somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুক্তমনা ব্লগার
কেহ বিশ্বাস করে, কেহ করে না। যে বিশ্বাস করে সেও সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না, যে অবিশ্বাস করে সেও না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা নির্ভর করে মানুষের খুশির উপর। ধর্মান্ধতা নিপাত যাক, মুক্তচিন্তা মুক্তি পাক।

ছুঁয়ে দিলাম, মানুষ না হয়ে উঠার গল্প

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জন্ম আমাদের মুসলিম পরিবারে। তখন বয়েস আমাদের ৮-১০ বছর। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়ি ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছের হিন্দু বাড়িতে চাপাকল ছিল না। পুকুর ছিল ওদের। আমরা গাঁয়ের লোকেরা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে নেমে গোসল করতাম, সাঁতার কাটতাম, পানকৌড়ি-পানকৌড়ি খেলতাম ডুব দিয়ে দিয়ে। এছাড়াও পুকুরের পানিতে আমরা বাসনকোসন হাঁড়িপাতিল ধুতাম, কাপড় ধুতাম, সকাল-সন্ধ্যা হাত-মুখ-পা ধুতাম, মাছ মাংস আনাজপাতি ধুতাম, ভাত রান্না করার জন্য চাল ধুতাম। গরু গোসল করাতাম, গরুর জন্য মাঠ থেকে কচি ঘাস তুলে ধুতাম। সমস্ত রান্নাবান্না হতো পুকুরের পানিতে। কিন্তু পুকুরের পানি আমরা পান করতাম না। পান করতাম চাপাকলের পানি।

আমাদের প্রতিবেশী যে হিন্দু বাড়িতে চাপাকল ছিল না, ওরা আসতো আমাদের বাড়িতে চাপাকল থেকে পানীয় জল নিয়ে যেতে। আমাদের বয়েসী ছেলেমেয়েরাই আসতো বেশিরভাগ সময়। জল ভরে নিয়ে যেতে ওরা আনতো মাটির কলসী। কেউ বা আনতো এলুমিনিয়ামের কলসী, কেউ আনতো এলুমিনিয়ামের জগ। তখন আমরা ভালো মানুষের বেশ ধরে ওদের আশেপাশে গিয়ে দাঁড়াতাম, ঘুরঘুর করতাম ওদের কাছাকাছি বিশেষ উদ্দেশ্য মনে নিয়ে। ওরা চাপাকলের হাতল ধরে বানরের মতো ঝুলতে ঝুলতে চাপ দিতো। আর সেই বানর-ঝুলন্ত ছোট ছোট মানুষগুলির চাপে অল্প অল্প শীতল রূপালী জলের ধারা বেয়ে পড়তো ওদের পাত্রে। ওরা ঝুলতে থাকতো। আস্তে আস্তে জলে ভরে উঠতো ওদের পাত্র। ওরা নিজ নিজ জলভরা পাত্র ওদের কাঁখে তুলে নিতো। অমনি আমরা হুড়মুড়িয়ে পড়ি-মরি করে গিয়ে ওদের কাঁখে নেওয়া জলভরা পাত্রটি আমাদের হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিতাম। ছুঁয়ে দিসি, ছুঁয়ে দিসি বলে বনে বাদাড়ে দিতাম ছুট।

ওরা আঁৎকে উঠতো ওদের জলভরা পাত্রের গায়ে আমাদের হাতের মৃদু ছুঁয়ে দেওয়া দেখে। সমবেত করুণকণ্ঠে আর্তনাদ করে প্রতিবাদের ঝড় তুলতো, ছুঁয়ে দিলি! দিলি ছুঁয়ে! ছুঁয়ে দিলি আমাদের জলের পাত্র! এতক্ষণ ধরে এত কষ্ট করে বানরের মতো ঝুলে ঝুলে কল চেপে চেপে বিন্দু বিন্দু জল তুলে পাত্র ভরলাম বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই খাবো বলে। আর তোরা আমাদের এত বড় সর্বনাশ করলি? আমাদের পাকাধানে মই দিলি? আমাদের জলের পাত্রের উপরে হাত ছোঁয়ায়ে দিলি? হে ঈশ্বর, হে ভগবান!

ওরা কলসী উপুড় করে সব পানি ফেলে দিতো। সব পানি পড়ে যাবার পরেও কিছুক্ষণ খালি কলসীকে জোরেসোরে ঝাড়তে থাকতো যাতে আমাদের ছুঁয়ে দেওয়া কলসী থেকে জলের শেষ বিন্দুটিও ঝড়ে পড়ে যায়। তার পর কলসী ধুয়ে আবার কলের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে চাপ দিয়ে দিয়ে পানি তুলে কলসী ভরে নিতো। আমরা আবার এসে ভরা কলসীর উপরে একটু করে ছুঁয়ে দিয়ে দিতাম দৌড়। আবার শুরু হতো ওদের করুণ আর্তনাদ। আবার হতো একই দৃশ্য ও সংলাপের অবতারণা।

