somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি মর্মস্পর্শী বাস্তবতা

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কয়েকদিন ধরেই বস্তিতে কিছু অপরিচিত লোকদের দেখা যাচ্ছে । বিষয়টি ভালো নয় অবশ্যই । এই খবর কুলসুম জানতে পেরেছে আবুলের কাছ থেকে । আবুল এই বস্তির একমাত্র চায়ের দোকানদার । মানে হল বস্তির এক কোনায় রাস্তার মোড়ে আবুলের একটি চায়ের দোকান আছে । এলাকার মুরব্বি থেকে শুরু করে ছেলে-ছোকরারা সেখানেই বিড়ি-সিগারেট আর চা খায় । বস্তির আবার একটি সুন্দর নামও আছে । হাসনাহেনা বস্তি । কিন্তু এই নাম তেমন পরিচিত নয় । সবাই বলে উত্তর পাড়ার বস্তি । এই নামেই বেশ পরিচিত এই বস্তিটি ।
এই বস্তিতেই কুলসুম আছে আজ প্রায় পাঁচ বছর হল । কুলসুমের স্বামী নেই । না, মরেনি । কিন্তু মরার চেয়েও খারাপ কাজ করেছে সে । প্রথম যখন এই বস্তিতে এসে উঠে কুলসুম, তার স্বামী আর তাদের ছয় সন্তান, এগার বছরের ছেলে স্বাধীন, দশ বছরের মেয়ে জয়া, আট বছরের ছেলে বেলাল, পাঁচ বছরের ছেলে বাধন, দুই বছরের মেয়ে রিতু, দুই মাসের কোলের মেয়ে হিরা তার ঠিক কয়েক মাসের মাথাতেই পাশের ঘরের মর্জিনার সাথে পালিয়ে যায় ঐ লোক । মর্জিনারও স্বামী ছিল । সেও ছিল হারামী । সারাদিন মদ খেয়ে জুয়া খেলে এসে মর্জিনাকে খুব মারত । এমনিতে সুন্দর দেখতে মেয়েটা স্বামীর ভয়ে সবসময় কাচুমাচু হয়েই থাকত । দেখলে সবসময় কুলসুমের মায়াই লাগত । আসলেই অনেক মায়াবী চেহারা ছিল মেয়েটার । তাই তার স্বামী ঐ মেয়েটাকে নিয়ে যখন পালিয়ে গেল, কুলসুম এই কথা যখন জানতে পারল কেন জানি সে বেশি একটা রাগ করেনি । তার স্বামীর উপরেও না । কিন্তু কুলসুমের স্বামীর মধ্যে কোন খারাপ গুণ ছিল না । কুলসুম তখন এক গার্মেন্টেসে কাজ করত । কারণ তার স্বামী সবসময় ঘরেই থাকত । ছেলেমেয়েগুলাকে দেখাশুনা করত । স্বামী চলে যাওয়ার পর কুলসুম গার্মেন্টেসের কাজ ছেড়ে দিল । তারপর সে আশেপাশের বাসায় বুয়ার কাজ নিল । তার ছোটবোন মারিয়াকে সে তার কাছে নিয়ে এসে রেখেছে বাচ্চাগুলার দেখাশুনার করার জন্য । এর মধ্যে অবশ্য স্বাধীনটা খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে মিশে এত খারাপ হয়ে গেল যে গতবছরই ঘর থেকে বেরিয়ে আর কোনদিন ঘরে ফেরেনি । কেউই জানে না ও কোথায় ? ওর সাথে যারা মিশত তারাও নাকি জানে না । কুলসুম তাই অনেক চেষ্ঠা করেও স্বাধীনকে খুজে পাইনি । জয়ার বিয়ে হয়ে গেছে তিন মাস আগেই । ওর স্বামী রিকশাওয়ালা । তারা কিছুদূরেই আরেকটি বস্তিতে থাকে । গোলামের বস্তিতে । তাই এখন বাসায় কুলসুম, কুলসুমের বোন আর কুলসুমের চার সন্তান । এর মধ্যে রিতু আর হিরা পাশের এক প্রাইমারী স্কুলে যায় । বেলাল আর বাধন দুই ভাই সকালে ফুল কুড়িয়ে তা দিয়ে মালা বানিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করে । তারা প্রাইমারীর গণ্ডি পার হয়েছে । গরীবের ছেলে-মেয়ের বেশি পড়ার দরকার কি ।
সবাই বলাবলি করছে এই লোকগুলার উদ্দেশ্য কি । কেউই ঠিকমতো ঠাউর করতে পারেনা । যাক, গরীবের পেট চালাতে গেলে এতদিকে খেয়াল করতে নেই । তাদের এত সময়ও নেই । ঠিক, কুলসুমেরও নেই । তাই তো কয়েকদিন এই ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে বস্তির লোকজন সবকিছু ভুলে গেল । তবে এতকিছুর মধ্যেও লোকগুলার বস্তির মধ্যে যাতায়াত কিন্তু থেমে নেই । তারা যে এই বস্তির কেউ, তা কিন্তু নয় । তারা আসে বস্তির মতিনের কাছে । মতিনকে এই বস্তির কেউই পছন্দ করেনা । সে এই বস্তিতে আছে তিন বছর । সবাই যখন জানতে পারল হারামীটা গাজা, হেরোইন ইত্যাদি বিক্রি করে তখন বস্তির সকলেই মতিনকে এড়িয়ে চলত । কেউই মতিনের সাথে কথা বলেনা । তবে মতিনের কাছে সবসময় একই লোক আসে না । আজ এ এল তো কাল ও । তবুও বস্তির লোকজন মতিনকে এ ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করেনা ।
