somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুক্তমনা ব্লগার
কেহ বিশ্বাস করে, কেহ করে না। যে বিশ্বাস করে সেও সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না, যে অবিশ্বাস করে সেও না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা নির্ভর করে মানুষের খুশির উপর। ধর্মান্ধতা নিপাত যাক, মুক্তচিন্তা মুক্তি পাক।

“মাদ্রাসাকে মাদ্রাসার জায়গায়” রেখে দেয়া কি “মাদ্রাসা প্রেম”? নাকি গরীবের বাচ্চাদের বিরুদ্ধে অভিজাতদের ষড়যন্ত্র?

০৮ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
মাদ্রাসা শিক্ষাকে মুল ধারার শিক্ষার সাথে যুক্ত করার দাবীটি বহু পুরনো। বাংলাদেশের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন গুলো অন্তত গত তিন দশক ধরে দাবী করে আসছে, মদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন এবং একে ক্রমশ মুলধারার শিক্ষার সাথে যুক্ত করার কথা। এর প্রধান যুক্তিগুলো হচ্ছে –
– মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের যুগোপযুগী শিক্ষার মধ্যে নিয়ে আসা, যেনো তাঁদের মাঝে শ্রম বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো দক্ষতা তৈরী হয়।
– একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজে অসমতা বা ইনিকুয়ালিটি হ্রাস করতে সহযোগিতা করবে
– মূলধারার শিক্ষায় বৃহত্তর ছাত্র সমাজের সাথে অংশ গ্রহনের ফলে এই ছাত্র ছাত্রীরা মূলধারার বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত হতে পারবে
– সর্বোপরি, এই সকল শিশুরা যেনো, আজকের অগ্রসর পৃথিবীর নানান বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে পারে

এখন, এই বিশাল ছাত্র গোষ্ঠীকে মূলধারার শিক্ষার সাথে একিভুত করার অর্থনৈতিক দায়টি রাস্ট্রের। বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন গুলো সেই লক্ষেও কাজ করছে বহু বছর ধরে। রাস্ট্রের কাছে দাবী জানিয়েছে, শিক্ষার অর্থনৈতিক দায় যে রাস্ট্রকেই নিতে হবে, সে আন্দোলন আজও জারি আছে।

বলাই বাহুল্য, মাদ্রাসা শিক্ষা কেন্দ্রিক যে রাজনীতি বাংলাদেশে রয়েছে, সেই গোষ্ঠী এই ধরনের শিক্ষা আন্দোলনকে মাদ্রাসা শিক্ষা “ধংসের” আন্দোলোন বলে চিনহিত করে আসছে বহু বছর ধরেই। এরা এই একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার আন্দোলন কে মাদ্রাসা ছাত্রদের “বিরুদ্ধে” বলে প্রচার করে থাকেন। অথচ, আজ পর্যন্ত, কোনও ছাত্র সংগঠন এ ধরনের কোনও দাবী তোলেনি যে মাদ্রাসা ছাত্রদের শিক্ষা তুলে দিতে হবে বা তাঁদের শিক্ষার অধিকার বাতিল করতে হবে। বরং এই সকল ছাত্র সংগঠন গুলো “শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার” এই দাবীতেই আন্দোলন করে যাচ্ছে গত চার – পাচ দশক ধরে। এই সকল সংগঠন যে শিক্ষার অধিকারের সংগ্রামে নিষ্ঠ সেখানে মাদ্রাসার সকল শিশুর শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটিও যুক্ত। তুলনা করবার জন্যে দুটি ছবি তুলে দিলাম আপনাদের জন্যে। একটি মাদ্রাসার এবং একটি ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলের। বলুন তো একজন নৈতিক মানুষ হিসাবে, আমরা কি এই অসমতা কে সমর্থন করবো?

সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়েছে হেফাজত এ ইসলামী এবং তাঁদের পোশাকী সমর্থকেরা। যদিও এই সকল পোশাকী “মাদ্রাসা প্রেমিক” দের সন্তানেরা পড়াশুনা করেন শহরের সবচাইতে দামী ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে এই সকল মাদ্রাসা প্রেমিকদের সন্তানেরা চলে যান আমেরিকার, কিম্বা যুক্তরাজ্যের বা নিদেন পক্ষে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে। এই সকল অভিজাত পোশাকী মাদ্রাসা প্রেমিকদের মুল লক্ষ্য হচ্ছে, মাদ্রাসা শিক্ষারথিদের কে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দাবীকে “মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে” বা “মাদ্রাসা ছাত্রদের বিরুদ্ধে” বলে প্রচার করা।

এই সকল পোশাকী মৌলবাদী দের দাবী হচ্ছে “মাদ্রাসাকে মাদ্রাসার যায়গায় থাকতে দিন” ! এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই ধরনের পোশাকী মৌলবাদীদের পোশাক খানিকটা খুলে এদের নগ্ন ঘিনঘিনে চেহারাটা খানিক্টা তুলে ধরা।

২.
আমাদের দেশের ভদ্রলোক নাগরিকদের একটি অংশ মনে করেন “মাদ্রাসা কে মাদ্রাসার স্থানে থাকতে দেয়া উচিত”। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষা কে নিয়ে কোনও রকমের সংস্কার বা পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন বিষয়ে কিছু বলা যাবেনা। এরা বলেন মাদ্রাসায় এদেশের দরিদ্র মানুষের সন্তানেরা পড়ে, সুতরাং মাদ্রাসা থাকতে হবে। মাদ্রাসা না থাকলে দরিদ্র মানুষের বাচ্চারা কোথায় পড়বে? দরিদ্র মানুষের সন্তানদের শিক্ষার এই ধারনাটি খুব জনপ্রিয়, কিন্তু বাঙ্গালী উচ্চ শিক্ষিত গোষ্ঠী কোনদিনও এই দুইটি প্রশ্ন করেন না নিজেদেরঃ
১ – মাদ্রাসা না থাকলে কি এই দরিদ্র মানুষের সন্তানেরা পড়তে পারবে কোথাও? পৃথিবীর বিভিন্ন স্বল্প আয়ের দেশে যেখানে মাদ্রাসা নেই সেখানে কি দরিদ্র মানুষের বাচ্চারা পড়াশুনা করেন? নেপালে দরিদ্র মানুষের বাচ্চারা কোথায় পড়েন? শ্রীলঙ্কায় দরিদ্র মানুষের বাচ্চারা কোথায় পড়েন? ভারতের কেরালায়, যেখানে প্রায় ১০০% মানুষ স্বাক্ষর, এই অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের বাচ্চারা কোথায় পড়েন? ঘানা কিম্বা ইথিওপিয়া কিম্বা সুদানে দরিদ্র মানুষের বাচ্চারা কোথায় পড়াশুনা করে?
২ – যদি ধরেই নেয়া হয় যে, মাদ্রাসা ছাড়া আসলেই গরীব মানুষের বাচ্চাদের আর কোনও গতি নেই, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, মাদ্রাসায় পড়ে কি এই সকল দরিদ্র মানুষের সন্তানেরা আদৌ তাদের নিজেদের ও পরিবারের দারিদ্র ঘোচাতে পারছেন? তাঁরা কি পারছেন তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক “বর্গ” বা “শ্রেনী” র উত্তোরন ঘটাতে?

৩.
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর নতুন পুস্তক “The country of first boys” পুস্তকের একটি লেখায় চমৎকার একটি যুক্তি তুলে ধরেছেন। যারা বইটি পড়েন নি, তাঁদের জন্যে উল্লিখিত প্রবন্ধটির একটি সারাংশ তুলে ধরছি প্রথমে। উল্লেখিত প্রবন্ধটির শিরোনামেই তিনি পুস্তকটির নামকরণ করেছেন। তারপরে অমর্ত্য সেনের যুক্তি দিয়ে আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার চেস্টা করবো।

