যুদ্ধের পরপরই রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে তোলা ছবিতে বুদ্ধিজীবীদের লাশ দেখা যাচ্ছে (সৌজন্যমূলক ছবি: রশীদ তালুকদার, ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রথম পর্ব
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ২য় পর্ব
১৯৭১ সাল এর বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস (পর্ব ১)
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বলতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টুকুতেই পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জ্ঞানী গুণী এবং মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের হত্যা করাকে বুঝানো হয়েছে । ১৯৭১সাল এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ সময়ে এসে পাকিস্তান বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করলো যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা আর সম্ভব না তখন তারা নবগঠিত দেশকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে দূর্বল ও পঙ্গু করে দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন । সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানী বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদর এবং আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ হতে তুলে এনে নির্মম ভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করেন । এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত টা সকলেরই জানা আছে । বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছিল । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত বিক্ষত এবং বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় । অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি এমনকি পাওয়াও যায়নি বহু লাশ । ১৯৭১সাল এর ১৪ই ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস । বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মরণে বাংলাদেশের ঢাকায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে । তাছাড়া বাংলাদেশ ডাকবিভাগ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিটের সিরিজ বের করেছে ।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যারা দৈহিক শ্রমের বদলে মানসিক শ্রম অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেন তারাই হলেন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী । বাংলা একাডেমী প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা হলো
১। বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক
২। বিজ্ঞানী
৩। চিত্রশিল্পি
৪।কন্ঠশিল্পি
৫। সকল পর্যায়ের শিক্ষক
৬। গবেষক
৭। সাংবাদিক
৮। রাজনীতিক
৯। আইনজীবী
১০ চিকিৎসক
১১। প্রকৌশলী
১২। স্থপতি
১৩। ভাস্কর
১৪। সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী
১৫। চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সমাজসেবী এবং সংস্কৃতিসেবী ।
পাকিস্তান নামক অগণতান্ত্রিক এবং অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই বাঙালিদের অথবা পূর্বপাকিস্তানীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে । তারা বাঙালিদের ভাষা এবং সংস্কৃতির উপর আঘাত হানেন । তারই ফলশ্রুতিতে বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে এবং বাঙালিরা সেই অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেন । এই সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকতেন সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা । তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতেন । তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন বা হয়ে উঠতে থাকেন যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে । এইজন্য শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাষকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন । তাই যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানী বাহিনী বাছাই করে করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকেন । তাছাড়াও যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন পাকিস্তানের পরাজয়ের সময় হয়ে আছে ও যখন শুধুই সময়ের ব্যাপার মাত্র তখন বাঙালি জাতি যেন শিক্ষা সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে তাই তারা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দেবার লক্ষ্যে তালিকা তৈরি করেন এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ।
এ প্রসঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে যে যুক্তিটি দেওয়া হয়েছে তা প্রাসঙ্গিক এবং যুক্তিযুক্ত ।এটা অবধারিত হয়, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের রচনাবলির মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে। একটি জাতিকে নিবীর্য করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া । ২৫ মার্চ রাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে তারপর ধীরে ধীরে শেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বর ১০ তারিখ হতে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুতগতিতে ।
যুদ্ধের পরপরই রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে তোলা ছবিতে বুদ্ধিজীবীদের লাশ দেখা যাচ্ছে (সৌজন্যমূলক ছবি: রশীদ তালুকদার ১৯৭১) ২৫ মার্চ এর রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথে একসাথেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল । পাকিস্তানী সেনারা অপারেশন চলাকালীন সময়ে খুজে খুজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫শে মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়েছিল । তবে সে পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কয়েকদিন আগে । যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা সামরিক বাহিনী আল
বদর এবং আল শামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করেন যেখানে এই সব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে । ধারণা করা হয় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি । কারণ স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তার স্বহস্তে লিখিত ডায়েরী পাওয়া যায় যাতে অনেক নিহত এবং জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায় । তাছাড়াও আইয়ুব শাসন আমলের তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের এক সাক্ষাৎকার হতে জানা যায় যে ফরমান আলীর তালিকায় তার বন্ধু কবি সানাউল হকেরও নাম ছিল । আলতাফ গওহরের অনুরোধে রাও ফরমান আলি তার ডায়েরীর লিস্ট থেকে সানাউল হকের নামটি কেটে দেন । তাছাড়া আলবদরদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন বলে তার ডায়েরীতে একটি নোটও পাওয়া যায় ।
তাছাড়াও তার ডায়েরীতে হেইট এবং ডুসপিক নামে দুজন আমেরিকান নাগরিকের কথাও পাওয়া যায় । এদের নামের পাশে ইউএসএ এবং ডিজিআইএস লেখা ছিল । এর মধ্যে হেইট ১৯৫৩ সাল থেকে সামরিক গোয়েন্দাবাহিনীতে যুক্ত ছিল এবং ডুসপিক ছিল সিআইএ এজেন্ট । এই কারণে সন্দেহ করা হয়ে থাকে যে পুরো ঘটনার পরিকল্পনায় সিআইএর ভূমিকা ছিলো । মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনিই ।
রাও ফরমান আলি খান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সমসাময়িক ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ ১৯৭১সাল এর সময়কার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম উচ্চপদস্থ অফিসার। সামরিক পুলিশ এবং শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক পুলিশ ও রাজাকারসহ নিরাপত্তা বাহিনীর আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন ও তদারক করতেন। তিনি প্রথমদিকে একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ রেজিমেন্টের পরিদর্শক ছিলেন এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা হন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ছিলেন। সেসময় বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় তিনিই হলেন অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত।
রাও ফরমান আলি তার নিজের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগসমূহ প্রত্যাখ্যান করলেও হামুদুর রহমান কমিশন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পায়। যুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তার সহকর্মী এবং সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। যুদ্ধের পর তাকে সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তার সকল ব্যাজ ফিরিয়ে নেয়া হয়। তবে ১৯৭৯ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুর পর জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক তাকে তার উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। এসময় সংঘটিত গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠা আন্দোলন দমনে নির্যাতন ও হত্যায় তাকে দায়ী হিসেবে ধরা হয়। জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর আলি আত্মগোপনে চলে যান। ২০০৪ সালে অল্পদিন অসুস্থ থাকার পর রাওয়ালপিন্ডিতে মৃত্যুবরণ করেন।
চলবে.............................................।
তথ্যসূত্রঃ বাংলা পিডিয়া ও উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য ওয়েব সাইট