ছোট বেলা থেকেই শুনে এসেছি মা-বাবার পরেই শিক্ষকের অবস্থান। মা-বাবা ও পরিবার থেকে পারিবারিক শিক্ষা গ্রহণ করি এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করি শিক্ষকের নিকট থেকে।
শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে। সমাজের সবাই শিক্ষকের পরামর্শ মেনে চলে। সবাই স্যার বলে সম্বোধন করে। অথচ জ্ঞান বিজ্ঞানের স্বর্গ রাজ্য হিসেবে পরিচিত যুক্ত রাজ্যের রাণী যাকে নাইট উপাধী প্রদান করে শিক্ষিত মহল তাকেই স্যার বলে থাকেন। কাজী কাদের নেওয়াজের “ শিক্ষা গুরুর মর্যাদা” কবিতা বা একজন আদর্শ শিক্ষক প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে ছোট্ট বেলা থেকেই শিক্ষকদের ভক্তি করে আসছি।শিক্ষকগণও তাঁদের কাজের মাধ্যমে গুরুর আসন দখল করে আছেন। তবে বর্তমানে শিক্ষকগণ তাদের মর্যাদাকে অর্থের মাপকাঠি দিয়ে মাপতে গিয়ে অল্প কিছু স্বার্থের বিনিময়ে স্বল্প মূল্যে বিকিয়ে দিচ্ছেন হাজার কোটি মূল্যের মর্যাদা।
মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে মান-সম্মান-মর্যাদা অর্জন করা। তাইতো এখন ব্যবসায়ী/আমলা/কামলা সবাই হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে মর্যাদা পেতে মরিয়া। অন্য দিকে শিক্ষাগুরুরা জীবনের শুরু থেকেই অফুরন্ত মর্যাদা ভোগ করে থাকে। একটা কথা আছে সাধা মালে আধা দাম বা যা সহজে পাওয়া যায় তার মূল্যায়ন কম। এই বিবেচনা না কি ভুল করে শিক্ষকগণ তাদের মর্যাদার কথা বিবেচনা না করে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরে মর্যাদা পায়ে দলে সামান্য অর্থের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে। এখন চোঁখ বন্ধ করে কোন আদর্শ শিক্ষক খুঁজলে কাউকে খুঁজে পাই না। জোড়া তালি দিয়ে একজনকে আদর্শ শিক্ষকের আসনে বসালেও তাকে কিছু দিন আগে পুলিশে ধরে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ব্যবহার করে অর্থ তসরুফ বা দূর্ণীতির দোষে দুষ্ট হওয়ার কারনে।
শিক্ষক হচ্ছে জাতি গঠনের মহান কারিগর। তাঁদের মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে আদর্শ মানুষ হয়ে জাতি গঠন করবে শিক্ষার্থীরা। আমি প্রতিনিয়ত মানুষ হওয়ার জন্য চেষ্ট করে যাচ্ছি, তবে এর পিছনে কোন শিক্ষকের কি ভূমিকা তা বিশ্লেষণ বড়ই কঠিন। তাই শুধু যে সকল শিক্ষকের অধীনে ক্লাশ করেছি বা শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণ করেছি তাদের নাম উল্লেখ করছি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণঃ
জনাব আব্দুর রউফঃ
আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন পাশের গ্রামের রউফ স্যার।স্যার এর নিকট থেকে কতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করেছি তা মনে নেই তবে তিনি আমাকে দিয়ে একটা গুরুদায়িত্ব পালন করিয়েছিলেন যখন আমি সেই কাজের মর্মার্থ তখন বুঝিনি। একটি রেজিস্টার দিয়ে বললেন এই লেখাটুকু পড়িয়ে গ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগুলোর স্বাক্ষর নিয়ে আসবে। এখন বুঝতে পারছি যে, কাজটি ছিল বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির মিটিং এর দাওয়াত অর্থাৎ কমিটির সভাপতি (তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান), সেক্রেটারি ও সদস্যদের মিটিং এর নোটিশ পড়িয়ে স্বাক্ষর গ্রহণ করা। ছোট্ট বেলায় এতো বড় দায়িত্ব কে আমাকে দিয়ে পালন করিয়েছিলেন তা বোধগম্য নয়। দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছিলেন, না কি কোন ভুল করার কারনে থাপ্পর মেরেছিলেন তা আমার স্মরণে নাই।
জনাব মতিউর রহমানঃ
আমার পাশের বাড়ীর নকী মুন্সী যাকে কাকা বলে সম্বোধন করি তিনি জনাব মতিউর রহমান আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্বল্পকালীন দায়িত্ব পালন করেন। হয়তো তিনি অন্য স্কুলে ছিলেন বা আমি ছাত্র হিসেবে স্কুলে তার সময় ছিলাম না তাই তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহনের কোন স্মৃতি নেই।
জনাব আশরাফ আলী ফকিরঃ