এই প্রবন্ধটিতে অমর্ত্য সেন ভারতের “ফার্স্ট বয়” সংস্কৃতির বেশ ভদ্রস্থ ভাবে সমালোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, বহু বছর ধরে ভারতে এই “ফার্স্ট বয়” সংস্কৃতি চালু হয়ে আসছে। তিনি তাঁর নিজের শৈশবেও দেখেছেন এই সংস্কৃতি। বহু সফল মানুষ তাঁদের প্রৌঢ় বয়সের সময়েও ভুলতে পারেন না যে তাঁরা এক সময় “ফার্স্টবয়” ছিলেন। এমন কি বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সারা জীবন ধরে সেই স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়ান। কেউ কেউ, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় গণিতে বা পদার্থবিজ্ঞানে কত নাম্বার পেয়েছিলেন সেটাও মুখস্থ রাখেন সারা জীবন ধরে আর বিভিন্ন পার্টী বা সামাজিক অনুষ্ঠান গুলোতে খোশগল্পে সেসব বলে বেড়ান। এরপর ডঃ সেন, ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু সাধারণ আলোচনা করেছেন, কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে আলোচনা করেছেন ভারতের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা। এবং ভারতের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনি কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। সেই সকল প্রশ্নের একটি প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে এই রকমঃ

ভারতের প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ শিশু হাইস্কুল পর্যন্ত আসতে পারেনা। অর্থাৎ সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এমন যে সেখানে যারা সারা ভারতে “ফার্স্টবয়” হচ্ছেন, তাঁরা আসলে এক ধরনের শিথিল প্রতিযোগিতায় “ফার্স্টবয়” হচ্ছেন। যেখানে প্রতিযোগিতায় শতকরা ৫০ ভাগ প্রতিযোগী আসতেই পারছেন না। পুরোটা ফাকা মাঠে গোল দেয়া না হলেও, অন্তত অর্ধেক ফাকা মাঠে গোল দিচ্ছেন এই সকল কথিত “ফার্স্টবয়”রা। এটা কি একটা “ফেয়ার গেম” বলা যাবে? যাবেনা। ধরুন ভারতের এই বঞ্চিত শতকরা ৫০ ভাগ শিশুকে যদি কোনোভাবে হাইস্কুল ফাইনাল পর্যন্ত ধরে রাখা যায়, তাহলে কি বিষয়টা আমাদের বর্তমান “ফার্স্টবয়”দের জন্যে খানিকটা হলেও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, তাঁদের “ফার্স্টবয়ত্ত্ব” ধরে রাখার ক্ষেত্রে?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি আরেকধাপ এগিয়ে, ভারতের এই সকল “ফার্স্টবয়” গন, পড়াশুনা করেন হয় ইংরাজি মিডিয়ামে, অথবা প্রাইভেট স্কুলে নিদেন পক্ষে পাবলিক স্কুলে পড়লেও বাড়ীতে বা শিক্ষকের বাসায় টিউশন মিলিয়ে এদের পেছনে বাবা-মার মাসের বেতনের একটি বড় অংশ ব্যয় হয়ে থাকে। এবার দ্বিতীয় অবস্থাটির কথা ভেবে দেখুন তোঃ

ভারতের যে শতকরা ৫০ ভাগ বঞ্চিত শিশু, তাঁরা শুধু হাইস্কুলে আসাই নয়, যদি তারাও এই সকল “ফার্স্টবয়”দের মতো একই রকমের সুবিধাদি পেতো, তাহলে এই সকল “ফার্স্টবয়”দের “ফার্স্টবয়ত্ত্ব” ধরে রাখাটা কতটা সহজ বা কঠিন হতো?

এই দুটি প্রশ্নের পরে, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, এই সংক্রান্ত রাজনীতিটির আলোচনা করেছেন। ভারতের যে মূলধারার রাজনীতি এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেনীর যে রাজনীতি, তাতে করে উল্লেখিত বঞ্চিত শতকরা ৫০ শিশু কখনই মূলধারার প্রতিযোগিতায় এসে ভিড়তে পারবেনা। সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকেই সেভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে, গড়ে তোলা হয়েছে, এবং এই ব্যবস্থাকেই মহিমান্বিত করা হচ্ছে প্রতিদিন, যাতে এই সকল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের সন্তানদের সারাজীবনের “ফার্স্টবয়” ইমেজ টী প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখিন না হয়। যেনো আরো বহু বহু বছর ধরে এদের সন্তানদের “ফার্স্টবয়” হওয়া টা ঝামেলা মুক্ত, নির্ঝঞ্ঝাট হয়।


এবার আসুন, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এর এই এনালজি টা যুক্তি কাঠামোটি বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রোয়োগ করে দেখা যাক।

