তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, শুধুমাত্র একটা এলাকার মুভি দেখা কোনো কাজের কথা নয়, দেখার মত করে দেখতে হলে সব দেশীয় মুভিই দেখতে হবে, হলিউডি মুভিও তার মধ্যে একটা। তারই ধারাবাহিকতায় দেখলাম মুভি The Pianist. সত্যি করে বলি, প্রথমবার দেখে খুব ভালো লেগেছিলো কিন্তু ভেবেছিলাম, একবার দেখেছি এই যথেষ্ট, এত কষ্টের মুভি ২য়বার আর দেখবো না।
বড় ক্লান্ত ছিলাম সেদিন। অফিস সেরে, ক্লাস করে, ৬ নম্বর বাসের ধাক্কা খেয়ে বাসায় ফিরে কোনো রকমে স্নান করে খেয়ে আমার তখন মরার মত অবস্থা। মনটাও ভালো ছিলো না। শ্রান্ত অবসন্ন দেহে যখন মুভি ছেড়ে দিয়ে বসলাম তখন নড়াচড়া করার মত শক্তিও নেই আর।
তারপর শুরু হলো মুভি। প্রথমত: এটা ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এবং দ্বিতীয়ত: সত্যঘটনা অবলম্বনে তৈরী। এ ধরণের মুভি দেখতে কিছুটা হলেও মানসিক শক্তি প্রয়োজন। প্রথম ৪০-৪৫ মিনিট দেখে মন খুবই খারাপ হয়ে গেলো। পোল্যান্ড নিবাসী স্পিলম্যান, একজন মেধাবী কিন্তু নিরীহ পিয়ানোবাদক, তার বাবা-মা আর তারা ৪টি ভাইবোন ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় যখন জার্মান নাজি বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে, কারণ একে তো তারা পোলিশ, এবং তারচেয়েও বড় কথা তারা ইহুদী। হাতে নীলরঙা তারা চিহ্নিত এমব্লেম পরে (এভাবে ইহুদীদের কে সনাক্ত করা হতো) শুরু হলো তাদের অনিশ্চিত জীবন। অশেষ বঞ্চনা ও নির্যাতনের এক পর্যায়ে এসে স্পিলম্যান তার মা-বাবা-ভাইবোনের কাছ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে কারণ একজন ইহুদী পুলিশ অফিসার তাকে বাঁচিয়ে দেয়, আর বাকি সবাইকে নাজিরা হত্যা করার জন্য এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
বিছিন্ন হয়ে কিছুদিন তাকে কাজ করতে হলো জার্মান ঘেটো ক্যাম্পে। সেখানে অমানুষিক পরিশ্রম আছে, খাবার আছে এবং সেই একই নির্যাতন ও নিপীড়ন, বিনা অপরাধে কুকুরের মত গুলি করে হত্যা। পালিয়ে গিয়ে পুরনো পরিচিতদের কাছে সে আশ্রয় নিলো, তারাও যথাসাধ্য চেষ্টা করলো তাকে থাকার জায়গা দেবার। সেসব জায়গায় কেউ এসে তাকে খাবার দিয়ে যেতো, নইলে না খেয়ে থাকতে হতো। একবার সে ধরা পড়ে গেলো এক প্রতিবেশী জার্মান মহিলার হাতে, তারপর কোনোমতে পালিয়ে বাঁচলো। এভাবে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতেই সে দেখা পেয়ে গেলো তার সেই পুরনো বান্ধবীর, যে মেয়েটি একসময় চেলো বাজাতো, এখন সে একজন অভিনেতার স্ত্রী এবং অন্তসত্ত্বা। অভিনেতা স্বামীটি খুব ভালো লোক, তারা ২জন মিলে তাকে অন্য একটা অপরিচিত বাসায় আত্মগোপন করে থাকার জায়গা দিলো। এখানেও সেই একই সমস্যা, দিনের পর দিন কেটে যায়, কেউ খাবার দিতে আসে না, সে নিজেও বেরোতে পারে না। ভয়াবহ ক্ষুধায় সে মরোমরো হয়ে রইলো কতদিন, জন্ডিস হয়ে গেলো তার। একেবারে মৃত্যুর আগ মুহুর্তে এসে মেয়েটি তাকে খাবার দিলো, ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করলো। তারপর একসময় যখন রাশিয়ানরা জার্মানদের আক্রমণ করলো তখন বোম্বিং হয়ে সেই বাড়িটাও গেলো ধ্বসে।