আমরা খিকখিক করে হেসে বলতাম, আমরা কলসীর উপরে একটু ছুঁলেই যদি সে পানি তোদের খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায় তাহলে আমাদের ছোঁয়া কল থেকে পানি নিয়ে খাস কীভাবে? কল তো আমরা সারাদিনই ছুঁই! এ বলে কল ছুঁয়ে দিতাম। ওরা বলতো, আরে ধুর পাগল কোথাকার! মুসলমানে কল ছুঁলে তো জল নষ্ট হয় না। জল নষ্ট হয় মুসলমানে জলের কলসী ছুঁলেই। আর জল তো কল থেকে আসে না, বোকারা! জল আসে মাটির নিচ থেকে। আমরা বলতাম, এই মাটির উপর দিয়ে তো আমরা দিনরাত হাঁটি। তখন নষ্ট হয় না পানি? ওরা বলতো, আরে না না, তোরা কিচ্ছু জানিস না। মুসলমানে মাটির উপর দিয়ে হাঁটলেও মাটির নিচের জল নষ্ট হয় না। নষ্ট হয় কেবল মুসলমানে জলের কলসী ছুঁয়ে দিলেই। কলসী আর মাটি কি এক জিনিস হলো? কল আর কলসী কি এক জিনিস হলো? আমরা বলতাম, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে মরলে তোরা দোজখে যাবি। মুসলমান হয়ে যা। ওরা বলতো, মুসলমানের সবাই যাবে নরকে। আমরা হিন্দুরা যাবো সগ্যে। এভাবে জলকেলি, দৃশ্য ও সংলাপ চলতো কয়েক দফা।

এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতো। আমরা ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত দিয়ে ঘরে ফিরে আসতাম। আমাদের খালি কলসীগুলিতেও পানি ভরে আনতে হবে যে। ওরা আবার জল ভরে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতো। আমরা আর ছুঁতাম না।

আমরা মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়া মানব-সন্তান। ওরা হিন্দুর ঘরে জন্ম নেওয়া মানব-সন্তান। দেখতে আমরা একই রকম। আমরা একই রকম কাপড় পরতাম। একই স্কুলে যেতাম। একই বাজার থেকে বাজার করতাম। বাস করতাম একই এলাকায়। একই আলো বাতাসে বেড়ে উঠছিলাম আমরা। ফুসফুসে টেনে নিচ্ছিলাম একই অক্সিজেন। কিন্তু আমাদের ছোঁয়া কলসীর পানিকে ওরা নষ্ট বলতো কেন? এক ধর্মের মানুষের ছোঁয়া আরেক ধর্মের মানুষের কাছে নষ্ট কেন? আমরাও কেন ওদের বারে বারে কষ্ট দিতাম ওদের ভরা কলসী ছুঁয়ে দিয়ে? বারবার ওদের কষ্ট আর্তনাদ ও রাগ দেখে আমরা কেন আনন্দ পেতাম? কেন এটা একটা আনন্দের খেলা ছিল আমাদের কাছে? কতই বা বয়েস ছিল আমাদের! ৮-১০ বছর। বয়েসের কারণেই কি? কিন্তু আমাদের বয়োজেষ্ঠরা জানতো আমাদের এই নিষ্টুর খেলার কথা। তারা তো আমাদের মানা করতো না এই সাম্প্রদায়িক খেলা খেলতে! বড়রাও কি মজা পেতো আমাদের ছোটদের এই সম্প্রদায়িক খেলায়?

ওরাও তো আমাদের মতোই ছোট ছিল। ওরা ওই বয়েসেই কীভাবে জানতো, কলসী মুসলমানে ছুঁয়ে দিলে সেই জল আর পানের যোগ্য থাকে না? ওদের বড়রাই তো ওদের এই শিক্ষা দিয়েছিল। শিখিয়েছিল বৈষম্য। ওদের শিশুমনের ভেতরে রোপন করেছিল সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজ। মানুষে-মানুষে বিভেদহীন মানবতার কথা আমাদের কিংবা ওদের শিশুমনে তো আমাদের কিংবা ওদের গুরুজনেরা কেউ কখনো বলেনি। ওদের বড়রা ওদেরকে শিখিয়েছিল, মুসলমানের ছোঁয়া খাওয়া যায় না। আমাদের বড়রা আমাদের শিখিয়েছিল, মুসলমান ছাড়া বাকি সব মানুষ মৃত্যুর পরে দোজখে যায়, সে যত ভালো মানুষই হোক না কেন। ওরা আর আমরা ছিলাম মানব-সন্তান। কিন্তু ওদের পিতামাতারা ওদের শিখিয়েছিল হিন্দু হতে। আর আমাদের পিতামাতারা আমাদের শিখিয়েছিল মুসলমান হতে। মানুষ হতে কারুরু পিতামাতাই শেখায় নি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:৫২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দীপনের দীপ নেভে না

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯


ছবিঃ সংগৃহীত
আজকে সামুর অন্ধকার ব্লগার নামে খ্যাত ফয়সাল আরেফিন দীপনের মৃত্যু দিবস। ২০১৫ সালে আজকের এই দিনে জঙ্গি হামলায় দীপন মারা যান নিজ প্রকাশনীর কার্যালয়ে । যে ছেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বজলুল হুদাকে জবাই করে হাসিনা : কর্নেল (অব.) এম এ হক

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৯

মেজর বজলুল হুদাকে শেখ হাসিনা জবাই করেছিলেন।

(ছবি ডিলিট করা হলো)

শেখ মুজিবকে হত্যার অপরাধে ২৮শে জানুয়ারী ২০১০ এ মেজর (অব.) বজলুল হুদা সহ মোট ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মি. চুপ্পুর পক্ষ নিয়েছে বিএনপি-জামাত; কারণ কী?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬


বিএনপি গত ১৬ বছর আম্লিগের এগুচ্ছ কেশও ছিড়তে পারেনি অথচ যখন ছাত্ররা গণহত্যাকারীদের হটিয়েছে তখন কেন বিএনপি চু্প্পুর পক্ষ নিচ্ছে? অনেকেই বলছে সাংবিধানিক শুন্যতা সৃষ্টি হবে তার সংগে বিএনপিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×