এই ভরসন্ধ্যায় খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছি।চাচাতো বোন বীথির বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে গানবাজনার আয়োজন চলছে। অন্যান্য চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোনরা খুব আনন্দ করছে। কিন্তু আমার খুব বিরক্ত লাগছে ব্যাপারটা।এমনিতেই মাইগ্রেনের ধাত আছে আমার তারমধ্যে আবার আমি একটু নির্জনতা-প্রিয় মানুষ, হৈ হুল্লোড় পছন্দ করি না।তবু বীথির বিয়ে বলে কথা,মেজো চাচীর অনুরোধে,আব্বু আম্মুর জোরাজুরিতে আর স্বয়ং বীথির মুখের দিকে তাকিয়ে এ বাড়িতে আসতেই হলো।যাই হোক,এমুহুর্তে আলো-আধারির নির্জনতায় বেশ ভালোই লাগছে,মৃদুমন্দ বাতাস বইছে,সাথে পাল্লা দিয়ে বাসন্তী রঙের শাড়ির আঁচলটা উড়ছে,আর মাইগ্রেনের ব্যথাটাও অনেকটা কমে এসেছে। হঠাৎ মাথায় রোমান্টিসিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।খালি গলায় গেয়ে উঠতে মন চাইছে...তোমার খোলা হাওয়ায়,লাগিয়ে পালে,তোমার খোলা হাওয়ায়...টুকরো করে কাছি,আমি ডুবতে রাজি আছি,আমি ডুবতে রাজি আছি... তোমার খোলা হাওয়ায়... পেছনে হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেয়ে আপনাআপনিই গান গাওয়া থেমে গেলো আর মেজাজটাও বিগড়ে গেলো হুট করে।কে এলো আমার শান্তিভঙ্গ করতে?? পেছনে তাকানোর আগেই একটা ভরাট কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। সীমান্ত সাহেব!!! এই ভদ্রলোক এলেন কোত্থেকে??? "গানটা কিন্তু ভালোই গাইছিলেন!!! আপনার এই গুণটা বেশ লাগে আমার!!!" বলেই গটগট করে হেঁটে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। মনে মনে রেগে গেলাম,বলতে ইচ্ছে হলো,আপনার বেশ লাগার নিকুচি করি!!! কিন্তু মুখে কিছু বললাম না।চাচীর কোন এক বান্ধবীর ছেলে,আমার মতামতের তোয়াক্কা না করে ভদ্রলোকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।লোকটা কেমন যেন,ভালোও লাগে না আবার খারাপও লাগে না।দেখতে যথেষ্ট সুদর্শন,গড়পরতা আট-দশটা ছেলের চেয়ে লম্বা, গায়ের রঙটাও মোটামুটি ফর্সা, যথেষ্ট সুঠামদেহী,বয়সটা বোধহয় বত্রিশ/তেত্রিশের কাছাকাছি,ব্যাংকার।যেকোনো মেয়েই বর হিসেবে এমন কাউকেই পছন্দ করবে কিন্তু আমার মতামতের তোয়াক্কা করা হয়নি বলে ভেতরে ভেতরে রেগে আছি,তাই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি,পছন্দ করার বদলে। ভদ্রলোক বোধহয় বুঝতে পারেন ব্যাপারটা কিন্তু তোয়াক্কা করেন না,হবু বধূর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন বরং!!! তার এই স্বভাব আমার বিরক্তি আরো বাড়িয়ে দেয় কিন্তু আমি কিছু প্রকাশ করি না, নির্বিকার থাকি বরাবর।এটাই আমার স্বভাব।