আমার গ্রামের নাম দূর্গাপুর। গ্রামটি বানিয়াচং উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। গ্রামে প্রায় ২ হাজার লোকের বসবাস। ১৯৯৭ সাল, আমি তখন ক্লাস টু’তে পড়ি। তখন গ্রামের মানুষ রক্ষণশীল ছিল। বাড়িতে TV আনতে দিত না । ছোটদের বিনোদন বলতে বৈশাখী (বৈশাখ মাসে পাকা ধান তোলার কার্যক্রম) শেষে ফুটবল, কাবাডি খেলা। বর্ষাকালে ছেলেরা ১৬ গুটি/ ৩২ গুটির খেলা (অনেকটা দাবা খেলার মত) আর মেয়েরা বউচি, লুডো আর ৫ গুটি / ১০ গুটির খেলা খেলত। বড়রা আড্ডা দিয়ে সময় কাটাত। মাঝে মধ্যে রাতে কিচ্ছা, পালাগান আর পুঁথি পাঠের আসর বসত। এছাড়া বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে তেমন কিছুই ছিলনা। গ্রামে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ : বিনোদনের অভাব।
তখন দূর্গাপুর গ্রামে মাত্র ২ খানা TV ছিল; সাদা-কালো TV । শুক্রবার এলেই BTV তে বাংলা ছায়াছবি দেখার জন্য গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যেতাম। বেশিরভাগ সময় মানুষের ভিড়ে ঘরের ভিতর ঢুকতে পারতামনা। ভিড় ঠেলে ঢুকতে পারলে মাটিতে গাদাগাদি করে বসতাম । কখনো জানালা বা টিনের বেড়ার ছিদ্র দিয়ে এক চোখে তাকিয়ে TV দেখতাম আর তখনই আচমকা লাঠি নিয়ে তাড়া করত টিভির মালিক। তখন দৌড়াতাম আর ভাবতাম ইশ! নায়ক মনেহয় বড় হয়ে যাচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে আরেক গ্রামে গিয়ে দেখতাম নায়ক বড় হয়নি। কী কপাল মাইরি! ৫ মিনিট দেখার পর বিজ্ঞাপন শুরু হল । এবার এই টিভির মালিক তাড়া করল, দৌড়ানো আবার শুরু । এবার শেষ ভরসা বাজারের চা-স্টল। এমনি করে সন্ধ্যা নেমে এল। মাগরিবের আযানের পর কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি গজল বাজছে। চা-স্টলের বাইরে জানালা দিয়ে চাতক পাখির মত তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর ছায়াছবি আবার শুরু হল। “দিপু নাম্বার টু” মুভির গুপ্তধন খোঁজার দৃশ্য, এমন সময় একজন এসে খপ করে আমার হাত ধরল। বলল, “এই তুই ছন্দু মাস্টারের নাতি না?” আমি বললাম, হ । “তুইনা পড়া-লেখা করস? তুই TV দেখস কেন? বাড়ি যা পড়তে বস”। দিপু নাম্বার টু ছয়াছবির শেষ দৃশ্য আর দেখা হলনা ।
তখন সপ্তাহের বিনোদন বলতে শুক্রবারের ছায়াছবি আর আলিফ লায়লা। দিলদার, হুমায়ুন ফরীদি, টেলি সামাদ আর এ টি এম সামসুজ্জামান এর কমেডি খুবই ভাল লাগত। তখন সামাজিক নানা প্রেক্ষাপট নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হত। সূর্য দীঘল বাড়ি, দিপু নাম্বার টু, পাদ্মা নদীর মাঝি, হঠাৎ বৃষ্টি, আমার দেশ আমার প্রেম, চিত্রা নদীর পাড়ে, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, মাটির ময়না, আগুনের পরশমনি, স্বপ্নের ঠিকানা আরো কত মুভি ! ছোট বেলায় অনেক কষ্ট করে মুভি দেখতে হয়েছে। আর আজ ২০ বছর পর যখন খুশি, যেখানে খুশি মুভি দেখতে পারছি। শুধু বাঙালি মুভি না সারা বিশ্বের মুভি এখন হাতের মুঠোয়। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার আর জীবন যাত্রার মানের প্রভূত উন্নয়নের ফলে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের হাতেই রয়েছে রঙিন TV রুপি Smart Phone .
২০ বছর আগে একটা সাদাকালো TV কেনার বড়ই সাধ হয়েছিল। কিন্তু পারিবারিক রক্ষণশীলতার কারণে বাবা-মায়ের কাছে কোন দিন বলতে পারিনি। আজ একাদশে বৃহস্পতি; অফিসে Desktop এ TV, বাসায় Laptop এ TV আর হাতে Smart phone এ TV
কী হতভাগা আমি আমার এখনো TV কেনা হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:১২