অনেকেই ভাববেন- বলে বসবো এর কারণও বিবর্তন বাদ। আসলেই তাই। আমার ভাগ্নে ডা. জাহিদ বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় এইডস গবেষক ও চিকিৎসক। তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য জেনেছি। বাংলাদেশে তালিকাভূক্ত এইডস রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। এরমধ্যে প্রায় দেড় হাজার রোগী মৃত্যুবরণ করেছে। সারা বিশ্বে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি এই রোগে এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যাও প্রায় চার কোটি! প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশিও হতে পারে। তবে রোগীর মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগ রোগীই চিকিৎসার আওতায় নেই। প্রতিবছর আনুমানিক ১৮ লক্ষ নতুন এইচআইভি সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। বিজ্ঞানীরা ১৯৮০ সালে প্রথম এইডসের (AIDS) সম্পর্কে জানতে পারেন। ভয়ঙ্কর এই রোগ সম্পর্কে জানার পর পেরিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ ৪০ বছর। কিন্তু এখনও বিশ্বের কোনও দেশই এর প্রতিষেধক তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু কেন ৪০ বছর পরেও এইডসের প্রতিষেধক আবিস্কার করতে পারছে না বিজ্ঞানীরা?
এইচআইভি-১ ভাইরাসটি দক্ষিণ ক্যামেরুনে সিআইভি (সিপিজি) নামক ভাইরাসের বিবর্তনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছে। সিআইভি হল "বানরজাতীয় প্রাণীর প্রতিরক্ষা অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস", যা বন্য শিম্পাঞ্জিকে সংক্রামিত করে। ভাইরাসটি নিজে যেমন এসেছে বিবর্তনের মাধ্যমে তেমনি নিজেও বারবার বিবর্তিত হতে পারে। যে কোনও প্রতিষেধক তৈরির পর সেটি মানব শরীরে প্রয়োগের আগে কোনও সমতুল্য ডিনএ-গঠনযুক্ত প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করে দেখা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এইডসের প্রতিষেধক তৈরির ক্ষেত্রে এমন কোনও প্রাণীর মডেল নেই, যার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন মানুষের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। এইডসের (AIDS) ভাইরাস অত্যন্ত দ্রুত তার চরিত্র ও গঠনে পরিবর্তন ঘটায়। ফলে কোনও নির্দিষ্ট চরিত্র ও গঠন অনুযায়ী তৈরি প্রতিষেধক এই ভাইরাসকে রুখতে পারে না। তাই দীর্ঘ ৪০ বছর পরেও এইডসের (AIDS) প্রতিষেধক তৈরি করে উঠতে পারেননি বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীরা। এইচআইভি এমন একটি ভাইরাস যেটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয় এবং জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে মানবদেহকে প্রতিরোধহীন করে নিরাময়হীন অবস্থায় নিয়ে যায়। HIV ভাইরাস মানুষের শরীরের টি-সহায়ক কোষগুলিকে (T-helper cell) আক্রমণ করে যেগুলি শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্যে অতীব প্রয়োজনীয়। HIV ভাইরাস কোনরকম লক্ষণ ছাড়াই ১০ বছর পর্যন্ত মানুষের শরীরে নিরবে বাস করতে পারে।
একবার সংক্রামক HIV (মানব প্রতিরক্ষা অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস) শরীরে ঢুকলে তাকে পুরোপুরি দূর করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, তাই HIV সংক্রমণ হলে এইডস প্রায় অনিবার্য। তবে বিনা চিকিৎসায় এইডস পর্যায়ে পৌঁছতে যদি লাগে গড়ে দশ বছর, তবে চিকিৎসার দ্বারা তাকে আরো কিছু বছর পিছিয়ে দেওয়া যায়। চিকিৎসাও খুবই ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে এখনো বিদেশি সাহায্যে বিনা পয়সাতেই ওষুধ দেয়া হচ্ছে। এইচআইভি'র চিকিৎসায় নানাবিধ অগ্রগতি হলেও এই ভাইরাসের নিশ্চিত প্রতিষেধক এখনও মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। এইচআইভি ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করার পর দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকতে পারে, যা এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরীর পেছনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে করা হয়। এই প্রতিষেধক নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানব শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে, এমন কোনও প্রতিষেধকই এইডসের (AIDS) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। রোগীর শরীরে রোগ প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তৈরি করে প্রতিষেধক কেবল এই ভাইরাসের সংক্রমণের গতি কমিয়ে দেয়, কিন্তু এটিকে থামাতে পারে না। HIV সংক্রমণের পরে রোগীর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়ে। HIV-তে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে কোনও রকম প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করে না বলে বিজ্ঞানীরা প্রতিষেধকের সাহায্যে শরীরে অ্যান্টিবডির সংখ্যা বা শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে না। HIV এমন ধরনের ভাইরাস যা দীর্ঘদিন কোনও রকম উপসর্গ ছাড়াই আক্রান্তের শরীরে লুকিয়ে থাকতে পারে, বাড়তে থাকে। ফলে ডিএনএ-তে লুকানো ভাইরাস খুঁজে পাওয়া এবং সেটিকে ধ্বংস করা শরীরের অ্যান্টিবডির পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও এই ভাইরাসকে দমন করার ক্ষেত্রে একই রকম সমস্যা হয়। অনেক ক্ষেত্রে শরীরে বাসা বাঁধা দুর্বল ভাইরাসকে কাজে লাগিয়ে, তার ডিএনএ-র গঠন বিশ্লেষণ করে প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু HIV-এর এর ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয়নি। তাছাড়া, অধিকাংশ প্রতিষেধক মানুষের শ্বাসযন্ত্র এবং অন্ত্রের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল হয়। কিন্তু HIV মানুষের যৌনাঙ্গ ও রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে দ্রুত সংক্রমিত হয়। ফলে একে রোখা বেশ মুশকিল।
এইডস রোগের উৎপত্তি ও এর ভ্যাকসিন আবিস্কার করতে না পারার ব্যাখ্যা শুধুমাত্র বিবর্তন দিয়েই দেয়া সম্ভব। এরপরও উন্নত দেশের কিছু মানুষ এবং দরিদ্র দেশের সিংহভাগ মানুষ বিবর্তনবাদকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে কিছু না বুঝেই।