সে যাই হোক, ভদ্রলোকের কথায় আমার চিন্তার জাল ছিন্ন হলো,"এতো সুন্দর নির্জন একটা পরিবেশ,এলোমেলো দখিনা হাওয়া বইছে আর আপনি আপনার এতো সুন্দর মেঘকালো চুলগুলো খুলে রাখার বদলে খোঁপায় বেঁধে রেখেছেন?? ইটস নট ফেয়ার!!! খুলে ফেলুন তো দেখি!!! নয়তো আমাকে দিন,আমিই খুলে দিচ্ছি।" এবার আমি আর নীরব থাকতে পারলাম না,রাগটা তড়াক করে চড়ে গেলো মাথায়,"কি শুরু করেছেন এসব??? আমার চুল আমি যেভাবে খুশি সেভাবে বাঁধবো,তাতে আপনার কি??? আমার ব্যাপারে একদম ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করবেন না!!! আপনাকে আমি সেই অধিকার দিইনি,আর কখনো দেবোও না,কথাটা মাথায় রাখবেন দয়া করে!!! এমনিতেই আমার শান্তিভঙ্গ করেছেন, কিছু বলিনি তাই বলে যা খুশি তাই করবেন???" আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু লোকটার থমথমে বিষাদগ্রস্ত মুখ দেখে রাগটা হুট করে নেমে গেলো আবার।পাশ ফিরে খানিকটা সরে দাঁড়ালাম। মাথাটা ঠান্ডা হতেই মনে হলো,লোকটা তো ভুল কিছু বলেননি!!! এই খোলা হাওয়ায় চুলে খোঁপা তো সত্যিই বেমানান!!! কিন্তু লজ্জায় চুলটা খুলতেও পারছি না, কেমন যেন লাগছে... লোকটার কথায় খোলা হয়ে যাবে তাহলে...লজ্জায় পড়বো আর উনি এতে আশকারা পেয়ে যেতে পারেন!!! কি যে করি??ভাবতে ভাবতেই আবার পেছনে ভরাট কন্ঠ শুনতে পেলাম,আর টের পেলাম আমার খোঁপায় হাত পড়েছে,"হয়েছে হয়েছে থাক, আমার সামনে আর লজ্জা পেতে হবে না।আমিই খোঁপা খুলে দিচ্ছি।" বলে সীমান্ত সুন্দর করে আমার চুল খুলে দিলেন, আপনাআপনিই হাতদুটো চুলে চলে গেলো আর এলোচুল পিঠ বরাবর এঁকেবেঁকে নেমে গেলো,হাওয়ায় উড়তে শুরু করে দিলো কি এক অবোধ্য আনন্দে!!! ভীষণ লজ্জা পেলাম।লোকটা কি করে আমার মনের কথাটা বুঝে ফেললো?? এজন্যই বোধহয় পুরোপুরি অপছন্দও করতে পারি না মানুষটাকে!! কেমন যেন একটা আকর্ষণ আছে তার মধ্যে!!! এসব হাবিজাবি ভাবছি হঠাৎ বীথির ছোটবোন তিথির কন্ঠ শুনতে পেলাম,"দীবাপু তুমি এখানে??সবাই তোমাকে খুঁজছে!!! আপাকে হলুদ দেবে না??? সীমান্ত ভাইয়া আপনিও এখানে?? বুঝেছি বুঝেছি!!! এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে কি চলছিল হুম!!! তাড়াতাড়ি নীচে আসুন আপনারা নইলে কিন্তু সব বলে দেবো সবাইকে!!!" বলেই হাসতে শুরু করলো। আমি ধমকে উঠলাম,"চুপ কর ফাজিল!!! বেশি পেকে গেছিস!!! আমাদের মধ্যে কিছু চলছিল না!!! নীচে যা!!! আসছি আমরা!!!" বলতেই তিথিটা দুষ্টুমির হাসি হাসতে হাসতে দৌড়ে নিচে চলে গেলো। আমিও ওকে অনুসরণ করতে যাবো হঠাৎ টের পেলাম আমার শাড়ির আঁচলে টান পড়েছে..."কিছু বলবে না?? এভাবেই চলে যাবে?? এতো সুন্দর রোমান্টিক সময়টাকে মিথ্যে করে দেবে??"কথাগুলো শুনে বিষম এক লজ্জা যেন আমায় ঘিরে ধরলো...এ যেন এক অবর্ণনীয় অনুভূতি...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১১