দৃশ্যপট – ১
ধরুন বাংলাদেশের ষাট লক্ষ কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা বাংলাদেশের জিলা স্কুল গুলোতে চলে আসলো। সেখানে আরো অনেক ছাত্রের সাথে গণিত, ইংরাজি, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, বায়োলজি, সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি পড়তে শুরু করলো। অবস্থা টা কি দাঁড়াবে বলুন তো? জিলা স্কুলের “ফার্স্টবয়”দের কি পরিশ্রম আরেকটু বেশী করতে হবে, তাঁদের “ফার্স্টবয়ত্ত্ব” ধরে রাখার জন্যে?

দৃশ্যপট – ২
ধরুন বাংলাদেশের এই ষাট লক্ষ কওমি মাদ্রাসার ছাত্র যদি দেশের বিভিন্ন জিলা স্কুলে অর্থাৎ মূলধারার স্কুল গুলোতে চলে আসে, সেখানে আরো অনেক ছাত্রের সাথে গণিত, ইংরাজি, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, বায়োলজি, সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি পড়তে শুরু করলো। শুধু তাইই নয়, বরং এদেরও বাড়ীতে প্রাইভেট শিক্ষক পাওয়া গেলো, কিম্বা টিচারের বাড়ীতে ব্যাচে পড়ার সুযোগ পেলো এই শিশুরা, তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াবে বলুনতো? আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখার পারফরম্যান্স কি চাপের মুখে পড়ে যাবে? আমাদের উচ্চ মধ্যবিত্ত – উচ্চবিত্ত পরিবারের যে সকল ছেলে মেয়েরা এখন ফার্স্টবয় বা ফার্স্ট গার্ল হচ্ছেন, তাদের নিজ নিজ আসন টি কি একটু অনিশ্চিত হয়ে পড়বে?
আমি আরেকটু এগিয়ে যেতে চাই –

দৃশ্যপট – ৩
ধরুন বাংলাদেশের এই ষাট লক্ষ কওমি মাদ্রাসার ছাত্র যদি দেশের বিভিন্ন ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে অর্থাৎ মূলধারার দেশী বিদেশী ইংরাজি মিডিয়াম স্কুল গুলোতে চলে আসে, সেখানে আরো অনেক ছাত্রের সাথে গণিত, ইংরাজি, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, বায়োলজি, সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি পড়তে শুরু করলো, ও লেভেল এবং এ লেভেল পড়তে লাগলো। বলুন তো ধনীর দুলাল দের কি অবস্থা হবে? এই ধনীর দুলালেরা যারা বাবার গাড়ী করে স্কুলে যান, টিফিনে কে এফ সি বা পিজ্জা হাটে বেড়াতে যান, তাদের পক্ষে তাদের গ্রেড ধরে রাখা কি আরেকটু কস্টকর হয়ে উঠবে?

কিন্তু বাস্তবে এই তিনটি দৃশ্যপটের কোনটিই হবে না। কেননা, আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তি, শিক্ষিত বাঙ্গালী মনে করেন, মাদ্রাসা কে মাদ্রাসার যায়গাতেই রাখতে হবে। এর কোনও সামাজিক উল্লম্ফন ঘটানো যাবেনা। গরিবের বাচ্চা মাদ্রাসায় পড়বে আর “আমাদের বাচ্চা” জিলা স্কুলে পড়বে কিম্বা আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়বে। এর নাম হচ্ছে “মাদ্রাসা প্রেম” । উচ্চ শিক্ষিত বাঙ্গালীর “মাদ্রাসা-প্রেম”।

ভেবে বলুন তো এটা কি আসলে মাদ্রাসা প্রেম? নাকি পরের সন্তান চুলোয় যাক, “আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে”র নাগরিক স্বার্থপরতা?

