । ১৪তম ডিভিশন সদর দফতরের সাথে নিম্নলিখিত ইউনিট গুলো যুক্ত ছিলঃ ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী রেজিমেন্ট সি.ও লে.কর্নেল সাফফাত আলি-পাকিস্তানী, ৩য় কমান্ডো ব্যটেলিয়নের উপকরন সি.ও লে.কর্নেল জেড.এ খান-পাকিস্তানী, ১৯তম সংকেত প্রদানকারী রেজিমেন্ট সি.ও লে.কর্নেল ইফতেখার হুসাইন পাকিস্তানী, এবং ১৪৯তম পদাতিক বাহিনী। PAF পাকিস্তানী বিমান বাহিনী এর সব কিছু তেজগাঁও বিমানবন্দরে জড়ো করা হয় । সাথে ২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্ট থেকে এক স্কোয়াড্রনের কমপক্ষে ১৪টি M24 শ্যাফি ট্যাঙ্ক ঢাকায় জড়ো করা হয় । এইসকল ইউনিটের সংযুক্তি হিসাবে ৫৭তম ব্রিগেড, ১৪তম ডিভিশন এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দফতর থেকে অন্যান্য সাহায্যকারী ইঞ্জিনিয়ারিং সরবরাহকারী, এবং চিকিৎসা ইউনিট দল ঢাকায় অবস্থান নেওয়া ।
বাঙালি সশস্ত্রদলঃ ১০ম ইবিআর (সি.ও লে.কর্নেল মহিউদ্দিন বাঙালি) ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানরত ছিল । ২৫০০ ইপিআর সৈন্যদল (১৩তম, ১৫তম এবং ১৬তম উইং, সাথে ইপিআর সদর দফতর উইং এবং সংকেত প্রদানকারী উইং) পিলখানায় ইপিআর সদর দফতরে অবস্থান করছিল । প্রতিটি ইপিআর উইঙে ছিল ৩টি কোম্পানী। যদিও বেশিরভাগ ইপিআর সৈন্যরা পিলখানায় অবস্থান করছিল, তবুও এর মধ্যে দুটি কোম্পানীকে মিরপুরে, দুটি কোম্পানীকে রাষ্ট্রপতি ভবনে এবং একটি কে গভর্নর হাউসে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার নিসার আহমেদ খান ছিলেন পুরো ইপিআর বাহিনীর প্রধান এবং পশ্চিম পাকিস্তানী লে.কর্নেল আনোয়ার হোসাইন শাহ ইপিআর এর ঢাকা সেক্টরের সৈন্যদের কমান্ডার। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অন্তত পক্ষে ২০০০ সশস্ত্র পুলিশ ছিল। ২য় ইবিআর বাহিনী (সি.ও লে.কর্নেল রাকিব-বাঙালি) ছিল ঢাকার উত্তরে জয়দেবপুরে সাথে এক কোম্পানী ছিল টাঙ্গাইলে, আরো এক কোম্পানী ছিল ময়মনসিংহে এবং একটি ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অংশ ছিল গাজিপুরে। ইপিআর এর দ্বিতীয় উইঙের সদর দফতরও (সি.ও ক্যাপ্টেন কামার আব্বাস- পশ্চিম পাকিস্তানী) ছিল ময়্মনসিংহে, যেখানে কোন বাঙালি অফিসার ছিল না ।
ছবি তথ্যঃ ইন্টারনেট ।