আবার শুরু হলো বেঁচে থাকার তাড়না, পালিয়ে বেড়ানো জীবন। চারিদিকে তখন শুধু ধ্বংসস্তুপ আর লাশ। একমুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে ভগ্নপ্রায় শরীরে একটা বাড়িতে ঢুকে বহুকষ্টে একটা খাবারের ক্যান খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে সে অনুভব করলো, তার ঠিক সামনে একজন জলজ্যান্ত জার্মান সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে।
জার্মান সৈন্যটি কিন্তু চাইলেই তাকে বিনাবাক্য ব্যয়ে হত্যা করতে পারতো। কিন্তু তা সে করেনি। সে পিয়ানোবাদক জেনে সৈন্যটি কেবল তাকে একটু পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতে বলেছিলো। তার হাতের অসাধারণ বাজনা শুনে সৈন্যটি তাকে অনেকদিন পর্যন্ত সেখানেই থাকার আশ্রয় দেয়, খাবার এনে দেয়, চলে যাবার সময় তার গায়ের গরম কোটটি পর্যন্ত খুলে দেয়। তারপর যুদ্ধশেষে এই বেচারা পিয়ানোবাদক স্পিলম্যান স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, আবার আগের মত পোলিশ রেডিওতে পিয়ানো বাজানো শুরু করে, আর সেই সৈন্যটি, যে তাকে জীবন ভিক্ষা দিয়েছিলো, সেই হতভাগ্য কয়েক বছর পর একটা সোভিয়েত ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। রাশিয়ানদের হাতে ধরা পড়ার পর সে একজন পোলিশ লোকের কাছে নায়কের নাম করে তার সাহায্য চেয়েছিলো, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে............
চলচ্চিত্র মাত্রেই সময়ের কথা বলে। এই মুভিটিও তার ব্যতিক্রম নয়। দেখার বিষয় কেবল একটাই, তা হলো, এই কথাটা কিভাবে বলা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছানো যাচ্ছে কিনা বা তারা সেটা অনুধাবন করতে পারছে কিনা। মেকিং, পরিচালনা এবং অভিনয়ের কারণে ছবিটি দেখার সময় আপনার একবারও মনে হবে না যে আপনি বর্তমান সময়ে আছেন, ছবিটি নিজ গুণেই আপনাকে সেই সময়ে টেনে নিয়ে যাবে। জীবনের কাছে মানুষ যে কতটা জিম্মি, যুদ্ধ যে মানুষের জীবনকে কতদুর বিপর্যস্ত করতে পারে এবং যুদ্ধ যে মানবতার বিরূদ্ধে কতবড় অভিশাপ, এই মুভিটি না দেখলে তা বোঝা সম্ভব নয়। একদিকে মানুষের অসহায়ত্ব, অন্যদিকে মানুষের নিষ্ঠুরতা যেমন আপনাকে কাঁদাবে, মানুষের মহত্ত্ব তেমনি আপনার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলবে।
আমি বোধহয় প্রথমবার দেখে বুঝতে পারিনি যে মুভিটি আমার ঠিক কতখানি ভালো লেগেছে, তাই বোকার মত ভেবেছিলাম আর দেখবো না। অথচ পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো, রোমান পোলানস্কির মুভি, এত ভালো মুভি মাত্র একবার দেখলাম? নাহ... আবার দেখতে হবে, বারবার দেখতে হবে, ১০০ বার দেখতে হবে.............
যতই দেখি, ততই প্রেমে পড়ে যাই।

....................................................................................
[অতিরিক্ত দীর্ঘ লেখার জন্য খুবই আন্তরিকভাবে দু:খ প্রকাশ করছি। এই ব্লগে অনেক বড় বড় মুভি বোদ্ধা আছেন, আমার দেখার এবং জানার পরিধি তাদের তুলনায় অত্যন্তই সীমিত।]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৫:৪২