আশরাফ স্যার ছিলেন একটু রাগী প্রকৃতির শিক্ষক। তিনি পড়ানোর পাশাপাশি পড়া আদায়ের জন্য বেদম প্রহার করতেন। প্রচলিত বেতের লাঠির পাশাপাশি বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী ঝোপ/ঝাড়/জঙ্গল থেকে চিফঠির ডাল বা ঢোলকমলির গাছ সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের পিঠে ভাঙ্গার রেকর্ড গড়তেন। অনেক কোমলমতি শিক্ষার্থী স্যারের ভয়ে তটস্থ থাকতো। আমি প্রথম দিকে কিছুটা ভয় পেলেও পরবর্তীতে ভয়কে জয় করে স্যারের প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলাম। স্যার শিক্ষকতার পাশাপাশি কবিতা লিখতেন। আমিও ছোট বেলায় কয়েটকা কবিতা লিখে পাল্ডুলিপি দেখিয়ে স্যারের পরামর্শ চেয়েছিলাম। স্যারের উৎসাহ না পেয়ে আমার কবি প্রতিভা হ্রাস না পেলেও আমি কবি হিসেবে পরিচিত হতে আগ্রহ পেলাম না। বর্তমানে ঢাকার শহরে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি। আবার পবিত্র কোরআনে কবিদের বিভ্রান্তকারীদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাই আমি কবি হওয়ার চেষ্টা না করলে সাবেক রাষ্ট্রপতিসহ অনেকেই সুযোগ পেলেই নিজেকে কবি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে এবং আমার দুটি গবেষণামূলক প্রবন্ধের বই প্রকাশ হওয়ার পরও অনেকে আমাকে কবি বলে। স্যার শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে কাব্য চর্চা অব্যহত রাখেন এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। তাঁর কবিতার মান যথেষ্ট ভালো হলেও প্রচারের অভাবে যথাযথ সম্মান না পেয়ে মনে কষ্টে আমার সাথে যোগাযোগ করতেন । আমি তাঁকে স্যার ও কবি হিসেবে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোঁখে দেখতাম।
জনাব কাজী আজিজুর রহমানঃ
কাজী আজিজুর রহমান স্যার কে কাজী স্যার হিসেবে সম্বোধন করতাম এবং গ্রামের লোকজন তাকে সাইজ্যা কাজী বলে ডাকতেন। তিনি সাদামাটা জীবন-যাপন করতেন। দায়িত্বের সাথে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি নিজের ক্ষেতের কৃষিকাজ ও কাছা দিয়ে পুকুর/বিলের মাঝ ধরতে কুন্ঠাবোধ করতেন না। তার একদিনের পাঠদানের কথা আমার বেশ মনে আছে, শ্রেণিকক্ষের সংকট বা অতিরিক্ত গরম এর কারনে চান্দা(জারুল) গাছের নিচে পড়ানোর সময় জিজ্ঞেসা করলেন জাতীয় ফলের নামের বানান কি হবে? ইদ্রিস ছাড়া আমরা সবাই ভুল করলাম। আমরা সবাই চন্দ্র বিন্দু(ঁ) ছাড়া কাঠাল বলেছিলাম এবং ইদ্রিস চন্দ্র বিন্দু(ঁ) দিয়ে কাঁঠাল বলে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে স্যারের প্রহার থেকে নিস্তার পেয়েছিল। যদিও ইদ্রিস মাধ্যমিকের গন্ডি না পেরিয়ে বাল্য বয়সে বিয়ে করে বর্তমান পর্যন্ত চারটি বিয়ে করার গৌরব অর্জন করেন।
জনাব কহিনুর খানমঃ
আমার বড় বোনের বান্ধবী কোহিনুর আপা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হয়ে আসেন। তিনি ছিলেন আমার শ্রেণি শিক্ষক। প্রথম শ্রেণিতে ক্লাশ ক্যাপ্টেন নির্বাচনে আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম তা বর্তমানের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাপ লক্ষ্যণীয়। এ অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা নতুন নিবন্ধ লেখা আবশ্যক মনে করে তৃতীয় শ্রেণীর একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। আমি বরাবরই অভাগা। হয়তো ভালো কিছু অর্জন করতে পারি নাই বা অর্জন করলেও মুল্যায়ন পাই নাই। তৎকালীন বাংলায় লেটার মার্ক পাওয়া কঠিন ছিলো। ক্লাশের ফার্স্ট বয় পাঁচটি বিষয়ে লেটার মার্ক পেল এবং আমি বাংলাসহ ছয়টি বিষয়ে লেটার মার্ক পেয়ে দ্বিতীয় হলাম। মোট নম্বর বেশি পাওয়ায় ফাস্ট বয়কে একটা পুরস্কার দেওয়া হলে ছয়টা বিষয়ে লেটার পাওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ একটা খাতা আদায় করে নিলাম।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ
জনাব আব্দুর রউফ
জনাব হারুন অর রশিদ
জনাব কাঞ্চন আলী মিয়া
জনাব মোক্তার হোসেন
জনাব হাজারী স্যার
জনাব ইয়াদ আলী স্যার
জনাব আফজাল স্যার
কোহিনুর ম্যাডম
মিল্লাত স্যার
কলেজ এর শিক্ষকগণঃ