হঠাৎ একদিন কুলসুমের গা কাপিয়ে জ্বর এল । সে ভীষণ সাঙ্ঘাতিক জ্বর । এই জ্বর কুলসুমকে একেবারে বিছানায় শুয়ে দিল । এক কুলসুমের আয়েই এই সংসার চলত । এখন এই জ্বরের কারণে কুলসুম কাজেও যেতে পারছে না । এভাবে প্রায় দশ-পনেরদিন হয়ে গেল । তবুও জ্বর নামে না । কুলসুমের বদলে যে মারিয়া কাজে যাবে, সেটাও সম্ভব না । কারণ মারিয়ার এক হাত নেই । তাছাড়া মারিয়ার শুচিবায়ুর সমস্যা । বেলাল আর বাধন ফুলের মালা বিক্রি করে খুব কম টাকাই কামায় । এর মধ্যে কুলসুমকে আশেপাশের ঘরের কয়েকজন মহিলা মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল । ডাক্তার বলেছে কি নাকি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের কারণে জ্বর । কুলসুম এগুলার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝেনা । ওর খালি চিন্তা বাচ্চাগুলাকে কিভাবে খাওয়াবে । এভাবে প্রায় একমাস কেটে গেল । কুলসুম মোট চার বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করত । তার দীর্ঘ অনুপস্তিতির কারণে তার এই চার বাসা থেকে নতুন বুয়া রেখে দিল । তাই কুলসুম বেকার হয়ে গেল । জমিয়ে রাখা অল্প কিছু টাকাও প্রায় শেষের দিকে । এখন কি করা যায় । একদিন বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ মতিন আসল কুলসুমের বাসায় কুলসুমকে দেখতে । কুলসুম মতিনকে দেখে বেশ অবাক হল । মতিন কুলসুমকে দেখে সান্ত্বনা দিল এবং তার দুরাবস্থা দেখে তাকে এক বুদ্ধি দিল । কুলসুম তা ভেবে দেখবে বলে মতিনকে চলে যেতে বলল । মতিন হাসতে হাসতে কুলসুমের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।
এর দুইদিন পর বাধন আর রিতুকে কুলসুম অসুস্থ শরীরে মতিনের বাসায় দিয়ে আসল । কথা ছিল তাদের দুইজনার বিনিময়ে মতিন তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিবে আর পাঁচ কেজি চাল দিবে । তবে কুলসুম যদি এই টাকা আর চাল তিন মাসের মধ্যে মতিনকে ফেরৎ দিতে পারে তাহলেই শুধু বাধন আর রিতুকে সে ফিরিয়ে নিতে পারে । কুলসুম অনেকটাই বাধ্য হয়েই এই কঠিন কাজটি করল । সে ভাবল তিন মাসের আগেই তো সে সুস্থ হয়ে যাবে । তখন সে অনায়াসেই তাদের দুইজনকে ফিরিয়ে আনতে পারবে । আর এই মুহূর্তে বাকিদের অবস্থাও তাকে দেখতে হবে । তবে আরেকটি শর্ত এই তিনমাস কুলসুম তার দুই সন্তানের সাথে দেখা করতে পারবে না ।
ঠিক, তিনমাসের মধ্যে কুলসুম অনেকটাই সুস্থ হল । তার আগের তিন কর্তার কাছ থেকে সবমিলিয়ে সাত হাজার টাকা ধার নিয়ে এসে যখন সে মতিনের ঘরের সামনে আসল তখন সে দেখল সেটি তালা মারা । তার পিলা হঠাৎ চমকিয়ে উঠল । আশেপাশে জিজ্ঞেস করে যখন কুলসুম জানতে পারল যে মতিন আরও দুইমাস আগেই সকল ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এই ঘর ছেড়ে দিয়েছে তখন তার আর হারানোর কিছুই বাকি নেই ।
এরপরের সব ঘটনা খুব মর্মস্পর্শী । দুই সন্তানকে হারিয়ে কুলসুম এখন পাগল হয়ে গেছে । বেলাল বস্তির পাশের এক গাড়ির গ্যারেজে কাজ নিয়েছে । সেই সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে । হিরাকে আর তার মাকে দেখাশুনা করে তার খালা মারিয়া । বেলাল জানে তার দুই ভাইবোন কোনদিন ফিরে আসবে না । সে আর কোনদিন তাদের দেখতে পাবে না । সে তাই মাঝে মাঝেই কাঁদে, নীরবে, একাকী । সেদিন সে যদি বুঝতে পারত এমন কিছু হতে পারে তাহলে সে কোনদিন এমন কিছু হতে দিত না ।

সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প বলেছে, বাংলাদেশ পুরোপুরি এনার্খীতে, তারা মাইনোরিটির উপর অত্যাচার করছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৬



৩ দিন পরে আমেকিকার ভোট, সাড়ে ৬ কোটী মানুষ ভোট দিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে; ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৫১ ভাগ। এই অবস্হায় সনাতনীদের দেওয়ালী উপক্ষে ট্রাম্প টুউট করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

×