[ এটি একটি সিরিজ গল্প ]
(এই গল্পটি মূলত মোঃ বেলাল জোয়ার্দারের । আগে বেলাল জোয়ার্দারের একটু পরিচয় দেই । বেলাল জোয়ার্দার জমিদার বংশে জন্মেছিলেন আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে । তার দাদার দাদা ছিলেন এই বংশের সর্বশেষ জমিদার । জমিদার প্রথা এরপর বিলুপ্ত হয়ে গেল । কিন্তু এই বংশের লোকদের জমিদার ভাব এখনও রয়ে গেছে । তাছাড়া যেই বাড়িতে বেলাল জোয়ার্দার থাকেন সেটিও রাজবাড়ি । এই বাড়িও জমিদার আমল থেকেই দাড়িয়ে আছে । একটু পুরানো হয়ে গেলেও বাড়িটি এখনও বেশ শক্তপোক্ত হয়েই দাড়িয়ে আছে । জমিদার বংশ বলে গ্রামের সবাই এই বংশের লোকদের খুব সম্মান করে । বেলাল জোয়ার্দার বিয়ে করেছিলেন এই গ্রামেরই দর্জি মোহন শেখের মেয়ে, আঁখিকে । পুরো নাম জাহানারা শেখ আঁখি । বিয়ের পর অবশ্য নাম হয় জাহানারা জোয়ার্দার আঁখি । পত্নীসুখ বেশিদিন সহ্য হয়নি বেলাল জোয়ার্দারের । তাইতো বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় মারা যায় আঁখি । এরপর আর বিয়ে করেননি বেলাল জোয়ার্দার । অবশ্য বিয়ের দুই বছরের মাথায় একটি ছেলে হয়েছিল । নাম রেখেছিলেন মোঃ হাসান জোয়ার্দার । ছেলেটির বয়স এখন আটাশ বছর । তিন বছর আগেই চলে গেছে ইটালিতে । তার নাকি এ দেশে ভালো লাগে না । থাক, কি আর করার, তাই একটু টাকা-পয়সা খরচ করে পাঠিয়ে দেয়া হল বিদেশে । ছেলেটা অবশ্য ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছে । যাওয়ার আগে অবশ্য বিয়ে করেছে এই গ্রামেরই জালাল হোসেনের মেয়ে, সখিনাকে । বউকেও পরের বছর নিয়ে গেছে ইটালিতে । তারা দুজন সেখানে ভালোই আছে । এই হল পরিচয় । এবার শুরু করবো ঘটনা বলা । )
গল্পের শুরুর স্থান হল রাজধানী শহর, ঢাকা । বেলাল জোয়ার্দারের আপন কোন ভাইবোন নেই । তার বাবার সে একমাত্র সন্তান । কিন্তু তার দুই চাচার মোটমাট পাঁচজন ছেলে-মেয়ে ঢাকা শহরেই থাকে । অবশ্য সবাই বেলাল জোয়ার্দারের থেকে ছোট । তারা সবাই এখন ঢাকাতেই স্থায়ী । বেলাল জোয়ার্দার অবশ্য এসে উঠেছেন তার সবচেয়ে ছোট চাচাত ভাই করিম জোয়ার্দারের বাসায় । করিম জোয়ার্দার বেলাল জোয়ার্দারের থেকে বয়সে প্রায় পনের বছর ছোট । দুই ছেলে-মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার তার । বেলাল জোয়ার্দার এই প্রথম ঢাকাতে এলেন । এসেই উঠেছেন তার বাসায় এতে করিম জোয়ার্দার অনেক খুশি । তার বিয়েতেও তার এই বড় ভাই আসেনি । এই বড় ভাইটি তার অনেক প্রিয় । ছোট বেলা থেকেই করিম জোয়ার্দারের স্বপ্ন ছিল একদিন সে বেলাল জোয়ার্দারের মত হবে । সবাই তাকে দেখলেই সম্মান করবে । আসলে বেলাল জোয়ার্দারের স্বভাব-চরিত্রই এরকম । অনেকদিন পর দুই ভাইয়ের মধ্যে কথোপকথনঃ