মাদ্রাসাকে মাদ্রাসার যায়গায় রেখে দিলে কি মাদ্রাসার ছাত্রদের সামাজিক গতিশীলতা বা “সোশ্যাল মোবিলিটি”র পথ খুলে যায়? নাকি চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়? রিকশা চালকের ছেলে রিকশা চালাবে, কাঠ মিস্তিরির ছেলে আমার ফারনিচার বানাবে, ডাক্তারের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে আর ইঞ্জিনিয়ার এর ছেলে ডাক্তার হবে, চিরকাল ধরে এই ব্যবস্থা চলতে থাকে, সেটা কি খুব কাম্য? হ্যা সমাজের অভিজাত শ্রেনীর কাছে সেটাই সবচাইতে কাম্য দৃশ্যপট, সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই ধর্ম, সেটাই শাশ্বত ! এর ব্যতিক্রম যারা বলে, তাঁরা বেয়াদব, নাস্তিক, অশিক্ষিত, বোকা। রিকশা চালকের ছেলে বড় জোর মসজিদের তৃতীয় মুয়াজ্জিন হবে, সেতো আর আমার ছেলের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারেনা, তাই না? রিকশা চালকের ছেলেটি যেনো চিরকাল মাদ্রাসায় যেতে পারে, তাই “মাদ্রাসা কে মাদ্রাসার যায়গায়” রাখা দরকার। মাদ্রাসার ছেলে যেনো কখনও একাউন্টিং না পড়ে, তাহলে তো স্ট্যান্ডারড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে আমার ছেলের চাকুরীটা ঝামেলায় পড়ে যাবে, তাই না? মাদ্রাসার ছেলে যেনো কখনও ফারমেসি না পড়ে, তাহলে তো নোভারটিস এ আমার মেয়ের চাকুরী টা ঝামেলায় পড়ে যাবে, তাই নয় কি? সুতরাং মাদ্রাসা কে মাদ্রাসায় রাখতে হবে। এর বিরোধিতা যারা করবে, তাদের কে “সেকুলার” বলে ব্যাঙ্গ করা হবে, তাদেরকে নাস্তিক বলে ছি ছি করা হবে, তাদের কে নিরবোধ বলে হেসে উড়িয়ে দেয়া হবে।

সামাজিক গতিশীলতা বা “সোশ্যাল মোবিলিটি”র ধারনা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা
“সোশ্যাল মোবিলিটি”র ধারনাটি খুব সহজ। ধরুন – ডাক্তার এর ছেলে ডাক্তার – ইনজিনিয়ার বা উকিল হবে আর রিকশা চালকের ছেলে হবে রিকশা চালক বা কাঠ মিস্ত্রি বা বড়জোড় টেম্পো চালক। যদি এমনটাই ঘটে কোনও সমাজে, তাহলে এটা একটি বদ্ধ সমাজের উদাহরণ, যেখানে সোশ্যাল মোবিলিটি প্রায় শুন্যের কোঠায়। সোশ্যাল মোবিলিটির ধারনাটি একটি পজেটিভ ধারনা। স্বাভাবিক ভাবেই, আমাদের দেশে এটি একটি বিরল ঘটনা, সেই জন্যেই, মাদ্রাসার একটি ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী বিভাগে সুযোগ পেলে তা জাতিয় পত্রিকায় খবর হয়ে ওঠে, কারণ এটি একটি বিরল ঘটনা।

সোশ্যাল মোবিলিটির সমস্যাটি শুধু আমাদের নয়, ভারত, পাকিস্থান, চীন এমন কি আমেরিকা সহ পৃথিবীর বহু দেশে বিদ্যমান। একটা বেশ জনপ্রিয় বিবৃতিও চালু আছে পসচিমা দেশে – আমেরিকায় কোনও একটি তরুন যদি এক প্রজন্মে তাঁর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন চায়, তাহলে তাঁর ফিনল্যান্ডে ইমিগ্রেশন নেয়া উচিত। অর্থাৎ একজন দরিদ্র আমেরিকান যুবক তাঁর সপ্ন বাস্তবায়ন করাটা আমেরিকায় যতটা কঠিন ফিনল্যান্ডে ততটা কঠিন নয়।

বলুন তো, মাদ্রাসার ছাত্ররা যদি বংশ পরম্পরায় মাদ্রাসাতেই থেকে যায়, তাহলে সেটা সেই সকল পরিবারগুলোর জন্যেও কি খুব সুবিধাজনক কিছু?

