নতুন কোন ওষুধ বাজারে আনতে ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে হয়। তবে প্রথম পরীক্ষা করা হয় অন্য প্রাণীর উপর। একটি ক্ষুদে প্রাণির উপর করা পরীক্ষা সফল হলেই তা মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়। কন্তু তা কাজ করে কি কারণে? ওখানেই ভূমিকা রাখছে বিবর্তনবাদ। মানুষ অন্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা কিছু নয়। তারা একই ধরনের কোষ দিয়ে গঠিত ও জীবন প্রণালী একই রকম বলেই এক প্রাণির উপর পরীক্ষায় সফল হওয়া ওষুধ প্রয়োগ করতে পারছে অন্য প্রাণীর উপর। বানর, গিনিপিগ, ইঁদুর, জেব্রা ফিস ও ব্যাঙের উপরই বেশি পরীক্ষা চালানো হয়।
বানরঃ
মার্কিন কোম্পানী নোভাভ্যাক্স টিকা আবিষ্কারের জন্য ১২ টি বানরের উপর দুই ডোজ টিকা দেযার পর তাদের উপর করোনাভাইরাস সংক্রমণ করে। এতে ১১টি বানরের শরীরে কোনরূপ উপসর্গ দেখা দেয়নি। একটি বানরকে অল্প পরিমাণে ডোজ দেয়া হয়েছিল।ওটির ফুসফুসে করোনাভাইরাস সামান্য দেখা যায়। তার দুই দিন জরের মতো হয়েছিল। এই সফলতার পরেই তারা ১৩১ জন মানুষের উপর ২ ডোজ করে টিকা প্রয়োগ করে সফলতা পায়। শেষে পরীক্ষা শুরু করে ৩০ হাজার মানুষের উপর। সেই সফলতার পরেই টিকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। ইবোলা ভাইরাসের ওষুধও প্রথম বানরের উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। বানর ক্লোন করেছে চীন। ক্লোন বানরের মধ্যে ক্যান্সার, ডায়াবেটিকসসহ বিভিন্ন জিনগত ত্রুটি গবেষণা ও নিরাময়ের কাজের লাগানো হবে। তাদের একটি পরীক্ষাগারে মানব বানরের হাইব্রিডও করা হয়েছে। এখান থেকে অঙ্গ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। বানরের ভ্রুণে মানব দেহের যেকোন ধরনের টিস্যু তৈরি করা সম্ভব। বানরের সাথে মানুষের জিনের ৯৫% মিল রয়েছে। ফলে পরীক্ষা চালানোর জন্য বানর খুবই উপযোগী। কিন্তু বানরের উপর পরীক্ষা চালানো সহজ নয়। এদের সংখ্যাও সীমিত। এটির জন্য অনুমোদন নিতে হয় বিভিন্ন বিভাগ থেকে। প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে যারা কাজ করে তাদের আপত্তি রয়েছে।
গিনিপিগঃ ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য বা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দূর করতে পরীক্ষাগারে গিনিপিগের ব্যবহার হয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। মানুষের শরীরে প্রয়োগের আগে তা প্রয়োগ করা হতো গিনিপিগের উপর। জীবাণু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রাণীটি। লুই পাস্তুরসহ বহু বিজ্ঞানী গিনিপিগ ব্যবহার করেছেন। এজন্যই এখনো মানুষের উপর কোন কিছু প্রয়োগ করলে তা গিনিপিগের সাথে তুলনা করা হয়। বলা হয় মানুষকে গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। তবে এজন্য গিনিপিগের আলাদাভাবে চাষ করা হয় এবং উৎপন্ন গিনিপিগ পরীক্ষাগারের জন্যই বিক্রি করা হয়। মহাকাশ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাতেও এর ভূমিকা রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পূটনিক-৯ এ এবং চীন ১৯৯০ সালে যাত্রী হিসেবে মহাকাশে গিনিপিগকে পাঠিয়েছিলে। ১৯৬০ এর দশকে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারেই ২৫ লক্ষ গিনিপিগ ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রথম মহাকাশ ভ্রমণকারী লাইকা নামের সেই কুকুরটির কথাও আমাদের মনে আছে।