- (প্রথমে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে) অনেক দিন পর আপনাকে দেখে কি যে ভালো লাগছে, ভাইয়া ।
বেচে থাক, বেচে থাক । হুম, তোদের কাছে আসতে হঠাৎ মন চাইল, তাই চলে এলাম ।
- ঠিকি করেছেন । থাকেন তো একা একা । আমাদের কাছে থাকলে থাকবেনও ভালো ।
আরে না, না, কই একা থাকি ? রুস্তম আছে না ? ও তো একাই যথেষ্ট আমার দেখাশুনা করার জন্য ।
- এসেছেন নিজের ইচ্ছায়, এখন যেতে পারবেন আমাদের ইচ্ছায় ।
আরে, না, না, বেশিদিন থাকবো না । তোদের কথা খুব করে মনে পড়লো । তাই আসলাম । চলে যাব অল্প কয়েকদিন পরেই ।
- না, না, তা হবে না । আপনার বউমা তো শুধু বলে আমি কেন আপনাকে নিয়ে আসি না ? বাচ্চাগুলার যদি এই স্কুল-কলেজের ঝামেলা না থাকতো তাইলে মনে হয় আমরা আপনার কাছে গিয়েই থাকতাম ।
কি বলিস এইসব ? তোরা আমার কাছে গিয়ে থাকবি কেন ? ঐটা তো বদ্ধ গ্রাম । ধূলা-বালি, কাদা, ময়লা, গোবর, খালি গন্ধ আর গন্ধ । তোরা শহরের মানুষ ওখানে বেড়াতে যাস, ওইটুকুই । থাকতে পারবি না । ঐটা আমাদের মত গ্রাম্য মানুষদের জন্য ।
- তা, আপনি যাই বলেন । আপনার কাছে থাকতে পারলে ঐসব কোন ব্যাপারই না । ভাইয়া, হাসানের খবর কি ? হাসান আর সখিনা কি ফোন দেয় ?
হুম, তা দেয় । গ্রামে কি আর ভালো নেটয়ার্ক পাওয়া যায় ? বাজারে গিয়ে কথা বলে আসতে হয় । প্রতি শনিবার আর রবিবার এক ঘণ্টা করে কথা হয় ওদের সাথে । গত সপ্তাহে আমি তোর নাম্বার দিয়েছি ওকে । এই সপ্তাহে তোর নাম্বারেই ফোন দিবে ।
- ভালো করেছেন, কাজের মত কাজ করেছেন । আপনার বউমার সাথে তো হাসানের কোনদিন কথাই হয়নি । এ যাত্রায় হবে । তাছাড়া বাচ্চাগুলাও যখন শুনেছে যে ওদের একজন কাকা বিদেশে থাকে তখন তারাও কাকার সাথে কথা বলতে চায় । ভালোই হবে । আচ্ছা, আপনি উঠেন । হাত-মুখ ধুয়ে আসেন । (রুস্তমের দিকে তাকিয়ে) এই তুইও যা, হাত-মুখ ধো । ভাইয়া তো আবার তোকে ছাড়া খায় না । একসাথেই খাবার দিচ্ছি ।
বেলাল জোয়ার্দার ভাইয়ের কথা শুনে হাসতে লাগলেন । আসলেই কোনদিন তিনি মুখ ফুটে না বললেও তার এই ভাইটি তার কাছে অনেক প্রিয় । নিজের আপন কেউও হয়তো এত প্রিয় হত না । ওদিকে আবার তিনি রুস্তমের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেও হাসছে । অনেক তৃপ্তির সেই হাসি । যেন গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ শহরের মানুষের কাছে সম্মানটুকু আদায় করে নিয়েছে ।
(চলবে)