শেষ প্রশ্ন !
সুতরাং যে সকল এলিট মানুষেরা বলেন, “মাদ্রাসাকে মাদ্রাসার যায়গাতেই রাখতে হবে”, তাঁরা কি আসলে মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রদের কিম্বা তাঁদের পরিবারের বন্ধু? নাকি এরা আসলে নিজেদের সন্তানদের পেশার যায়গাটিকে ঝুকিমুক্ত রাখার জন্যে এই রাজনৈতিক সংগ্রামটি চালিয়ে যাচ্ছেন “মাদ্রাসা প্রেমিক” হিসাবে? এরা বলছেন “মাদ্রাসা কে মাদ্রাসার যায়গায় থাকতে দিন”, এই কথাটি কি তাঁরা আসলে মাদ্রাসার বাচ্চাদের প্রতি প্রেম থেকে বলছেন, নাকি নিজেদের সন্তানদের চাকুরীর বাজার নিষ্কণ্টক রাখার জন্যে বলছেন? প্রশ্নটি খতিয়ে দেখুন। দেখুন, এই সকল মাদ্রাসা প্রেমিকের কতজনের বাচ্চা কাচ্চারা মাদ্রাসায় পড়ে, তাহলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। হিসাব করে দেখলে দেখবেন, শতকরা ৯৯.৯৯% মাদ্রাসা প্রেমিকের বাচ্চারা পড়েন, মুল্ধারার স্কুলে, অভিজাত স্কুলে কিম্বা শহরের সবচাইতে দামী ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে। সুতরাং এদের মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সোস্যাল মোবিলিটির চাকাটিকে সব সময় নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে রাখা।

এই সকল ভন্ড “মাদ্রাসা প্রেমিক” দের চিনে নেয়াটা জরূরী।
আমি বিভোর হয়ে স্বপ্ন দেখি, আজ যে বাচ্চা ছেলেটি বা মেয়েটি মাদ্রাসায় যাচ্ছে, তাঁরা যেনো কখনও মূলধারায় পড়াশুনার সুযোগ লাভ করে, গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, ফার্মেসী, একাউন্টিং এই সকল এপ্লাইড বিশয়ে পড়ার সুযোগ পায়, আর সেই সকল প্রতারক “মাদ্রাসা প্রেমিক” দের সন্তানদের ঘাড়ে টোকা দিয়ে বলে – “সরে যা, আমি এসেছি” …… !

বাংলাদেশের সকল মাদ্রাসার ছাত্র – ছাত্রী বাচ্চারা মাদ্রাসার কবল থেকে মুক্তি পাক ! আর যে সকল ভন্ড প্রতারকেরা নিজেদের সন্তানদের ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে পাঠিয়ে “মাদ্রাসা প্রেমিক” সাজেন, তাঁদের পোশাকটি খুলে ফেলে চিনে নিক এই সকল প্রতারকদের। চিনে নিক সেই সকল প্রতারকদের, যারা “মাদ্রাসা প্রেমিক” সেজে আসলে মাদ্রাসার বাচ্চাদের বংশ পরম্পরায় মাদ্রাসায় বন্দী করে রাখতে চায়।

আমি জানি, সেদিন খুব দূরে নয়।

সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৬
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণপরিষদের সাথে বিএনপির সখ্যতার কারণ কি ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭


বিএনপির নেতাদের সাথে গণপরিষদের নেতাদের ঘন ঘন সাক্ষাতের বিষয়টি মিডিয়াতে প্রচারিত হচ্ছে।বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে যখন বিএনপি হাই কমান্ড থেকে পটুয়াখালী -৩(দশমিনা-গলাচিপা) আসনের নেতাকর্মীদের কাছে চিঠি দেয়া হয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫২



সুকান্তর একটা কবিতা আছে, দুর্মর।
"সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়:, জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।" মানুষের ভবিষ্যৎ বলা সহজ কিন্তু একটি দেশের ভবিষ্যৎ কি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২১

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

ট্রাম্প হচ্ছে একজন আপাদমস্তক বিজনেসম্যান। কমলা হ্যা্রিস যেহেতু ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত তাই ইন্ডিয়ান ভোটার টানার জন্য সে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে টেনে জাস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসকন

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭


INTERNATIONAL SOCIETY FOR KRISHNA CONSCIOUSNESS যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ISKCON এর বাংলা অর্থ হল আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ। যে সংঘের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় করে তোলার মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রকৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×