ইঁদুরঃ ইঁদুর ও মানুষের শারীরিক প্রক্রিয়াগুলো প্রায় একই রকমভাবে পরিচালিত হয়। তাই পরীক্ষাগারে ইঁদুরের উপরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করা হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। জৈব পরীক্ষার জন্য জীবিত প্রাণির প্রয়োজন হয়। শিম্পাজী, গরু-ছাগল ইত্যাদির চেয়ে ইঁদুর ছোট বলে অপেক্ষাকৃত সহজে পরিচালনা করা যায়। এছাড়া ইঁদুর সাপ-বিড়াল-সিংহ ইত্যাদির তুলনায় নিরীহ প্রাণি। অপরিসীম প্রজনন ক্ষমতা থাকায় খুব কম সময়েই বিভিন্ন জেনারেশনের উপর পরীক্ষা চালানো যায়। মানুষের সাথে ইঁদুরের ৯০% জিনের মিল রয়েছে। এজন্য মানুষের বিভিন্ন প্রকার জিনের মিথস্ক্রিয়ার প্রকৃতির পরীক্ষার জন্য মানুষেরই ভাল প্রতিনিধিত্ব করে ইঁদুর। ওষুধের প্রভাব নির্ণয় করেতে হয়। এদের নির্দিষ্ট জিনকে বন্ধ করে বা খুলে রেখে পর্যবেক্ষণ করা যায়। কিভাবে নির্দিষ্ট জিন নির্দিষ্ট রোগের জন্য দায়ী তা নির্ণয়ে ইঁদুর ভূমিকা রাখে। বাইরে থেকে ডিএনএ এদের শরীরে প্রবেশ করানোর পরে প্রজনন করানো হয় পরীক্ষার জন্য। মানুষের যন্ত্রণাদায়ক রোগের র্যাপিং মডেল তৈরিতেও ইঁদুরের সাহায্য নেয়া হয়।
জেব্রা ফিসঃ
বাংলায় এ মাছটিকে অঞ্জু মাছ বলে। তাদের শরীরে অনেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গই মানুষের মতো। তাই সামপ্রতিক সময়ে রোগীকে কোন ওষুধ দিবেন তা আগে জেব্রা ফিসের উপরই প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া জানা যায় দ্রুত। কোন রোগীকে ঠিক কোন ওষুধ দেয়া যেতে পারে তাও জেব্রাফিসের উপর গবেষণা করে জেনে নেয়া যায়। ইঁদুরের বা গিনিপিগের উপর পরীক্ষা চালানোর জন্য বিরাট আয়োজন লাগে, অনেক জায়গা ও বিপুল খরচ করতে হয়। ছোট একটি একুরিয়ামেই প্রচুর জেব্রা ফিস রাখা যায়। ইঁদুর বা বানরের উপর পরীক্ষা চালাতে গেলে অনেক নিয়ম কানুন মানতে হয় এবং এথিকসের প্রশ্ন উঠে। শুধু ভারতেই এখন ৪০টি গবেষণাগারে জেব্রা ফিস ব্যবহৃত হচ্ছে। জেব্রা ফিসের রোগ প্রতিরোধও অনেকটাই মানব শরীরের মতো। তাদের শ্বাসযন্ত্র না থাকলেও যকৃৎ, হৃদপিণ্ড রয়েছে। জেব্রা ফিসের ভ্রুণ বাইরে বিকশিত হওয়ায় তা বাইরে থেকেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। কোন রোগীর দেহে টিউমার পাওয়া গেলে তা থেকে কোষ সংগ্রহ করে জেব্রা ফিসের মধ্যে প্রবেশ করালে ৩/৪ দিনের মধ্যেই মাছের মধ্যেও টিউমার দেখা দেয়। কোন ওষুধ বেশি কার্যকর তা এই মাছের উপর পরীক্ষা করেই রোগীর উপর প্রয়োগ করা হয়। ক্যান্সার চিকিৎসাতেও এই মাছ ব্যবহার করা হচ্ছে।
ব্যাঙঃ
স্কুল পরীক্ষাগারে ব্যাঙের প্রচলন ব্যাপক। জীববিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই মাধ্যমিকে ব্যাঙ কেটে তার পৌস্ট্রিকতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ব্যাঙ কাটতে হয়। আমি প্রথম যে ব্যাঙটি কেটেছিলাম তার পেট সেলাই করে ছেড়ে দিয়েছিলাম। বেঁচেছিল কিনা জানি না। সম্প্রতি চীন ব্যাঙ নিধন বন্ধ করতে প্লাস্টিকের ব্যাঙ ব্যবহার শুরু করেছে। তাতে লক্ষ লক্ষ ব্যাঙ রক্ষা পাবে। ব্যাঙ মেরুদণ্ডী প্রাণী বলে এর উপরও বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায় চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। জেনোপস নামের এক ধরনের ব্যাঙের সাহায্যে আগে নারীদের প্রেগনেন্সি পরীক্ষা করা হতো। ওই প্রজাতির ব্যাঙের চামড়ার নিচে ইনজেকশন দিয়ে নারীর মূত্র ঢুকিয়ে দেয়া হতো। সেটি যদি ওই মূত্রের প্রভাবে ৫-১২ ঘণ্টার মধ্যে ডিম পারতো তাহলেই নিশ্চিত হওয়া যেতো ওই নারী গর্ভবতী। নারী ব্যাঙের প্রজননে ভূমিকা রাখছে মানবী নারীর প্রজনন! কেন মিলে গেল? কিভাবে সম্ভব? ওই বিবর্তনবাদ দিয়েই শুধু ব্যাখ্যা করা যায়।